spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যশাহীন রেজা'র কবিতা : লাবণ্য, প্রেম ও দ্রোহের নির্যাস

লিখেছেন : হাসান হাফিজ

শাহীন রেজা’র কবিতা : লাবণ্য, প্রেম ও দ্রোহের নির্যাস


হাসান হাফিজ

স্বপ্নমেদুরতা, আত্ম-অবলোকনের হালকা মৃদু আবেশ, প্রকৃতির অনুরণন, গভীর জীবনবোধের দেখা মেলে কবি শাহীন রেজার কবিতায়। তার কবিতাভ্রমণ নিতান্ত অল্পদিনের নয়। সেই পথযাত্রায় অর্জিত অভিজ্ঞতা,জীবনমন্থন, উপলব্ধি, জীবনের ইতি-নেতির সূক্ষ্মনিবিড় পর্যবেক্ষণ-মূল্যায়ন তিনি ধরতে চেয়েছেন কবিতার ছত্রে ছত্রে। নানান আঙ্গিকে তিনি কবিতা লিখেছেন। বিষয়বৈচিত্র্যও লক্ষ্যণীয়। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার। সেগুলো অর্জন করেছে পাঠকপ্রিয়তা। তার কবিখ্যাতি দেশের গণ্ডি সীমান্ত ছাড়িয়ে পল্লবিত, প্রসারিত হয়েছে। সেটার মূল্যও যথেষ্ট বলে বিবেচনা করি আমরা।
বলেছি, বিচিত্র বিষয় তিনি উপজীব্য করেছেন কবিতার। হাইকু রচনায় তার সিদ্ধি ও পারঙ্গমতা চমৎকার। কবিতাসংসারে এইসব সুকৃতি তার অভিনিবেশ,শক্তিমত্তা ও সাহসের পরিচয় নিঃসন্দেহে। স্বাদেশিকতার বলয় পার হয়ে বহির্বিশ্বেও তার স্বচ্ছন্দ সাবলীল পরিভ্রমণ আমরা নিরীক্ষণ করি। নির্বাচিত কবিতার (প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০২০) একটি কবিতার নাম : চুরুট। শাহীন রেজা লিখছেন,
আপনার চুরুট থেকে বলিভিয়ার জঙ্গলে যে স্বপ্নধোঁয়ার জন্ম হয়েছিলো, তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বার আগেই বুর্জোয়া কার্বনের কালো আগ্রাসীতে ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো। তবুও আজো সেই চুরুটের ঘ্রাণে কিছু মানুষ মাতাল হয়ে থাকে। ওই ক্যাপ আর দাড়ি আজও কিছু মানুষের অহঙ্কারে বীর্য হয়ে জ্বলে।
জেনে রাখুন প্রিয় কমরেড,একদিন এইসব বিষাক্ত কার্বনকে ঢেকে দিয়ে আপনার চুরুটের স্বাপ্নিক ধোঁয়া আবারও ছড়াতে থাকবে বিশ্বময় আর সেদিন পৃথিবীর সমস্ত যুবকের ঠোঁট আলোকিত হবে হাজার হাজার চুরুটে।
এই কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে অসমাপ্ত বিপ্লবের জন্য হাহাকার, একইসঙ্গে আমরা দেখা পাই আশাবাদের ক্ষীণায়ু ঝিলিকেরও। কখনো কখনো অধ্যাত্মবোধেও কবি প্রাণিত, দোলায়িত এবং উজ্জীবিত। শরীরী ভাষা, বোধ, গহিন উপলব্ধি এক অতীন্দ্রিয় আলোকের অভিসারী হয়ে ওঠে অবলীলায়। সেও এক উত্তরণ বটে। ‘একদিন রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন আমার শহরে’ ব্যতিক্রমী নামের একটি কাব্যগ্রন্থ আছে শাহীন রেজার। একটি কবিতার শিরোনাম হচ্ছে ‘মোম ঘর’।
সেই কবিতার উদ্ধৃতি–
দেহ এক মোম ঘর
কখনও গলে পড়ে কখনও বা স্থির
যেন সৌরসৌধ;
মমিদের কথা মনে পড়ে–
মোম ঘরে
আয়নায় আলতার চোখ;
কান্না ধূসর হলে পৃথিবীতে
শুধু এক গাণিতিক বোধ
বিয়োগ বিয়োগ।
এসো মোম ঘরে যাই
জ্বলে উঠি মমি হই
তারপর পৃথিবীটা শুধু পিরামিড।
শাহীন রেজা বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন কবির স্নেহসান্নিধ্য ও আশীর্বাদ লাভ করেছেন। সে সৌভাগ্য তার কবিতাযাত্রাকে নতুন মাত্রা ও প্রেরণা দিয়েছে। আলোকিত তো করেছেই। কবি আল মাহমুদ তাঁর অনুজ এই কবি সম্পর্কে লিখেছেন,
