spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাদীর্ঘ কবিতা : কাজী জহিরুল ইসলাম

দীর্ঘ কবিতা : কাজী জহিরুল ইসলাম

চমক দেখি তার

মনের মসজিদে দাঁড়িয়ে দু’রাকাত নফল প্রার্থনা করো হে মুসাফির।
বেথেলহেম থেকে মক্কা-মদিনায় ছুটছো অহেতুক,
পুজোর অর্ঘ্য তো দেবার মূল গৃহ হৃদয় মন্দির।

২.
দুচোখ খুলে আমি ক্ষুদ্র ধূলিকণা সরাতে পারছি না,
অথচ চোখ দুটো বন্ধ করলেই
দম্ভ প্রস্তর,
উড়ছে কী দারুণ, আকাশ শূন্যতে;

প্রেমের উত্তাপে যাচ্ছে গলে সব জমানো পর্বত,
বুকের যত ঘৃণা।

৩.
বাজছে শৈশব, চিকন মিহি সুরে
আমের বড়া দিয়ে তৈরি মায়া-বাঁশি;

স্বর্গ-নগরীতে রম্ভা-মেনকারা কত কী পন্থায়
বাজায় দেহ-বীণা,

হৃদয় একতারা কোথাও দেখি না তো
বেদনা টোকা দিয়ে গাইছে ভালোবাসি।

৪.
দীর্ঘ হাঁটাপথে ক্লান্ত হয়ে আমি ভাবছি মনে মনে,

পথের শেষ নেই, এ-পথ নিয়ে যাবে, আমাকে কোন দেশে?
কেউ তো পথপাশে জড়িয়ে ধরছে না আদরে ভালোবেসে,

পথেরা বেঁধে রাখে তবুও প্রতিদিন মায়ার বন্ধনে।

৫.
এ-পথ ভালো নয়, ওপথে যেও না হে, নতুন রাস্তাটি সহসা খুঁজে নাও,

পথের নানা বাঁকে হেঁটেছি বহুকাল
এতোটা পথ ঘুরে
তবুও সকলেই পৌঁছে যায় কেন পুরনো সেই বাড়ি?

অনেক পথ আছে দুপায়ে হাঁটবার, এখানে পথিকের রয়েছে স্বাধীনতা,
যে-পথে যেতে চাও, ইচ্ছে হেঁটে যাও,
পথের শেষে তুমি পৌঁছে যাবে সেই মায়াবী নীল গৃহে,
আকাশ, স্থল-জলে কত না পথ আছে,
কিন্তু জানো না তো সকল রাস্তার লক্ষ্য একটাই,

মরুর শেষে জল, সাগর পার হলে পাহাড় থাকে খাড়া,
আকাশে উড়ে উড়ে বৃক্ষশাখে পাখি গুটিয়ে বসে ডানা;

কুয়াশা ঢাকা এক সুনীল কুহেলিকা… লক্ষ্যবস্তুর দৃশ্য কেঁপে কেঁপে উঠছে পর্দায়।

স্পষ্ট কোনো ছবি দেখেনি আজও কেউ,
অথচ সেই ছবি ক্কালবে চমকায়।

৬.
ক্ষুদ্র তৃণলতা কিংবা মহীরুহ, দালান উঁচু উঁচু,

মেঘের চুম্বনে দম্ভ বিকশিত;

পথের দুই পাশে ছিন্ন কুঁড়েঘর; যাচ্ছে দূরে সরে,
সকলই সরে যায়; সকলই নশ্বর, দীর্ঘ রাস্তার
যাত্রী সকলেই,

স্থিতির লোভ তবু আড়ালে ঢেকে রাখে এ-মহাসত্যকে, ‘বস্তু নস্থিত’।

৭.
জুনেরা গলে যায়, জুলাই ভেঙে পড়ে, এ-ঘন সভ্যতা
মন্দ্র-ধীর লয়ে টানছে অম্বরে গ্রহের মহাকাল;

কী-এক ঘোর লাগা নেশার টানে সব কাঁপছে তালে তালে,
সঠিক ছন্দের জটিল ব্যাকরণে,

মৌন দালানেরা হঠাৎ চমকালে সন্ধ্যা ঘন হয়,
নতুন গৃহহারা, শহরে এলো যারা
নীরবে চুমু খায় বৃক্ষ-পাখিদের;

হাতেরা হাত ধরে, বুকেরা বুক ছোঁয়, চোখেরা ইশারায়
হৃদয়ে ঢেউ তোলে,
পায়েরা গলে যায় পায়ের গহ্বরে…

রাত্রি ঢুকে পড়ে শব্দ কুহকের নিঠুর মায়াজালে,

পায়রা দল বেঁধে ডানার পাহারায় শহর ঢেকে রাখে,
ভয়েরা চমকালে,
প্রহরী সচকিত, গর্জে ওঠে তার কণ্ঠ-চণ্ডিকা।

৮.
নদীতে ভেসে একা গুগলি খায় এক শুভ্র পাতিহাঁস;
আড়ালে দৃষ্টির থাকে সে সারাদিন,
রাত্রি নেমে এলে পৃথিবী চরাচরে, ডানার ঝড় তোলে
ছোট্ট মাদীহাঁস;

সখ্য তার সাথে আমার চিরকাল।

আঁধারে মেলে ধরে গোপন ছন্দে সে ডানার উচ্ছ্বাস,
সখা গো হে প্রাচীন, পদ্মমৃগনাভী, শুভ্র পাতিহাঁস।

নরোম কাদা হয়ে নিজেকে মেলে ধরো
ঠোঁটের খুব কাছে,
গোপন জলাভূমি;

চঞ্চু-নিব দিয়ে হংসী লিখে রাখে কালের সমাচার,
হৃদয় খেরোখাতা কতো কী আঁকিবুঁকি।

কষ্ট-প্রাপ্তির, স্বপ্ন-অভিবাস ভোরের রোদ্দুরে
শুকিয়ে মজবুত,
সেখানে চাষবাস;

নতুন মানুষের বসতি উজ্জ্বল।

৯.
মুগ্ধ তৃষ্ণায় পায়েরা খুঁজে ফেরে নগর জনপদ,
মরুর নির্জনে, খোঁজে সে আশ্রয় – জলের উল্লাস;

পায়েরা তৃষ্ণায় ক্রমশ হেঁটে যায়,
মৌন নির্জনে রাতের প্রস্তর ভাঙে সে আঙুলের প্রবল ধাক্কায়,

নগ্ন এই দুপা বুঝিবা ভেঙে দিল শহুরে সভ্যতা,
তাই সে ভয়ে ভয়ে রাত্রে চমকায়,
নিয়ন আলো ফেলে পর্যটক-চোখে।

১০.
জলের পাটাতন যখন ফুলে ওঠে
মাছেরা পাখনাতে সহজে ভর দিয়ে
সাগর শূন্যতে বেড়ায় ভেসে ভেসে…

নীলের ক্যানভাসে ভাসছে ক্রমাগত শুভ্র এক ঝাঁক
মাছের ছানা-পোনা,
চেয়েছি গুনে নিতে প্রাপ্তি জীবনের, আসলে বুঝিনি তো,
এ-মহাঅর্জন সংখ্যা দিয়ে বুঝি কখনো যায় গোনা?

