spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকভারত কি হাসিনাকে রাখবে নাকি বাংলাদেশের হাতে তুলে দিবে?

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

ভারত কি হাসিনাকে রাখবে নাকি বাংলাদেশের হাতে তুলে দিবে?

কাজী জহিরুল ইসলাম

সব ডিক্টেটরই কম-বেশি মানুষ খুন করেছে, ভবিষ্যতের ডিক্টেটরেরাও তা করবে কিন্তু হিটলারের পরে সম্ভবত সবচেয়ে ঘৃণিত কয়েকজন খুনি ডিক্টেটরের একজন শেখ হাসিনা।  তার শাসনামলে, তার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ নির্দেশে, কত মানুষ খুন হয়েছে এর একটি হিসেব আমরা হয়ত একদিন জানতে পারবো, আমি অনুমান করছি এই সংখ্যাটি এতো বেশি যা শুনলে আমরা হয়ত শিউরে উঠবো।  

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ডিক্টেটরেরা ক্ষমতাচ্যুত হবার পর রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে এবং অনেকেই পেয়েছেন কিন্তু আজ দুদিন হয়ে গেল শেখ হাসিনাকে এখনও পর্যন্ত কোনো দেশ রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজী হয়নি বলে বাংলাদেশ এবং ভারতের মিডিয়াগুলো জানিয়েছে।  কেন কোনো সভ্য দেশ তাকে আশ্রয় দিতে চায় না? কারণ এতো বড়ো একজন খুনিকে আশ্রয় দিয়ে দেশগুলো তাদের মানবাধিকার সংক্রান্ত ইমেজের ক্ষতি করতে চাইছে না। যে দেশ তাকে আশ্রয় দেবে সেই দেশের দিকে পৃথিবীর মানুষ আঙুল তুলে প্রশ্ন করবে, তোমরাও কি এই খুনের অংশীদার? আজকের পৃথিবীতে কেউ মানুষ হত্যা করার মত ভয়ঙ্কর অপরাধের দায় নিতে চায় না।

একজন মানুষ যখন চুরি করে সে তার চুরি করা ধন-সম্পদ কোথায় রাখে? যারা তার চুরির সহযোগী বা সুবিধাভোগী তাদের কাছে, যেমন তার পরিবার, আত্মীয় বা বিশ্বস্ত বন্ধুর কাছে। একজন মানুষ যখন ভয়ঙ্কর অপরাধ করে পালায়, তখন সে কোথায়, কার কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়? তার খুনের সহযোগী বা সুবিধাভোগীর কাছে। যখন পৃথিবীর কোনো দেশ হাসিনার খুন, লুটপাট, চুরির সহযোগী হতে চাইছে না তখন হাসিনা এবং তার পরিবার আশা করছে ভারত নিশ্চয়ই তাকে আশ্রয় দেবে। তাদের এই প্রত্যাশার দুটি কারণ আছে। প্রথমত, ১৯৭৫ সালে তার পিতা ও পরিবারের সদস্যদের হত্যা করার পরে তাকে ৬ বছর আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। দ্বিতীয়ত, গত পনের বছরে বাংলাদেশের স্বার্থ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তিনি ভারতকে অকাতরে দান করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি ভারতকে যা দিয়েছি ভারত আজীবন তা মনে রাখবে? হয়ত এই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে ভারত তাকে আশ্রয় দিতে পারে তবে হাসিনার খুন ও লুটপাটের সহযোগী হিসেবে ভারত বিশ্ববাসীর কাছে নিজের এই নগ্ন মুখ উন্মোচন করবে কী-না সেটিও তারা ভেবে দেখবে বলে আমার মনে হয়। 

এই মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তার পারদ তলানীর দিকে নেমে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়টাতে নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের এতো বড়ো ক্ষতি তিনি করবেন কী-না তা নিশ্চয়ই ভেবে দেখবেন। একথা তো ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ভালো করেই জানে, শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেবার মানেই হচ্ছে ১৮ কোটি মানুষের ঘৃণার গনগনে আগুন ভারতের দিকে নিক্ষিপ্ত হবে। শেখ হাসিনা ভারতের ফেভারে যত চুক্তি করেছেন সেই চুক্তির নৌকাগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের মানুষের ঘৃণার নদীতে পাল তুলে ভারতের বন্দরে এসে ভিড়বে না। এইসব চুক্তির বাস্তবায়নের জন্য দরকার বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন। 

যে ন্যায্য ছাত্র আন্দোলনের দাবীর মুখে ডিক্টেটর হাসিনার পতন ঘটলো তার ঢেউ ভারতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসে আছড়ে পড়েছে, তা আমরা মিডিয়াগুলোতে দেখতে পেয়েছি। এই ঢেউ যে ভারতের ভেতরেই সুনামী হয়ে উঠবে না তা হলফ করে বলা যায় না। শেখ হাসিনার বয়স এখন ৭৬, ভালো লাইফ স্টাইল এবং চিকিৎসা পেলে তিনি আরো বছর দশেক কমপক্ষে বাঁচতে পারেন। এই সময়টা যদি তিনি ভারতে থাকেন তাহলে তার অবস্থানের কারণেই ভারতের ভূখণ্ডে আন্দোলনের সুনামী না হলেও ছোটোখাটো টর্নেডো যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে। সুতরাং এতো বড়ো একটা বোঝা কেন ভারত তার ঘাড়ে নেবে, যখন সারা পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? 

