আহমাদ মাযহার
রবীন্দ্রনাথ যখন বেঁচেছিলেন তখন বাংলাদেশ নামের কোনো রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়নি। কিন্তু মূলত বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে যে ভৌগোলিক অঞ্চলে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা সম্ভব হয়েছিল সেই অঞ্চলটি আবহমানকালের বাঙালি জাতির বাসভূমি হিসেবে বিবেচিত ছিল বলেই। সে হিসেবে অতীতের বাংলাদেশ নামীয় পূর্ববঙ্গ ভূখণ্ডে বসবাসরত বাঙালিমাত্রেরই উত্তরাধিকার ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষ বহন করে চলেছে। অন্যদিকে যদি আমরা দেখি যে রবীন্দ্রনাথের জন্ম যে ভৌগোলিক অঞ্চলে তা বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত নয়, সেদিক থেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষ নন। কিন্তু এ কথা ভাবা কি আজ আর আমাদের পক্ষে সম্ভব? কারণ বাঙালির বিচিত্র অভিব্যক্তিতে আজ রবীন্দ্রনাথ কী ভীষণ অন্তরঙ্গভাবেই না প্রাসঙ্গিক। এর একটা বড় নিদর্শন ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে বিজয়ী ও মুক্ত বাংলাদেশে ফিরে এসে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে প্রথমেই যে বক্তব্য রেখেছিলেন তাতে তাঁকে স্মরণ করে নিতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকেই। তিনি বলেছিলেন, কবি আপনি দেখে যান আপনার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। অথচ পাকিস্তানি আমলের একপর্যায়ে বাংলাদেশের রেডিও-টেলিভিশনে এই রবীন্দ্রনাথই ছিলেন নিষিদ্ধ নাম। তাঁর জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান করতে হয়েছে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাধা অতিক্রম করে। মোটকথা রবীন্দ্রনাথকে বাঙালির রীতিমতো সংগ্রাম করে অর্জন করতে হয়েছে সে সময়ে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রাম করে চলতে চলতেই তাঁর লেখা গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। সম্প্রসারণশীল বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। সেই তিনি যদি বাংলাদেশের মানুষ না হন তাহলে বাংলাদেশের মানুষ কে? আমাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই প্রাসঙ্গিকতা বাঙালির আত্মপরিচয়-সন্ধানের মধ্য দিয়ে ক্রমশ অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে। বর্তমানের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তাঁর জন্ম না হলেও, কিংবা পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত এই অঞ্চলে না এলেও চেতনাগত সম্পন্নতার দিক থেকে তিনি বাংলাদেশেরই মানস-সন্তান। কারণ এখানে জমিদারি দেখতে এসে এখানকার প্রকৃতি, মানুষ ও সমাজের সঙ্গে তাঁর যে নিবিড় গভীর যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল তা তাঁর সমস্ত চেতনালোককে করে তুলেছিল আলোকিত এ উজ্জীবিত; তাঁর মানসলোক এর প্রভাবে হয়ে উঠেছিল আধুনিকতায় সঞ্জীবিত। আশ্চর্য যে, ১৮৯০ পূর্ববর্তী রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্যকে বিশ্লেষণ করলে তখন পর্যন্ত তাঁর যে ধর্মবিশ্বাস পাওয়া যায় তা ছিল আনুষ্ঠানিকতা সম্পৃক্ত। আদি আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি তিনি ছিলেন অনেক বেশি অনুগত। আদি ব্রাহ্মসমাজে আচরিত হিন্দুত্বকেই তিনি মনে করতেন বিশুদ্ধ হিন্দুত্ব। কেবল তা-ই নয়, অন্যান্য ধর্মের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করতেন হিন্দুধর্মকে। ১৮৯০-এর আগে রবীন্দ্রনাথ যে জাতীয়তাবোধে আস্থাশীল ছিলেন তা ছিল হিন্দু ভারতীয় জাতীয়তা–যেমনটি ছিল তাঁর প্রায় সকল পূর্বসূরিরই মনোভঙ্গি। সেখানে অহিন্দুর অবস্থান একদিকে যেমন সংকীর্ণ, তেমনি হেয়কর। পূর্ববঙ্গে আসার পরেই তাঁর জাতীয়তাবোধের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। জমিদারি দেখতে এসে শিলাইদহ সাহজাদপুর বা পতিসরের মানুষকে তিনি ভৌগোলিক, সমাজতাত্ত্বিক, অথবা অর্থনীতিকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেননি। বাংলাদেশের পল্লির স্বাতন্ত্র্য কলকাতা নগরবাসী রবীন্দ্রনাথকে কৌতূহলী করে তুলেছিল বলে তিনি তা দেখেছিলেন কবির কৌতূহল ও সহমর্মী চোখ দিয়ে। গবেষণা* থেকে এটা এখন স্পষ্ট যে, ক্রমবিকশিত পরিণতি-অভিমুখী যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাই তা এই বাংলাদেশের মানুষ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির অন্তর্গত প্রভাব থেকে সৃষ্ট। এখানকার সামগ্রিক প্রভাবে তাঁর ধর্মচিন্তা, স্বাদেশিকতা, জাতীয়তাবোধ, সমাজ সচেতনতা, সাহিত্যিক আদর্শ–সবকিছুরই পরিবর্তন ঘটেছিল। রবীন্দ্রজীবনীকারদের গবেষণা থেকে এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, রবীন্দ্র-মানসের আদিপর্বের তুলনায় এই পরিবর্তন অনেকটাই ব্যাপক ও গভীরতর।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়। তার আগেই আদমশুমারিতে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ বাংলাদেশে সংখ্যায় মুসলমানেরা বেশি। কিন্তু সামগ্রিক দিক থেকেই তারা ছিল অনগ্রসর। লেখাপড়া, চাকরি, রাজনীতি কোনো ক্ষেত্রেই তাদের প্রাধান্য ছিল না। এই প্রাধান্য না থাকাজনিত বিভ্রান্তিতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল সাম্প্রদায়িক বিরোধ। এই বিরোধের জের ধরেই আসে সাতচল্লিশের দেশভাগ এবং এরপর এসব ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রাধান্য বাড়তে থাকে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমগ্র সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপে মুসলমানেরা হয়ে উঠতে থাকে নিয়ন্ত্রক। আর এই পর্বে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন বাংলার মুসলমানের আরো কাছের মানুষ। এই পর্বেই বাঙালি মুসলমান তাদের প্রাণের দায়ে রবীন্দ্রনাথকে অর্জনের জন্য সংগ্রাম শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন তাদের নানা প্রগতিশীল সংগ্রামের উপকরণ। সাম্প্রদায়িকতা থেকে অসাম্প্রদায়িকতায়, বিরোধ থেকে প্রীতিতে, ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে ভালোবাসায় উত্তরণের সংগ্রামী মাধ্যম।
তাঁর কবিচেতন্যে বাংলাদেশের বাউলদের প্রভাব যেন অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে হাজির করে আমাদের কাছে। কৈশোরে পশ্চিমবঙ্গের বৈষ্ণবপ্রভাব তাঁর অন্তর স্পর্শ করলেও এর তত্ত্বগত গভীরতা তাঁকে অধিকার করতে পারেনি। বৈষ্ণবদের ভক্তি-উচ্ছ্বাস তাঁকে ততটা আকৃষ্ট করেনি যতটা আকৃষ্ট করেছিল এর দ্বৈতাদ্বৈতবাদ। পরিণত বয়সে লেখা তাঁর Religion of Man (১৯৩০) বা মানুষের ধর্ম (১৯৩৩) বইয়ে যে কথা বলা হয়েছে তাতে বৈষ্ণবধর্মের উল্লেখ পাওয়া যায় না বরং পাওয়া যায় পূর্ববঙ্গের বাউলদের চিন্তাভাবনার উল্লেখ। তাঁর গানের সুরেও পড়ে পূর্ববঙ্গের বাউলসুরের ব্যাপক প্রভাব। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ থেকে বাংলার মুসলমানেরা যে রাষ্ট্র পেয়েছিল তাতে তাদের প্রত্যাশা কিছুমাত্র পূরণ হয়নি। এই হতাশা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাতেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব। এখানেও রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ হয়ে উঠতে লাগলেন আপনতর। এ কথা আজ স্পষ্ট যে, বাংলার মুসলমানের আত্মপরিচয়ের এই যাত্রাপথেই রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে আপন হয়ে উঠেছেন। অনেক সময়েই মনে হয় যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব না ঘটলে এই সম্পন্ন-রবীন্দ্রনাথকে আমরা হয়তো কোনোদিনই উপলব্ধি করতে পারতাম না। রবীন্দ্রনাথের নির্ঝর বাঙালির আত্মপরিচয়ের নির্ঝরকেও যে জাগিয়ে দিতে পেরেছে সেটা কম কথা নয়। সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমরা তাঁকে আপন করে নিয়েছি। বার আমরা তাঁর কাছে ফিরে যাই সে কারণেই। প্রশ্ন করি তাঁকে বারবার। তাঁর সমগ্র জীবনের ধারাবাহিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে ‘নানা রবীন্দ্রনাথের মালা’ আমরা পাই তাকে যেমন গড়ে দিয়েছে পূর্ববঙ্গ মানে বাংলাদেশ, তেমনি বাংলাদেশও তাকে গড়ে নিয়েছে নিজের মতো করে–এমনটা বললে হয়তো ভুল বলা হবে না। সেই পথ ধরে রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যতেও বাঙালির জীবনে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন, বারবার। বিশ্ববাঙালির অন্তর থেকে আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বমানবের অন্তরে।
*এ বিষয়ে গোলাম মুরশিদের গবেষণা-গ্রন্থ রবীন্দ্রবিশ্বে পূর্ববঙ্গ পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রচর্চা (১৯৮১) একটি বিশিষ্ট গ্রন্থ। বর্তমান রচনার কোনো কোনো সিদ্ধান্ত প্রধানত এই বইয়ের গবেষণালব্ধ উপাত্ত অবলম্বনে গৃহীত।