মাছেরা অগণিত, মাছেরা ছুটে যায়, সাগরে ডুবে ডুবে, গভীর তলদেশে…
আবার মাঝে মাঝে ওরাই উড়ে যায়, দূরের অম্বরে…

মেঘের মঞ্চতে দেখেছি বসে একা, আমার চারপাশে
বোধের জলকণা, বাতাসে ফুলে ফুলে কাঁদছে কিন্নর;

কী ব্যথা বালিকারা গোপনে লুকিয়েছ?

বুম্বা পৃথিবীতে তৃতীয় পুরুষের পরেই পাঠালেন
আলোক-রেখা এক ত্বড়িৎ বিদ্যুৎ শুভ্র রমনীকে,
বশোঙ্গার নারী
মাটির পৃথিবীতে নেমেই কেন রোজ পোড়ায় নরলোক,
তবে কি সেই থেকে
পুরুষ পেতে চায় রমনী সুন্দরী,
অথচ প্রতিদিন রূপের বিদ্যুতে পোড়ায় রমনীরা পুরুষ-অন্তর?

১১.
তোমাকে খুব চিনি, মেঘের বিদ্যুতে হঠাৎ জ্বলে ওঠা স্বর্ণরেখা তুমি;
তুমি কি ভুলে গেছ হেদার পল্লীতে প্রথম দেখা হলো?
সবে তো গ্রীবাখানী উঁচুতে তুলে ধরে ঘোষণা করেছিলে,
কৃষির সভ্যতা উঠবে হয়ে এই নরোম মৃত্তিকা,
তোমার স্তন্যতে এ-মাটি উর্বরা, মাতৃমূর্তি হে, প্রাচীন প্রিয়তমা;

তোমাকে ভুলে যাবো, কৃতজ্ঞতাহীন পুরুষ বুঝি আমি?
তোমার চুল দিয়ে গড়েছি আফ্রিকা,
কাকাও কফিবন, শস্য মিলেটের সবুজ প্রান্তর,
বজ্র-দেবতারা বুকের সন্তান যখন কেড়ে নিল,
নুনের স্রোতে তুমি একাই কেঁদেছিলে একাশি বছরের তীব্র বর্ষণ,
অশ্রু স্রোতধারা তৈরি করে দিল হাজারো জলাশয় শুষ্ক পৃথিবীতে।

তোমার মৃদু হাসি ফোটালো রাশি রাশি পুষ্প উদ্যান
আরব মরুদেশে;
কী করে ভুলে যাবো তোমাকে প্রিয় লুসি?

দু’পায়ে আঁকোনি কী এ-হোমোসেপিয়েন্স গর্ব সভ্যতা,
প্রেইরি অঞ্চল অবধি বিস্তৃতি?

মধ্যপ্রাচ্যের উষ্ণ মৃত্তিকা মিলনে উত্তাল।
ছুঁয়েছে পুরুষের শক্ত আঙুলেরা তোমার নীল দেহ,
কে ছিল সে-পুরুষ? তুমি কি ভুলে গেছ
অচেনা সেই মুখ,
কামুক ঠোঁটজোড়া তামাটে সুপুরুষ নিয়ান্ডারথাল?

১২.
এ-মহাজাগতিক শব্দ সিম্ফনি উষ্ণ জল ধোয়া
স্নিগ্ধ মেঘ হয়ে
পৃথিবী ভ্রমণের বৃত্ত এঁকে দেয়;

সে-মেঘ ঝরে পড়ে অগ্নিদাহ-বারি; সদম, গোমরায়,
অ্যালোন বৃক্ষেরা নিদাঘ পুড়ে ছাই,
দু’জন দেবদূত লুতের গৃহে কেনো প্রদোষে এসেছিল?
নুনের থাম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অদো, নবীর প্রিয়তমা;
কী ছিল অপরাধ সদম-রমণীর?

কুয়াশা কুহেলিকা দূরের মেঘ এসে অন্ধ করে দেয়
আজিজ-পত্নীকে;
পাপের বৃষ্টিতে জুলেখা কেনো ভেজে? প্রাচীন মিশরের রমনী-ভোজসভা
প্রণয় কাব্যের শ্রেষ্ঠ একখানি উপাখ্যান হলো?
আরব-কাহিনীর এলিট রমনীরা
কোন সে কুয়াশার অন্ধকারে ডুবে আঙুল কেটেছিল নিজেরা আনমনে?

বৃষ্টি নূপুরের নিপুন ঝংকারে ছন্দ-তাল বেঁধে সিজার পাড়ি দেয়
সুনীল সাগরের অথৈ জলরাশি,
তামাটে তরুণীর অগ্নি-যৌবনে মুগ্ধ সম্রাট;

শব্দ সিম্ফনি উষ্ণ বাষ্পের নরোম মেঘ হয়ে
লক্ষ বছরের আকাশ ঢেকে দেয়;
পৃথিবী ঘুরে ঘুরে এ-ঘন নীল মেঘ ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত
মানব হৃদয়ের গভীর ঘাসে ঘাসে।

১৩.
কোন সে বৃষ্টিতে অন্ধ হয়েছিল নিরোর নীল চোখ?
মাতৃহত্যার নিঠুর দায়ভার কেন সে মস্তকে ধারণ করেছিল?
পুড়ছে মহারোম,
জগদ্বিখ্যাত তরুণ সম্রাট পাপের কোন বাঁশি বাজাল সেই রাতে?

উল্টো রতিসুখ-মগ্ন মৈথুনে, বিভোর পার্বতী।

কীসের ইঙ্গিত? স্বয়ং ভগবান! স্খলন অসময়ে?
লাস্য প্রেমময়ী অগ্নি-ক্রোধে পুড়ে হলেন চণ্ডিকা!

শিবের বুক জুড়ে এ-কোন নারীছায়া? তবে কি ভগবান ভোগ্যা-পরনারী?
ক্রুদ্ধ পার্বতী!

গৌরী-প্রার্থনা…প্রভূর নির্দেশে দুজন মিলেমিশে অর্ধ নর-নারী,
হলেন নবরূপে আবির্ভূত তারা
ঋষিরা পূজো দেয় “স্ত্রীপুংসরূপায়”…

মেঘেরা দেশে দেশে ফেরারি যাত্রায় ছুটছে, ছুটে যায়,
রাবণ সেই মেঘে ভাসায় ব্যোমরথ।

দণ্ডকারণ্যে কেনো সে মেঘ এসে সহসা থেমে যায়?
রাবণ চমকায় মেঘের বিদ্যুতে?
নাকি সে বিদ্যুৎ বনের রাস্তায়, শ্রীরাম পত্নীর
গোপন দেহবাঁকে হঠাৎ চমকায়?

অশোক কাননের নীরব পাহারায় রচিত হলো মেঘ,
নতুন কোনো এক গোপন অধ্যায়…

১৪.
উষ্ণ পরিযায়ী ঘূর্ণি বায়ু এসে বিষ্ণু-নাভীমূলে
প্রবল ঝড় তোলে,
ব্রহ্মা চোখ মেলে:
‘সৃষ্টি মেলে ধরো প্রাচীন ভূ-ভারত’;

জলধি মন্থনে কত কী উঠে এলো
সীতার দুল শুধু জটায়ু খুঁজে পেল।

তোমার জরায়ুর কোমল পুষ্পেরা পৃথিবী-বাগানের
নানান কাণ্ডতে দারুণ ফুটে আছে, হে-প্রিয় আদি মাতা,
জননী মনুষ্য-প্রজাতি পৃথিবীর।

কত কী ঘটে গেল এ-গোল ভূগোলের নানান পৃষ্ঠায়
বৃত্তাবর্তের প্রবল স্রোত ঠেলে,

তুচ্ছ ক্ষমতার উচ্চ রাজাসন;

প্রেমের বৃষ্টিতে দারুণ উচ্ছ্বাসে ভিজছে এ-যুগের নতুন ইভাদম,
প্রেমিক অষ্টম ডেভিড এডোয়ার্ড
দু’পায়ে ঠেলে দেয় পৃথিবী কম্পিত সিংহাসনখানি!

পূবের হাওয়াতে দারুণ ভেসে ভেসে পেয়েছে এই ফুল গৌর মৃত্তিকা;

১৫.
ঘ্রাণের উত্তাপে উঠছে বুদবুদ বুকের জল ঠেলে,
বৃত্ত ফেটে যায় উষ্ণ তরলের,
শূন্য বৃত্তের বৃহৎ কাফেলায় যুক্ত হতে চায় বক্ষ-নির্যাস;

আকাশ হাহাকার সুনীল শূন্যের, তোমার সন্তান
সেখানে মাথা তোলে; দু’হাতে আঁকে রেখা,
কত কী আঁকিবুকি, কত কী আঁকছে সে,
জ্যেষ্ঠ বস্তুর গর্ব তার হাতে…

সে হয় ইমরুল, সে হয় বোধচারী অভিদ গাল্পিক,
গল্প-কাঁথা বোনে বৃক্ষ-পুত্রের
আফ্রোদিতি আর পার্সিফোন মিলে পাপের সৃষ্টিকে
অমর করে তোলে;

পাপের আদি বিষ কেনান রাজ্যের গুপ্ত পর্বতে
কীভাবে উড়ে এলো
সুদূর আসিরিয় রাজার বোধ ছিঁড়ে?

দ্রাক্ষারসে ডুবে জোয়ার পর্বতে কী পাপ করে লুত,
খোদার প্রতিনিধি?
কোন সে ইঙ্গিতে লুতের কন্যারা পিতার শয্যায়?

বোধের বাহকেরা এসব দাগ-রেখা কালের প্রস্তরে নিয়ত লিখে রাখে …

১৬.
আমিও লিখছি তা,
অমিয় বুদবুদ বোধের ভাপে-তাপে উঠছে প্রতিক্ষণ
ঢাকনা ঠেলে ঠেলে; সে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে
সে ওঠে আনমনে,
নিদ্রা জাগরণে,
মনের প্রান্তরে হর্ষ মেঘমালা
অনিষ্পন্নের অন্তহীন এই দ্বিধার ফয়সালা।

কে খেল গন্ধম? কে তাকে দিয়েছিল?
কেন সে খেল ফল?
বৃত্ত নিষেধের আদম ভেঙেছিল? নাকি সে
নির্দেশ পালন করেছিল?
কে দেবে উত্তর এসব প্রশ্নের?

হাজারো প্যারাডক্স ভাসছে বুদবুদে;

বৃত্ত যত ভাঙি নতুন গড়ে ওঠে তার ‘চে শতগুন,
মৌন নির্জনে,
শব্দ বেজে ওঠে, বাজে সে অবিরাম ছন্দে গুনগুন।

নির্জনতা বুঝি রয়েছে কোনোখানে? তবুও ঋষিজন সাধনা করে যায়
নির্জনতা ছোঁবে,
হেরার গুহাঘরে শব্দ বেজে ওঠে ‘ইকরা’ পড়ো তুমি।
কীভাবে পড়ি আমি?
অক্ষরের পাঠ আমি তো নিইনি হে…
অন্ধকার ভেঙে আলোর দরোজারা সহসা খুলে গেল,
বিসমি রাব্বিক আল্লাজি খালাক, পড়তে শুরু করে নিরক্ষর নবী,
এও তো সম্ভব,
এও তো ইশারায় কোথাও লেখা ছিল…

কে দায়ী বলো তবে? কে খেল গন্ধম?
ইভের প্ররোচনা?
নাকি সে আদিমাতা ইশারা পেয়েছিল, মর্ত্যে পতনের?
শস্য-সন্তানে পৃথিবী উর্বরা করার সুমহান ছিল না নির্দেশ?

১৭.
পুরুষ যদি ভালোবেসেছে দেখি এক ভিন্ন ছেলে-যুবা
কিংবা নারী প্রেমে পড়েছে নারীদের,
হবে কি অন্যায়?
গ্রন্থে তবে কেন তরুণ যুবাদের রূপের বর্ণনা রয়েছে বহমান?
সদম গোমরাকে উল্টে দিয়েছেন জানি-সে ইতিহাস,
তা বলে আজও এর
পুনরাবৃত্তির মিলবে দেখা বুঝি?

তখন পৃথিবীর উদরে ক্ষুধা ছিল মানুষ জন্মের,
তাই সে মেনে নিতে চায়নি প্রজনন-ক্ষমতাহীন কোনো বন্ধ্যা নর-নারী।

এখন মানুষের তিক্ত পদভারে কাঁপছে মৃত্তিকা,
বিজ্ঞ ম্যালথাস কবেই বলে গেছে এমন দিন এলে
ক্রদ্ধ হবে এই ধরণী চণ্ডিকা,
এই কি ভালো নয়,
নিঠুর পরিণতি জলোচ্ছাস-ঝড়ে,
ভূমির কম্পনে,
দেখার চেয়ে ঢের?

