spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকআওয়ামী লীগ নিজেদের নিষিদ্ধ করেছিল

লিখেছেন : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

আওয়ামী লীগ নিজেদের নিষিদ্ধ করেছিল


আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য নতুন কিছু নয়। ১৯৭২ সালে তারা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এর মাত্র দুই বছর পর এই আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের দলকেই নিষিদ্ধ করে গঠন করেছিল ‘বাকশাল’।

তারা মাত্র ৯ মাসে সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়নের কৃতিত্বের দাবীদার। এ সংবিধান ছিল বুহুদলীয় সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার জন্য প্রণীত একটি সংবিধান, যার অধীনে ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগ সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়। এত সংখ্যক আসন লাভের আর কোনো রেকর্ড বাংলাদেশে নেই এবং আমার মনে হয় না যে, আগামী কয়েকশ বছরে এই রেকর্ড ভাঙা কোনো দলের পক্ষে সম্ভব হবে।

নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যদি জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হতো তাহলে ‘জনপ্রিয় সরকারগুলোর দুর্ভাগ্যজনক পতন ঘটতো না এবং অভ্যুত্থানে সরকার প্রধানদের নিহত হওয়ার এবং লজ্জাজনকভাবে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার ঘটনা ঘটতো না। আওয়ামী লীগ তাদের জন্মলগ্ন থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র ছাড়া কিছু বোঝে না। প্রথম সংসদে ২৯৩ আসন সম্ভবত দলের শীর্ষ নেতাদের মাথা বিগড়ে দিয়েছিল।

পার্লামেন্টের অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে বর্ণনা করতে এক ব্রিটিশ লর্ড ১৬৪৮ সালে বলেছিলেন, “পার্লামেন্ট কোনো পুরুষকে নারী এবং কোনো নারীকে পুরুষে পরিণত করা ছাড়া সবকিছু করতে পারে।” ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বাস্তবে কখনও তা করেনি। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পুরো সংসদ হাতে থাকার দম্ভে সংসদীয় গণতন্ত্রের মহান পুরোহিত ও পূজারিরা ‘দিনকে রাত এবং রাতকে দিনে পরিণত করেছিল’।

সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মাথায় তারা সংসদীয় গণতন্ত্রের অসারতা ও অকার্যকারিতার কথা বলে ১৯৭২ সালের সংবিধানের খোল-নলচে পাল্টে ফেলেছিল। নিজেদের সাধের আওয়ামী লীগসহ সকল দল নিষিদ্ধ এবং ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠিত হয়, একদলীয় প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা। পাল্টে ফেলা সংবিধানই বলে দিয়েছিল, দেশে থাকবে একটি মাত্র দল ‘বাকশাল’। সেই দলের সদস্য হবে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যসহ সরকারি বেসরকারি সকল নাগরিক। সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোট আবশ্যক। কিন্তু ‘৭২ এর সংবিধান আমূল পরিবর্তন করা হয়েছিল, কোনো গণভোটের আবশ্যকতা অনুভব করেননি। ‘৭২ এর সংবিধান প্রনেতাদের সিংহভাগই তখন প্রথম সংসদের সদস্য। তারাই পরিবর্তনের এক কর্মযজ্ঞটি সম্পন্ন করেন।

আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা প্রথমবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৯৬ সালে এবং তখন থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। তিনি তার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম মেয়াদ (১৯৯৬-২০০১), দ্বিতীয় মেয়াদ (২০০৯-২০১৩) ও তৃতীয় মেয়াদে (২০১৪-২০১৮) বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য ছোটো-বড়ো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন। কিন্তু যে স্বপ্নকে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বিশাল বা ‘মহাস্বপ্ন’ বলা যেতে পারে, এবং যে স্বপ্ন বাস্তবায়ন বঙ্গবন্ধু নিজেই শুরু করেছিলেন, পিতার সেই আধা-বাস্তবায়িত স্বপ্ন সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের সংকল্পের কথা তিনি একটি বারের জন্যও উচ্চারণ করেননি। তার বর্তমান ও চতুর্থ মেয়াদ (২০২৪–চলমান) সবে শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশকে উত্তাল করে ফেলেছে। পরিস্থিতি রীতিমতো বিস্ফোরণোন্মুখ। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৯০ সালে এরশাদকে উৎখাত করার আন্দোলনের তীব্রতাকেও ছাড়িয়ে গেছে এবারের আন্দোলন। গত ষোলো বছর যাবত জনপ্রিয়তার আনন্দ-জোয়ারে ভাসা সরকারের অবস্থা পানিতে ভাসমান খড়কূটোর অবস্থায় পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত স্বপ্নটি কি অবাস্তবায়িতই থাকবে?

আগে উল্লেখ করেছি, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কখনোই যে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি নয় তার প্রমাণ ১৯৭৫ সালের আগস্টে সপরিবারে দেশের দেশের প্রতিষ্ঠাতা, একচ্ছত্র নেতা ও প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ২০৭টি আসন লাভ করে সরকার গঠন করেছিল এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যগরিষ্ঠতা সত্বেও দলের চেয়ারম্যান ও দেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অভ্যুত্থানে নিহত হন। হত্যাকান্ডগুলোর পেছনে ষড়যন্ত্র তত্ব রয়েছে। কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যদি জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হতো, তাহলে অভ্যুত্থানকারী বা ঘাতকরা কোনো অঘটন ঘটাতে চৌদ্দবার ভাবতো। ১৯৮৮ সালে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ২৫১টি আসন। কিন্তু দুই বছর পর এরশাদকে জনপ্রিয় আন্দোলনে লজ্জাজনকভাবে উৎখাত হতে হয়।

সন্দেহ নেই, আওয়ামী লীগ প্রাচীন ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। কিন্তু তারা গণতন্ত্র বেশি বোঝে বলে কারও তোয়াক্কা করে না। তারা গণতন্ত্রের কথা কেবল মুখে বলে। তারা তাদের অন্তরে লালন করে একদল ‘বাকশাল’। ঘোষণা দিয়ে ‘বাকশাল’ কায়েম করার চেয়ে যেকোনো উপায়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতার আসনে বসে বাকশালী কর্তৃত্ববাদ ও স্বেচ্ছাচার চালানো বরং সহজ। তাতে সাপও মরে না, লাঠিও ভাঙে না। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনে ‘ঐতিহাসিক বিজয়’ লাভ করে আসছে। সর্বশেষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে তারা পায় ২৩০টি আসন। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ লাভ করে যথাক্রমে ২৩৪, ২৫৭ ও ২২৪টি আসন। এই তিনটি নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে তা দেশবাসীর জানা।

সাজানো বা প্রহসন, ভোটারবিহীন বা বিরোধী দলের অংশগ্রহণবিহীন — যেভাবেই নির্বাচন হোক না কেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেছে, এটাই সত্য। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বার বার এভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান পছন্দ করেনি। তারা ক্ষুব্ধ হয়েছে। শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতিতে তারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করার উপযুক্ত কোনো প্ল্যাটফর্ম পায়নি। তারা হতাশ হয়েছে। এক একটি নির্বাচন হয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দম্ভ বেড়েছে। সে দম্ভেরই অংশ ছিল প্রধানমন্ত্রীর মুখে ছাত্রদের হেয় করে আপত্তিকর ভঙ্গিতে বক্তব্য প্রদান। মনে হয়েছে, টানা চারবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ভার তিনি বহন করতে পারেননি। কিন্তু ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর অপমানসূচক উক্তি তাদের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করতে করেছে। তাদের বিক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। আন্দোলন ধারণ করেছে তীব্র আকার, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের ও বিভিন্ন শ্রেনিপেশার মানুষের গত ষোলো বছরের পুষে রাখা ক্ষোভ। এ ক্ষোভের আগুনে এখন জ্বলছে সমগ্র দেশ।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on মরুভূমি
সাদ আব্দুল ওয়ালী on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
রাবেয়া আখুঞ্জী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা