spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যআরশি নিকেতন : চার

ধারাবাহিক আত্মজীবনী। লিখেছেন : তৈমুর খান

আরশি নিকেতন : চার

তৈমুর খান


অপার্থিব সেইসব মুখগুলি


তখন বারো বছরের বেশি বয়স হবে না। বরাবরই আমার ভোরবেলায় ওঠার অভ্যাস ছিল। মসজিদে ফজরের আজান হলেই শয্যা ত্যাগ করে মাঠে যেতাম প্রাতঃকৃত্য করার জন্য। সেদিনও গেছি। আবছা কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে চোখের সামনে হঠাৎ দেখলাম এক দীর্ঘদেহী শ্বেতশ্মশ্রু পুরুষ পায়ে কাঠের খড়ম পরে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। শরীরের প্রতিটি লোম পর্যন্ত তাঁর সাদা, এমনকি পোশাক-আশাকও একেবারে শুভ্র। আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তাঁকে গালমন্দ করে দিলাম এক দৌড়। কিছু দূর গিয়েই পিছন ফিরে দেখি কিছুই নেই। তারপর বহুক্ষণ ভালো করে নিরীক্ষণ করলাম কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে পেলাম না। সেদিনের কথা বাড়িতে এসে বলতে লাগলাম। সবাই শুনে তাজ্জব হয়ে গেল। মানুষ হলে নিশ্চয়ই এত দীর্ঘ হতো না। নিশ্চয়ই অন্য কিছু। হয়তো জ্বিন কিংবা পীরও হতে পারেন। কেন তিনি আমার সামনে এলেন?
এ প্রশ্নের মীমাংসা করলেন আমার মা। মা বললেন, আমাদের সংসারে দীর্ঘদিন কোনো সন্তান আসেনি। বহু ডাক্তার,কবিরাজ, এমনকি ঝাড়ফুঁক পর্যন্ত চলেছে কিন্তু কিছুই ফল হয়নি। অবশেষে এক ফকির নাকি বলে গেছেন সন্তান হলে এবং সেই সন্তানের বারো বছর বয়স হলে একবার পাথরচাপুড়ির দাতাবাবার রওজায় মাটি স্পর্শ করে আসতে হবে।তিনি একটি জড়িবুটিও গোলমরিচসহ খালি পেটে সেবন করতে বলেছিলেন। তারই ফলে নাকি আমাকে গর্ভে ধারণ। হয়তো সেই সময়টিই উপস্থিত হয়েছে, তাই সেখানে যাওয়া কর্তব্য। দাদা বললেন, সে আর এমন কাজ কী! একদিন চলে যাব। এরকম কথাবার্তা চলতে চলতেই প্রায় ছয় দিন কেটে গেল। সবাই পরামর্শ দিল, আবার যদি কোনোদিন সেরকম দীর্ঘদেহী শ্বেতশ্মশ্রুকে দেখতে পাই তো আমি যেন সালাম করি। সাতদিন কাটতে কাটতেই প্রথম যেদিন যে সময়ে তাঁকে দর্শন করেছিলাম, আবার সেই বারে, সেই সময়ে তিনি ভিন্নভাবে দেখা দিলেন। সেদিন আর তিনি সামনে আসছেন না, সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছেন। আমি তাঁর পেছনে আছি। যেতে যেতে তিনি পেছন ফিরে তাকালেন। শান্ত স্নিগ্ধ মহিমান্বিত কোনোরূপ তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠল। এক জ্যোতির্ময় আলো ঠিকরে বেরিয়ে এলো। সমস্ত শরীর সাদা পোশাকে ঢাকা। আমি হাত তুলে তাঁকে সালাম জানালাম আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি চোখের সামনে মিলিয়ে গেলেন। আর কখনোই তাঁকে দেখতে পাইনি। বহুবার বহু জায়গায় তাঁকে দেখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু না, একবারও তিনি আসেননি। একদিন কাকার শ্বশুর আল্লারাখা নলহাটি থেকে আমাদের বাড়ি এলেন। তিনি অসম্ভব পরহেজগার মানুষ। সর্বদা দোয়া-দরুদের আমল করেন। তিনি আমাকে একটা চাদরে শুইয়ে দিয়ে চারিপাশে দাগ কেটে বহু দোয়াদরুদ পাঠ করলেন এবং একটা কালো সুতোয় শরীরের মাপ নিয়ে বললেন, “যিনি দেখা দিয়েছিলেন, তিনি আল্লাহর কামেল ফকির। ভালোর জন্যই তিনি দেখা দিয়ে থাকেন।” সেদিন আমি অনেকটাই আশ্বস্ত হয়েছিলাম।
বেশ কয়েক বছর পর আমাদের বাড়ির দরজায় সম্পূর্ণ কালো পোশাক পরে
অচেনা একজন ফকির এসে দরজায় চেঁচিয়ে বললেন: “মা, বাড়িতে আছিস?”
মা রান্নাঘর থেকে ছুটে গিয়ে বললেন, “কে?”
ফকির বললেন, “আমাকে চিনবি না, তোদের আজ একটা সংবাদ জানাতে এসেছি। একটা বড় বিপদ আসতে চলেছে। সাবধানে থাকিস।”
মা বললেন, “কী সেই বিপদ?”
ফকির বললেন, “তা বলতে পারব না, তবে আসবেই।”
সেদিন সেই ফকির কোনো ভিক্ষা নেননি। তিনি ভিক্ষা নেন না আগেই জানিয়েছিলেন। কিছু খাবারও খেতে চাইলেন না। কথা কয়টি বলে দরজা থেকে কোথায় অন্তর্হিত হয়ে গেলেন। আর দেখা পাওয়া গেল না।
সেই দিনটা ছিল মাঘ মাস। কনকনে ঠান্ডার দিন। এই মাসের এক তারিখ শুক্রবার বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমি পৃথিবীর মুখ দেখেছিলাম। সালটা ছিল ইংরেজি ১৯৬৭-এর জানুয়ারি মাস। মা বিপদের আশঙ্কায় সেদিন সারাদিন আল্লাহকে স্মরণ করেছিলেন। বিপদ কেটে গেলে আল্লাহর উদ্দেশ্যে মসজিদে ক্ষীর রান্না করে দেবেন এমনও অঙ্গীকার করেছিলেন। আমারও যে ভয় পাইনি তা নয়। সবাই ভয়ে ভয়ে দিনটি পার করে রাত্রে শয্যাশায়ী হয়েছিলাম। অনেক রাতে সেদিন শুরু হয়েছিল ফাঁপি—
মাঝে মাঝে দমকা বৃষ্টিপাত। একটা দড়ির খাটে লেপ-কম্বল নিয়ে গুটিসুটি মেরে আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অনেক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি আমার বিছানাপত্তর আগুন লেগে দাউ দাউ করে পুড়ছে। আমার গায়ে-হাতে-পায়ে তাপ লাগলেও উঠে দাঁড়াবার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। থরোথরো এক কাঁপুনি এবং মুখেও কথাহারা হয়ে পড়েছি। বাড়ির ভেতর থেকে কপাটের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে দেখে বাড়ির লোকেরাও দরজা ধাক্কাতে শুরু করেছে। ব্যাপারটা কী আমিও কিছুই বুঝতে পারছি না তখনও। আগুনের লেলিহান শিখা যখন আমাকেও পোড়াতে শুরু করেছে তখন হতভম্বের মতো উঠে দাঁড়িয়েছি। পায়েও ফোসকা পড়ে গেছে। কোনোরকম দরজাটা খুলেই বাইরে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারলাম। সবাই পানি ঢেলে আগুন নিভিয়ে ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখল, ওপরের টালির চাল ভেদ করে একতলার মাটির আবরণ ভেদ করে একটা বজ্র প্রবেশ করেছে আমার শয্যায়। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম বলে প্রচণ্ড শব্দে আমার জ্ঞান হারায়নি ঠিকই, কিন্তু শরীরের সমস্ত স্নায়ুগুলিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। সেই বজ্রের আগুনেই জ্বলে পুড়ে হয়তো নিঃশেষ হয়ে যেতাম আর কয়েক মিনিট থাকলেই। বিপদটি যে এভাবেই আসবে তা কেহই আঁচ করতে পারিনি। পরের দিন বহু লোকজন, কুটুম্ব আত্মীয়-স্বজন সবাই দেখতে এসেছিলেন। বাজের কী ক্ষমতা এবং অলৌকিকভাবে আমার বেঁচে ওঠা একটা স্বপ্নের মতো ব্যাপার বলে সকলের কাছেই মনে হয়েছিল। এই ঘটনার পরে বহুদিন সেই ফকিরকে খুঁজেছিলাম কালো জোব্বা পরা, মাথায় কালো পাগড়ি বাঁধা অদ্ভুত দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা তাঁকে আর কোথাও দেখতে পাইনি।
আরেকদিন ছিল প্রচণ্ড বর্ষণমুখর দিন। সকাল থেকে প্রায় দ্বিপ্রহর পর্যন্ত আমাদের কিছুই খাবার জোটেনি। সকালে একবার শুধু গুড়ের চা আর তার সঙ্গে বাড়িতে থাকা কিছুটা গমের আটা ভাজা। গুড়ের চায়ের সঙ্গে গমের আটা ভাজা কেমন লাগে? অনেকটা আগের দিনের আটার হালুয়ার মতো। তাই একবার খেয়ে নিয়ে আবার কিছু খাবার হয় কিনা সেই দিকেই চেয়ে আছি। হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মামাদেরগ্রাম লক্ষ্মীনারায়ণপুরের নফুর শেখ এসে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হলো। অসহায় ভাবে সে মাকে কিছু খাবারও চাইল। কিন্তু মা ছিল নিরুপায়। ছেলেপুলেরাই তো খাবার পায়নি, তাকেই বা কিভাবে দেবে? তবু বলল একটু অপেক্ষা করতে। নফুর শেখ কাঁধে বাঁক নিয়ে মাটির হাঁড়ি চাপিয়ে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করত। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেদিন তার একটি হাঁড়িও বিক্রি হয়নি। আট-দশ আনার মুড়ি কিনে খাবে তারও পয়সা ছিল না তার কাছে। মা তার দূর সম্পর্কের বোন হয়। তাই বোনের বাড়িতে এসেছে। হাঁড়িগুলি নামিয়ে রেখে সে অপেক্ষা করতে লাগল।
আরও কিছুক্ষণ পর দরজায় আরও একজন ভিক্ষুক এসে উপস্থিত হলো। তারও একই আবেদন।
আমি এসব দেখে কান্না থামিয়ে চুপ করে তাকিয়ে ছিলাম তাদের দিকে। দারিদ্র্য কাকে বলে, খালি পেটে থাকলে কেমন লাগে তা নিজে যেমন অনুভব করছিলাম, তেমনি অন্যের ক্ষেত্রেও এই অবস্থার উপলব্ধি হচ্ছিল। মা কিছুক্ষণ পর সকলের জন্যই এঁঠের সঙ্গে পুঁইশাক রান্না করে নিয়ে এলেন থালায় করে। আমার পরের বোনটি কারও জমি থেকে কুড়িয়ে এনেছিল এগুলি। ভাতের বদলে থালা ভরে আমরা সেদিন তা-ই খেয়েছিলাম। বৃষ্টি ছাড়লে নফুর শেখ তার হাঁড়িগুলি নিয়ে যেতে যেতে বলেছিলেন, “আজ কতদিন পর এরকম পেট ঠান্ডা করে খেলাম! কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না। শুধু ভাগ্নের জন্য রেখে গেলাম আমার দোয়া। একদিন অনেক বড় হবে সে।”
মাটির হাঁড়ি ভর্তি বাঁক নিয়ে সে সোজা হেঁটে যাচ্ছিল পশ্চিমমুখী। মনে হচ্ছিল কোনো দেবদূত হেঁটে যাচ্ছে আমার সামনে দিয়ে। আমি অনেকক্ষণ চেয়েছিলাম সেই দিকে। চোখ দুটি অশ্রুতে ভরে গেছিল। তার কয়েকদিন পরেই লোকটি ইহজগৎ ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তার হেঁটে যাওয়ার ছবিটি কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি।
ভিক্ষুকটিও যাবার সময় দুই হাত তুলে কী প্রার্থনা করেছিল জানি না, তবে যাবার সময় বলে গেছিল, “তোর এই ছেঁড়া প্যান্ট একদিন দামি কাপড়ে বদলে যাবে। তোর এই শুকনো মুখ একদিন হাসিতে ভরে যাবে।”
সেই ভিক্ষুকটির সঙ্গেও আর কোনোদিন সাক্ষাৎ হয়নি। ওই দুর্যোগের দিনে সেদিন কাউকেই ভাত খাওয়াবার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। এই কথা ভেবে আজও কষ্ট হয়। ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে যায় নফুর শেখ ও ভিক্ষুকের কথা। কোনো ভোরবেলা, মাঘ মাস অথবা বৃষ্টির দিনে আমার মনের দরজায় ভিড় করে আসে এইসব অলৌকিক-মুখগুলি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