spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার 'বাংলা রিভিউ' : পর্ব -২

লিখেছেন : মাহমুদ নোমান

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার ‘বাংলা রিভিউ’ : পর্ব -২


| মাহমুদ নোমান |

আন্দোলন মানে তো আন্দোলিত হওয়া। ভেতরের তাগাদা। প্রতিটা আন্দোলন থেকে শিক্ষার অনেক কিছু থাকে। প্রভাব দুইদিকে বয়ে নেয়। ঘোলা জলে মাছ শিকারও করে অনেকে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে; তবে আন্দোলন জরুরি অন্তত বেঁচে আছি কীনা সেটার যাচাইকরণে; গত পরশু আমার ঘরে সিলিং ফ্যান মুছে দিয়ে দেখেছি বাতাস কী দারুণ গতিতে বেড়ে গেছে, অথচ ফ্যানে আমি কিংবা কেউ ময়লা ছুঁড়ে মারিনি, ময়লা হয়ে গেছে। আমরা কেউ ভাবিনি যে এইরকম ছাত্র আন্দোলন ‘আমি আমি সেরা/ কথা বললে হাত কড়া’ টাইপের সরকারকে দমন করে দিতে পারে। কিন্তু দমন হয়েছে এই আন্দোলনে, আন্দোলিত করতে পেরেছে মানুষের ভিতরকার; অন্য কিছু হাত, এককথায় অজুহাত’ না খোঁজে অন্তত শেখ হাসিনার বুঝে নেওয়া উচিত এমনকি এই অন্তর্বর্তী সরকারের যে — আমি আমি ঠিক/ ছি ছি ধিক…

একটা পরিবারের কথা মাথায় আনুন। যে ঘরটা আটজনের। আমার বাবা নেই। মা-ই প্রধান। আমরা উনার ছেলে। আমাদের কথা-মত– ভালো-মন্দ যুক্তি না ভেবেই মা নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, নিলে হয়তো ছেলেরা চুপ থাকবে,কিন্তু বার-বার! একসময় বিস্ফোরণ ঘটবেই। কারও কথা শুনতে অস্বস্তি লাগাও এটাই স্বৈরাচারী। সত্যিকারের নেতা হতে হলে নিজের ভাগটা পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে হয়। যেমন আমার মা মাঝেমধ্যে ভালো জিনিস অল্প হওয়ায় ভাগটা পান না। শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বাজে দিকটা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধকে অতিরিক্ত ব্যবহার করা। মুক্তিযুদ্ধকে ক্ষমতা পাবার ও ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার করেছে, এমনকি পৈতৃক সম্পত্তি ভেবেছে। সব শয়তানি করে মুক্তিযুদ্ধের উপর চালিয়ে দিয়ে ক্ষমতা থাকতে চেয়েছে। মানে মানুষের আবেগের জায়গা মুক্তিযুদ্ধকে অতিরিক্ত ব্যবহার করা। এমন ব্যবহার করেছে– যেই একজন আওয়ামী সমর্থক জীবনে আওয়ামী সরকারকে ব্যবহার করে এক কাপ চা খাননি অথচ যত পারে আওয়ামী সরকারকে দিয়েছে সেও যদি আওয়ামী সরকারের কার্যক্রমের কোনও ত্রুটির কথা বললো অমনি তাঁকেও রাজাকার বলে দমিয়ে দিয়েছে, দিতে চেয়েছে,দমিয়েছেও; এটার পরিণতি কতটা ভয়াবহ শেখ হাসিনা আজ হয়তো বুঝছেন। এতো ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে গেছেন যে বাঙালি মহান মুক্তিযুদ্ধকেও পর্যন্ত অস্বীকার করেছে,এমনকি নিজেকে রাজাকার বলতেও দ্বিধাবোধ করেননি। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারকে দমিয়ে ছেড়েছে। এই আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতি এবং মানুষের জন্য বড় একটা শিক্ষা…

এবার আসি কেউ যদি ঘোলাটে জলে মাছ ধরে সেটার পরিণতিও ভবিষ্যতের জন্য রাখা ভালো। আমি এই আন্দোলনের সুফলগুলো দেশের প্রেক্ষিতে মঙ্গলজনক ব্যাপারগুলো বলতে বেশি আগ্রহবোধ করছি। শেখ হাসিনা সরকার মূলত বেশিদিন ক্ষমতায় থেকে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। আমার এক কবি বন্ধুর কথাই বলতে চাচ্ছি আজ — সে যখন একটা ছোট চাকরির খোঁজে মেসে তখন আমাকে বন্ধু বলে ডেকেছে আমার লেখালেখি নিয়ে কী উৎসাহে সব জায়গায় বলতো কিন্তু একজন আমলার পা চেটে আমলার পাশে দাঁড়ানোর যেই চাকরি হলো অমনি আমার মেসেজের উত্তরও আর দেয়নি। এরকম কবি দেশের শত্রু, এরকম চারদিকে, এদের অভ্যাস পা চাটার, দেখবেন উত্তাল সময় থেমে গেলে আবার এই সরকারের কম্বলেও ঢুকে যাবে আর যাঁরা নিজেকে বিকিয়ে দেবে না,ভুল দেখলে বলে দেবে,তাঁরা বিচ্ছিন্ন একা একা,অথচ এঁরাই সত্যিকারের কবি…

উল্লেখ করতে এসেছি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কবি ও সাহিত্য পত্রিকার ভূমিকা নিয়ে; আলাদাভাবে একেকজন কবি হয়তো নিজের তাগিদ আর গন্ডিতে তৎপর ছিলেন এই আন্দোলনে কিন্তু সম্মিলিত প্রয়াসে কোনও সাহিত্য সংগঠন কিংবা পত্রিকা তেমন এগিয়ে আসেননি। সংগঠন বললে সশরীরে উপস্থিতি লাগে শুধু লেখনী দিয়েই হয় না। সেক্ষেত্রে ‘বাংলা রিভিউ’ অনন্য কীর্তি গড়েছে এই ছাত্র আন্দোলনের বদৌলতে; জুলাইয়ের ১৬তারিখ ‘রক্তাক্ত স্বদেশ’ শিরোনামে অগ্নি ছড়ানো আর তেজোদ্দীপ্ত কবিতা শ্লোগান নির্ভর লেখনী সিরিজের পর ১৮জুলাই আরেকটা শিরোনাম দিয়েছিল ‘রুয়ে দিলে রক্তবীজ’… এই সিরিজে লিখেছেন স্বনামধন্য অগ্রগণ্য কবি ও ইতিহাসের সুনিপুণ বিশ্লেষক কবি সালেম সুলেরী। উনার কবিতাটি অন্তমিলে শ্লোগানে মুখরিত করার অভূতপূর্ব সুরারোপ নির্ভর লেখনী, সহজেই জনসাধারণের মুখে উচ্চকিত কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হওয়ার এবং বুকে সাহস বাড়িয়ে দেওয়া শ্লোক যেন–
তোমার-আমার মৃত্যুুর চেয়ে
‘বীরের মৃত্যু’ সেই–
অধিকার আর প্রতিকার চেয়ে
আমরণ লড়বেই।
— রক্তের জলে ধোবো অনিয়ম;সালেম সুলেরী)

‘রুয়ে দিল রক্তবীজ’ শিরোনামে যাঁরা লিখেছেন প্রত্যেকে জানাশোনা এবং প্রতিষ্ঠিত কবি প্রতিভা। জনসাধারণ উদ্দীপ্ত করে আন্দোলনে আমরা পেয়ে যাই এমন কিছু কবিতা যেটি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় আবার বেশ কিছু অযথাই লেখা’ হয়ে যায় এই ফাঁকে যাঁরা ধান্দায় থাকে সর্বদা,যাঁদের মনে সায় দেয় না, এককথায় বলতে হয় তেলালী; মানে নিজেকে বিপ্লবী উপস্থাপনের জন্য লেখা, কিন্তু বিপ্লব নেই মনে বিপ্লব নেই লেখায়…

