spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকসরকার চুলের চামড়া ছিলার মধ্যে নেই

লিখেছেন : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

সরকার চুলের চামড়া ছিলার মধ্যে নেই


আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

বাংলাদেশ সরকারের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সরকার বিরোধী যেকোনো ঘটনায় সাত-পাঁচ না ভেবে উপসংহারে উপনীত হতে পারা। হিন্দি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে: “বাল কি খাল নিকালনা” (बाल की खाल निकालना) অর্থ্যাৎ “চুলের চামড়া ছিলা।” ইংরেজিতে এটিকে বলা হয়: “quibble about”, যার উপযুক্ত বাংলা অর্থ নেই, তবে এর ব্যাখ্যা হতে পারে “অহেতুক খুঁটিনাটি বিষয়ে যুক্তিতর্ক বা প্যানপ্যান করা।” সরকার ‘চুলের চামড়া ছিলা বা চামড়া ছাড়ানোর তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। তারা ‘কি হলো,’ ‘কিভাবে হলো,’ কেন হলো,’ এসব খুঁটিনাটি প্রশ্নের ধার ধারে না। মোটা দাগে কথা বলে। “মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার’।

সরকার বিরোধী কিছু ঘটলেই সরকারে থাকা লোকজন ‘পাইছি যে পাইছি’ চেতনায় সোজা বলে দেয় এর পেছনে ‘বিএনপি-জামাত-শিবির জড়িত’। কথাটি আগে কেবল মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারাই তাদের ‘বাগবিধি’ হিসেবে ব্যবহার করতো। প্রশাসনের লোকজন, যারা সরকারের নন, বরং রাষ্ট্রের কর্মচারি, কোনো ঘটনার ব্যাপারে সাংবাদিকদের “কারা এর সাথে জড়িত” মর্মে প্রশ্নের উত্তরে তারা আগে: “খতিয়ে দেখা হচ্ছে,” “বিষয়টি বিচারাধীন,” ধরনের উত্তর দিতেন। এখন তারা আর কোনোকিছু খতিয়ে দেখাদেখির মধ্যে নেই। তারাও মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতাদের মতো এক লাফে উপসংহারে চলে যাচ্ছেন। সোজা বলে দিচ্ছেন: ‘বিএনপি-জামাত-শিবির জড়িত’।

অতএব, তারা ছাত্রদের কোটা আন্দোলনে দেশজুড়ে দুই শতাধিক নিহত ও অনগন সংখ্যক আহত হওয়ার ঘটনার পেছনে ‘বিএনপি-জামাত-শিবির জড়িত’ বলে তাদের নির্মূল করার অভিযানে নেমেছেন।

বাংলাদেশে সংবাদপত্রের “অবাধ স্বাধীনতার (!) যুগে অধিকাংশ সাংবাদিক এখন সরকারের সুবোধ সন্তান হয়ে গেছেন। কেউ বেপরোয়া হতে সাহসী হন না। সাহস দেখালেই যথাস্থানে ডিম্ব থেরাপি, ইলেকট্রিক শক, লাল মরিচের গুড়ার প্রয়োগ! এই ইস্যুতে যৎকিঞ্চিৎ সাহস দেখাতে গিয়েছিলেন সমকালের ‘ফারুক ওয়াসিফ’। তিনি দৈনিক সমকাল এ “সবাই আক্রান্ত, তাহলে জিতল কে?” শিরোনামে তার উপসম্পাদকীয় নিবন্ধের এক স্থানে উল্লেখ করেছেন, “যে বিএনপি-জামায়াত গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে কিছুই করতে পারেনি, তারা হঠাৎ করে এত সক্ষমতা অর্জন করে ফেলল যে, রাষ্ট্রই তাদের কাছে কাবু হয়ে গেল? যে বিএনপি গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার প্রেস ক্লাবে জমায়েত ও বায়তুল মোকাররমে গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি দিয়েও ৫ মিনিটের বেশি দাঁড়াতেই পারল না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অভিযোগ মোতাবেক, তারা কী করে সারাদেশে আগুন জ্বালিয়ে ফেলল? নাকি ভিনগ্রহ থেকে এলিয়েনরা সত্যি সত্যিই এসেছিল? হাওয়ার ওপর তাওয়া ভেজে গেল কে? সবাই এখন যার যার পছন্দমাফিক ‘ভিলেইন’ খুঁজছে। যে শত্রু ‘চেনা’ তাকেই কুপোকাত করতে চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে অচেনা এক গতিপথে।”

