আহমদ মতিউর রহমান
সাহিত্যে সাধারণ মানুষের কথা আনা, দ্রোহ-বিদ্রোহ প্রতিবাদ নিয়ে আসার কাজটি কাজী নজরুল ইসলাম করতে পেরেছেন সফলভাবে। তাই তিনি শুধু বাংলা ভাষার নন উপমহাদেশেরও একজন তুলনারহিত কবি ও লেখক। দেশ নেতারা যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন সেখানে নজরুল মনুষ্যত্বের ঝাণ্ডা উঁচু করে ধরেছেন। তার এ কাজ এ সংগ্রাম ও বিদ্রোহ বৃথা যায়নি। তার ফল এ মাটিতেই ফলেছে। যে কোন বিচারে তিনি যুগান্তকারী একজন মহান লেখক ও সাধক। নজরুল কবি হিসাবেই আমাদের কাছে সমধিক খ্যাত। সাহিত্যের আদিম ও সমৃদ্ধ শাখা হলো কবিতা। এর ফলে এ নাম। কিন্তু তিনি শুধু কবিতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি সাহিত্যের আন্যান্য শাখায়ও পদচারণা করেছেন। নজরুলের এসব রচনাবলীর মাঝে আছে– গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, কথিকা, সম্পাদকীয়, পত্র-সাহিত্য ও অভিভাষণ। গবেষকদের মতে কবি নজরুলের কবিতা ও গদ্যসাহিত্য সৃষ্টি সংখার দিক দিয়ে প্রায় সমান। নজরুলের ৪২ টি কাব্য গ্রন্থের পাশাপাশি ৪১ টি গদ্য গ্রন্থ রয়েছে।
বাংলা কথা সাহিত্যের ইতিহাসে নানা পর্যায় গেছে। অনেক কথা সাহিত্যিক কবিতা লেখা দিয়ে শুরু করেন। কিন্তু পরে হয়েছেন নামকরা কথা সাহিত্যিক। নজরুলের জীবনেও এ রকমটা দেখা যায়। তিনি কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও শুরু করেন গদ্য দিয়ে। নজরুলের প্রথম দিককার কবিতার চেয়ে গল্প বেশি জনপ্রিয় ছিল। তাঁর প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে মে মাসের ‘সওগাত’ পত্রিকায় ছাপা হয়। তবে কথা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুলের সৃষ্টিগুলো ভাল অবস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে এমনটা বলা যাবে না। এ বিষয়ে আলোচনা পর্যালোচনা গবেষণা কম। অনার্স মাস্টার্সেও নজরুলের সাহিত্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পড়ানো হয় না বলে অভিযোগ। ফলে অনেক দিক অনালোচিত থেকে গেছে।
বাংলা সাহিত্যে নজরুলের পদচারণে অসাধারণ, যা বিস্ময়ের উদ্রেক করে, তার অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে অনবদ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে। বাংলা সাহিত্য চিরঋণী তার কাছে। যদি তার বিদ্রোহের দিকটা আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই তিনি বুলবুল, তার কণ্ঠ সুমধুর। তিনি শুধু গান গেয়ে যান গানের পাখির মতো অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ নিপীড়ন ও মানব-বৈষম্যের বিরুদ্ধে। ১৯২৭ সালে এক সাহিত্য সভায় তিনি ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভণ্ডামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।’ নজরুলের সাহিত্যে কঠোরতা আর কোমলতার অসাধারণ মিশ্রণ ঘটেছে। তার কাব্যে উচ্চারিত হয়েছে সাম্য আর মৈত্রীর বাণী। সমাজের উঁচু-নিচু সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি । সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-প্রীতি, বিরহ-মিলন মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে।
২.
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে নজরুলের রচনা সম্ভারের একটু উল্লেখ করে নিই। কবিতার অঙ্গনে বিপুল কাজ করেছেন তিনি। এর বাইরে নজরুল ৩ টি উপন্যাস ও অসংখ্য গল্প লিখেছেন। তার লেখা উল্লেখযোগ্য গল্প হলো– রিক্তের বেদন, ব্যথার দান, মৃত্য ক্ষুধা, পদ্ম গোখরো, অগ্নিগিরি, জিনের বাদশা, শিউলি মালা ইত্যাদি। নাটক, নাটিকা ও গীতি-বিচিত্রার মাঝে– মধুবালা, ভূতের ভয়, ঈদ, বিজয়া, শ্রীমন্ত, গুল-বাগিচা, বিদ্যাপতি, বাসন্তিকা, বাঙালি ঘরে হিন্দী গান, জন্মাষ্টমী, সাপুড়ে, বনের বেদে, লাইলী মজনু ইত্যাদি। প্রবন্ধ গ্রন্থ– যুগবাণী, রাজবন্দীর জবানবন্দী, দুর্দিনের যাত্রী, রুদ্র মঙ্গল ও ধুমকেতু।
নজরুলের প্রথম গদ্য রচনা ছিল “বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী”। ১৯১৯ সালের মে মাসে এটি ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচি সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেছিলেন। এখান থেকেই মূলত তার সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটেছিল। এখানে বসেই বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে: “হেনা”, “ব্যথার দান”, “মেহের নেগার”, “ঘুমের ঘোরে”। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় যার নাম ‘ব্যথার দান’– এছাড়া একই বছর প্রবন্ধ-সংকলন ‘যুগবাণী’ প্রকাশিত হয়। এটি নজরুলের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। এই গ্রন্থের গল্পগুলোর ভাষা আবেগাশ্রয়ী, বক্তব্য নরনারীর প্রেমকেন্দ্রিক। ‘রিক্তের বেদন’ : পৌষ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ ১২ই জানুয়ারি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ মোট ৮টি গল্প আছে এতে। নজরুলের প্রথম উপন্যাস ‘বাঁধন হারা’ আগস্ট ১৯২৭ এ প্রকাশিত হয়। এটি একটি পত্রোপন্যাস। ‘কুহেলিকা’ তার সর্বশেষ উপন্যাস, এটি ১৩৩৪ (১৯২৭) সালে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে এটি ‘নওরোজ’ পত্রিকার পাঁচটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল । ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক নওরোজ পত্রিকায় “কুহেলিকা” উপন্যাসের প্রথম অংশ প্রকাশিত হয়। তার কিছুদিন পর নওরোজ বন্ধ হয়ে গেলে সওগাত পত্রিকায় তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯৩১ সালে এটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
৩.
নজরুলের “মৃত্যুক্ষুধা” উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালে। উপন্যাসটি ‘সওগাত’ পত্রিকায় ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাস থেকে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাস পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে মুদ্রিত হয়। সমালোচকদের মতে “মৃত্যুক্ষুধা“ কাজী নজরুলের ইসলামের ‘কালজয়ী’ উপন্যাস। বলা হয়েছে এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সাম্যবাদী চেতনার উপন্যাস।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৬ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এ সময় ৪৯ বাঙালি পল্টনে হাবিলদার হিসাবে কর্মরত অবস্থায় তিনি প্রকাশ করেন ‘বাউণ্ডুলের আত্মকথা’। এটি একটি আত্মজৈবনিক উপাখ্যান। ১৯১৯-২০ পর্বে প্রকাশিত হয় ‘ব্যথার দান’ ও ‘রিক্তের বেদন’ গ্রন্থ দুটির গল্পগুলি। অনেক পরে প্রকাশিত হয় চারটি গল্প নিয়ে ‘শিউলিমালা’ এবং ‘বনের পাপিয়া’। ‘রাজবন্দীর চিঠির পত্রের আকারে একটি কাহিনী।
“মৃত্যুক্ষুধা” কবি নজরুলের কাহিনী বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত। ১৯২৬ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত নজরুল পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে বাস করতেন। এখানকার চাঁদসড়কের পাশে বিরাট চত্বরওয়ালা একতলা গ্রেস কটেজে তিনি অবস্থান করতেন। “মৃত্যুক্ষুধা” উপন্যাসের পটভূমিতে রয়েছে ঐ বাড়ি, ওমান কাথলি পাড়া এবং কলতলার পারিপার্শ্বিকতা।
উপন্যাসটির প্রথমাংশ কৃষ্ণনগরে এবং শেষাংশ কলকাতায় অবস্থানকালে লিখিত। কৃষ্ণনগরের সংক্ষিপ্ত জীবনে নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট এবং দুঃসাধ্য কৃচ্ছ্রসাধন ছিল কবি নজরুলের নিত্যসঙ্গী। তাই দারিদ্রের চিত্র, সাম্য ও বিপ্লবীচেতনা এ উপন্যাসের রূপকল্পের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ। তৎকালিন দারিদ্র্য, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে কাহিনীর বিকাশ। উপন্যাসের পটভূমি কৃষ্ণনগরের চাঁদসড়কের বস্তি এলাকা। এ এলাকায় বাস করে একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবার। এ পরিবারে আছে রোগগ্রস্ত বৃদ্ধ মা, তিন পুত্রবধূ যাদের সকলেই বিধবা, আর তাদের সন্তানাদি। আর আছে তিন পুত্রবধূর একমাত্র দেবর প্যাঁকালে। সে সদ্য যুবক। বয়স আঠারো-উনিশ। পরিবারের লোক সংখ্যা অনেক। সবার ভরণপোষণের ভার প্যাঁকালের ওপর ন্যস্ত। কুর্শি খ্রিষ্টান হলেও প্যাঁকালের ভালোবাসার জন্য ব্যাকুল। সেজন্য বিধবা-রূপসী ভ্রাতৃজায়া মেজ-বউয়ের বিয়ের প্রস্তাব তার কাছে অতি তুচ্ছ। কুর্শিকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় প্যাঁকালে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। সপরিবার মেজ-বৌয়ের মুসলিম থেকে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ। অন্যদিকে রুবি আনসারকে ভালোবাসলেও রুবির পিতা তাকে বিয়ে দেয় আইসিএস পরীক্ষার্থী মোয়াজ্জেমের সঙ্গে । এমন একটি প্রেমের কাহিনী।
মোয়াজ্জেমের মৃত্যুর পর বিধবা রুবির জীবনে নেমে আসে সমাজের সকল বিধিনিষেধ। নারী জীবনের দুর্বিষহ অন্ধকার এবং সমাজের বাস্তবচিত্র এই উপন্যাসে তুলে ধরা হয়। এর পর শুরু হয় আনসার ও রুবির পর্ব। দেশপ্রেমিক সমাজকর্মী ও সংসার-বিরাগী আনসার এসে আশ্রয় গ্রহণ করে লতিফা ওরফে বুচির বাসায়। লতিফার স্বামী স্থানীয় কোর্টের নাজির। পরে কৃষ্ণনগরের জেলা-ম্যাজিস্ট্রেটের তরুণী কন্যা সদ্য-বিধবা রুবির সঙ্গে শৈশব প্রণয়ের স্মৃতি আনসারের মনে উদয় হয়। যদিও রুবি-আনসারের পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটেছে উপন্যাসের শেষাংশে। মাঝখানে কয়েক বছর দু’জনের সাক্ষাৎ হয়নি। কারণ রুবির অমতে তার বিয়ে হয়েছিল অর্থলোভী এক যুবকের সঙ্গে। তাদের সংসার টিকে ছিল মাত্র এক মাস। বাইরের সাজসজ্জা ও আচরণ রুবির বিধবাসুলভ হলেও মনে প্রাণে সে আনসারকেই স্বামী বলে মানে। আনসার রাজবন্দি হয়ে রেঙ্গুন চলে যায়, সেখানে ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হবার আশায় ওয়ালটেয়ারে যায়। এ সংবাদ শোনামাত্র অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে যাত্রা করে রুবি।
৪.
উপন্যাসে যেসব চরিত্র সন্নিবেশিত হয়েছে সেই সব চরিত্রের একেবারে কাছাকাছি ছিলেন লেখক ঔপন্যাসিক কাজী নজরুল ইসলাম। কথাসাহিত্যিক হিসেবে তার জীবন দৃষ্টি ছিল অসাধারণ। সাধারণ মানুষের নৈকট্য, তাদের প্রতিদিনের জীবন ও ঘটনাপ্রবাহ সরাসরি প্রত্যক্ষ করা লেখক নিজের সৃজন শক্তির মিলিত সম্পদে তৈরি করেছেন উপন্যাসের সুনির্দিষ্ট গতিপথ, চরিত্রগুলোও আপন বৈশিষ্ট্যে ঘটনার পালাক্রমে এগিয়ে যাওয়া। সবশেষে অনিবার্য পরিণতি টেনে আনতে শৈল্পিক আর মনোজাগতিক প্রভাবকেও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখেছেন। সব থেকে বেশি দায়বদ্ধতা ছিল প্রচলিত ব্যবস্থার সঙ্গে চরিত্রগুলোর অন্তর্নিহিত বিরোধ আর উদ্ভূত সঙ্কট স্পষ্ট করা।
মনে রাখতে হবে এগুলো নজরুলের প্রথম দিককার রচনা। তখন তার আবেগ ছিল কাঁচা। তারপরও তিনি নিবিষ্ট মনে কাহিনি বর্ণনের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমান চরিত্রের সমাহার ঘটিয়েছেন তা এক কথায় অসাধারণ। বাঙালি মুসলমান কথা সাহিত্যিকরা তখনো নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সময়ে তার এই অসামান্য উদ্যোগ বাংলা কথাসাহিত্যের গতি পথকে উচ্চকিত করেছে এ কথা নিসন্দেহে বলা যায়। তার জীবন দৃষ্টি আর সমাজভাবনা ফুটে উঠেছে তার কথাসাহিত্যে। এগুলোর পঠন পাঠন ও আলোচনা পর্যালোচনার আরো অবকাশ রয়েছে বৈকি।