তৈমুর খান
প্রায় ৩০ বছর ধরে গল্প লিখে চলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ কথাসাহিত্যিক হার্ভে হ্যাভেল। ‘দ্য অড অ্যান্ড দ্য স্ট্রেঞ্জ: খুব ছোট কথাসাহিত্যের একটি সংগ্রহ’ গ্রন্থে তিনি ছোটগল্প সম্পর্কে লিখেছেন:
“একবার আমার মাথার খুলির ভিতরে, আমার ডাক্তার কিছু লবণ যোগ করলেন, শুধু স্বাদের জন্য। তিনি আমার মাথার খুলিতে কিছু ফলও ঢেলে দিলেন—একটি আপেল, একটি নাশপাতি, কয়েকটি বীজহীন আঙ্গুর এবং একটি পাকা কলা। তারপরে তিনি একটি বৈদ্যুতিক ব্লেন্ডার ব্যবহার করে তার সর্বোচ্চ গতিতে সেট তৈরি করলেন যাকে তিনি ‘a yogurt parfait.’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি উপাদানগুলি মিশ্রিত করা শেষ করার পরে, অন্যান্য চিকিত্সক এবং কয়েকজন নার্সকে তার নতুন সংকলনের নমুনা দেওয়ার জন্য ইশারা করলেন।”
আজ থেকে ৪০ বছরেরও অধিককাল আগে লেখা ছোটগল্পগুলিতে এরকমই মানবজীবনের নানা উপাদানে মণ্ড তৈরি করে কুদ্দুস আলি পরিবেশন করলেন ‘পদ্মার ঢেউ রে…’(মার্চ ২০২৪) নামক গল্প সংগ্রহ গ্রন্থখানি। কুদ্দুস আলি ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখি শুরু করলেও এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ছাত্র হিসেবে নিজের পরিচয় দিলেও সাহিত্য জগতে তেমন প্রচারিত হতে চাননি। তাই নিভৃতে ‘চরৈবেতি’ নামক পত্রিকার সম্পাদনা করে এবং সাধ্যমতো লিটিল ম্যাগাজিনগুলিতে গল্প লিখেই নিজেকে আড়ালে রেখে দিয়েছেন।
‘পদ্মার ঢেউ রে…’ তাঁর স্বনির্বাচিত দ্বিতীয় খণ্ড গল্প সংকলন। মোট ৩২ টি গল্প নিয়ে এটি প্রকাশিত হয়েছে। ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন বীরভূমের প্রান্তিক এলাকার পাথর খাদানসহ মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রার নানা পরিচয় এই গল্পগুলিতে উঠে এসেছে। সেইসঙ্গে মানুষের আঞ্চলিক সংলাপও তিনি নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। স্থানকাল পরিচয়ের উল্লেখেও কোথাও তিনি বাস্তবতার উল্লঙ্ঘন করেননি। স্বল্প পরিসরে গল্পকার নিজস্ব ভঙ্গিমায় সমাজের নিম্নবিত্ত গরিব অসহায়, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সৎ ও ভণ্ড মানুষের উপলব্ধির নানা স্তরে প্রবৃত্তির যে জাগরণ টের পেয়েছেন তা গভীর মনস্তাত্ত্বিক উপায়ে গল্পে প্রতিফলিত করেছেন। ঘুঙুর পড়া সূর্যমণির মদবিক্রি ও দেহবিক্রির কৌশল, সন্তানের স্বপ্ন দেখা সন্তান না হওয়া কোহিনূরের অপত্য স্নেহ ও প্রিয়তমা রূপ, সাপের বিষ নামাতে গিয়ে রমজান ওঝার শান্তি মাস্টারের ১৪-১৫ এর মেয়ে চৈতালির জীবনের প্রেম আবিষ্কার, নূপুর নামক সুন্দরী কলেজ ছাত্রীর কাউকে পাত্তা না দেওয়ার পর এক সময় নিজেই পাগলী বেশে তার সকল বন্ধুর কাছে প্রেমের আবেদন জানানো, উঠতি লেখক অপূর্বর দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী অপর্ণার সঙ্গে মানসিক সংঘাত এবং নামকরা লেখকের সঙ্গে সাক্ষাতের আনন্দ, দেশ ও রাজনৈতিক দল সম্পর্কে হরিহরদের মতো আনপড় লোকেদের বিচিত্র ধারণা, মা-হীন সংসারে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার অবস্থা এবং কন্যাদের অবৈধ সম্পর্কে জড়ানো শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা, মাতাল ও চরিত্রহীন অধ্যাপক পিতার কন্যার আত্মঘাতী হওয়ার কারণ, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবন ও আচরণ, রোমান্টিক ও অ্যান্টি-রোমান্টিক জীবনের দ্বন্দ্ব ও মাধুর্য, অসুস্থ পিতার প্রতি কন্যার কর্তব্য, দেহবিক্রি, প্রাত্যহিকের ফেরিওলা, লোভ ও হিংসার পরিণতি, পাথর খাদানের কর্মী এবং মালিকের দ্বারা যৌনশোষণের শিকার হওয়া সাঁওতালি রমণীদের মনস্তাত্ত্বিক বিক্রিয়া, বিধবা মধুপাহাড়ীর সোনিয়া সরেনের ধর্ষিতা হওয়া এবং জোর করে বিয়ের প্রস্তাব পাওয়ার পর তার মনের অবস্থা ইত্যাদি বহু দিকের আলোকপাত জীবন রসায়নের তীব্র দ্রবণ গল্পগুলিকে যেমন এক মরমিয়া স্পর্শ দান করেছে, তেমনি বহু অজানা জীবনের আর্তনাদ, আবেগ গল্পগুলির মধ্যে লুকিয়ে আছে। ‘পদ্মার ঢেউ রে…’ গল্পের নামকরণের মধ্য দিয়েই লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন মুর্শিদাবাদ মালদহ বাংলাদেশ নদী সীমান্তের ভাঙনের সঙ্গে জনজীবনের ভাঙনের উত্থান পতনের কাহিনিও কতখানি সম্পৃক্ত। রুকসানা-ইকবালের দাম্পত্য জীবনের কাহিনির সঙ্গে সীমান্ত এলাকার নুন পাচারের কাহিনি, অস্থির জনজীবন, বেকারত্ব, খাদ্যাভাব, মিছিল-আন্দোলন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিও খুব বাস্তবতার সঙ্গে স্থান পেয়েছে। লেখক স্থান-কালের ও ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেই গল্পের প্লটে পাঠককে সামিল করেছেন। চাকরি পাওয়ার কঠিন পরিস্থিতিও প্রেমের আবেগের সঙ্গে স্রোতের সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। ইকবালের শেষ পরিণতি আমরা দেখতে পাইনি। কিন্তু খুন-জখম, ষড়যন্ত্রের ফিসফিসানি, অন্ধকার আর অন্ধকারের ছায়ামূর্তি গল্পের রহস্যকে আরো ঘনীভূত করেছে। গ্রামবাংলার সুদের কারবারি, তার শোষণ ও গর্জন, শোষিত পীড়িত মানুষের দুরবস্থা, যৌনতা, নিষিদ্ধ প্রেমের ছোবল সবই স্বাভাবিক এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবেই গল্পে উপস্থিত হয়েছে। গ্রাম বাংলার ধূলিমলিন জীবনের স্বপ্ন ও বোধের নানা রূপ ও কটুগন্ধ লেখক তুলে ধরেছেন। ভ্রান্ত প্রেমের মরীচিকার মধ্যেও নায়ক-নায়িকাদের আমরা কখনো দেখতে পাই। অপরাজিত, বীরপুরুষ, ছেলেটি, লকডাউন, বুড়িটা, আদর্শের কাঁটা, প্রতীক্ষা প্রভৃতি গল্পগুলিতে সাম্প্রতিক কালের বহু ছায়া পড়েছে। আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে বহু সমস্যা ও সংকটের সম্মুখীন করেছেন। সহজ জীবনের অনাড়ম্বর ভাষায় কাহিনির সাবলীল গতি ও স্বাভাবিকতা এবং লেখকের ব্যক্তিজীবনের অবিমিশ্র যাপনকথাও পাঠক সহজে ধরে ফেলবেন।
তার মাথার খুলিতে সেই ফল-দই এর মিশ্রণ তৈরি হতে থাকবে যার বিচিত্র স্বাদ এই গল্পগুলি।
#
পদ্মার ঢেউ রে…:কুদ্দুস আলি,চরৈবেতি প্রকাশন, রাজগ্রাম, বীরভূম,প্রচ্ছদ: লাবণ্য নার্গিস, চলভাষ:৯৫৬৪৯২৯০৩০, মূল্য ১০০ টাকা।