তৈমুর খান
৭
কষ্টের সঙ্গেই দেখা হয় বারবার
মাধ্যমিকে কোনো টিউশনি পড়া সম্ভব হয়নি। তখন টিউশনি ফি ছিল কুড়ি টাকা। একজন শিক্ষক অনেকগুলো বিষয় পড়াতেন। কিন্তু প্রতিমাসে কুড়ি টাকা পাবো কোথায়? সুতরাং নিজে নিজেই পড়তে হবে। কোনো কিছু না পারলে কোনো পূর্বের দাদাদের কাছে বুঝিয়ে আনতে হবে। তখন গাঁয়ে ছিলেন আব্দুল ওহাব এবং সাদরুদ্দিন। যখন কিছু না পারতাম তাঁদের কাছেই সাহায্য নিতাম। কিংবা আবুল খায়ের কাকা (বাবার কাকার ছেলে) বহরমপুর থেকে গ্রামে এলে তাঁর কাছে করে নিতাম। দু’বছর আয়াস হাইস্কুলে পড়াকালীন শিক্ষা সম্পর্কে আমার নতুন করে অনুরাগ জন্মে। বিশেষ করে বিদ্যালয়ের নন্দদুলাল গাঙ্গুলী স্যার একাধারে ইংরেজি ও বাংলা দুটি বিষয়ই পড়াতেন। তাঁর পড়ানোর ধরন এবং বিষয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রতিমুহূর্তে তাকে অতিক্রম করে যাওয়া আমার কাছে দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চার মনে হতো। ধরুন উনি ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের কোনো অংশ পড়াচ্ছেন যেটা সিলেবাসে আছে, তো সেই সূত্রেই তিনি পুরো ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যটিই আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরছেন। কিংবা ধরুন শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্তে’র কোনো একটি অংশ পড়াচ্ছেন, তো সেখানে পুরো ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটিই ছায়াছবির মতো চোখের সামনে স্পষ্ট করে তুলছেন। ইংরেজি বিষয়টিতেও একই অবস্থা। শেক্সপিয়ারের প্রসঙ্গ এলেই ‘ম্যাকবেথ’ বা ‘কিং লিয়ার’ অনেকটাই উপস্থাপন করছেন। এতদিন বাবার কাছে পয়ারের ছন্দ বা তান শুনে অভ্যস্ত হয়েছিলাম;কিন্তু এই স্কুলে এসে পেলাম বিশ্ব সাহিত্যের আস্বাদন। দেখার ও শোনার বিস্তার ঘটল। দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে গেল। এমনি করে চলতে চলতেই মাধ্যমিক পরীক্ষা সমাগত।
সেই সময় পরীক্ষা হতো নলহাটি হরিপ্রসাদ হাইস্কুলে। আমার গ্রাম থেকে অনেকটাই দূর। সুতরাং যাওয়া-আসা করে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। নলাটিতে থাকতেই হবে। কিন্তু থাকব কোথায়? থাকার খরচই বা কে দেবে? দূর সম্পর্কের এক পিসি থাকেন বটে, কিন্তু দুবেলা পেটপুরে খাওয়ানো তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাঁদের বাড়ির অবস্থাও ভালো নয়। এই একটি সমস্যা দেখা দিল আমার সামনে। সবাই যখন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য নলহাটিতে মেস ভাড়া নিয়ে থাকার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলল, আমি তখন দিশেহারা। যাওয়া-আসা করে পরীক্ষা দেওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ বাস ভাড়ার পয়সা কেউ দেবার ছিল না। অবশেষে এক দোকানদার ফজলে হক চাচা মাকে বললেন, “আমি চার কেজি চাল ধারে দেবো, অগ্রহায়ণ মাস এলে আমাকে পরিশোধ করতে হবে।”
ফজলে চাচার কথা শুনে মা এক কথায় রাজি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চার কেজি চাল নিয়ে উপস্থিত হলো। বাবা আর আমি সেই চাল নিয়ে নলহাটি রওনা হয়ে গেলাম। নলহাটির পিসি সব শুনে বললেন, “কষ্ট হলেও আমরা কি ফেলে দিতাম? ভাইপো বলে কথা! পিসির বাড়ি থেকে পরীক্ষা দিবে তার জন্য চাল কেন লাগবে?”
বাবা বললেন, “তোমার কথা তো জানি, তোমাদের সংসার কিভাবে চলে তাও জানি। তবে শুধু এই চালই চার কেজি দিলাম, আনাজপাতি কিছু দিতে পারলাম না।”
পিসির দুটি ছোট ছোট ঘর। একটি ঘর আমাকে ছেড়ে দিলেন যাতে নিরালায় পড়াশোনা করতে পারি। আর পাশের ঘরে তাঁরা রইলেন। পিসেমশাই রাস্তার ধারে সাইকেল মেরামত করেন। সারাদিন পর বাড়ি আসেন। রোজগারপাতি হলে চাল-ডাল সঙ্গে নিয়েই আসেন। এমনিভাবেই প্রায় দিন দশেক নলাটিতে থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পরীক্ষাহল এত কড়াকড়ি ছিল যে টু শব্দটি করার উপায় ছিল না। বিশ্বরূপ কাঁঠাল তখন হরিপ্রসাদের হেড মাস্টার। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে অনবরত ক্লাসে চক্কর দিচ্ছেন। কেউ ঘাড় ঘোড়ালেই তার খাতা কেড়ে নিয়ে আধঘন্টা বসিয়ে দিচ্ছেন। তাই সর্বদা ভালো মানুষ হয়ে পরীক্ষা দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।
পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি এসেও এক আতান্তরে পড়েছিলাম। তেমন কোথাও কাজ ছিল না। রিলিফে কয়েকদিন পুকুর কেটেছিলাম। তখনো জেসিবি আসেনি। তাই মাটি কাটার কাজটি ছিল আদিম কালের কাজ। পুকুরের নিচু গর্ত থেকে ঝুড়ি ভরা মাটি নিয়ে সিঁড়ির ধাপে ধাপে ওপরে এসে ফেলতে হবে। ভীষণ কষ্টের কাজ ছিল। রিলিফ বলতে সারাদিন মাটি কাটলে পাঁচ কিলোগ্রাম গম পাওয়া যেত। সেই গম ভেঙে দলিয়া রান্না হতো। আর গমের দলিয়া কোনোদিনই আমি খেতে পারতাম না। আমার পক্ষে তখন অসহ্য হয়ে উঠছিল।
গ্রীষ্মকালে তালের গাছে বাবা রস পাড়তেন। প্রথম প্রথম শরবতের মতো সুমিষ্ট রস হতো। কিন্তু পরে প্রচণ্ড রোদ-গরমে রস পেকে গিয়ে তাড়িতে পরিণত হতো। মুনিষ-মজুর শ্রেণির লোকেরা কর্মশ্রান্ত দুপুরবেলায় শরীরকে সতেজ করার জন্য কুড়ি পয়সা গ্লাস এই রস পান করতে আসত। বাবা যেদিন মাঠের কাজ করতেন, কিংবা ব্যাংকের কাজে ভিন গাঁয়ে যেতেন— সেদিন আমিই তাল গাছে চেপে মাটির বড় ভাঁড়ে রস পেড়ে আনতাম। সেই রস মেপে মেপে বিক্রিও করতাম। অবশিষ্ট যেটুকু থাকত সেটুকু নিজেও পান করে দুপুর বেলাটাকে নেশায় উপভোগ করতাম। নেশা অতিরিক্ত হলে কোনো মরা পুকুরে গিয়ে সারাদিন পানিতে পড়ে থাকতাম। এই তাড়ি পান করতে করতেই নিজেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম।
সেই সময় আর একটা কাজও করতে হতো। তাড়ি পাতার সিজিন চলে গেলে, মাঠে ধান কুড়াবার সিজিন চলে গেলে, গোরুর পালে গিয়ে ঝুড়ি ভর্তি গোবর নিয়ে সেগুলো ঘুঁটে দিয়ে শুকিয়ে বিক্রি করারও প্রচলন ছিল। গাছ গাছালির মরা ডাল ভেঙে, অথবা বোনকে সঙ্গে নিয়ে পাতা কুড়িয়ে জ্বালানি জোগান দেবারও কাজ করতে হতো। মোড়ল পাড়ায় বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে কেউ পাঁঠা বা খাসি কাটলে তার চামড়াটি বাবা দাম করে নিয়ে আসতেন। সেই