spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েআন্না কারেনিনা : বিশ্বসেরা উপন্যাস

লিখেছেন : শান্তা মারিয়া

আন্না কারেনিনা : বিশ্বসেরা উপন্যাস

শান্তা মারিয়া

একটি মেয়ের গল্প শুনুন। সুন্দরী সুশিক্ষিতা এই তরুণী এক প্রাজ্ঞ ও প্রভাবশালী আমলার স্ত্রী। সমাজে তার দারুণ প্রতিপত্তি, সুনাম, প্রতিষ্ঠা। একদিন মস্কো রেল স্টেশনে তার সঙ্গে দেখা হল এক তরুণ সামরিক অফিসারের। আর তারপর থেকে তাদের জীবন গেল একেবারে বদলে। 

কিন্তু পৃথিবীতে তো শুধু তারাই নেই। আছে তরুণীর স্বামী শিশুপুত্র। আছে সমাজ, সংসার, আর আছে সমাজের কিছু অমোঘ নিয়ম কানুন। সেই সঙ্গে রয়েছে নিজেদের সম্পর্কের জোয়ার ভাটা,ভালোবাসার অনিবার্য কিছু দাবি। ঠিকই ধরেছেন, এ গল্প পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস–লেভ তলস্তয়ের আন্না কারেনিনার। আন্না আর কাউন্ট ভ্রনস্কির জীবনের গল্প।এটি আমার সবচেয়ে প্রিয় বই এবং বিশ্বসাহিত্যের সেরা উপন্যাস। দ্বিমত থাকতে পারে। তবে মুগ্ধকর এবং অন্যতম সেরা যে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। 

লেভ  তলস্তয় এমনিতেই প্রিয় লেখক। কিন্তু তাঁরও ওয়ার  অ্যান্ড পিস,  রেজারেকশন এর মতো বিখ্যাত উপন্যাস রেখে আন্না কারেনিনার প্রতি আমার প্রেমকে অবিচল রেখেছি।

বইটি প্রকাশ হয় ১৮৭৭ সালে। উপন্যাসটি ১৮৭০ এর দশকে জারতান্ত্রিক রাশিয়ার অভিজাত সমাজের প্রেক্ষাপটে লেখা। আট পর্বের সুপরিসর উপন্যাস।

প্রকাশের পরপরই বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে। কারণ এখানে মানবিক সম্পর্কগুলোকে, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাকে এত নিবিড়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে যা রীতিমতো বিস্ময়কর। 

বিশাল পরিসরের বইটি জার আমলের রাশিয়ার যে অভিজাত সমাজের প্রেক্ষাপটে লেখা, সে সমাজকে তলস্তয় খুব ভালোভাবেই জানতেন কারণ তিনি নিজেও ছিলেন উচ্চ অভিজাত সমাজের সদস্য। ধনী কাউন্ট। আন্না কারেনিনায় তার জীবনের অনেক ঘটনাও স্থান পেয়েছে। এমনকি অনেক সময় উপন্যাসের নায়ক লেভিনকেন্দ্রিক ঘটনা ও মানসিক বিশ্লেষণ মিলে যায় তলস্তয়ের জীবনের ঘটনা ও মনোজগতেরে সঙ্গে।

কাহিনিটি সংক্ষেপে বলি।

সেন্ট পিটার্সবুর্গের প্রভাবশালী প্রৌঢ় আমলা আলেকসেই আলেকজান্দ্রভিচ কারেনিনের স্ত্রী তরুণী সুন্দরী আন্না আর্কাদিয়েভনা কারেনিনা সমাজের একজন সম্মানিত ও সুপরিচিত জনপ্রিয় নারী। তিনি তার স্বামীর চেয়ে বিশ বছরের ছোট। তিনি মস্কোতে আসেন তার ভাই প্রিন্স স্তেপান আর্কাদিচ অবলোনস্কি বা স্তিভার সংসারের গোলযোগ মেটাতে।বাড়ির তরুণী গভার্নেসের প্রেমে পড়ায় চপলমতি স্তিভা তার পাঁচ সন্তানের জননী স্ত্রী ডল্লির(প্রিসেন্স দারিয়া আলেকজান্দ্রভনা অবলোনস্কায়া) সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন।