নতুন পৃথিবীকে গ্রহণ করে নাও
খেয়ালী প্রকৃতির এটাই সমাধান।

১৮.
কী ভুলে নূহ নবী ক্রুদ্ধ হুঙ্কারে ডেকেছে গর্দভ,
‘ওরে ও উঠে আয়,
যদি বা শয়তান সঙ্গে থাকে তোর, তবুও উঠে আয়’,

গাধার লেজ ধরে নূহের কিস্তিতে দুষ্ট শয়তান
আয়েশে উঠে এলো;
এ-ও কি ভুল ছিল?
কী দোষে কুশীলব মঞ্চে পাঠ গেয়ে হচ্ছে অপরাধী?
পাণ্ডুলিপিখানি লিখেছে যে লেখক,
প্রশ্ন করো তাকে, কেনো এ প্যারাডক্স?

প্রাচীন অপরাধে গাধার শাবকেরা খিস্তি শোনে আজও…
আজও সে ভারবাহী, আজও সে গর্দভ।

দস্যু বাল্মিকী কী গুণে মহাঋষি?
কী গুণে হাতেমের দু’হাত উপচায় দানের সম্পদে?
দস্যু হৃদয়ের জটিল সরোবরে ফোটাল রাশি রাশি কোমল পদ্ম কে?

কঠিন পাথরের গভীরে মুদ্রিত প্রেমের কাতরানি,
কে লেখে সেই বাণী?

নিজাম ডাকাতের প্রতাপে কম্পিত দিল্লি বদায়ুন,
শহরে এলো এক সর্ব ধর্মের নতুন সিলসিলা,
এলেন আউলিয়া নিজাম উদ্দিন,
প্রেমের জলে ধোয়া নতুন তরিকায়
আকুল দিল্লির হিন্দু, মুসলিম, জৈন রাজপুত।

১৯.
হৃদয় মসজিদে দাঁড়াও মুসাফির।

পাহাড়ে পর্বতে অনেক ছোটাছুটি, ধুসর মরুভূমি
জেগেছে সারারাত,
উটের কাফেলারা অন্ধ হয়ে গেছে,
অশ্বখুর-ধ্বনি শুনেছি বহুকাল,
এ-কালে ব্যোমতরী,
কত কী ব্র‍্যান্ডের ছুটছে দ্রুতগামী যন্ত্রযান পথে;
তীর্থ কত দূর? কোথায় মন্দির, শুদ্ধ সিনাগগ,
অর্থডক্স চার্চ?
কোথায় ঈশ্বর, আল্লা, ভগবান?

অন্ধ লোক শুধু দূরের আলো খোঁজে,
সে ছিল দৃষ্টির দিব্য আলোময়
নতুন জাগরণ,
ক্কালবে জ্বলছিল নূরের উজ্জ্বল আলোক শিখা তার;
সে ছিল হাল্লাজ;
কুবিজ পর্বত ডেকেছে ইঙ্গিতে দূরের শৈশবে;
কর্ণকুহরের গভীরে কোন গান কুবিজ প্রস্তর গোপনে গেয়েছিল?
কোন সে গোপনের ইশারা পেয়েছিল
প্রাচ্য ভূগোলের ফার্সে মানসুর?

জামার কত রঙ, বর্ণে চমকায়, ঝিলিক দেখে তার
কেবল বোকারাই জামার কাছে যায়,
সে একা পেয়েছিল
সে একা দেখেছিল
জামার নিচে জ্বলে নূরের দ্বীপশিখা,

ভ্রান্ত মরিচীকা ভেবেছে মূর্খেরা…

২০.
আমাকে দূরে ঠেলে কী করে পূর্ণতা পাবে হে দাম্ভিক?
একাকী তুমি শুধু পূর্ণ সংখ্যার ক্ষুদ্র ফ্রাকশন,
প্রমাণ যদি চাও হাজারো দিতে পারি,

পৃথিবী সুবৃহৎ সবুজ থালা এক,
মানুষ, প্রাণীকূল সকলে চারপাশ রেখেছে ঘিরে এর,
যা কিছু চাষবাস, মন্দ-উত্তম, সবই তো এ-থালায়
উপুড় ঢেলে দাও,
যখনই খিদে পায়, তৃষ্ণে কাতরাও,
পূর্ণ থালা থেকে মুষ্ঠি তুলে নাও;

এবার ভেবে দেখো তোমার চাষবাসে আবাদ যদি হয়
আগাছা, কণ্টক, গুল্ম বিষমাখা,
উদরে কার যাবে সে-বিষ মাখা ভাত?

কাজেই সাবধান,
নিজের জন্যেই ফলাও সুস্বাদু আঙুর, নাশপাতি;

হয়ত জেনে গেছো বলছে বিজ্ঞান, মানুষ যত কথা
নিত্য বলে যায়,
মাত্র সাত ভাগ ভাষার অবদান,
কণ্ঠে উঠানামা পূর্ণ আটত্রিশ, অবাক হচ্ছো কি?

আরো তো বাকি থাকে অর্ধ শতকের অধিক সংযোগ,
কি করে ঘটে জানো?
অঙ্গভঙ্গির প্রাচীন কসরতে।

এবার বলি শোনো গোপন ভেদ-কথা,

সতেরো লক্ষেরও অধিক বৎসর মানুষ ডেকেছিল
‘প্রাণের প্রিয়তমা’ অঙ্গে নির্বাক ভঙ্গি তুলে শুধু;

অর্থহীন কিছু শব্দে কাছে ডাকে
দ্বাদশ লক্ষেরও অধিক বৎসর;

হাজারো নামে আজ যে ভাষা খণ্ডিত,
এই তো সেই দিন
মানুষ শিখে নিল গ্রন্থ-বিজ্ঞানে রচিত এই ভাষা।

সে-কথা লেখা আছে এ-কালে, মানুষের ডিএনএ-কোষে কোষে,

এবার বলো তবে,
তিরিশ লক্ষেরও অধিক বর্ষের বিবর্তন দেখে,
পারম্পর্যের হিসেবে ভুল আছে?
শুধু কী বেঁচে যারা তারাই যুক্ত হে?
অতীত যারা আজ,
আসেনি যারা আজও
সকলে মিলে এক পূর্ণ সংখ্যার যোগ্য প্রতিনিধি।