১৯৭৫ থেকে ১৯৮১, এই ছয় বছর ভারত তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল কারণ তখন তিনি ছিলেন সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত সরকার প্রধানের নিরীহ কন্যা। তখন তিনি ছিলেন ভারতের জন্য দুই কারণে সম্পদ। প্রথমত, নিহত সরকার প্রধানের আশ্রয়হীন কন্যাকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্ববাসীর সুনাম অর্জন করেছিল। দ্বিতীয়ত, তরুণ বয়সী হাসিনাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করতে পারলে এবং একদিন তাকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসাতে পারলে বাংলাদেশ থেকে কাঙ্খিত সুবিধা আদায় করতে পারবে। আজ ৭৬ বছরের ক্ষমতাচ্যুত খুনি ডিক্টেটর শেখ হাসিনা সকল দিক থেকেই ভারতের জন্য এক বিরাট বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয়। বরং ভারত যদি তাকে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা সমর্থিত সরকারের হাতে তুলে দেয় এবং বাংলাদেশের মানুষকে সহযোগিতা করে তাকে বিচারের আওতায় আনার জন্য, তাহলে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ভারত অনেক বেশি লাভবান হবে। স্বৈরাচারের বিচারকার্যে সহযোগিতার জন্য পৃথিবীর কাছেও ভারতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় এই মুহুর্তে নরেন্দ্র মোদির ভারত বড়ো একা। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভূটান, মালদ্বীপ কেউ তার পাশে নেই। পাকিস্তান তো চিরকালের শ্ত্রুই। একমাত্র বাংলাদেশই বন্ধু রাষ্ট্র ছিল, যে দেশ থেকে অফিশিয়ালি তৃতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আসে, কেউ কেউ বলেন আন-অফিশিয়ালি বাংলাদেশ তাদের রেমিটেন্স সংগ্রহের প্রধান বাজার, সেই বন্ধু দেশটিকেও নিশ্চয় একজন খুনিকে আশ্রয় দিয়ে হারাবেন না।

০৬/০৮/২০২৪

বুমেরাং

………..

গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার দীর্ঘ অপশাসনের মধ্য দিয়ে দেশ, গণতন্ত্র ও মুক্তযুদ্ধের চেতনা বিরোধী বহু কাজ করেছে। এই লেখায় আমি এসবের বাইরে গিয়ে তার কয়েকটি অপকর্মের কথা বলবো যেগুলো তার ও তার দলের ক্ষতি করেছে। 

১। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিতর্কিত করেছেন। একটি ভূয়া এবং হাস্যকর চেতনার উত্থান ঘটাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন, ফলশ্রুতিতে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে এর অবসান হয়েছে। 

২। বাংলাদেশের মানুষকে বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী করে তুলেছেন। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুর নাম অতিমাত্রায় ব্যবহার করে, তার নামে অখাদ্য-কুখাদ্য পুস্তকের পাহাড় রচনা করিয়ে, বাংলাদেশের সকল স্বপ্নের একমাত্র দ্রষ্টা বানাতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের চরম বিদ্বেষ তৈরী করেছেন। তার পতনের মধ্য দিয়েও বঙ্গবন্ধুর এই ইমেজ উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। 

৩। বাংলাদেশের মানুষকে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছেন। এখন ক্রিকেট খেলায় ভারত হারলে মানুষ আনন্দ মিছিল করে, ভারত জিতলে মানুষ গালাগালি করে। ভারতকে নানান রকম অন্যায্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে, এমন কী দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে ভারতের জন্য টন টন  ইলিশ মাছ উপহার পাঠানোর ঘটনাকেও এদেশের মানুষ ভালোভাবে দেখেনি। ভারসাম্যহীন অসংখ্য চুক্তি তো আছেই। বাংলাদেশের ৮ লক্ষ উচ্চশিক্ষিত বেকার কাজের জন্য ঘুরছে অথচ এই দেশে ২৬ লক্ষ ভারতীয়কে চাকরি করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এসব কারণে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ ভারত বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। তার পতনের মধ্য দিয়ে এই ঘৃণা মুছে যাবে না। দুই দেশের প্রশাসনকে বহুদিন আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে এই ঘৃণা মোছার জন্য। 

৪। প্রকৃতপক্ষে তিনি আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করেছেন। পিতার মত তিনি দলটিকে নিষিদ্ধ করেননি কিন্তু জ্যান্ত কবর দিয়েছেন এবং দলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে নেতা-কর্মীদের একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে চরম স্বার্থপরের মত নিজের বোনকে নিয়ে পালিয়ে গেছেন। হিটলারের মতো নিকৃষ্ট স্বৈরাচারও এমন কাপুরুষোচিত কাজ করেনি। সর্বত্র দলীয়করণ করে এই দলের জন্য তিনি দেশের আপামর জনসাধারণের ঘৃণা অর্জন করেছেন। অভ্যুত্থানের পরে মানুষ আওয়ামী লীগের প্রায় সব অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে। তার ক্ষমতায় থাকার শেষ কয়েক দিনেই বিভিন্ন অফিস থেকে তার ছবি নামানো এবং দলের অফিস ভাংচুর করা শুরু হয়ে যায়, যা অতীতে আর কখনোই হয়নি। তার দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-নেত্রীদের ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই কান ধরে উঠবস করায় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা। এই ঘটনা আমাদের এই শিক্ষা দেয় ক্ষমতা গণভবন বা বঙ্গভবনে থাকে না, ক্ষমতা থাকে সাধারণ মানুষের বুকে। কিন্তু এই বোধ শেখ হাসিনার কখনোই হয়নি। তিনি শেষ দিনও আর্মি, পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্র যে মানুষের বুক সেইখানে আরো গুলি করার কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা তো এদেশেরই সন্তান, এই উন্মাদের কথায় তারা আর রাজী হননি। শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