……….
মগ্ন চৈতন্যে সাঁঝের কাব্য
……….
সন্ধ্যা নেমেছে পৃথিবীর কোল জুড়ে, বাদলের ধারা শেষে
কবিতারা জেগে উঠেছে– আজি এ মন্থর ক্ষণে,
মগ্ন চৈতন্যে কোন সুদূরলোক থেকে ভেসে আসে সাঁঝের কাব্য?
গোধূলির শেষ রক্তাভ মায়ায়- কামিনী-মাধবীলতার বনে–
কোন সে বাশুরিয়া সুর তোলে বিষাদের– নিসর্গ সন্ধ্যালোকে?
ঝরে পড়া নক্ষত্রের বুকে নিঃশব্দ বাতাসের কানাকানি,
কলাবতীর বাড়ন্ত গ্রীবা ছুঁতে চায়– ধবল কাশের পেলব দেহ–
একাদশী সন্ধ্যাতারার মেলায়– চন্দ্রাবতীর হাটে।
নীল-আসমান সরোবর সাঁতরে– বাড়ন্ত শরীর নিয়ে
একলা জেগে থাকে অনূঢ়া চাঁদ– মেঘেদের রাজ্যে,
মেঘমল্লার জল ঝরছে আজ সমস্ত ধরণীর ’পরে–
কেউ জানে না– কোথা হতে পথের শুরু– কোথায় যে শেষ,
মেঘেরা আড়াল নিলে দেখা হয়নি বিদায়ী রামধনুর সাতরঙ,
আড়ষ্ট সময়ের কুঞ্জে কান্নার জল জমেছে অসহায়ের মতো।
কার্তিকের সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁ আর বনজ্যোৎস্নায় বিমূর্ত রজনীর
গান শুনে নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করেছে যে বিষণ্ন পথিক–
তার জন্য অপেক্ষায় থেকে থেকে নীলকন্ঠ পাখি
আগমণি গান থামিয়ে দেশান্তরী হয়েছে বহু আগে;
সন্ধ্যামালতী দোলনচাঁপার অরণ্যে বনস্থ জোছনার লোভে
নিজেদের পৌষল দেহ নিয়ে ডানা মেলেছে রাতের পুষ্পরা–
বিমুগ্ধ আলোকরজনীতে– নিমগ্ন–নিবিড় শূন্যতায়,
ছুঁয়ে দেয়া শিশিরের বিন্দু বিন্দু জলকণা জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে
পথ খুঁজে নেয় নয়নমোহিনী নৈসর্গিক নির্জনতায়।
চুরি যাওয়া বিবাগী সময়ের অলিতে-গলিতে
অচেনা বেহালার উদাসী মিহিসুর– উথাল-পাথাল স্মৃতির দোলা–
উঠোন জুড়ে মিঠে সৌরভ, গাস্যির রাতে মহোৎসবের মেলা।
শরতের আসমানে কোজাগরী রাত নেমেছে আজ,
নক্ষত্রেরা জেগে থাকে মায়াময় শরীর নিয়ে পথের সমাপ্তিরেখায়,
অজস্র নক্ষত্রের আলোফুলে আজ ছেয়ে যাবে পৃথিবীর মানচিত্র।
…………..
নোনাজলের ইতিহাস
…………..
এখনও বিষাদমাখা রাত্তিরের ঘোর অন্ধকার কাটেনি এতটুকু,
অগণন নক্ষত্রবীথির মৌনমেলা ভেঙে
পৃথিবীর আলো ফোটেনি কোথাও;
এখনও অনেকটা পথ বাকি।
অনন্ত মহাকাল ছুঁয়ে পরিযায়ী ইচ্ছেগুলোর
অপমৃত্যু ঘটছে অহর্নিশি,
খুব গোপনে বুকের ভেতরে বসতি গেড়েছে- পাহাড়ি শঙ্খচূড়,
অথচ কি নিশ্চিন্ত বসবাস তার!
প্রোথিত গ্রন্থিতে নীলাভ ব্যথা লুকিয়ে–
দায় মেটাতে চায় পরিত্যক্ত জীবনের।
বসন্ত দিনগুলোর নির্বাসন হয়েছে সেই কবে!