ধর্মশালা আছে হাজারো পথে পথে,
কত না নাম-ধাম, বাহারী কারুকাজ,
যবন ধর্মের র‍য়েছে মসজিদ;
তারও তো কত শাখা, সুন্নি, শিয়া আছে,
যিশুর পুত্রেরা ঐক্যে আছে বুঝি?
না আছে হিন্দুর একটি মন্দির,

এ-শুধু রাস্তা হে, লক্ষ্যে ছুটবার,
সকল রাস্তার প্রান্তে চমকায় আলোক-রেখা একই

ভিন্ন রাস্তায় যতই হাঁটাহাঁটি
ঠিকই সে নিয়ে যাবে অচেনা সেই ঘরে।

২১.
পেখম মেলে দিয়ে আষাঢ় রাত্রির স্তব্ধ নির্জনে
বিশাল ভুতিজাম, শ্যাওড়া, বনগাব আঁধারে ছমছম ভীতির উদ্গাতা;
ঝরছে টুপটাপ হলুদ নিমফল,
ঘাটের বাঁশঝাড়ে লিপ্ত গিরগিটি গভীর সঙ্গমে,

নানান ভঙ্গিতে পেঁচার ক্রন্দন,
কচুরিপানা-ডোবা হঠাৎ জেগে ওঠে
যখন কানিবক, ডাহুক একসাথে যুগল চিৎকারে রাতের ধ্যান ভাঙে।

গোরস্তান থেকে শব্দ ভেসে আসে;
কবর ভেঙে ঢোকে খাদ্য-সন্ধ্যানে শেয়াল দম্পতি,
মৃতের হাড়-গোড়ে হামলে পড়ে ওরা,
হুক্কা হুয়া ডেকে রাত্রি ভেঙে দেয়,
আঁধার খানখান।

ভীতির স্তব্ধতায়, নতুন বোধ জাগে; কেউ কি উঠে এলো
প্রাচীন গোর ভেঙে?
উঠোনে দাঁড়িয়ে কে?
আমারই উচ্চতা, চাঁদের ক্ষীণ আলো তৈরি করে এক
ভুতুড়ে আবছায়া,
সে ছায়া আমারই তো;
টিকালো খাড়া নাক, লম্বা চুলে ঝুল,
চশমা বসে আছে মধ্য যৌবনে পা রাখা নাসিকায়,

কে এলো? আপনি কে?

আমি কি উঠে আসি? না আমি কোনো এক ভেল্কি জাদুবলে
কবর গহ্বরে নিয়মতান্ত্রিক নিয়মে শুয়ে পড়ি?

তাহলে এই আমি, দিব্যি সংসারী,
পুত্র-কন্যার
পিতার আসনে যে এখনও বসে আছি, এখনও আমি এক
নারীর গর্বিত স্বামীর চর্চায় পুরুষ দাম্ভিক,

কে আমি? চিনেছি কি নিজেকে আমি নিজে?

২২.
চিনতে পেরেছিল কাবিলও নিজেকে কি?

হাবিল মাঠে মাঠে চড়াত মেষ, ভেড়া; সে ছিল চলমান,
ছুটত দূরে দূরে ঘাসের প্রান্তরে, উপত্যকা থেকে দূরের সমতলে,
পদক্ষেপে তার প্রজ্ঞা অর্জিত হচ্ছে প্রতিদিন;

কৃষক কাবিলের চাষের জমি ছিল, স্থবির একস্থানে,
না হেঁটে কোনকালে
কেই বা ছুঁয়েছিল জ্ঞানের কালো রেখা, প্রজ্ঞা-প্রান্তর?

আদিম দুই শিশু লিপ্ত অবশেষে জটিল ঝগড়ায়,
আদম আদিপিতা,
হতাশ পৃথিবীর প্রথম পুত্রের ক্রুদ্ধ আচরণে;
ভগ্নি সুন্দরী তাকেই পেতে হবে,
কঠিন জেদ তার,
কাবিল অবশেষে ঘটাল পৃথিবীর প্রথম হত্যাটি,
ভ্রাতৃহত্যায় দু’হাত রঞ্জিত;
কাবিল বিব্রত;
হে খোদা হায় হায় এখন করবো কী?
কোথায় রাখি আমি নিথর সহোদর? উড়াল বায়সেরা শেখাল সৎকার।

ভ্রাতৃহত্যার নিঠুর চর্চায় মানুষ সেই থেকে পাচ্ছে নিষ্ঠুর পাপের মন্ত্রণা;

এ-কালে কাবিলেরা কত না কৌশলে ভ্রাতৃবক্ষকে দীর্ণ করে রোজ,

লিটল, ফ্যাটবয় মৃত্যু বিভীষিকা ছড়াল নিমিষেই,
দুই’শ হাজারের অধিক অসহায় মৃত্যু মানুষের!

কে ছিল সে-মানুষ? ছিল না সহোদর, মানব-সূত্রের?

প্যালেস্টাইনের ভূমিতে প্রতিদিন মারছে কাকে ওরা,
ভ্রাতৃরক্তের চেনে না দাগ-রেখা?
এ-কোন সভ্যতা
পুষছি এই কালে, এই কি আমাদের দম্ভ শিক্ষার!

কবিল দেশে দেশে উঁচিয়ে তরবারি এখনও হেঁটে যায়;
যায় সে কার গৃহে? কাকে সে খুন করে?
প্রকৃত সত্য কি এটাই নয় যে সে হত্যা করে রোজ
কেবল নিজেকেই?

২৩.
আমিও একদিন স্থবির, বসে পড়ি, জানি এ-অন্যায়,
চড়ায় মেষ যারা দাহনা প্রান্তরে পায়ের রেখা গুনে
তারাই জ্ঞানবীজ গোপনে রাখে বুনে
মানব-বক্ষের নরোম কোষে কোষে;
প্রবহমান স্রোত ফসল তুলে দেয় নতুন জন্মের অযুত জ্ঞানগৃহে।

এই যে চলমান, সময়-সভ্যতা
হঠাৎ তারও চাই খানিক বিশ্রাম, ধ্যানীর হিমালয়,
হেরার গুহাগৃহ,
কপিলাবস্তুর বৃক্ষ বোধিমূল
সিনাই পর্বত,
অলিভ গিরিচূড়া,
তমসা নদীতীর
যাত্রা বিরতির সাক্ষ্য দেয় আজও…

নীরবে একদিন আমিও চুপচাপ
চিহ্ন সেইসব যা ছিল আঁকা পথে, গুনেছি সাবধানে।
পড়েছি বসে এক নীরব রাস্তার খানিক দূরে গিয়ে,
নিজের ভেতরের অসীম কোলাহল এনেছি বের করে,
বিছিয়ে দিয়েছি পাখির কণ্ঠতে, সাগর গর্জনে,
ঝড়ের বেসামাল ধ্বংস তাণ্ডবে।

হয়েছি এরপর মৌন নির্জন,
তখনই শুরু হয় প্রকৃত যাত্রার অসীম আয়োজন;
আমি তো স্থির হতে বসেছি নির্জনে
অথচ এই ক্ষণে
ক্ষিপ্রতায় উড়ে বাহন অদ্ভুত সামনে এসে বলে, এখনই উঠে পড়ো…

আমাকে নিয়ে যায় কত না জায়গায়,
দেখায় ঘুরে ঘুরে
পাতাল জল ফুড়ে, জলজ রাজ্যটি, কত কী
ইতিহাস,
জলের খুব নিচে তপ্ত পাথরেরা গভীর ক্রন্দনে
কাঁপছে ঢেউ তুলে;

মেঘের কন্যারা তখন দিশেহারা গাঁয়ের পথ ভুলে,
শকট অদ্ভুত এমন উভচর দেখেছে কেউ আগে?