“… আমি সহসাই কাউকে ‘কবি’ বলি না। এ জন্যে আমার প্রতি অনেকের ক্ষোভ আছে। আমি মনে করি, যার লেখা কবিতা হয়ে ওঠে না তাকে কবি বলে স্বীকৃতি দিলে যেমন তার ক্ষতি হয় তেমনি ক্ষতি হয় কবিতারও। আমি কবিতাকে ভালোবাসি বলেই কোনোদিন এই কাজটি করিনি। যাদেরকে আমি এ পর্যন্ত ‘কবি’ হিসেবে উল্লেখ করেছি, আমার বিশ্বাস কালের বিচারে তারা ‘কবি’ হিসেবে স্থায়ী হয়ে যাবেন। শাহীন রেজাকে আমি একজন ‘কবি’ হিসেবে শনাক্ত করেছি। আমার বিশ্বাস, সে কবিতায় আন্তরিক এবং নিয়মিত হলে একদিন প্রত্যাশিত স্থানেই তার অভিষেক ঘটবে। যখন চোখে দেখতাম, তখন তার অনেক কবিতাই আমি পাঠ করেছি। এখনো মাঝেমধ্যে অনুজ কবিদের সহযোগিতায় অনেকের সাথে তার কবিতাও শ্রবণের সুযোগ ঘটে। শাহীনের বর্তমান কবিতাগুলোকে আগেকার চেয়ে আমার কাছে আরো পরিণত বলে মনে হয়। অবশ্য এটাই সময়ের ধর্ম। সময়ই একজন মানুষকে বদলে দেয়, সমৃদ্ধ করে।
শাহীন রেজার অনেক কবিতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি,আনন্দিত হয়েছি, পুলকিত হয়েছি। ভালোলাগা যাকে বলে তা একটা অনুভবের বিষয়। আমি সারাজীবন পড়তে পড়তে এসেছি। আয়ু ঝরিয়ে ঝরিয়ে গড়িয়ে পড়েছি এই দেশে। এই মাটিকে আমি মাতৃতুল্য গরীয়সী মনে করি। আমার কবিতায় এই মায়ের গন্ধ আছে, শাহীন রেজার কবিতায়ও সেই মাকে শনাক্ত করেছি। একজন তরুণ কবির জন্য এটা কম কথা নয়। শাহীন রেজার কবিতা আমার মনে হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি এন দিয়েছে। কবিদের কাজ এ রকমই হয়। কখনো নেশা ধরিয়ে দেয়, কখনো আশা জাগিয়ে তোলে আবার কখনো ভাষার বিবৃতিতে বিষণ্ন হয়। শাহীন এ ক্ষেত্রে সফল, তা বলতেই পারি। আমার একান্তজন হিসেবে বলছি না। কবিতায় তার চাষবাস যে নিরলস,আমি দীর্ঘদিন ধরে দূর থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। সে সর্বদা কবিতা সৃষ্টির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ। তার কবিতা সহজ-সাবলীল গতিসম্পন্ন। সে শব্দে-গন্ধে পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারে।
তার একটি কবিতায় আছে এ রকমই পঙক্তি–
‘দাঁড়াও মধ্যরাত/কুয়াশার ছায়াপথে বাতাসেরা
অবিরাম নদীর চেরাগ।’
মধ্যরাতকে থামিয়ে দেয়ার ক্ষমতা তো একজন কবিই রাখে। নদীর চেরাগ আবিষ্কার করার ক্ষমতা, তাও তো একজন কবিরই দক্ষতা।”
মহৎ গীতিকবি কে জি মোস্তফার স্নেহসিক্ত একটু রচনাংশ দিয়ে শেষ করবো এই লেখা। কে জি মোস্তফা লিখেছেন,
“…শাহীন রেজা প্রেমের কবি। তার কবিতায় প্রেম যেন চিরসবুজ- চির ভাস্বর। তার প্রেম বিশেষ কোনো রমণীকে নিয়ে নয়। এ প্রেম ছুঁয়ে থাকে প্রকৃতি, জীবন এবং ঈশ্বরকেও। তার কবিতা যেমন শ্রুতিমধুর– তেমনি তা ভাবনাময়ও। তিনি পাঠককে যেমন আন্দোলিত করেন, তেমনি ভাবানও। আমাদের সমকালীন কবিতায় যা অনেকটাই অনুপস্থিত।
শাহীনের কবিতার অধিকাংশ জুড়ে আছে মেঘ ও বৃষ্টি। মনে হয় শাহীন স্নিগ্ধতায় বিশ্বাস করেন। তিনি হারিয়ে যেতে ভালোবাসেন ছায়াসুনিবিড় কল্পরাজ্যে– যে রাজ্য মানুষকে নিয়ে যায় স্বপ্নময় এক অচিন ভুবনে। শ্রাবণজুড়ে জলের আগুনে আলোরঘর খুঁজে বেড়ানো শাহীন স্বপ্ন দেখেন একটি ঘুমপাখির। যা তাকে শুধু নয়–তার কবিতাকেও পৌঁছে দেবে এক অনাবিল সুখ-সাম্রাজ্যে। তার কবিতার যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে দৃশ্যমান তা হচ্ছে–আত্মোপলব্ধি, প্রকৃতিপ্রেম এবং রমণীয়তা…”

………..
লেখক : কবি, সাংবাদিক। সিনিয়র সহ সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. হাসান হাফিজ ভাই দুই অগ্রজকে কোট করে ছেড়ে দিলেন! আরও কিছু বলার থাকে, বলার ছিল, পড়তে গিয়ে বুঝতে পারি অপূর্ণ তা…। শব্দের পেলব পেয়ে কবিতা কবির থেকে অন্যের হয়ে যায় অথবা কবিতাচিন্তা টুস করে মুখ খুলে অথবা বিচ্ছুরণে স্পর্শের বাইরে অতি স্পর্শের সতত শতধা…। শুভেচ্ছা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা