spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধনিষ্পেষিত মানুষের মুক্তির পয়গাম আবদুল হাই শিকদারের কবিতা

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

নিষ্পেষিত মানুষের মুক্তির পয়গাম আবদুল হাই শিকদারের কবিতা

আবু তাহের সরফরাজ

সত্তরের দশকের কবিতার ভাষাভঙ্গি ও রূপ-বৈচিত্র্য বদলে নেয়ার প্রচেষ্টা দেখা যায় আশির দশকের কবিতায়। এই প্রচেষ্টা যে কবিদের সচেতন প্রয়াস, তা কিন্তু নয়। সময়ের সাথে-সাথে যাপিত জীবনের বাস্তবতা বদলে যায়। বদলে যায় সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ধরণ। এসবের অভিঘাত এসে পড়ে কবিতায়। আবার কোনো কোনো কবি স্বকীয় কাব্যবৈশিষ্ট্য নির্মাণে সচেষ্ট হন। এরই কৌশল হিসেবে সেসব কবি আগের দশকের কবিতার বলয় ভেঙে ভিন্ন আঙ্গিকে কবিতার শরীর নির্মাণে কুশলী হয়ে ওঠেন।
সত্তরের দশকটি ছিল উত্তুঙ্গ সময়। ওই সময়ের কবিতা গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে সময়ের ছাপচিত্র হয়ে ওঠে। সাধারণ পাঠকের খুব আন্তরিক হয়ে উঠতে প্রতিদিনের ব্যবহৃত পরিচিত ভাষায় ওই সময়ে কবিতা লেখা হয়। শব্দের কোষ্ঠকাঠিন্যে কবিতাকে ভার-আক্রান্ত করে তোলেননি ওই দশকের কবিরা। কল্পনাপ্রসূত নয়, বাস্তবতার নিবিড় আলিঙ্গনই ছিল সত্তরের কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যকে অনেক কবিতা-সমালোচক অকবিতা হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। তারা বলতে চান, সেই সময়ে কবিতার ভাষা ছিল স্লোগানধর্মী দেয়াল-লিখনের ভাষা। অবশ্যি এহেন তকমা যারা এঁটে দেন কবি হিসেবে তারা নামিদামি হলেও তাদের কবিতার বিষয়বস্তু পাঠকের মাথার ওপর দিয়ে যায়। কবিতার স্বরূপ বিষয়ে তারা কী কী যেন বলেন, সেসব কথাও পাঠকের মাথার ওপর দিয়ে যায়। তবে গণমাধ্যমের প্রচারণায় কবি হিসেবে তারা পরিচিত হয়ে উঠেছেন। গণমাধ্যম কী স্বার্থে গুটি কতক কবিকেই বারবার প্রচার করে, সেই গূঢ় দূরাভিসন্ধি সাহিত্যঘনিষ্ঠ পাঠক মাত্রই জানেন।
আশির দশকে কবিতার যে ভিন্ন আঙ্গিক আমাদের চোখে পড়ে তা মূলত ছোটকাগজ কেন্দ্রিক আন্দোলনের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ে। দেখা যায়, এই দশকে যাপিত সময়ের বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে অন্তর্জগতের বিচিত্র রূপ ও ভাষ্য কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে। আবার কারো কারো কবিতায় সময়ের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। আবদুল হাই শিকদার এদের অন্যতম। তার কবিতা সহজ ও প্রাঞ্জল। বোধের অতলান্তিক গহ্বরে ডুব দিয়েও তার কবিতায় আবহমান বাংলার ঐতিহ্য আমাদের মুগ্ধ করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা ধারণ করে শিকদারের কবিতা গণমানুষের কবিতা হয়ে ওঠে। যে সমাজ-বাস্তবতায় তার শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত হয় সেই সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এরপর দেখা দেয় সেনা-অভ্যুত্থান, গুম-খুন ও স্বৈরশাসন। সবচেয়ে বড় কথা সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে এদেশে বারবার খর্ব করা হয়েছে। গণতন্ত্রের ওপর একের পর এক আঘাত এসেছে শাসকগোষ্ঠির পক্ষ থেকে। আবদুল হাই শিকদার সমাজ ও রাষ্ট্রের এহেন বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে কেবল ‘শিল্পের জন্যই শিল্প’ চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেননি। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি তিনি দায় অনুভব করেছেন। তার সংবেদি হৃদয় কাতর হয়ে উঠেছে শাসকের অত্যাচারী থাবার নিচে জাতিকে নিষ্পেষিত হতে দেখে। এটা হতেই পারে। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে উৎখাতে ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের সময় অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে এসব কবিতায় শব্দের বাড়বাড়ন্ত উচ্ছ্বাস নেই। আছে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের ইস্পাতদৃঢ় অঙ্গীকার। যে কবি কবিতায় কল্পনাপ্রসূত জগতে নিরন্তর পর্যটন করেন এই সময়ে তার কলম থেকেও গণমানুষের ভাষায় কবিতা লেখা হয়েছে। এটাই সময়ের প্রয়োজনে শিল্পের তাড়না। শিকদারের অন্তর্দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী। তাই তিনি বিশেষ সময়েই কবিতার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান না, তিনি সারা জীবনই জাতীয় উন্মেষের অপেক্ষায় আছেন। তাই তো তার কবিতায় বাংলার শ্যামলি নিসর্গ যেমন আমরা দেখতে পাই, একইসঙ্গে শাসকের জিঞ্জির ভেঙে গণমানুষের মুক্তির আর্তনাদ ধ্বনিত হতে শোনা যায়।
আশির দশকে এসেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উত্তুঙ্গ সময় পার করে। আগের দশকে দেশ স্বাধীন হয়। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের মৃত্যু-উপত্যকায় ঘুরে দেশের মানুষ ঘরে ফিরে এলো। প্রিয়জনের সান্নিধ্যে এসে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে নিতে ভাবলো, এবার নিশ্চয়ই আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাবো। কিন্তু দেশের মানুষ তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা নিয়ে দেখতে পেল, আশির দশকে এসেও দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো না। বরং রাজনৈতিকভাবে দেশে বিরাজ করতে লাগলো চরম অস্থিতিশীলতা। সামরিক অভ্যুত্থান, স্বৈরতন্ত্রের দুঃশাসন, রাজনীতিবিদদের দল-বদল, ছাত্র-আন্দোলন— সবমিলে আমাদের জাতীয় জীবনকে করে তোলে নৈরাজ্যবাদী। নিরাশার আঁধারে জাতি গণতন্ত্রকে হারিয়ে মুক্তির নতুন সূর্যের অপেক্ষা করতে থাকে। রাজপথে আন্দোলনে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত স্লোগান দিতে থাকে। পুলিশি নির্যাতনে বইতে থাকে রক্তনদীর ধারা। বাংলার নরম মাটি ভিজে ওঠে মুক্তিকামী মানুষের আত্মত্যাগে। যাপিত সময়ের এই বাস্তবতায় আবদুল হাই শিকদার কল্পনার রথে চড়ে তার কবিতাকে শিল্পরূপ দিতে চাননি। বরং দেশপ্রেমের প্রগাঢ় অনুভূতি থেকেই তিনি কবিতার নিশান উড়িয়ে বাংলার মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। দেশ ও মানুষের প্রতি তার এই উপলব্ধিবোধ তৈরি হয় তার শৈশবেই। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাহচর্যে তার শৈশব ও কৈশোরের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত হয়। ভাসাসীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা শৈশবেই তার ভেতর সংক্রমিত হয়। ভাসানীর কাছ থেকেই শিকদার পাঠ নেন দেশপ্রেমের। মূলত এ কারণেই আশির দশকের আরসব কবি থেকে শিকদারের কাব্যযাত্রার ভিন্নতা আমাদের চোখে পড়ে। শিকদার লিখেছেন, ‘দেশান্তরী যে হতে চায় হোক/আমি তো ভাই বাংলাদেশের লোক।’ তিনি বাংলাদেশের লোক বলেই দেশ ও দেশের মানুষের প্রতিনিধি হয়ে শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে উচ্চকিত কণ্ঠ তোলেন। লিখে চলেন একের পর এক কবিতা। তার এই শিল্পপ্রচেষ্টা কাঁপিয়ে তোলে অত্যাচারীর ভিত। ১৯৯৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন। ভাগ্য তার পক্ষে থাকায় তিনি প্রাণ নিয়ে বেঁচে ওঠেন। এরপরও নিজের শিল্পসত্তাকে তিনি ঘাতকের প্রলোভনে বিকিয়ে দেননি। বরং তার আত্মা এই বলে কেঁদে ওঠে যে, ‘এই বধ্যভূমি একদিন স্বদেশ ছিল’। নিজের দেশকে চোখের সামনে বধ্যভূমিক হতে দেখে যে কাতরতা শিকদারকে মূহ্যমান করে তোলে, সেই কাতরতা দরদি কবির পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব।

আমাদের পাছার নিচে সংসদীয় গণতন্ত্রের পোঁতা পেরেক,
আকাশের বদলে তাদেরই টানানো কালো পর্দা।
— আর দেখবার কিছু নেই।

চারদিকে উৎকট গন্ধের কোলাহলে
এখন টেবিলে টেবিলে পরিবেশিত হচ্ছে তাদেরই পাপ।
—এই পাপ উদরপূর্তি করে খেতে হবে।

ভাইসব ভায়েরা আমার,
এই হচ্ছে সেই স্থান,
—আর আমরা চলেছি।
পেরেক পদ্য

সহজ শব্দের বুননে সহজ কয়েকটি কথা। বাংলাদেশের যাপিত বাস্তবতার রক্তাক্ত চিত্র। কবিতার এই বৈশিষ্ট্যই মূলত শিকদারকে আশির আরসব কবিদের থেকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। ভাষারীতির সঙ্গে আছে মাটিঘেঁষা মানুষের অধিকারের কথা। ফলে শিকদারের কবিতা মানেই সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার স্ফুরণ। প্রাণের জাগরণ। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রচলিত। রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে (বেশির ভাগ ক্ষেত্রই ভোটচুরির মাধ্যমে) সংসদে অধিষ্ঠিত হয়। এরপর দেশ শাসনের নামে তারা জনগণকে শোষণ করতে শুরু করে। চলে লুটপাট। ক্ষমতার কর্তৃত্ব নিরাপদ রাখতে দেশজুড়ে রাজনৈতিক দলটির পোষ্যবাহিনী থাকে। সরকারি ছত্রছায়ায় এই পোষ্যবাহিনী নানা উপায়ে নির্বিচারে লুটপাট চালাতে থাকে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, দেশটা ওই রাজনৈতিক দলের। দলটির বাইরে যারা এই দেশে বসবাস করে তাদের কোনো অধিকার এই দেশে নেই। এটাই সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশে। লুটপাট ও দুর্নীতির এই পরিবেশে বসবাস করে আবদুল হাই শিকদার প্রতিমুহূর্তে পীড়িত হন। দেশবাসীর মর্মন্তুদ আর্তনাদ তার কানে ধ্বনিত হতে থাকে। তিনি তাই কবিতাকে শোষকের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। কল্পনার ফানুস উড়িয়ে পাঠককে বাস্তবতা থেকে শিল্পের প্রতি-বাস্তবতায় নিয়ে যেতে তিনি আগ্রহী নন। যাপিত বাস্তবতাকেই তিনি কল্যাণময় ও সমৃদ্ধ করতে সচেষ্ট।

তোমার ভিতরে আজ ঘুম নেই বাংলাদেশ,
কেবল ঘুমের জন্য বোবা হাহাকার মাথা কুটে মরে সর্বত্র
তুমি অস্থির তুমি ব্যাকুল তুমি উন্মত্ত।
শিকড় থেকে ক্রমাগত আলগা হয়ে যাচ্ছে মাটি।
টালমাটাল অস্তিত্ব থর থর কেঁপে উঠছে।
ভয়ঙ্করভাবে বিস্ফোরিত তোমার দু’চোখ বেয়ে নামছে অবিরত রক্তের ধারা।

রাজনৈতিক শোষণ-পীড়নে কোণঠাসা দেশের মানুষ। এরপরও প্রতিরোধের ঐক্য তারা গড়ে তুলতে পারে না। নিষ্পেষিত হয়েও তারা ঘুমন্তের মতো নিরীহ জীবনযাপন করে। কিন্তু শোষকের অত্যাচারে জর্জরিত দেশমাতৃকা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ছটফট করতে থাকে। একাত্তরে অনেক রক্তের বিনিময়ে যে জননীকে আমরা পেয়েছিলাম, সেই জননীর বুক থেকে শেকড় উপড়ে আলগা হয়ে যাচ্ছে মাটি। থরথর কেঁপে উঠছে বাংলাদেশ। শোষকের প্রতি ঘৃণায় আর ক্ষোভে জননীর বিস্ফোরিত দুই চোখে নামছে রক্তের ধারা। শিকদারের কবিতায় এই যে বর্ণনা আমরা পাচ্ছি সেটা তো আমাদের অস্তিত্বের বাস্তবতা। বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে কবিতাকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে শিল্প হিসেবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা শিকদার করেননি। এই মর্মে বলা যেতে পারে, সত্তর দশকের কবিতার ধারাবাহিকতা শিকদারের কবিতায় লক্ষণীয়। এই বৈশিষ্ট্যকে যারা ‘অকিবতা’র অনুষঙ্গ হিসেবে দেখেন সেসব সমালোচক পাঠকঘনিষ্ঠ শিল্পচর্চাকে গুরুত্ব দেন না। তারা আসলে পাঠকের ওপর কবিতা কিংবা যে কোনো শিল্পের স্বরূপ আরোপ করতে চেষ্টা করেন। এরা আসলে বিশেষ ফিকির নিয়েই এই চেষ্টা করেন। এসব সমালোচক সাহিত্যে সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে চান। যেহেতু তারা জানেন তাদের লেখা কবিতা শিল্প হয়ে ওঠে না, ফলে সিন্ডিকেট তৈরি করে তারা নিজেদের নামটি জারি রাখতে চান। সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক ছাড়া সাধারণ পাঠক তাদের এই কূটকৌশল ধরতে পারেন না।
কবিতায় রাজনৈতিক অভিঘাত কেন থাকবে না? কবিতা কি রাজনীতির বাইরে? কবিতা কি কেবলই ফুলপাখিলতাপাতা আর আমিতুমি-তুমিআমি বলয়ে বন্দি? তা তো নয়। কবিতা সর্বগ্রাসী। কবিতা সবকিছুকেই শিল্পের মোড়কে সুশৃঙ্খল শব্দের বুননে ধারণ করতে পারে। সময়ের প্রয়োজনেই কবিতা কখনো হয়ে ওঠে গণমানুষের হাতিয়ার, আবার কখনো বোধের আমলনামা। চোখের সামনে শোষিত মানুষের আর্তনাদ দেখতে দেখতে যে কবি প্রেমিকার সৌন্দর্য নিয়ে কবিতা লেখেন সেই কবির মানবিক সত্তা প্রশ্নবিদ্ধ। আবার এও সত্যি, কবির অন্তর্জগতে কখন কী অভিঘাত সৃষ্টি হবে তা আগে থেকে বলে দেয়া মুশকিল। কবিতা যেহেতু ইশারা-ভাষ্যে নির্মিত হয় সেহেতু কবিতার ভাববৈচিত্র্য নানা রূপেই চিত্রিত হতে পারে। শিকদার কি কেবলই দেশ ও দেশের মানুষের জন্যই কবিতা লিখেছেন? তা কিন্তু নয়। আরও নানা বিষয়ে তার লেখা কবিতা আমাদের চোখে পড়ে। সেই রকম একটি কবিতা ‘নির্মাণকলা’।

বিয়ের রাতে বউকে বললাম,
দেখো আমার কিন্তু কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই,
মানে এই মানে নেই আর কি।
কথা শুনে বউ বিছানায় ছড়িয়ে দিল
এক হাজার একশত একটি আলিফ লাইলা,
—তোমার কি ধারণা আমার সয়েল টেস্ট
আগেই হয়ে গেছে?
তারপর আমরা দুজন মিলে
বানিয়ে ফেললাম একটা বাড়ি।
নির্মাণকলা

বাসর ঘরে স্বামী স্ত্রীকে বলছে যৌনতার কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা তার নেই। এটা শুনে স্ত্রী বিছানায় ছড়িয়ে দিল এক হাজার একশো একটি আলিফ লাইলা। আরব্য রজনীর সেই কাহিনি আমরা সকলেই জানি। প্রতি রাত্রে নতুন কাহিনি শুরু হতো। কাহিনি শেষ হতো ভোররাতে। আবার পরের রাত্রি আরেক কাহিনি। এভাবেই চলতে থাকে দীর্ঘ কাহিনিকথন। কিন্তু এই কবিতায় বিছানায় বউটি যে আলিফ লাইলা ছড়িয়ে দিল সেটা আসলে দাম্পত্যের রহস্যময় চাঁদর। দাম্পত্য নারী-পুরুষের দীর্ঘ জীবনযাত্রার সরণি। এই যাত্রা একইসঙ্গে দীর্ঘ ও রহস্যময়। একজন আরেকজনকে বোঝাবুঝির শেষে স্বামী-স্ত্রী একসাথে সংসার যাত্রা আরম্ভ করলো। এই হচ্ছে কবিতার আদ্যপান্ত। সাদামাটা একটি কবিতা, অথচ গূঢ়ার্থ কী গভীর! দাম্পত্য-দর্শন এই কবিতায় শিল্প-সুষমায় পাঠককে মুগ্ধ করে। তবে শিকদারের মূল্য লক্ষ্য পাঠককে মুগ্ধ করা নয়, বাংলার সার্বভৌমত্ব ও সংস্কৃতির প্রতি দেশের মানুষকে সচেতন করা। কবিতার মধ্য দিয়েই তিনি এ কাজটি করে চলেন নিষ্ঠার সঙ্গে। বলা দরকার, মানবতাবাদী আবদুল হাই শিকদারের মানবপ্রীতি কেবল দেশের মাটিতেই আবদ্ধ নয়, তিনি গোটা বিশ্বকেই পরম আদরে মাতৃভূমির মর্যাদা দিয়েছেন। সকল মানুষের অধিকার রক্ষায় তার কবিতা ঝলসে উঠেছে শব্দরূপ অগ্নিস্ফুলিঙ্গে। তিনি লিখছেন:

আর যদি দেখি মানুষ মানুষকে শোষণ করছে
আর যদি শুনি মানুষ অনাহারে মরছে
তাহলে পৃথিবীকে ধিক্কার।

ওপরের পঙক্তি থেকেই বোঝা যায়, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আবদুল হাই শিকদার শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। বিশ্বেও যে প্রান্তেই মানবতা লঙ্ঘিত হবে সেই প্রান্তেই শিকদারের কবিতা নিগৃহীত মানুষের নিশান হয়ে উড়বে। সুতরাং বলা চলে, শিকদারের কবিতা নিষ্পেষিত মানুষের মুক্তির পয়গাম। তার কবিতার বইগুলোর শিরোনাম পড়লে এই কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। আশি লক্ষ ভোর (১৯৮৯), আগুন আমার ভাই (১৯৯১), রেলিঙ ধরা নদী (১৯৯২), যুগল বন্দি ভূগোলময়, মানব বিজয় কাব্য (১৯৯২), এই বধ্যভূমি একদিন স্বদেশ ছিল (১৯৯৮)। মানবাত্মার মর্মমূলে পৌঁছে শিকদার কবিতার মধ্য দিয়ে মানুষেই জয়গান গেয়েছেন। মানুষ হিসেবে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক সংগ্রামই শিকদারের শিল্প-সংগ্রাম। আর তাই পাঠকদের তিনি আহ্বান জানাচ্ছেন:

আসুন ঘৃণা ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে
আসুন বারুদ ও রক্তপাতের বিরুদ্ধে
আসুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে
আমরা সবাই দাঁড়িয়ে যাই
যেভাবে ইউরোপীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন
গাজী সালাহউদ্দিন
আর আমাদের প্রতিটি কবিতা অর্জন করুক আশ্চর্য দ্যুতি।

সাম্রাজ্যবাদী কিংবা সংসদীয় গণতান্ত্রিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পাঠককে ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করছেন আবদুল হাই শিকদার। তার ভাষ্য, যে কবিতা অন্যায়ের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হয়ে উঠবে সেই কবিতা থেকে আশ্চর্য দ্যুতি বিচ্ছুরিত হবে। কবিতাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করার দুঃসাহস কেবল শিকদারের পক্ষেই সম্ভব। কেননা, তার কবিতা গণমানুষের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠলেও কবিতার কোত্থাও শিল্প-সৌন্দর্য সামান্য ম্লান হয়নি। বংর পাঠক হিসেবে আমরা তার কবিতা পড়ে উজ্জীবিত হয়ে উঠি। কবিতার এই ধারা আমাদের মনে করিয়ে দেয় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাকে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নজরুলের কবিতা এখনো আমাদের রক্তে আগুন ছুটিয়ে দেয়। সাম্প্রতিক শেখ হাসিনার উৎখাতে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়ে গেল এই আন্দোলনে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি আন্দোলনকারীদেরকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল। আন্দোলনের ভিডিও ফুটেজে গানটির ব্যবহার আমরা দেখেছি। শিল্পোৎকৃষ্ট কবিতার সার্থকতা এখানেই। দেখতে পাচ্ছি, নজরুলের দেখানো পথেই কাব্যচর্চা করে চলেছেন আশির দশকের মেধাবী কবি আবদুল হাই শিকদার। তিনি অবশ্যি ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্যচর্চা করে আসছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ডিগ্রি অর্জন করার পর কর্মজীবন শুরু করেন সাংবাদিকতা দিয়ে। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, গবেষণা ও সম্পাদনা মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা নব্বইয়ের বেশি। কবি নজরুলের বিষয়ে শিকদারের ব্যাপক কৌতূহল। প্রচুর গবেষণা করেছেন নজরুলকে নিয়ে। সেসব গবেষণা বই আকারে প্রকাশও করেছেন। বিদ্রোহী কবির প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা থেকেই তিনি নজরুল ইন্সটিটিউটের দায়িত্ব পালন করেছেন। নজরুল সংক্রান্ত তিনটি তথ্যচিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনা করেছেন। নজরুলের মতোই মানুষের প্রতি দরদি কবি আবদুল হাই শিকদার। আল্লাহ-প্রেমিক কবি। আল্লাহর বিধানের কাছে আত্ম-সমর্পণ করে শিকদারের বিনীত উচ্চারণ:

জানি একদিন একটা চিঠি পাবো আমি
খুব ঘন নীল প্রিয়দর্শিনীর লীলায়িত ভঙ্গির মতো
পৃথিবীর সাময়িক ভ্যানগুলোকে বোকা বানিয়ে আমাদের
উদ্ধার করে নিয়ে যাবে।
আজকের জীবনের সমস্ত গ্লানি অন্ধকার
আর টুকরো টুকরো মৃত্যুও অনেক ওপারে
সেদিন কোথাও কোনো দুঃখ থাকবে না।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