ফারুক ওয়াসিফ লেখার লিংক তার ফেসবুক ওয়ালেও দিয়েছিলেন। সেটি এখন আর ওপেন হয় না। যাহোক, অফিসের কাজ শেষে তিনি যখন বাসায় ফিরে আসছিলেন তখন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কয়েক ঘন্টা পর তাকে ছেড়েও দেওয়া হয়েছে। তার ওপর কোন থেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছিল, তা এখনো জানা যায়নি। যেহেতু খুব দীর্ঘসময় তাকে আটক রাখা হয়নি, ধরে নেয়া যেতে পারে অল্পবিস্তরের মধ্যে তিনি নিস্তার লাভ করেছেন। হয়তো মুচলেকা দিয়েছেন। তিনি আগে হয়তো কেবল ঘুঘুু দেখেছিলেন, এবার ফাঁদও এসেছেন, তাতে সন্দেহ নেই।

“অতিরিক্ত স্বাধীন” দেশে সাংবাদিকদের লেখারও তেমন কিছু থাকে না। বিজেপি সরকার পরিচালিত পাশের দেশ ভারতেও অধিকাংশ সাংবাদিক সরকারের “ফরজন্দ-এ-খাস” (খাঁটি পুত্র)। এ কারণে সমালোচকরা এখন ভারতের অধিকাংশ মিডিয়াকে বলেন ‘গদি মিডিয়া। কি আর করবেন বেচারা-বেচারি সাংবাদিক ভাইবোনেরা। কিছু লিখে তো খেতে হবে। সমালোচকরা তাদের পিছু ছাড়েন না। তাবেদার সাংবাদিকদের জন্য তাদের নতুন বাণী হচ্ছে:

“আগার দেশ মে মুসলমান আউর পড়োস মে পাকিস্তান না হোতা,
কুচ পত্রকার সড়ক কিনারে ওয়ান হানড্রেড’কে কাচ্ছে বেচ রাহে হোতে।”

(দেশে যদি মুসলমান না এবং দেশের পাশে পাকিস্তান না থাকতো,
কিছু সাংবাদিক রাস্তার পাশে একশ’ রুপি দামের জাঙ্গিয়া বেচতো।)

বাংলাদেশেও সাংবাদিকদের অবস্থা কমবেশি একই রকম। ‘জামায়াত-বিএনপি-শিবির,’ ‘স্বাধীনতার শত্রু,’ ‘রাজাকার-আলবদর,’ ‘পাকিস্তানের দোসর,’ প্রতিশব্দ আছে বলে তারা কাগজ ভরে কাহিনি লিখে, ভিডিও নিউজ রিপোর্ট করে দিনগুজরান করতে পারছেন। কি অহঙ্কার নিয়ে ৪৭ বছর আগে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম।

১৯৭৭/৭৮ সালে প্রেসক্লাবে কাঁচুমাচু হয়ে প্রবেশ করে কোনো টেবিলের কোনায় বসে গিলতাম জহুর হোসেন চৌধুরী, খন্দকার আবদুল হামিদ, নির্মল সেন, এনায়েতউল্লাহ খানের কথা। চোখের কোনা দিয়ে তাদের দেখতাম। ভাবতাম কবে তাদের মতো হতে পারবো। তখন জিয়উর রহমানের সামরিক আইনের যুগ। মানিক মিয়া তখন বেঁচে ছিলেন না। যেহেতু বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসনে সেন্সরশিপের যুগ, অতএব প্রবীণ সাংবাদিকদের কথায় আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময়ে সেন্সরশিপের কথা উঠতো। মানিক মিয়া একাধিকবার গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ ছিলেন। আবারও জহুর হোসেন চৌধুরী মানিক মিয়াকে খোঁচা দিয়ে বলতেন, ‘মানিক ভাই, ইত্তেফাকে যা ছাপছেন, আইয়ুব খান আবার আপনাকে ধরবে।’ মানিক মিয়া নাকি তাঁর বরিশালের টানে অনার্য শব্দে উত্তর দিতেন, “‘বা–ল’ ছেঁড়বে!”

এখন সেই রামও নেই, অযোধ্যাও নেই!

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