তবু তারেই খোঁজে– পোড়ামাটির গন্ধমাখা
অস্ফুট বৃষ্টির ঘ্রাণে, শরতের শেষ বিকেলে।
অকস্মাৎ চমকটা কাটতেই চোখে পড়ে– কেউ কাছে নেই;
তখন নিঃসঙ্গ গাঙচিল একাকী ফিরে চলে নীড়ে।
বহমান নদীর গর্ভে বিবর্ণ পাথরে
প্রাচীন শিলালিপি খুঁজতে গিয়ে শুনতে পায়–
নিবিড় নৈঃশব্দ্যের বুক চিরে হাওয়ায় ভেসে আসা কান্নার গান,
কে যেন পেছন থেকে বলে– পথের শেষে দাঁড়িয়ে কী খোঁজ তুমি?
ওখানে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের পায়ের আওয়াজ শোনা যায়;
ঠিক তখনই চলমান ঘড়ির কাঁটাটা–
আর্তনাদ করে ওঠে সময় শেষের ঘণ্টা বাজিয়ে যায়।
সেদিন অবনমিত সত্তা আবিষ্কার করেছিল গুঢ় সত্যটা–
সনির্মিত গণ্ডির ভেতরে নিজেকে আড়াল করে কোনো লাভ নেই,
কবে কোন মৌন প্রহরে অলক্ষ্যে ভেসেছিল বেহিসেবী জীবন,
শ্রাবণে প্লাবনে একাকার করে দিয়ে
যখন হারিয়েছিল ভালবাসাহীন বিজন পথের বাঁকে!
সেই বিস্রস্ত সত্তা আজ জেনে গেছে- অভিশপ্ত বলয়ের সীমানা পেরিয়ে
নির্মম মুহূর্তগুলো প্রতিশোধের নেশায় মাদল নৃত্যে মেতেছে।
বিসর্জনের সমস্ত আয়োজন যখন শেষ– তাকে আটকায় সাধ্য কার!
বুকের মধ্যে একটা পাথুরে নদী বয়ে যায় অবিরাম,
পাহাড়-জঙ্গল ছাড়িয়ে আরও দূরে– পিপাসিত সমুদ্রের কাছে,
শুধু কারো কারো বুকে জমে থাকে– বিষণ্ন হাহাকার, সকরুণ সুর।
তখন মঞ্চস্থ হয় শোকসন্তপ্ত নাটকের শেষ পরিচ্ছেদ,
চূর্ণ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব খুঁজতে গিয়ে ফিরে তাকায়
ইতিহাসের পোড়া পাতায়,
যেখানে অন্ধকারের দেয়ালে আঁকা আছে
তার প্রতিটি পদক্ষেপ– হাসি-কান্নার ইতিবৃত্ত
বিয়োগান্তক নাটকের সমস্ত দৃশ্যের পরিসমাপ্তি হলে
কে মনে রাখে নির্বাক অক্ষিযুগলের নোনাজলের ইতিহাস?
পাখি উড়ে গেলে কেবল পড়ে থাকে শূন্য খেলাঘর।
…………
বৃষ্টির রাত
…………
এমনই রাত আসে– বৃষ্টির রাত,
আষাঢ়ের জলধারা ঝরে পড়ে অবিরাম
পৌষালী ঠান্ডা বয়ে যায় ভেজা বাতাসে,
আঁধারের সাথে জলকেলি– নিঃসীম নিরবতায়,
নক্ষত্রেরা পথ হারায় অচেনা ছায়াপথে;
জোছনাবিহীন বিষণ্ন রাতে– মেঘেরা কাঁদে।
এমনই রাত আসে– বাদলের রাত,
একাকী আকাশ ডেকে যায়– নিঝুম নিরালায়,
খসে পড়া পলেস্তরায় পুরনো ইতিহাস- বিবর্ণ;
নিরব রাতের অন্ধকারে মাতাল বাতাসে
শিস কেটে যায় নৈশ প্রহরীর হুইসেল,
ঘোর লাগা নিষিদ্ধ প্রহরে দূরে জেগে থাকে শুধু-
বিরহী ধূসর আকাশ।
এমনই রাত আসে– শ্রাবণের রাত;
ফেরারি পাখিরাও ঘরে ফেরে–
ফিরে চলে রোজকার যাত্রী- সুখী নীড়ে;
অপেক্ষার প্রহরে চেনা সুখের আবেশ,
নীলাভ আলোয় নির্ঘুম প্রহর জাগা,
স্বপ্নঘোরে রিনিঝিনি কাঁকনের সুর;
অতঃপর– আয়েশি ঘুম।
এমনই রাত আসে– বিষণ্নতার;
চেনা নগরীর ছায়া ছায়া ভেজা পথে–
নিশীথের অতিথিরা ফিরে যায়– উত্তাপবিহীন,
নিঃসঙ্গ বাতিস্তম্ভের আড়ালে প্রতীক্ষারত চাতকী;
বেহিসেবি জীবনের ভাঁজে ভাঁজে বেজে যায়
ভুলে যাওয়া বেহালার সুর– দুঃখী বিউগল।
…………
ফানুস
………….
জলরঙে আঁকা জীবন,
শিল্পীর বিমূর্ত ক্যানভাসে– চেনা সুখ,
হাসি-কান্নার বাহারি জলছবি।
মোমজোছনার কোমল আলোয়
দুঃখ ভোলার সকল আয়োজন শেষ হলে–
অবিনাশী কবিতা লিখে যায় কবি।
অনন্ত রাত্রির অদ্ভুত আঁধার ফুরালে
সুরের রঙ খোঁজে শিশিরের ভাঁজে,
মেঘলা দুপুরে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি–
বদলে দিয়ে যায় জীবনের রঙ,
তখন– বাদলা দিনের পাগলা হাওয়ায়
মনে রঙিন ফানুস ওড়ায়,
সময় ঘড়ি উল্টো পথে চলে,
খোঁজে– সুখের আকাশ, নাটাই ঘুড়ি;
পাখির ডানায় ক্ষ’য়ে যাওয়া ক্ষণ
সুর তোলে ভাঙা বীণায়,
আলোর পাখি উড়ে যায় দূরে–
পড়ে থাকে শূন্য খাঁচা।
………….
স্বপ্নের শহর
…………
ধূলিমাখা এ শহরের পথে প্রান্তরে–
ছুটে চলা দাপুটে হাওয়ার ভাঁজে ভাঁজে
নেচে বেড়ায় ছায়া ছায়া আঁধারের নিরেট কঙ্কাল।
গলি থেকে রাজপথ, পুরনো জঞ্জালের ফাঁকে
খোঁজে- প্রদীপ শিখার হারানো ইতিহাস;
নীল খামে বন্দী পাথুরে সভ্যতা, মাঝে কিছু
ফেলে আসা অমীমাংসিত জীবনের ভগ্নাংশ।
ভুলে যাওয়া বেহালার করুণ রাগিণীরা
বৃদ্ধার চোখে ক্ষয়িষ্ণু স্বপ্নের মতোই ধরা দেয়;
শ্যাওলা পড়া পুরনো অট্টালিকার ভাঁজে
প্রতিধ্বনি তোলে অচেনা অশরীরী।
শীষকাটা বাতাসে ঘুমায় অবাঞ্ছিত পথশিশু-
যে শিশু স্বপ্ন দেখতে জানে না,
যে শিশুর শৈশব মরে গেছে বহু আগে;
পাশে লোম-বিহীন কুকুরদের কোরাস,
যার সাথে এই পথকলিদের কোনোই তফাৎ নেই।
একটু দূরে রঙিন আলোর ঝলকানি–
ঘুমন্ত নগরীতে জেগে ওঠে রাতের পানশালা,
অচেনা অপ্সরীরা মেকি সজ্জায় নিশি জাগে;
ভেতরে ভেতরে অবশ্য টের পায় গোঙানিটা-
শববাহী বাহনের মতো।
তেমাথার মোড়ে মাথার চুলে জট পাকানো
সেই যে পাগলটা- আজও আছে দাঁড়িয়ে,
এখনও সে স্বপ্ন বিলায়– এই শহরের বুকে।
………..
বরং ভুলেই থাকি
…………
পথের শেষটা দেখা হলো না আর,
সেই যে ধুলোমাখা মোঠোপথটা–
দুরন্ত শৈশবের সাক্ষী হয়ে আছে আজও।
চলতে চলতে–
একদিন নদীর কাছে সপে দিয়েছিল নিজেকে,
কাকচক্ষু জলের সেই নদী–
সবুজ মাঠের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে,
আজও তেমন আছে কি?
না কি বদলে গেছে তার গতিপথ, হারিয়েছে যৌবন।
সে যাক- তবুও তো সে নদী!
বুকের কোঠরে জমে থাকা এক টুকরো ভালোবাসা।
খেয়াঘাটের সেই যে বুড়ো পাকুড় গাছটা-
বেঁচে আছে তো?
না কি গ্রাস করেছে লোভী প্রবঞ্চকেরা?
ওর শেকড়ে বাঁধা সারি সারি নৌকো,
নদী পার হয়ে চলে গেছি দূরে,
সকাল-দুপুর কেটেছে কত,
জলে, নদীর চরে!
সফেদ গাঙচিলেরা উড়ে গেছে মাথার উপর দিয়ে;
ভুলেই ছিলাম তারে, কতটা সময় বয়ে গেছে!
আরও আরও কত দিন, বছর–
দীর্ঘ একেকটা রাত,
দূরে আছি, যোজন যোজন দূর, ভালো আছি কি?
না, ওদের বলা হয়নি কিছুই,
আর সেই যে পথটা–
যার শেষটা আজও দেখা হলো না,
কেমন আছে সে?
কেমন আছে তার দু’ধারে অযত্নে বেড়ে ওঠা–
ঢোলকলমি, কলাবতী আর লজ্জাবতীর ঝোপ?
উচুণ্টি ও চোরকাঁটারা ঘুমিয়ে পড়েনি তো?
পথের ধারের শটিবনের সেই কড়া গন্ধ,
আজও ভেসে আসে কি?
নাগরিক মন আজ বড় ব্যস্ত,
ইট-কাঠ-পাথরের মাঝে বন্দী জীবন-
অরণ্যের গন্ধ খোঁজে, খুঁজে বেড়ায় সেইসব দিন;
পথের পরে’ ফেলে আসা দীর্ঘশ্বাসগুলো আরও গাঢ় হয়,
মাঝে মাঝে ডাক দিয়ে যায় নিঃসঙ্গ অতীত,
ভালোবাসা জমে আছে এই বুকের মাঝে,
জানানো হয়নি ওদের,
কী হবে- এসব অর্থহীন কথা শুনিয়ে?
এখন কিই-বা মূল্য আছে এসবের?
তারচেয়ে বরং ভুলেই থাকি, সে-ই ভালো।
………..
কীর্তনখোলার বাঁকে
………..
স্মৃতির দুয়ার খুলি– খুঁজে ফিরি আজো মনের গহীনে,
আজি হতে কত বর্ষা আগের ফেলে আসা দিনগুলি।
বুনোফুল ঘেরা মেঠোপথ– আর ফসলের মাঠে মাঠে,
দিন কাটাতাম হেলায় খেলায় কাকতাড়ুয়ার সাথে।
অলস প্রহর পেড়িয়ে যেত বট-শিমুলের ছায়ায়,
জড়িয়ে রাখত আমায় তখন কী এক নিবিড় মায়ায়!
গাঁয়ের পুকুরে উদাস দুপুরে- কচুরীপানার ভিড়ে,
ঘুঘু-ডাহুকের ডাকাডাকি আমায় রাখত ঘিরে।
ডানপিটে সব সাথিরা মিলে ধবল বকের ঝাঁকে,
হারিয়েছি মোর রাঙা শৈশব কীর্তনখোলার বাঁকে।
দিনের শেষে দিঘির পাড়ে সূর্য ডোবার ক্ষণে,
হারিয়ে যেতাম ঝিঁঝিঁপোকার সন্ধ্যা-রাতের গানে।
সাঁঝ বেলাতে ডাকত পাখি জুঁই-চামেলীর শাখে,
আঁধার হলে জমত খেলা জোনাক পোকার সাথে।
সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ততা আর হাজার কাজের ভিড়ে,
যখন তখন মন চলে যায় বাবুই পাখির নীড়ে।
…………..
রাত্রি তোমায় ভালোবাসি
…………..
আমি রাত্রির কোলে নিজেকে সঁপে দেই রোজ,
সঁপে দেই- আমার সমস্ত পাপ আর স্খলনের কাছে;
ঘুমহীন নিঃসঙ্গতাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে
দুর্জয় পাহাড়চূড়াকে ছুঁতে গিয়ে অদম্য সমুদ্রের স্রোত
উপেক্ষা করেছি; আবেগী ইচ্ছেদের দমন করে
নিরাভরণ শূন্যতায় ডুবতে ডুবতে
উৎসর্গের পেয়ালায় শেষ চুম্বন একে–
এক অমিয় প্রত্যাশার সৌধ গড়তে ছুটে গিয়েছি বারংবার,
ভুল ফাগুনে বিসর্জনের প্রহরে–
নিষিদ্ধ কবিতা পড়া হয়নি নক্ষত্রবিহীন তুমুল অন্ধকারে,
নৈঃশব্দের প্রাচীর ভেঙে উষ্ণতার খোঁজে
অচেনা আঁধারের সন্ধানে ছুটে গিয়েছি- নিষিদ্ধ বলয়ের বাইরে।
নিজেকে খোঁজার নিস্ফল প্রয়াসে আমি ঢুকে পড়ি-
প্রাগৈতিহাসিক সময়ের এক অন্ধকার গহŸরে।
অন্ধকারের যাত্রীরা আমার শবযাত্রায় সামিল হয়,
অদৃশ্য অশরীরী নীরব রাতের মধ্যপ্রহরে
পোষ্টমর্টেমে মেতে ওঠে যেন;
সীমানাহীন রাত্রি গড়ায়- ভোরের আয়োজনে,
রাত্রি আমায় ভাঙে-গড়ে, জীবম্মৃত সেই আমাকে,
প্রতিনিয়ত ব্যবচ্ছেদ করে আমার হৃদযন্ত্র, ফুসফুস;
আমি কাঁদি, আর ভেঙে পড়ি প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাসের মতো।
তবু অবলম্বন খুঁজি সেই রাত্রির মাঝেই,
এই রাত্রিই আমার একান্ত আশ্রয়; রাত্রি তোমায় ভালোবাসি।
………..
রক্তক্ষরণ
………..
সাগর সেচে মুক্তো আনবে বলে যে নাবিক
একদা নেমেছিল অথৈ নীলের জলে–
আজ সে ফিরে এসেছে, শূন্য হাতে;
সুখের পায়রা হয়ে একদিন যে সুখপাখি
হাতের তালুতে এসে বসেছিল —
আজ সেও উড়ে গেছে, মুক্ত আকাশ নীলে;
শুধু বুকে জমে আছে অভিশপ্ত স্মৃতির দহন।
সেবার ব্রত নিয়ে একদিন যে যোদ্ধা
শপথ নিয়েছিল আলোকবর্তিকা হবার–
আজ সে পথ হারিয়েছে, অন্ধকারের ডাকে;
একবুক স্বপ্ন নিয়ে একদিন যে মানুষ
পথে নেমেছিল জীবনের টানে–
আজ সেও থমকে দাঁড়িয়েছে, অনাকাঙ্ক্ষিত পরাজয়ে;
এখন মানবতার পায়ে কেবল পরাধীনতার শৃঙ্খল।
তপ্ত বৈশাখের অগ্নিবলয়ে আচ্ছন্ন বৈরি বাতাস,
মঙ্গল শোভাযাত্রায় কফিনের মিছিল শেষে
সবকিছু ভেঙ্গে পড়ে,
সভ্যতার বিসর্জনে শুধুই রক্তক্ষরণ;
বদলে যাওয়া এই সময়ে
এখন কেবলই মূল্যবোধের বেচাকেনা হয়।
………….
রাতজাগা পাখি
………….
আজ সকালে হিম কুয়াশার প্রাচীর ভেঙে
এক চিলতে রোদ্দুর হেসেছিল– আমাদের বারান্দায়,
আজ সকালে আকাশটা ভেসেছিল আবার– আলোর বন্যায়,
আর আমি সেই ভোরের নৈসর্গিক আলোয় স্নান শেষে দেখি-
তোমার মুখে ছায়া ফেলেছে লোভী সূর্য,
ওর নিরেট কোমল আলোর রেখা
কপাল-গাল ছুঁয়ে নেমে এসেছিল তোমার ঠোঁটে,
অকস্মাৎ এক অচেনা পোর্টেট হয়ে উঠেছিলে তুমি।
আজ সকালে একমুঠো সোনালি রোদ্দুর–
উঁকি দিয়েছিল আমাদের জানালায়,
কাঁচের শার্সিতে জমে থাকা শিশিরগুলো সব উবে গিয়েছিল তখন,
আমাদের বুকের মাঝে জমাটবাঁধা অভিমানগুলো-
মুছে দিতে সে হেসেছিল আরেকবার,
সে কি জানতো অভিমানী তোমাকে ছুঁয়ে দিয়েছিল বিরহী রাত?
তোমাকে নিমেষেই মানবী করে তুলেছিল আরেকবার।
কাল রাতে একমুঠো স্বপ্ন ভিড়েছিল– আমাদের উঠোনে,
কাল রাতে অপার্থিব এক আলোয় ভরে গিয়েছিল আমাদের ঘর,
রিনিঝিনি কাঁকনের সুরে স্বপ্নেরা পাখা মেলেছিল– নীল চাঁদোয়ায়,
আর আমি দু’হাতে স্বপ্ন সরিয়ে বাস্তবের ডিঙায় চড়েছিলাম কেবল,
ভুলে যাওয়া রাগিনীগুলো বেজে উঠেছিল নীরব রাতের প্রহরে,
কাল রাতে- তুমিও রাতজাগা পাখি হয়েছিলে আরেকবার।
…………..
এস এম জাকির হোসেন
কথাসাহিত্যিক ও কবি। জন্ম ১লা এপ্রিল, বরিশাল জেলার জাগুয়া গ্রামে। কীর্তনখোলার তীর ঘেঁষে সবুজ শ্যামল গ্রামীন পরিবেশে বেড়ে ওঠা। শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন ঢাকায় কাটালেও গ্রামের প্রতি রয়েছে তাঁর প্রগাঢ় আকর্ষণ। গাঁয়ের মেঠোপথ, সবুজ বনানী আর কীর্তনখোলার ধূ-ধূ বালুচরে পার করা শৈশবের দুরন্তপনার দিনগুলো সময় অসময়ে তাঁকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাইতো তাঁর লেখনিতে বারবার উঠে এসেছে গাঁয়ের কথা, নদীর কথা; বহুমাতৃক জীবনালেখ্য তথা গ্রামীন জনজীবনের গল্পগাঁথা।
লেখালেখিতে পছন্দের বিষয় গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও প্রবন্ধ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে– উপন্যাস ‘ধূসর গোধূলি’ (২০১৬), মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ‘একাত্তরের বিদেশি সুহৃদ: দুঃসময়ের সারথি’ (২০২২), উপন্যাস ‘ফেরা’ (২০২৩), গল্প সংকলন গ্রন্থ ‘নৈঃশব্দ্যের নিনাদ’ (২০২৩), উপন্যাস ‘চোরকুঠুরি’ (২০২৪) এবং গল্প সংকলন গ্রন্থ ‘নীল জোনাকির গল্প’ (২০২৪)। একক গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন সাহিত্য সংকলন গ্রন্থে তার বেশকিছু গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও ভ্রমণ কাহিনী স্থান পেয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা ও বাংলা ব্লগে লেখালেখি করছেন।
আগামিতে প্রকাশের তালিকায় রয়েছে আরও একাধিক গ্রন্থ– কিশোর উপন্যাস ‘নিঝুমপুরে একরাত্রি’, গল্প সংকলন গ্রন্থ ‘রূপালি ছায়াবীথি’, অণুকাব্য সংকলন ‘অনুপদী’, উপন্যাস ‘চোরকুঠুরি ২য় খণ্ড’ ও কাব্যগ্রন্থ ‘মগ্ন চৈতন্যের কাব্য’। ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে লেখক একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে দীর্ঘদিন চাকুরিরত ছিলেন। বর্তমানে নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনার কাজে নিয়োজিত।