তৈমুর খান
২৪
আমার নামটাই লেখা নির্বাচনের বড় শত্রু
লোকসাহিত্যের গবেষক তথা প্রত্নসন্ধানী সৈয়দ মৈনুদ্দিন হোসেনের সঙ্গে তাঁরই গাড়িতে চেপে আবদুর রাকিব, নাসির ওয়াদেন, তুষার আহসান, অনিমেষ মণ্ডল, বঙ্কিম লেট, বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমি যাচ্ছিলাম জয়দেব-কেন্দুলির ভক্তিভবনের অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা আবদুর রাকিব। তিনি বলবেন লোকসাহিত্যে লোকগানের প্রসঙ্গ নিয়ে। সময়টা ছিল ২০১৮ এর ১২-ই নভেম্বর। পথে মহম্মদ বাজারে ঢুকতেই একটা বড় মিষ্টির দোকান দেখে আমাদের গাড়ি থামানো হলো। সৈয়দ মৈনুদ্দিন বললেন, “এটি বীরভূমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রসমালাই এর দোকান। আজ যখন সুযোগ এসেছে চলুন তার সদ্ব্যবহার করি।” বলেই সবাইকে টেনে নিয়ে গেলেন দোকানের ভিতরে। চেয়ারে বসিয়ে বললেন এক প্লেট করে রসমালাই দিতে। রসমালাই খাওয়া না হতেই আবারও অর্ডার দিলেন ক্ষীরমালাই এরও। রাকিব সাহেবের পাশেই বসে খাচ্ছি। খেতে খেতেই কথা হচ্ছে।
—এবছর একটা সেরা খবর তৈমুর, তোমাকে বলা হয়নি।কয়েকদিনের মধ্যেই জানতে পারবে।
—কী খবর বলুন না?
—এবছর নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছ, আর আমার হাত দিয়েই এই পুরস্কার দেওয়া হবে তোমাকে!
আনন্দে আমার মুখটি রাঙা হয়ে উঠেছিল। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলাম। নিচু গলায় মিন মিন করে বলেছিলাম:
—আমি তো পুরস্কারের যোগ্য নই! কী এমন লিখেছি যে আমাকে ওঁরা নির্বাচন করেছেন?
রাকিব সাহেব বলেছিলেন:
—আরও আগে এই পুরস্কার তোমাকে দেওয়া উচিত ছিল। তোমার ‘আত্মক্ষরণ’ ও ‘আত্মসংগ্রহ’ পড়ে আমি চমকে গেছি।
নিজের সম্পর্কে প্রশংসা শুনলে আমি লজ্জায় আর মাথা তুলতে পারি না। এক্ষেত্রেও তাই-ই হলো। শুধু কিছু না বলে একটি কথাই বললাম, তাহলে আপনার সঙ্গেই একসঙ্গে যাব অনুষ্ঠানে। তিনি বলেছিলেন, “হ্যাঁ ওই ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসেই যাব।” কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, ততদিন তিনি আর পৃথিবীতে রইলেন না। ২১ নভেম্বর নবি দিবসের দিনেই সকাল সকাল তিনি ইহজগৎ ত্যাগ করলেন।
সেদিন ভক্তিভবনে গিয়ে আমরা একসঙ্গে সারাদিন কাটিয়েছিলাম। একসঙ্গে ছবিও তুলেছিলাম অজয় নদের তীরে দাঁড়িয়ে। তারপর সেই গাড়ি চেপে বাড়ি ফিরতে ফিরতে গণপুরে রাস্তার ধারে একটি মিষ্টির দোকানেও দাঁড়িয়েছিলাম। আবারও দু-পিস গরম গরম মিষ্টি আর দু-গ্লাস পানি পান করে ফিরে এসেছিলাম। সেদিন রাস্তায় যেতে যেতে অনেক কথাই হয়েছিল। বলেছিলেন এক আশ্চর্য সাহিত্য জগতের সংবাদও। বিখ্যাত এক নজরুল গবেষক যিনি নজরুল বিষয়ে অনেকগুলি পুস্তক রচনা করেছিলেন, তাঁর বিষয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে এক অধ্যাপক বলেছিলেন, “নজরুল সাহিত্যের আগ্রহী পাঠক।” কয়েকজন সম্পাদকের উল্লেখ করে বলেছিলেন, বাংলা বানান নিয়েও তারা কী রকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। তারপর বলেছিলেন সেই সময়ের তরুণ সাহিত্য যোদ্ধা গোলাম রাশিদের কথাও। আমাদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল। সাহিত্য নিয়ে আমরা যেভাবে অগ্রসর হবার চেষ্টা করছি এবং এত প্রতিকূলতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছি এটা খুবই আশাব্যঞ্জক বলেই তিনি মন্তব্য করেছিলেন।
২ ডিসেম্বর ২০১৮, কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউটহলে নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণের মুহূর্তটি স্মরণীয় হয়ে রইল । সুন্দর একটা অনুষ্ঠান, বহু মানুষের সমাগমে মুখর। সকলেই আছেন, শুধু রাকিব সাহেব নেই। সমস্ত অনুষ্ঠানটিতেই আমি এক পরম শূন্যতা অনুভব করে এক বিষাদের মধ্যে যেন তলিয়ে যাচ্ছিলাম। কিছুতেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলাম না। রাকিব সাহেব থাকলে তিনি আমার সম্পর্কে বলতেন, আমি কতদিন থেকে উন্মুখ হয়েছিলাম তাঁর মুখ দিয়ে কিছু শুনব বলে। এতদিন থেকে আমি সাহিত্যের পথে থাকলেও আজ অবধি কেউ তেমন আমাকে নিয়ে কিছুই বলেননি। বলার ক্ষমতাও সবার নেই। কিন্তু সে সুযোগ যখন হলো না, তখন নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে উঠেও কিছুই বলতে পারলাম না। আহত হৃদয়ে সর্বদা এক কাতরতায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হলো। তবু ভাঙা গলায় আমার অতীত জীবনের স্মৃতিচারণা এবং সাহিত্যের পথপরিক্রমার একটা বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। নতুন গতির কর্ণধার এমদাদুল হক নূর কী অমানুষিক পরিশ্রম করে তাঁর প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তা আগেই শুনেছিলাম। সেদিন গিয়েও প্রমাণ পেলাম তাঁর আন্তরিকতা ও ভালবাসা কতখানি। বিভিন্ন প্রান্তের বহু প্রান্তিক কবি-সাহিত্যিক যেমন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন, তেমনি সকলের থাকার এবং খাবার বন্দোবস্ত কিভাবে করেছেন তা দেখেও অবাক হলাম। এত মানুষ, এত আয়োজন, পুরস্কারের অর্থ মূল্য কম নয়, তারপরও হাসিমুখে সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময় ক’জন মানুষ পারেন? অনুষ্ঠানের দিন মঞ্চ সাজানো থেকে পরের দিনও সাহিত্য সম্মেলন পরিচালনা এবং ভুলে যাওয়া সাহিত্যিকদের মূল্যায়ন করা এক বিরল দৃষ্টান্ত বলে আমার মনে হলো। তিনি শুধু নিজের জন্যই কিছু করেন না, যা করেন সাহিত্য ও সাহিত্যিকের জন্য, যা করেন বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসার কারণে। এইসব কাজের মধ্যে তিনি কখনোই প্রাপ্তির কোনো আশাই করেন না। উঠতি তরুণ লেখকদের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তুলে এনে মর্যাদার সঙ্গে তাঁদের লেখা প্রকাশ করেন। অনেক সময় তাঁদের বইও প্রকাশ করেন। প্রতিভার মূল্য দিতে নতুন গতি পুরস্কারও প্রদান করেন। তেমনি লিটিল ম্যাগাজিন সম্পাদক, মানবাধিকার কর্মী, সমাজ কর্মী সকলেই পুরস্কৃত হন। যাঁদেরকে নিয়ে ভাববার কেউ থাকে না, তিনি তাঁদেরকে নিয়েই ভাবেন । মহৎপ্রাণ এই মানুষটি সম্পর্কে কেউ কোনোদিন ইতিহাস লিখবে কিনা জানি না, কিন্তু তাঁর সম্পাদিত ঈদ সংখ্যা নতুন গতির প্রতিটি সংখ্যা যাচাই করলে বুঝতে পারবে নীরবে নিভৃতে নিজ প্রাণের রক্তবিন্দু ক্ষয় করে কতটুকু শ্রম ও নিষ্ঠা তিনি ঢেলে দিয়েছেন। ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে উপেক্ষা করে, ভোগবিলাসকে দূরে ঠেলে এমনকি সংসারকেও পাত্তা না দিয়ে পরম কৃচ্ছ্র সাধনায় ইহজীবন অতিবাহিত করেছেন। আবদুর রাকিবের একটি বিখ্যাত বই ‘পথ পসারীর পত্রোত্তর’ তাঁরই প্রকাশিত একটি অমূল্য সম্পদ। বীরভূমের কৃতী মানুষ সাহিত্যিক স্বাধীনতা যোদ্ধা এম আব্দুর রহমানের সমূহ সৃষ্টিকেই যেমন সংরক্ষণ করেছেন, তেমনি তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন গুণীজনের রচনাকে সংগ্রহ করে নতুন গতির একটি ঈদ সংখ্যায় লিপিবদ্ধ করেছেন। আমার মতো প্রান্তিক একজন কবিকেও কলকাতার সারস্বত সাহিত্যিক মঞ্চে পুরষ্কৃত করেছেন। জীবনে যদি আর কোনো পুরস্কার নাও পাই, তাহলেও আমার আর কোনো আফসোস থাকবে না। কারণ নতুন গতি পুরস্কারই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার হয়ে রইবে। যে পুরস্কারের মধ্যে এত ভালবাসা, এত নিষ্ঠা ও দরদ মিশে আছ—সেই পুরস্কারের কথা কোনোদিন ভুলতে পারব না।
কলকাতার বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে বিভিন্ন সময় লিখলেও কলকাতার কোনো সাহিত্য অনুষ্ঠানে আমি আসতে পারি না। স্মারক পুরস্কার, বা সংবর্ধনা প্রাপ্তিও আমার কাছে বিড়ম্বনা মনে হয়। ২২০ কিমির অধিক পথ পাড়ি দিয়ে কলকাতায় একটি ফুলের মালার জন্য, বা একটি ধাতু নির্মিত বা প্লাস্টিক স্মারকের জন্য আসা আমার কাছে বিলাসিতা মনে হয়। তবু কাছাকাছি থাকলে হয়তো আন্তরিকতার টানে এসে উপস্থিত হতে পারতাম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতার কারণে আসতেই হয়। তবুও কলকাতা শহর আমার কাছে তেমন সড়গড় নয়। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত মেট্রো বা বাস ধরে যাতায়াত করাও খুব কষ্টকর মনে হয়। মেট্রো শহরের যান্ত্রিক বিপন্নতা আমাকে ক্লান্ত করে দেয়। তখন না থাকে সাহিত্যের প্রতি মনোযোগ, না উপলব্ধি করি স্বাচ্ছন্দ্য। কয়েকজন সাহিত্যিক বারবার ডাকলেও আজ পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয়নি। কারও পদতলে বসে কখনো ছবি তুলেছি এরকমও কোনো মুহূর্ত নেই। কারও সঙ্গে কখনো কখনো কলকাতায় এসেছি বটে, কিন্তু সেইখান থেকেই আবার ঘুরেছি। কলকাতার কবি-সাহিত্যিকরা মফস্সলের কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে ব্যবসা করেন। পত্রিকার গ্রাহক করেন। জোর করে বই কেনান। কিন্তু কখনোই তার প্রতিভা বিচার করেন না। নতুন গতি সেখানেই নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে। তাই এর সঙ্গে কারও তুলনা হয় না।
