তৈমুর খান
————————————————————————-
ঐতিহ্য, দেশপ্রেম, ঐক্য, মানবিকতা ভাবনায় উজ্জীবিত করার তীব্র ঝাঁকুনি দেওয়ার মতো উপন্যাস লিখেছেন মুসা আলি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা যে ইতিহাস, দেশবিভাজন, সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং রাজনীতি নিয়ে বেঁচে আছি—তারই বাস্তব অনুসন্ধানে যে বিশ্বাসঘাতকতা এবং দেশবিরোধী কার্যকলাপ লুকিয়ে আছে তা-ই উপন্যাসের বিষয় হয়ে উঠেছে। লেখক সুকৌশলে আমাদের সম্মুখীন করেছেন বহুমুখী বাস্তব নানা জটিল প্রশ্নের। উপন্যাসের নামকরণেই অর্থাৎ ‘ভিনদেশের ঘোড়েল’(নভেম্বর ২০২৩)এর রূপকাশ্রয়ে দেশের অস্থিরতা, চরম প্রতিকূলতা সৃষ্টির পেছনের মূল কলকাঠিকে চিহ্নিত করেছেন। তবে শুধু চিহ্নিত করেই ক্ষান্ত হননি, অন্ধকার ভেদ করে আলোর দিশারও নির্দেশ করেছেন। আর সেইখানেই এসেছে ভারতীয়ত্ব। যার মধ্যে আছে শিল্পীসাহিত্যিকের দায়িত্ব। সংস্কৃতি বোধ গড়ে তুলে মানুষের চেতনাকে শানিত করা। সুতরাং উপন্যাসটি সংস্কৃতি বনাম অপসংস্কৃতি, আলো বনাম অন্ধকার, দেশ তথা মানবপ্রীতি বনাম দেশবিরোধী তথা বিভাজনের মধ্যে লড়াই। একটা এলাকাকে কেন্দ্র করে তার সূচনা হলেও বৃহত্তর পটভূমি তথা সমগ্র দেশই তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি ও সংস্কৃতি চেতনা নিয়ে এই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে।
উপন্যাসের সূচনা হয়েছে খুব সাধারণ একটি গ্রাম্য পরিবেশে। গ্রামের ছেলেরা নাটক মঞ্চস্থ করবে। নাটকও ঠিক হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’। নাটকের খরচ-খরচার জন্য গ্রামের চাল ব্যবসায়ী মূর্খ বিবেক দেবনাথকে স্পনসর হিসেবে পেয়েছে। ৫০০০ টাকা দান করেছে বলে তাকে মঞ্চে সভাপতির আসনে বসানো হয়েছে। নাটকের অভিনয় দেখেই বিবেকের মন পরিবর্তন ঘটে। ধনকুবের অর্থের বলে নন্দিনী ও বিশুকে জয় করতে পারেনি। কারণ হৃদয় সত্য, আলো এবং প্রেমের ধারক। অপরদিকে অর্থ অন্ধ ও অহংকারের ধারক। বিবেকের আচরণে অতিনাটকীয়তা ধরা পড়লেও সে উৎসাহিত হয়ে ৫০০০০ টাকা এবং এক বিঘা জমি গ্রামের নাট্য সংস্থাকে দান করে। এই সংস্থায়ই ‘সোপান’ নামে আবির্ভূত হয়। ‘সোপান’ সংস্থার মূল পরিচালক হন উচ্চশিক্ষিত যুবক পল্লব দাশ। গ্রামের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তৈরি হয় নাট্যদল। প্রথম নাটক ‘তিতুমীর’ নিয়ে তারা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেও হেরে যায়। পরবর্তীতে নিজেদের আরো ভালো করে তৈরি করার সংকল্প করে। ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয় নানা জটিল পরিস্থিতি। দেশপ্রেম, সম্প্রীতি ও মানবিকতার লক্ষ্যে তাদের বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি। দেশীয় কর্মচারীদের ছাঁটাই করে, বিদেশি জিনিসপত্রের আমদানি করে এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রলোভন দেখিয়ে নানা অন্তর্ঘাতী কারবার শুরু করে দেয়। সবকিছুতেই ঔপনিবেশিক প্রভাব বাড়তে থাকে। নাটকের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্য মুখ থুবড়ে পড়ে। পিংপং বসু লাইফ চয়েস কোম্পানির ভারতীয় পূর্বাঞ্চল শাখার ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়ে এলে নাটকের বহু ছেলেমেয়েদের বিলাস বহুল জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে কাজে লাগাতে থাকে। প্রথমত জিৎ-কে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে কাছে টানে। তাদের নাট্য সংস্থাকে কোম্পানির এজেন্টে পরিণত করতে চায়। অ্যাডফিল্ম বানাবার টোপ দেয়। জিৎ-এর মাধ্যমেই আসে রফিকুলও। গরিব ও বেকার ছেলেদের দুর্বল জায়গাকে চিহ্নিত করেই কথার মোহিনী জালে আটকে রাখে পিংপং বসু। আবার এই পিংপং বসু বিহারে পিপুল বসু নামেও তার ব্যবসা চালায়। ভিন্ন নামে ও ভিন্ন বেশে তাকে নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে নামকরা বিদ্যালয়েও ফ্যান্টাস্টিক কোল্ড ড্রিঙ্ক বিলি করতে দেখা যায়। আসলে মদকেই কোল ড্রিঙ্ক নাম দিয়ে নেশাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্য তার। তারপর পরীক্ষায় কীটনাশক বিষের বীজাণু ধরা পড়লে ব্যবসা প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। তখন গ্রামের ভজহরি চক্রবর্তীকে দিয়ে ভারত-পাকিস্তানের খেলাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার হ্যান্ডবিল ছড়াতে বলে। সব মিলিয়ে উপন্যাসটিতে ব্রিটিশ দালাল পিংপং বসুর খলনায়কোচিত নানা পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে জটিল হয়ে ওঠে। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের লক্ষ্যে সোপান নাট্যদল প্রায় ভেঙে যেতে বসে।
নাট্য পরিচালক পল্লব তার বিশ্বস্ত সঙ্গী আসিফ ও জয়াকে সঙ্গে পায়। পল্লবের গুরু রহমান পদার্থবিদ্যায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সম্প্রীতি রক্ষায় এবং মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে। সেই আদর্শের ধারক ও বাহক পল্লবও। তাই সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি,দেশপ্রেম ও দেশবিরোধীর লড়াইয়ে পিছিয়ে আসে না। দেশ ও মানুষকে ভালোবাসার যে আবেগ, যে কর্মপন্থা তা তাদের জীবনযাপনে খুব সূক্ষ্ম ভাবে ফুটে উঠেছে। আসিফের দারিদ্র্য ও আদর্শ, জিৎ-এর স্বার্থপরতা ও যৌন আবেদনময়ী পিংপং বসুর সঙ্গিনীর স্পর্শ, রফিকুলের বোনের বিয়ের জন্য উদ্বেগ,বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্র-ছাত্রীদের আচরণ, নিখোঁজ সন্তানের জন্য আলিম চাচার কষ্ট, ভজহরির লোভ-লালসা ও বাঙাল ভাষায় কথোপকথন এবং পিংপং বসুর মানুষকে বশ করার ইন্দ্রজাল অতি দক্ষতার সঙ্গে এঁকেছেন।গুরু রহমানের আচরণে মাহাত্ম্য ও ত্যাগ অতি উচ্চমাত্রা পেয়েছে। তাই তাকে আসিফের মা বলেছে ‘ভারত’। ‘এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’ এই সমন্বয়ীভাবনার মহান দূত হিসেবেই সকলকে প্রেম বিলি করেছেন। বিশ্বসম্প্রীতির রসায়নে তিনি কোনো ভেদ রাখেননি। একটা উদ্দেশ্যমূলক উপন্যাস হলেও লেখকের দক্ষতায় তা পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পেরেছে আর এখানেই উপন্যাসটির গুরুত্ব। বিদেশের ঘোড়েল হিসেবে পিংপিং বসুকে আমরা প্রতীক হিসেবেই উল্লেখ করতে পারি। যে ঘোড়েল সব থেকে বিপজ্জনক জলের তলায় আত্মগোপন করে থাকে এবং সহজেই বিনাশ সাধন করে ।
#
ভিনদেশের ঘোড়েল: মুসা আলি, প্রচ্ছদ মেগাবাইট, প্রত্যয় প্রকাশনী, ৬১ মহাত্মা গান্ধী রোড, কলকাতা-৭০০০০৯, মূল্য ২০০ টাকা।