স্তিভার বন্ধু হলেন কনস্তান্তিন দিমিত্রভিচ লেভিন নামে এক উচ্চবংশীয়, ধনী, অভিজাত গ্রামীণ জমিদার। তরুণ লেভিন ভালোবাসেন স্তিভার সুন্দরী শ্যালিকা প্রিন্সেস কাতেরিনা আলেকজান্দ্রভনা শ্যেরবাৎস্কায়া ওরফে কিটিকে যিনি ডল্লির অতি আদরের ছোট বোন। লেভিন ছিলেন কিটি ও ডল্লির প্রয়াত বড়ভাইয়ের সহপাঠী এবং শ্যেরবাৎস্কি পরিবারের ঘনিষ্ঠ স্বজন।

কিটিও লেভিনকে ভালোবাসেন। কিন্তু সে ভালোবাসায় তেমন চমক ছিল না। বরং স্তিভার আরেক ধনী, সুদর্শন, অভিজাত বন্ধু কাউন্ট আলেকসেই কিরিলভিচ ভ্রনস্কি যিনি একজন চৌকষ সামরিক অফিসারও বটে, তার প্রতি মোহে পড়েন কিটি। এই মোহের বশে তিনি লেভিনের প্রেম ও বিবাহ-প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেন।

আশাহত লেভিন ফিরে যান গ্রামে তার জমিদারি মহালে। অন্যদিকে মস্কোয় আসা আন্নার সঙ্গে পরিচয়ের পর আপাদমস্তক তার প্রেমে পড়ে যান ভ্রনস্কি এবং কিটির ভালোবাসা ও মুগ্ধতাকে তিনি পাত্তাই দেন না। ভ্রনস্কির এই অপমান অন্যদিকে লেভিনকে ভালোবেসেও প্রত্যাখ্যান করার দুঃখে ম্রিয়মাণ কিটি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য বাবা মায়ের সঙ্গে যায় জার্মানিতে। 

ভায়ের সংসারের গোলযোগ মিটিয়ে আন্না ফিরে যান পিটার্সবুর্গে। ভ্রনস্কিও তার সঙ্গেই ফেরেন। এরপর বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, বল নাচ, থিয়েটার ইত্যাদিতে আন্না ও ভ্রনস্কির যোগাযোগ চলতে থাকে এবং একসময় তাদের দুজনের মধ্যে জন্ম নেয় বাঁধভাঙা প্রেম। অচিরেই সমাজের চোখে পড়েন তারা।

গ্রীষ্মে আন্না যান শহরের উপকণ্ঠে গ্রীষ্মাবাসে। সেখানে ছিল ভ্রনস্কির সামরিক ছাউনি। ফলে দুজনের যোগাযোগ আরও বাঁধাহীন হয়ে ওঠে। 

জার এবং রাজ দরবারের সামনে সামরিক অফিসারদের এক ঘৌড়দৌড়ের আয়োজন হয়। ভ্রনস্কি চৌকষ ঘোড়সওয়ার। তিনি জিতবেন এমনটাই ধরে নেয়া হয়। এখানে আন্না ও ভ্রনস্কির সম্পর্কের ভিতরকার স্বরূপ খুব সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেন তলস্তয়। ভ্রনস্কি কেন আন্নার প্রেমে পড়েন? হ্যা, সৌন্দর্যের ও ভালোবাসাজাত আকর্ষণ তো আছেই। সেইসঙ্গে রয়েছে তার আত্ম অহমিকাবোধ। আন্না হলেন অপরের স্ত্রী, উচ্চ সমাজের সুন্দরী নারী। তাকে দখল করে নিজের করায়ত্ব করার বাসনা আর তেজী ঘোড়াকে পোষ মানানোর মধ্যে কোথায় যেন একটা মিল রয়ে গেছে। 

ভ্রনস্কি যখন নিজের ভুলে ঘোড়দৌড়ে হারেন এবং তার ঘোড়ার মেরুদণ্ড ভেঙে যায়, তখন হতভাগ্য ঘোড়াটিকে গুলি করে মেরে ফেলা ছাড়া আর পথ থাকে না। এই ঘটনাটি আন্নার ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী। ভ্রনস্কি তার ভুলে শুধু প্রিয় মাদী ঘোড়া ফ্রু ফ্রুর মৃত্যুর জন্যই দায়ী হন না, তিনি ভবিষ্যতে আন্নার জীবনও ধ্বংস করবেন এমন একটা ইঙ্গিত কিন্তু লেখক এখানে দিয়ে দেন। 

এই ঘোড়দৌড়ের পরই স্বামী কারেনিনের জেরার মুখে আন্না ভ্রনস্কির সঙ্গে তার প্রেমের কথা স্বামীর কাছে স্বীকার করেন। আন্নার গর্ভে তখন ভ্রনস্কির সন্তান। স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্কের স্বীকারোক্তিতে কারেনিন মর্মাহত হলেও নিজের সামাজিক মর্যাদার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেন। তিনি আন্নাকে ফিরিয়ে আনেন পিটার্সবুর্গের বাসভবনে। বলেন, ঘটনাটিকে লুকিয়ে রাখতে হবে এবং সমাজে কোন কেলেংকারি রটতে দেয়া চলবে না। 

ভ্রনস্কি চান আন্না স্বামীকে ত্যাগ করে চলে আসুন তার কাছে। কিন্তু আন্না সেটা করতে পারেন না। এখানে ধরা পড়ে এই প্রেমের সবচেয়ে কষ্টকর দিকটি। আন্না তার ছেলে আট বছরের বালক সেরিওজাকে ভালোবাসেন তীব্রভাবে। স্বামীকে ছাড়তে হলে, ছেলেকেও ছাড়তে হবে এই বোধ তার জন্য মর্মান্তিক যন্ত্রণার। ছেলেটিও তার নিরুত্তাপ বাবাকে নয়, সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালোবাসতো একমাত্র মাকে।

কারেনিন একসময় স্ত্রীকে তালাক দিতে উদ্যত হন। কিন্তু সন্তান জন্মদানের সময় আন্না গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তাকে ক্ষমা করেন, নিজের কন্যা না জেনেও সদ্যোজাত শিশুটিকে ভালোবাসেন এবং ভ্রনস্কিকেও ক্ষমা করেন। গল্পটি এখানেও শেষ হতে পারতো। কিন্তু তাহলে সেটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হয়ে উঠতো না। 

এসময় ভ্রনস্কি আত্মহত্যার চেষ্টা করেও বেঁচে যান। আন্না তখন ভ্রনস্কির সঙ্গে নবজাত কন্যাকে নিয়ে গৃহত্যাগ করেন। সেরিওজা রয়ে যায় তার বাবার প্রাসাদে। 

অন্যদিকে লেভিন তার জমিদারিতে কৃষকদের স্বার্থ দেখেন ও নতুন কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। কৃষিকাজের শ্রমের ভিতর তিনি খুঁজে পান জীবনের প্রকৃত আনন্দ। নিজেকে তিনি জমিদার বা মালিক নয় বরং কৃষকের সঙ্গেই একাত্ম করে দেখেন বেশি। বিদেশ থেকে সুস্থ হয়ে কিটিও ফেরেন রাশিয়ায়। অভিমানী লেভিন তার সঙ্গে দেখা করেন না।

তবে, সবকিছু সত্ত্বেও কিটির প্রতি প্রেমকে ভুলতে পারেন না। কিটিও বুঝতে পারেন তার জীবনের প্রকৃত ভালোবাসা হলেন একমাত্র লেভিন। শীতে লেভিন যখন মস্কো আসেন তখন কৌশলে নিজের বাড়িতে তাদের নিমন্ত্রণে ডাকেন স্তিভা। ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয় লেভিন ও কিটির। বিয়ে করেন এই যুগল ও ফিরে যান গ্রামের প্রাসাদে বসবাসের জন্য। এখানে দুটি পৃথক ঘটনা সমান্তরালভাবে প্রবাহিত। একদিকে সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করছেন লেভিন ও কিটি। অন্যদিকে সংসার ভেঙে যায় আন্না ও কারেনিনের। কিটির বিয়ের আসরে এই উপলব্ধিতে পৌঁছান বড়বোন ডল্লি।

ভ্রনস্কি আন্নার জন্য তার সামরিক ক্যারিয়ার ত্যাগ করে প্রিয়তমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান ইউরোপ। সেখানে একঘেয়ে লাগায় ফিরে আসেন রাশিয়ার গ্রামে তার বিশাল জমিদারিতে। তার আগে তারা কিছুদিন কাটান মস্কোয়। সেখানে ভ্রনস্কি বিস্ময় ও বেদনায় আবিষ্কার করেন যে, তাদের বিয়ে বহির্ভূত এই প্রেমের জন্য চরম মূল্য দিতে হচ্ছে আন্নাকেই। ‘বেড়াল ইঁদুর খেলার মতো সমাজ তাকে প্রবেশাধিকার দিয়েই হাত নামিয়ে দিচ্ছে আন্নার প্রতি’। অভিজাত সমাজে আন্না হয়ে পড়েন ব্রাত্য।

আন্না তার শিশুপুত্রের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হন স্বামীর কূটকৌশলী বান্ধবী কাউন্টেস লিডিয়া ইভানোভনার কাছ থেকে। মরিয়া হয়ে আন্না চলে যান তার সাবেক বাড়িতে, দেখা করেন ছেলের সঙ্গে। সেরিওজাকে যদিও বলা হয়েছিল তার মা মৃত্যুবরণ করেছেন কিন্তু সে সেটা বিশ্বাস করেনি এবং সব সময় খুঁজতো মাকে। 

আজ তার জন্মদিনের সকালে আকস্মিকভাবে মায়ের ফিরে আসা তাকে আনন্দবিহ্বল করে দেয়। মাকে সে বিদায় দিতে নারাজ। কিন্তু উপায় নেই। আন্নাকে ছেড়ে যেতে হয় তার কান্নারত সন্তানকে।

উপন্যাসের এই অংশটা আমি কখনও শুকনো চোখে পড়তে পারি না। মা ও ছেলের ক্ষণমিলনের দৃশ্যটি এত করুণ, এত তীব্র বেদনাময় যে আমি কিছুক্ষণ বই থেকে চোখ সরিয়ে নিজের মধ্যে নিজে ডুবে যাই। বেদনাকে দেখার চেষ্টা করি অন্য মানুষের নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে।

কাউন্টেস লিডিয়া ইভানোভনার জালে ধরা পড়েন নিঃসঙ্গ হতভাগ্য কারেনিন এক বিচিত্র নব্য ধর্মীয় অতীন্দ্রীয়বাদের নেশায় পড়ে। আন্না অপমানিত হন থিয়েটার দেখতে গিয়ে সমাজের এক নির্বোধ মহিলার দ্বারা। এমনকি আন্নার অতি ঘনিষ্ট বান্ধবী নিজে যে স্বয়ং ব্যভিচারী সেই প্রিন্সেস বেটসি তর্ভেস্কায়াও আন্না ও ভ্রনস্কির এই বিয়ে বহির্ভুত একত্র বসবাসকে সমর্থন জানিয়ে সমাজের বিরাগভাজন হতে চান না। বাধ্য হয়ে আন্না ও ভ্রনস্কি চলে যান গ্রামের প্রাসাদে। এখানে ভ্রনস্কি আন্নার প্রেমে সুখী হলেও তার তো প্রয়োজন নিজস্ব কিছু কাজ। তিনি ধনী ভূস্বামীর ভূমিকায় সহজে মানিয়ে নেন নিজেকে। যুক্ত হয়ে পড়েন নানা রকম সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। কিন্তু সমাজে ব্রাত্য আন্নার তো আর নিজস্ব কোন বলয় নেই।

গ্রামজীবনে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। আন্না স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স পান না। দুজনেই এই বিয়ে বহির্ভূত প্রেমে ক্লান্ত হতে থাকেন একটু একটু করে, বিশেষ করে ভ্রনস্কির মধ্যে এই ক্লান্তি বাড়তে থাকে। আন্না যতই তাঁকে প্রেমজালে বাঁধতে থাকেন ততোই নিজেকে স্বাধীন করতে চান তিনি। দুজনের মধ্যে ঘন ঘন কলহ সৃষ্টি হতে থাকে। সেরিওজাকে হারানোর দুঃখ আন্নাকে ভোলাতে পারে না তার শিশুকন্যাও। মেয়েটি তখনও নেহাতই ছোট। কথাও ফোটেনি। তুলনায় সেরিওজা গোটা মানুষ হয়ে উঠছে। তার সাহচর্যের অভাব আন্নাকে গোপনে কাঁদায়। 

অন্যদিকে লেভিন ও কিটি ক্রমশ আরও বেশি করে সুখি হতে থাকেন পারিবারিক নতুন জীবনে। অন্তঃসত্তা স্ত্রীর প্রতি লেভিনের প্রেম ও যত্ন হয়ে ওঠে অনন্য। গ্রামে পারিবারিক জীবনের সুখ উপলব্ধি করতে থাকেন তারা আরও বেশি করে যখন তাদের কাছে বেড়াতে আসেন ডল্লি তার ছেলেমেয়েসহ। আসেন লেভিনের লেখক ভাই সের্গেই ইভানভিচ, কিটির বান্ধবী কুমারী ভারেঙ্কা এবং লেভিনের শাশুড়ি। এই পারিবারিক আবহে শহর থেকে এসে যোগ দেন স্তিভা। সঙ্গে নিয়ে আসেন ভাসেনকা নামে এক তরুণ যুবককে। ভাসেনকা কিটির সঙ্গে একটু প্রেম প্রেম ভাব দেখানোর চেষ্টা করেন। ঈর্ষাকাতর ও নিজের পারিবারিক মর্যাদা বিষয়ে অতি সচেতন লেভিন শায়েস্তা করেন ভাসেনকাকে। 

ডল্লি দেখা করতে যান ননদ আন্নার সঙ্গে যিনি লেভিনের জমিদারি থেকে কিছুটা দূরে ভ্রনস্কির নিজস্ব জমিদারিতে বাস করছেন তার মিসট্রেস হিসেবে। সেসময়ই ডল্লি আবিষ্কার করেন আন্না ও ভ্রনস্কির সম্পর্কের মধ্যকার ফাটল। দারুণ বিলাসিতা ও প্রাচুর্য সত্ত্বেও আন্না-ভ্রনস্কির গৃহস্থালি তার ভালো লাগে না। বরং তিনি লেভিন ও কিটির মধ্যকার দাম্পত্যের মাধুর্য এবং ভ্রনস্কির তুলনায় লেভিনের মানবিক শ্রেষ্ঠত্ব আরও বেশি উপলব্ধি করেন।

গ্রীষ্ম শেষে আন্না ও ভ্রনস্কি আসেন মস্কোতে। আসন্ন প্রসবা কিটিও মস্কোয় আসেন লেভিনের সঙ্গে শহুরে সুযোগ সুবিধায় সন্তান জন্মদানের উদ্দেশ্যে। মস্কোতেই লেভিনের সঙ্গে বোন আন্নার পরিচয় করিয়ে দেন স্তিভা। লেভিন আন্নাকে দেখে মুগ্ধও হন। লেভিন মুগ্ধ হন আন্নার রূপে, মননশীলতায়, মেধার আলোতে। তিনি আশংকা করেন এমন সংবেদনশীল নারীকে ভ্রনস্কি পুরো বুঝতে পারবেন না। এ আশংকাটি পাঠকেরও। পাঠক এর মধ্যেই বুঝে গেছেন, আন্নার মতো অপূর্ব নারীর যোগ্য দয়িত হতে পারেন কেবল লেভিন, কিছুতেই ভ্রনস্কি নন। ওখান থেকে উপন্যাসটি নতুন বাঁক নিতে পারতো অনায়াসে। তা অবশ্য হয়নি।

সমাজে নিজের সম্মান হারিয়ে আন্না তখন হতাশার চরম সীমায়। স্বামী তাকে ডিভোর্স দেননি, ফিরিয়ে দেননি ছেলেকে, ভ্রনস্কি তাকে অবহেলা করছেন। 