যাচ্ছি ছুটে আমি;
কখনো অম্বরে, কখনো জলে নামি;

যাত্রা পথে পথে দুহাতে অর্জন যা কিছু টাকা কড়ি
আয়েশে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছি ফুল পাখি জলজ তিমিদের,
যখন নীল মেঘে সাঁতার কাটে যান,
বৃহৎ পাখিদের পালক ফেলে জলে সময় দাঁড় টানে,
হাজারো দেবদূত মধুর সুর তোলে মল্লা-মাঝি-গানে।

চন্দ্র-তারা এসে স্নিগ্ধ আলো জ্বেলে দেখায় দূরপথ।

আমি তো নির্জনে চেয়েছি স্থির হতে,
অথচ উঠে বসি এ-মহাবিশ্বের সবচে দ্রুতগামী
দৈব-আলোরথে!

২৪.
দেখছি কত কিছু, কত কী ছোঁয় মন, কত কী কাছে টানে,
নীরবতার গানে শূন্য মুখরিত,
মেঘেরা ছুটে চলে, আকাশও যায় ছুটে,
দূরের সে স্থিত;
অনড় দাঁড়িয়ে সে কালের ছবি তোলে,
গুপ্ত রয়েছে যা,
ভাঁজের গেরো খোলে;
সেসব কৌশলে দৃশ্যমান করা কর্ম বুঝি তারই।

অতিথি আমি তার যাচ্ছি সেই বাড়ি,
যাবার পথে পথে, ছড়িয়ে দিয়ে যাই কত না আঁকিবুঁকি;
আমার পায়ে পায়ে পথের নির্মাণ,
কখনো এই পথ কখনো সে-দুয়ার ইচ্ছে-চাবি দিয়ে
কঠিন তালা খুলে একাই রোজ ঢুকি।

অন্য দরোজায় আবার টোকা দিয়ে নতুন পথে নামি,
কখনো দ্রুত ছুটি, কখনো আনমনে
মন্দ্র-ধীরে হাঁটি,
ক্লান্ত হলে আমি বৃক্ষ তলে থামি,
কখনো উল্লাসে কিংবা ক্রোধে ফাটি;

শান্ত অবয়ব নীরব জলাশয়ে শুধু কি বাল্মিকী একাই দেখেছিল?
আমিও দেখেছি তা,
পদ্মপত্রের নরোম কচিগায়ে ঊর্ণনাভ এক,
কে ছিল সেই পোকা?

ময়ুর দেখেছিল ফেরেশতার চোখ স্বর্গ বাগানের স্নিগ্ধ সরোবরে,
দেখেনি তার ছায়া সভয়ে কাঁপছিল পিশন নদীজলে,
ছায়ারা ভেঙে যায়, ছুটছে ত্রিধারায়,
কোথাও গিয়ে তারা আবার মিলেমিশে পূর্ণতায় উঠে মূর্তি গড়ে নেয়;

তুমি কি চেন সেই স্বরূপ মূর্তির?

২৫.
হঠাৎ মাঝরাতে ‘পেয়েছি’ চিৎকারে চকিতে জেগে উঠি,
নিমেষে বিদ্যুৎ আলোক রেখা-ছবি কোথাও মিশে যায়,
এই যে মাঝে মাঝে সে-ছবি দেখে ফেলি,

আমার সাধ্য কী দৃষ্টি মেলে তাকে নিজের ইচ্ছেতে
একটু দেখে নিই,
এ-শুধু তারই দয়া করুণা বর্ষণ,

সে-যদি চায় তবে মিলিত হবো আমি গভীর সঙ্গমে,
সুতোর টানে শুধু
পুতুল নেচে যাই পৃথিবী মঞ্চের বিশাল ক্যানভাসে।

স্বপ্ন দেখি রোজ নিদ্রা, জাগরণে
মিলবো একদিন গোলাপ খুশবুর স্নিগ্ধ গার্ডেনে,
নীলাভ আলো-ছায়া,
গাইছে ঝর্ণারা, যন্ত্রী শত পাখি
স্বর্ণ-বৃক্ষের মায়াবী ডালে ডালে,
দখিনা বায়ু এসে চোখের পাপড়িতে আলতো ছোঁয়া দেয়,
আসছে প্রিয়তমা মিষ্টি সুঘ্রাণে মাতাল চারপাশ…

মানুষ কেন এই ভ্রান্ত-বিভ্রমে থাকছে মশগুল?
ছিন্ন হয়েছি কি আমরা কোনো দিন? ক্কালবে চমকায়
এ-কোন আলোফুল?

সে-আলো খুঁজে পেতে পাহাড়-পর্বতে, ধুসর মরুপথে
তুষার ঝড় ঠেলে মেরুর হিমঘরে
ছুটছি প্রতিদিন,

দারুণ প্যারাডক্স। ঊর্ণনাভ-জাল।

আমার দেহ-সূতো আড়াই প্যাচে বাঁধে এ-মহাপৃথিবীকে;
কে বড়ো বলো তবে?

তবু এ-পৃথিবীর ক্ষুদ্র পাথরেই ঠুকছি মাথা রোজ
কত না ধর্মের তসবিহ গুনে গুনে।

২৬.
তবু কি ধর্মের শুদ্ধ হলিজলে পাপের দাগরেখা
যাচ্ছে ধুয়ে-মুছে কোথাও পৃথিবীর?

হত্যা, ধর্ষণে তোমার পুত্রেরা দক্ষ-দাম্ভিক,

গীর্জা প্রাঙ্গণে সাক্ষী ঈশ্বর, তোমার সন্তান
ক্রুদ্ধ হুঙ্কারে
ভ্রাতৃবক্ষের রক্তে স্নান করে চীনের নানকিনে;

চৌদ্দ হাজারের রক্তে রঞ্জিত রাখিন আরাকান,
রোহিঙ্গার লহু-জোয়ার অসময়ে
তীব্র খরস্রোতে ভাসছে নাফ নদী;

ইরাকী তুর্কম্যান হত্যা ধর্ষণে পাপের নগরীতে হয়নি পরিণত?
হাজারো কোল খালি সিরিয়-ইয়াজেদী গোত্র-মায়েদের;
ঊষ্ণ দারফুর-মরুর ভাঁজে ভাঁজে
রক্তে বহমান
গোত্রদ্বন্দ্বের নতুন নীল নদ;

সুনীল কিভু লেক পিগমি নারীদের কান্নাধারা স্রোতে
ভাসছে কতোকাল;
মাত্র শতদিনে তুতসী মিলিয়ন বক্ষ কোল খালি;
পাকিস্তানি সেনা একাত্তরে খুন করেছে জেনে বুঝে
তিরিশ লক্ষেরও অধিক নাগরিক;

কে ছিল সে-মানুষ?
ছিল না ভাই তারা?

সভ্যতার নামে তোমার পুত্রেরা ভ্রাতৃবক্ষের রক্তে স্নান করে;

চলছে আজো এই হত্যাযজ্ঞের নানান মহড়ার কত না আয়োজন।

২৭.
বিকেল পড়ে এলে টেরচা একফালি কমলা রঙা রোদ বৃষ্টিস্নাত পথে
আলোর খেলা করে,

রাস্তা পিচঢালা, ফাটল সরু এক,
ওখানে জলকাদা
খানিক জমে ছিল, সে-জলে আলো এসে এমন চমকায়! গুপ্তধন বুঝি?

এ-যেন জ্যোৎস্নায় জৈষ্ঠ্য-পূর্ণিমা;
হঠাৎ বর্ষণে উঠোন সয়লাব,
সঘন মেঘ ঠেলে তীব্র ভেসে উঠা চাঁদের বাটি থেকে
উপচে পড়ে দুধ,
আলোর দুগ্ধতে জ্বলছে ঝিকমিক সর্প মানিকেরা,
শতেক জানালায় লোভের চোখ জ্বলে, কে-যাবে সাহসী কে?
এখনই ছুটে চল, সাপের মাথা থেকে মানিক তুলে আনি;

এমন গল্পের রাত্রি কত শত বঙ্গবর্ষায়
তৈরি হয় গাঁয়ে,
সেসব গল্পের উষ্ণ ওম ছুঁয়ে কেটেছে শৈশব দূরের খাগাতুয়া গ্রামের পল্লবে।

এ-দূর পরবাসে বৃষ্টিস্নাত এক বিকেল হেলে পড়ে
পিচের রাস্তায় ফাটল দেখা দিলে
হড়কে পড়ে জল,
সে-জল উজ্জ্বল, সহসা টান মারে হৃদয়ে ফুলে ওঠা পালের গুন ধরে…

কত কী মনে পড়ে, কত কী বিস্মৃত!
নিরাক মারা রাত,
কোশার গলুইয়ে হ্যাজাক বাতি বাঁধা
অনড় বড়ো মামা ডাঁসার কোচ হাতে মূর্তি যেন এক, মাছের যমদূত;
কাকিলা, ফলি, শিং কালচে বেলে মাছ,
হঠাৎ চোখে পড়ে বোয়াল সুবিশাল,
খলসে, সরপুটি
পোনার ঝাঁক থেকে সহসা গেঁথে ফেলে
বিশাল শোল মাছ,
উল্কি আঁকা এক গজার ভেসে আছে, সেও-কি বাঁচে বলো?

রাত্রি পার হয়ে পূবের আসমানে ভোরের আলো ফোটে,
গুড়ার ফাঁকে জ্বলে রূপোর কারুকাজ,
মাছেরা ঝকঝকে আলোতে উজ্জ্বল গহনা বাংলার।

রাতের জমকুলি বরুণ বৃক্ষের খোড়লে শেষবার
বিকট ডাক ছাড়ে,
ভোরের কার্তিক মেছোর ঘাড়ে এসে শীতল শ্বাস ফেলে,
তখনও কেউ কেউ
মধ্য বিল থেকে ফিরছে আলো জ্বেলে।

গৃহিনী উলু দেয়,
মুয়াজ্জিন ওঠে মিনার-চূড়ো ঠেলে
আজান ভেসে আসে জগতে কী মধুর!

কল্যাণের ধ্বনি স্পর্শ করে বুঝি সকল অন্তর?

আজান-উলু ধ্বনি দু’পায়ে ঠেলে দিয়ে পাপের ঝাঁপি নিয়ে
বেরিয়ে পড়ে কত আদম সন্তান।

স্বার্থ দ্বন্দ্বের জটিল ব্যাকরণে বক্ষ খালি হয় নিত্য কত মা’র।

ভ্রূকুটি করে বুঝি এসব মহাকাল?

সকাল ঠিকই ছোঁয় তপ্ত দুপুরের তামাটে হাতখানি,
সে-হাত ছুটে যায়
ক্লান্ত বিকেলের স্কন্ধ ছোঁবে বলে,
বিকেল হেসে হেসে সন্ধ্যা ঠেলে দেয় রাতের গহ্বরে,
এভাবে আসে দিন, রাত্রি চিরকাল,
পূণ্য-পাপ দিয়ে তৈরি করে এক জটিল পৃথিবীকে
নিঠুর মহাকাল।

২৮.
কী ছিল এর আগে? কে ছিল? ছিল কেউ?
শূন্য থেকে শুরু?
সৃষ্টি শূন্যের, জগৎ সংসার যা কিছু চারপাশে?

পাহাড়, মরুভূমি, সাগর সুবিশাল;
এসব নিয়ে এই বৃহৎ গোলাকার পৃথিবী বহমান,
সৌরজগতের বৃত্ত-ঘুর্ণনে এও তো বড়ো নয়,
মিল্কিওয়ে যদি চিন্তাবৃত্তের সীমানা ধরি তবে,
নস্যি পৃথিবীটা,
কোথায় প্রাণীকূল?
দম্ভ অহমিকা কী নিয়ে করে লোক?

এমন আরো কত রয়েছে ছায়াপথ বিশ্ব-মহাকাশে,
এই-তো শেষ নয়, রয়েছে আরো আরো না জানা বিশ্বের
কত না ছায়া অস্তিত্ব নীলাকাশে, অন্ধকারে ডুবে।

ক্ষুদ্র মানুষের স্কন্ধে বসা মস্তিস্ক নিয়ে যদি ভাবতে বসে পড়ি,
সুরাহা হবে বুঝি? হবে না কিছুতেই।

রহস্যের ঘোর বসবে জেঁকে আরো।

কয়েক বিলিয়ন রয়েছে নিউরন,
প্রতিটি মানুষের মাথার ভেতরেই একটি মহাকাশ;
সেখানে জ্বলে আছে রাতের তারকারা…আহা কী উজ্জ্বল, জ্বলছে মহিমায়।

মানুষ পৃথিবীতে প্রস্ফুটিত যত, ভাবো তো যদি বলি,
অসীম আসমানে ততই য়্যুনিভার্স, ভাবনা ভুল হবে?

এবার বলি শোনো,
এ-মহাজগতের কেন্দ্রে জ্বলে আছে আলোর ঘুর্ণন,
ঘুর্ণমান সেই অসীম শক্তির কেন্দ্রে আছে এক পিণ্ড আঁধারের,

সেখান থেকে শুরু; শূন্য থেকে নয়।

এ-শুধু প্রসারণ, এখনও প্রসারিত হচ্ছে প্রতিক্ষণে;

এ-মহাবৃত্তের সকল ভাঁজে ভাঁজে অযুত বিলিয়ন
ক্ষুদ্র প্রসারণ নিয়ত ঘটে চলে,
চক্রাবর্তের নিয়ম মেনে ফের সঙ্কোচন ঘটে;
সকল চক্রই,
গ্রীষ্ম, শীত ঋতু; জোয়ার-ভাটা জলে,
প্রণয় বিচ্ছেদ, ঘটে যা সংসারে,
পূণ্য, পাপ, ঘৃণা কত কী দেবালয়ে,
কনফেশন গৃহে পাপের নিস্কৃতি;
পূর্ণ চন্দ্রের পরে যে আসে অমাবস্যা কালো রাত
সকলই সুবৃহৎ চক্রাবর্তের ক্ষুদ্র অনুগামী।

মৃত্যু মানুষের ভেবো না পরিণতি, শীতের মরা ডালে গ্রীষ্মে ফুল-পাতা
গজায় যদি তবে, মানুষ ফিরবে না?

বৃহৎ বৃত্তের যখন গতিবেগ লক্ষ্যে পৌঁছুবে,
তখন স্থির হবে, স্থির সন্নাসে
কয়েক মিলিয়ন বছর এ-জগত, এ-মহাগুহাকাল।

নিয়ম মেনে ফের সঙ্কোচন-খেলা, ছোটো সে হতে হতে,
হঠাৎ ঢুকে যাবে কৃষ্ণ পিণ্ডের আঁধার গহ্বরে।

এ-যেন ছুঁড়ে দেয়া আকাশে ঢিল এক, হাতেই ফিরে আসে,
যখন গতি তার স্তিমিত হয়ে যায়।

ওপরে যেতে যেতে আপন মহিমায় সে শুধু চমকায়,
সে শুধু চমকায়…

দু’চোখ মেলে আমি, কখনো চোখ বুঁজে,
একাকী বুঁদ হয়ে
চমক দেখি তার অবাক বিস্ময়ে।

হলিসউড নিউইয়র্ক। মে ২০২৪

আরও পড়তে পারেন

4 COMMENTS

  1. কাজী জহিরুল ইসলাম বিশাল প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়ে তাঁর কবিতায় চেতনাকে প্রবাহিত করেছেন। আদি অন্তহীন জীবনের প্রজ্ঞাময় ভূমি থেকে সভ্যতার প্রাচুর্যমণ্ডিত অভিজ্ঞানে তিনি বিচরণ করেছেন। তাই এসেছে নানা ধর্মীয় কিংবদন্তীর বিস্ময়কর তথ্য। ইসলামীয় মিথের প্রসঙ্গ। তার ব্যাপ্তি রচনার প্রশংসা করি। খুব ভালো লেগেছে পুরো কবিতাটি।
    “এ-মহাজাগতিক শব্দ সিম্ফনি উষ্ণ জল ধোয়া
    স্নিগ্ধ মেঘ হয়ে
    পৃথিবী ভ্রমণের বৃত্ত এঁকে দেয়;

    সে-মেঘ ঝরে পড়ে অগ্নিদাহ-বারি; সদম, গোমরায়,
    অ্যালোন বৃক্ষেরা নিদাঘ পুড়ে ছাই,
    দু’জন দেবদূত লুতের গৃহে কেনো প্রদোষে এসেছিল?
    নুনের থাম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অদো, নবীর প্রিয়তমা;
    কী ছিল অপরাধ সদম-রমণীর?”
    আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে জীবনবাদী চেতনার নানা স্তর তিনি সংযুক্ত করেছেন। তাই মহাসমায়ের অন্তরাল ভেদ করে কবিতাটিতে একটি দীর্ঘস্বর শুনতে পেলাম।

    • অনেক ধন্যবাদ প্রিয় কবি। আপনার মন্তব্য বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে। ভালোবাসা জানবেন।

  2. কাজী জহিরুল ইসলামের সাহিত্য যাত্রা প্রায় চার দশকের।বয়সেও তিনি এখন প্রবীনের কাতারে।এই পর্যায়ে এসে তিনি চর্চাকে নিয়ে এসেছেন পরিকল্পনার আওতায়।কাজী জহিরুল ইসলাম এখন পরিকল্পিতভাবে চর্চা করেন শিল্পের।এর আগে মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তকে রেখেছেন তার পরিকল্পনায়।এবার কবিতার আকারকে করেছেন পরিকল্পনার অংশ। সাহিত্যিক ভাষায় সম্ভবত একে পরীক্ষা প্রবনতা বলা যায়।
    আধুনিক যুগ চাহিদায় মানুষ খুবই কর্মব্যস্ত । কবিরাও নিজেদের ভাব,চিন্তা প্রকাশ করেন সংক্ষিপ্ত পরিসরে। দীর্ঘ কবিতার চর্চা তাই খুব কম।তিনি হেঁটেছেন সে পথে।তার এ কবিতাটি দীর্ঘ একটি কবিতা। দীর্ঘ কবিতায় পরম্পরা রক্ষার জন্য রেখেছেন ২৮ টি ক্রম। ক্রমসূত্র পাঠকের ক্লান্তি বিনাশে সহায়ক।ভাব, ভাষা, ছন্দ,বক্তব্যের চমৎকার সমন্বয় প্রায় ৬০০ পঙক্তির এই দীর্ঘ কবিতাটি। পাঠক প্রিয়তা ও গবেষণা উপাদন হিসেবে কবিতারটি সমাদৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস।ধন্যবাদ কবিকে।

    • প্রিয় তাজ ইসলাম, কবিতার বোধকে ধরে ফেলার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে আপনার। খুব ভালো লাগলো আপনার মন্তব্য পড়ে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