চামড়া নিয়ে সাইকেলে চাপিয়ে আমি শহরের উপকণ্ঠে একটি দোকানে বিক্রি করতে আসতাম। দাম শোধ করে কিছু লাভ থাকলে তা বাবাকে গিয়ে দিতাম। অনেক অনেক দিন এমনি করেই আমাদের সংসার চলেছে। কিন্তু এমনও হয়েছে, দাম করে আনা চামড়ার দাম আরও কমে গেছে। তখন মনে হয়েছে আমাদের মতো হতভাগ্য আর কেউ নেই। আমি চামড়া নিয়ে যেতাম বলে চামড়ার দোকানদার কখনো কখনো দু-এক টাকা বেশিও দিতেন। মনের খুশিতে সেদিন খুব জোরে সাইকেল চালাতে পারতাম। একবার পুরো চামড়াটাই ফুটো ফুটো হয়ে যায় বলে বিক্রি করাই যায়নি। সে বার মোড়লদের অনেক বলে কয়ে বাবা টাকা মুকুব করিয়েছিলেন।
দৈনন্দিন সংসার চালাতে গিয়ে বাবা ভেতর ভেতর মায়ের বিঘা দেড়েক জমি বিক্রি করে দিয়েছিলেন । কখনো কিছু চাল, কখনো কিছু ধান, কখনো কয়েক কেজি খুদ ধার নিয়ে বাবা আর পরিশোধ করতে পারেননি । তখন জমিটি লিখে দিতে বাধ্য হন। প্রায় নিঃস্ব কপর্দক শূন্য হয়ে যখন ঘরোয়া কলহ বিবাদে আমরা দিন কাটাচ্ছিলাম তখন নিরুপায় হয়ে বাবা আমাকে গেরস্থ বাড়িতে বাঁধা মুনিষের কাজে যোগ দিতে বলেন। বাঁধা মুনিষ বলতে একই গেরস্থ বাড়িতে সব সময়ের জন্যই সব রকম হুকুম পালন করে কাজ করতে হবে। সেখানে আমার কোনো স্বাধীনতা থাকবে না। এই কাজটিতে বরাবর আমার অনীহা ছিল। কিছুতেই আমি করতে পারব না একেবারে জেদ করেই তা বলেছিলাম। কিন্তু ছোট ভাইবোনসহ বাড়ির অসহায় সদস্যরা যাবে কোথায়? এই যন্ত্রণা থেকেই বা কি করে মুক্তি পাবো? অন্তহীন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়ি। তখন নিজে নিজেই গ্রাম ছেড়ে পালানোর ভাবনা মাথায় চেপে বসে। গ্রামের এক জামাই খালেক ভাই কুষ্ঠরোগী। এবং তারই সঙ্গী ব্রহ্মাণী নদীর তীরবর্তী কার্তিকডাঙা গ্রামের প্রায় অন্ধ সিদ্দিক ভাই। তারা দুজনেই মুম্বাই শহরে গিয়ে ভিক্ষে করে। আমাদের গ্রামে আসা যাওয়ার সুবাদে তাদের সঙ্গেও আমার পরিচয় ঘটে। তাদেরকে সব কথা একদিন বলে ফেললাম। তারা সব শুনে বলল, “মুম্বাই শহরে অনেক কাজ। আমাদের দেশের অনেকেই রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করছে। তাদের সঙ্গে কাজে লেগে পড়া যাবে।”
—কিন্তু আমি যাব কিভাবে?
—তার কোনো ভাবনাই নাই। আমরা দুজন করে লোক বিনা টিকিটে নিয়ে যেতে পারব।
—গিয়ে উঠব কোথায়?
—আমাদের সঙ্গে থাকবে, অডালায়। রেল লাইনের ধারে ধারে আমাদেরও দু একটা ঝুপড়ি আছে। যতদিন কাজ না হয় ততদিন আমাদেরই খাবে।
সব রকম ভরসা পেয়েই আমিও কোমর বেঁধে তাদের সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। কিন্তু আমার পকেট প্রায় শূন্য। এক টাকাও কাছে নেই। বাড়িতে কাউকে জানানোও যাবে না। রাত্রির অন্ধকারে সেই সময়ের মোগল সরাই এক্সপ্রেস ধরে আমাদের যেতে হবে এলাহাবাদের দিকে। তারপর সেখানেই পেয়ে যাব মুম্বাই যাবার ট্রেন। প্রায় তিন দিন লাগবে ট্রেনে যেতে।