এক পর্যায়ে আন্না পৌঁছে যান তার জীবনের প্রান্তে। রেল স্টেশনে চলন্ত রেলের চাকায় আত্মাহুতি দিয়ে শেষ করেন তার হতাশাগ্রস্থ জীবনের গ্রন্থ। 

আন্নার মৃত্যুতে নতুনভাবে তার স্মৃতিতে কাতর এবং অনুতাপে দগ্ধ ভ্রনস্কি চলে যান যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে। 

আন্নার মৃত্যুর পরও কাহিনীর শেষ অংশটা নেতিবাচক নয়। উপন্যাস শেষ হয় লেভিনকে দিয়ে। চিরদিন ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচলে প্রশ্নবিদ্ধ লেভিন শেষ অবধি পৌছে যান এক অমোঘ উপলব্ধিতে। তিনি কোন বিশেষ ধর্মের শৃংখলে আবদ্ধ ঈশ্বর নন বরং সমগ্র বিশ্বের সকল মানবের ও জীবজগতের মঙ্গলময় স্রষ্টা এক পরম শক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে পরম সত্যের আস্বাদ পান। 

আন্না কারেনিনা প্রকাশের পর জারশাসিত রাশিয়ার অভিজাত সমাজের অন্তরালবর্তী দ্বন্দ্ব, মূল্যবোধের ভাঙন, ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের পাশে নব্য বেনিয়া ও অনভিজাত পুঁজিবাদীর উত্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সনাতন মূল্যবোধগুলোও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আবার মানবিক অধিকারের বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 

লেভ তলস্তয়ের ‘আন্না কারেনিনা’ প্রথম পড়েছিলাম ১৯৮৭ সালে। উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী তখন আমি। আমাদের ইউনিভারসিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজের লাইব্রেরিতে ছিল তলস্তয় রচনাবলী। বইটি ধার করে এনেছিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে পড়ে ফেরত দিতে হবে। প্রথম খন্ডে ছিল ‘আন্না কারেনিনা’। যাকে বলে গোগ্রাসে গেলা। কিন্তু অমন উপন্যাস একবার পড়ে মন উঠবে কেন। পরে আলাদা করে দুটি খণ্ডে প্রকাশিত বইটি সংগ্রহ করি পুরানা পল্টনের সামনের ফুটপাথ থেকে। পুরানো নয় কিন্তু, একদম নতুন বই। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত। চামড়ায় বাঁধাই করা, ঝকঝকে কাগজে ছাপা সোভিয়েত যুগের সেই প্রোডাকশন দেখলেও মনের মধ্যে শান্তি সৃষ্টি হয়। 

তখন আমার একুশ বছর বোধহয়। তার মানে কিটির সমবয়সী প্রায়। মারাত্মকভাবে প্রেমে পড়ে গেলাম লেভিনের। আর আন্না মুগ্ধ করলো তার সৌন্দর্যে, গভীরতায়, বেদনায়। একটা আফশোস ছিল। আমার মতেও ভ্রনস্কি ঠিক আন্নার মতো সংবেদনশীল এক নারীর যোগ্য ছিলেন না। আন্নার কদর একমাত্র করা সম্ভব ছিল লেভিনের পক্ষে। কেন তার সঙ্গে লেভিনের প্রেম হলো না এটা আমার চিরকালের অতৃপ্তির বিষয়। শুধু মনে হতো লেভিনের সঙ্গে কেন কিটি?  কেন আন্না আর লেভিন পরষ্পরের নয়? আন্না, স্তিভা, লেভিন, কিটি, ভ্রনস্কি, ডল্লি, কারেনিন, নাতালি, লভভ, নিকোলাই, সেরিওজা সবাই খুব দ্রুত আপন হয়ে ওঠে। মূল চরিত্রগুলোর পাশাপাশি পার্শ্ব চরিত্রগুলোও অত্যন্ত জীবন্ত ও নিখুঁত হয়ে ওঠে তলস্তয়ের অবিশ্বাস্য প্রতিভার স্পর্শে।