কলকাতার প্রকাশকরা পশ্চিমবঙ্গীয় যেকোনো ধরনের মুসলিম কবি-সাহিত্যিককে অচ্ছুত করে রাখতে চান। কিন্তু বাংলাদেশের তৃতীয় শ্রেণির কবি-লেখকদেরও তাঁরা মর্যাদা দেন। অপরদিকে বাংলাদেশও পশ্চিমবঙ্গীয় অমুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের অঢেল সমাদর করেন। পশ্চিমবঙ্গীয় তৃতীয় শ্রেণির কবি-সাহিত্যিকরা বাংলাদেশে গিয়ে রাজা-বাদশার মর্যাদা পান। এসব দেখতে দেখতেই অনেক বেলা গড়ে গেছে জীবনের। অবেলার কাক এসে আয়ুর কার্নিশে বসেছে। কোথাও আর তেমন লেখা পাঠাই না এখন। আমার নামটাই লেখা নির্বাচনের বড় শত্রু। বহু সম্পাদক এই তুর্কি শব্দের নামটিতেই পাকিস্তানের গন্ধ পান। প্রকাশক তো আরও বেশি গন্ধ পান। মাত্র কয়েকজন যাঁরা আমার কাছাকাছি আসতে পেরেছেন, যাঁরা আমার হৃদয়ের সংরাগে স্পন্দন শুনতে পেয়েছেন, যাঁরা আমার কান্না ভেজা চোখ দেখতে পেয়েছেন—শুধু তাঁরাই আমাকে গ্রহণ করেছেন। তারাই প্রকাশ করেছেন আমার বই। সহযাত্রী নামে একটি প্রকাশনা সংস্থার খপ্পরে পড়ে একবার বেশ কিছু টাকাও নষ্ট হয়েছে। দায়সারা গোছের কয়েক কপি বই ছাপিয়ে তারপরে আর সংযোগ রাখেননি। কলকাতা গিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে, ফোন কেটে দিয়েছেন। বরং কিছু লিটিল ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠান বিনা পয়সায় বই ছাপিয়েছেন। এরকম একটি প্রতিষ্ঠান দৌড় প্রকাশনা। যার কথা আগেই বলেছি। বর্ধমানের বার্ণিক প্রকাশনা বিজ্ঞাপন দিয়ে পাণ্ডুলিপি আহ্বান করলে পাণ্ডুলিপি পাঠালে ২০১৬ সালে ‘জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা’ কাব্যটি প্রকাশ করেন। কাব্যটি বহুল পরিমাণে বিক্রি হয়। ২০১৬ থেকে আজ অবধি এর জন্য রয়্যালিটিও প্রদান করছেন। পরবর্তীকালে একের পর এক বইগুলি প্রকাশিত হয়। কোনো কোনো বইয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণও হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আত্মসংগ্রহ’(২০২১), ‘নব্বই দশকের কবি ও কবিতা’(২০২১), ‘আত্মস্বর’(২০২২), ‘কবির ভাঁড়ারের চাবি’(২০১৮), ‘কবিতার বাঁক ও অভিঘাত এক অন্বেষার পরিক্রমা’(২০২০), ‘এই কবিতাজীবন’(২০২৩) ইত্যাদি। এই প্রকাশনা থেকেই ২০২৩-২৪-এ প্রকাশিত হয় ‘কবিতা সমগ্র’-এর প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। ২০২৫-এ ‘কবিতা সমগ্র’ তৃতীয় খণ্ডও। প্রতিটি খণ্ডেই প্রায় দশটি করে কাব্য রয়েছে। এছাড়া বার্ণিক প্রকাশন আমার একটি উপন্যাস ‘জারজ’(২০২২) প্রকাশ করেছে। আবিষ্কার প্রকাশনী আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘জীবনের অংশ’(২০১৯) প্রকাশ করে। মোট ১৯ টি গল্প নিয়ে এই গল্পগ্রন্থ। প্রচলিত ধারায় গল্প লিখতে আমি একেবারেই পছন্দ করি না। যে গল্পের মধ্যে আমি নেই, সেই অলীক গল্প আমি লিখতেও পারি না। এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্পেই তাই আমার ব্যক্তি জীবনের ছায়া পড়েছে। এই প্রকাশনা থেকেই আমার ‘নির্বাচিত কবিতা’(২০১৭) এবং আত্মজীবনীমূলক টুকরো টুকরো গদ্যের বই ‘আত্মক্ষরণ’(২০১৬) প্রকাশিত হয়। ‘আত্মক্ষরণ’ পাঠক মহলে অল্প দিনেই সমাদৃত । যে বইটির কথা আবদুর রাকিবও আমাকে উল্লেখ করেছিলেন।