‘বাংলা রিভিউ’ এই আন্দোলনে সাহস জোগাতে যেসব শিরোনাম দিয়েছে সেসব আলাদা যোগ করেছে সম্পাদক কবি সাজ্জাদ বিপ্লবের দারুণ মুন্সিয়ানায়। শিরোনামগুলো অনন্য মাত্রার এবং বিপ্লবের সাথে চমৎকার ধারাবাহিক; ‘রক্তাক্ত স্বদেশ’ এরপর শিরোনাম দিয়েছে
‘রুয়ে দিল রক্তবীজ’ শিরোনাম, বিপ্লবকে কেমন সুচিন্তিত সর্বাত্মক চেষ্টায় এগিয়ে নিয়ে গেছে ‘বাংলা রিভিউ’-এর সম্পাদক। ‘রুয়ে দিল রক্তবীজ’ শিরোনামের সিরিজে কবি সালেম সুলেরীর পরের কবিতা কবি নূরুল হকের কবিতাটির কথাই উল্লেখযোগ্য– তিনি রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের
মৃত্যুকে নিয়ে যে চিন্তিত মতামত রেখেছেন পূর্বে সংগঠিত বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন মুক্তিকামী সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে, এক কথায় স্মরণযোগ্য–

প্রথম গুলিটি বুকে লাগার পরও
যে তুমি দ্বিতীয় গুলির প্রতীক্ষায়
বুক চিতিয়ে দিলে,
পূর্ণলোহু যৌবনের মধ্যাহ্নে প্রোজ্বল
হে অসম সাহসী বীর,
কি নামে ডাকবো তোমায়
কিংবা কোন উপমায় তোমাকে
চিত্রিত করব
যুথসই কোন শব্দ খুঁজে না পাওয়ার ব্যর্থতায়
নিজেই কেবল রক্তাক্ত হচ্ছি।
— কোন উপমায় তোমাকে চিত্রিত করব, আবু সাঈদ; নূরুল হক)

‘রুয়ে দিল রক্তবীজ’ শিরোনামের কবিতাটি লিখেছেন কবি মুজতাহিদ ফারুকী, কবিতাটি শান্তশিষ্ট শব্দে ভেতরকার শাণিত বোধ–

গোধূলিধূসর এই অধীকৃত ভুঁইয়ে
দুঃসাহসী যারা আজ রুয়ে দিলে
সূর্যের মত লাল টকটকে তাজা রক্ত-বীজ
তাদের সালাম।
— যারা রুয়ে দিলে রক্ত-বীজ;মুজতাহিদ ফারুকী)

আবু সাইদকে ইকারুসের সাথে তুলনা করে কবিতা লিখেছেন কবি শান্তা মারিয়া, নতুন পথের দিকে ইঙ্গিত করেছেন সহজাত ভাবিত জ্ঞানে–

আবু সাইদ ডেকে বলে ‘জাগো বাহে’
আর রংপুরের মাটি রঞ্জিত হয় তার রক্তে।
আবু সাইদ উড়তে চেয়েছিল
ডানা মেলে সুনীল আকাশে
শুধু মাত্র ওড়ার উল্লাসে সে ছড়িয়ে দিল বাহু
সূর্যের তাপে পুড়ে যাচ্ছে আবু সাইদ
বিন্দু বিন্দু হয়ে ঝড়ে পড়ছে পলল ভূমিতে
— নতুন ইকারুস; শান্তা মারিয়া)

এই সিরিজে কবি মাসুদুল হকের ছোট্ট কবিতাটি বহুধা ব্যঞ্জনাময়,আর্তির মধ্যে প্রার্থিত চুম্বন যেন–

মেয়েটা
কাঁদতে
কাঁদতে
একটা রক্ত জবা হয়ে ওঠে!
— রক্তজবা; মাসুদুল হক)

কবি মাসুদুল হকের কবিতাটি পড়ে একটা মনস্তাত্ত্বিক গানের কলি মনে এল– আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে উঠল ফোটে মন’…

বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অনন্য ঐতিহাসিক ঘটনা ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলন বাঙালিকে দিয়েছে নতুন দিগন্তের সূচনা, দেখিয়ে দিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন পথ। আর এই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনও সুদূর প্রভাববিস্তারী ছাত্র আন্দোলন এমনকি আপামর বাঙালির চেতনা চর্চার উর্বর আন্দোলন নিঃসন্দেহে বলা যায়; ভবিষ্যৎ বলে দেবে এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে কোন কোন কবি সাহিত্যিক আন্দোলিত হয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর হাতকে শক্তিশালী করেছেন বুকে সাহস দিয়ে…

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. অসাধারণ কাব্যিক বিশ্লেষণ……
    ধন্যবাদ তোমাদের সকলকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on ১০ টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