কিটির বাবা প্রিন্স আলেকসান্দর শ্যেরবাৎস্কির কথাই ধরা যাক। এই বৃদ্ধ প্রিন্স তার সততা, নীতিবোধ, সরল জীবনবোধ ও পরিহাসপ্রিয়তায় শুধু লেভিনকে নন, মুগ্ধ করেন পাঠককেও। কিটির প্রবাসী বান্ধবী ভারেঙ্কা, লেভিনের ভাই সের্গেই ইভানভিচ, আয়া আগাফিয়া মিখাইলোভনা, তরুণ যুবক ভাসেনকা, ভ্রনস্কির বন্ধু পেত্রভকে পর্যন্ত মনে হতে থাকে চিরপরিচিত।

কনস্তান্তিন লেভিনের কমিউনিস্ট বনে যাওয়া ভাই নিকোলাই লেভিন তার তিক্ত, করুণ জীবনবোধ নিয়ে আমাদের অতি আপন হয়ে ওঠে। তার মৃত্যুতে নিজেও উপলব্ধি করি জীবনের অর্থহীনতা ও পরম গন্তব্যকে। পড়তে পড়তে মৃত্যু এত নিবিড়ভাবে ধরা দেয় তার সমস্ত নির্লিপ্ত বেদনায় যে নিজের মৃত্যুর এক অনির্বচনীয় অনুভূতি জাগে। আন্নার এক অশুভ স্বপ্ন বারে বারে দেখা এবং মৃত্যুকালে সেই স্বপ্নের দৃশ্য খুঁজে পাওয়া কি নিয়তির অমোঘ নির্দেশ? তলস্তয় স্পষ্ট করে বলেননি। কারণ জীবন কখনও স্পষ্ট করে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয় না। 

লেভিন ও কিটির প্রেমও আমি মনপ্রাণ দিয়ে উপভোগ করি।

তাদের প্রেম, বিরহ, বিয়ে, দাম্পত্য সব মিলিয়ে কি মধুর আখ্যান। লেভিনের মতো আবেগী, চিন্তাশীল, সুদর্শন, কখনও ঈর্ষাকাতর, অনুভূতিপ্রবণ, সৎ, যত্নশীল একজন মানুষকে ভালো না বেসে পারা যায়? উপন্যাসের চরিত্রের প্রেমে পড়া আমার চিরকালের অভ্যাস। জীবনে লেভিনকে খুঁজে পাইনি কোনদিন। তবে যখনি তার কাছে যেতে ইচ্ছা হয়েছে আমি হাতে তুলে নিয়েছি আন্না কারেনিনা। ব্যস চলে গেছি মধ্য রাশিয়ার উদার প্রান্তরে, লেভিনের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি তার জমিদারি পক্রোভস্কয়ের ঘাসকাটা মাঠে, ফসলের ভূমিতে। 

কতবার পড়েছি বইটি? কম করে হলেও পঁচিশ ত্রিশবার তো হবেই।যতবার আন্নার মৃত্যুর অংশটা পড়ি ততবার আশা জাগে হয়তো এমনটা ঘটবে না, হয়তো এবার আন্না এই কঠোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।যতবার পড়ি, ততোবারই শেষ ট্রেনের প্লাটফর্মে দাঁড়ানো আন্নাকে বলি, প্লিজ, এমনটা করো না। জীবন অনেক বড়, আর তোমাকে বাঁচতে হবে নিজেকে ভালোবেসে। 

এখন যত ভাবছি কেন আমার এই উপন্যাসটি এত প্রিয় ততই মনে হচ্ছে এর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য এর অনিবার্যতায়। যা ঘটেছে তার যদি ব্যত্যয় হতো, যদি অন্যরকম ভাবে ঘটনাগুলোকে প্রবাহিত করা যেত তাহলে লেখাটি তার সৌন্দর্য হারাতো। এটা এমন এক নিটোল অলংকার যার একটি পাথরও এদিক ওদিক করা চলে না। লেভিন, কিটি, আন্না, ভ্রনস্কির শুধু নয়, ডল্লি, স্তিভা, আলেকসেই কারেনিন এমনকি শিশু সেরিওজার পর্যন্ত হৃদয়ের তলদেশ অবধি উন্মুক্ত হয় এই অনন্য উপন্যাসে। মানুষের চিন্তার গতিকে এত নিবিড় এত বিস্তৃত এত সঠিকভাবে আর কোন উপন্যাসে দেখা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা