spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাক্ষাৎকারসাক্ষাৎকার : ওমর বিশ্বাস

গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব

সাক্ষাৎকার : ওমর বিশ্বাস

১.জীবন কি? আপনার বর্তমান জীবন, অবস্থান– যা হতে চেয়েছিলেন বা যা হয়েছেন–এসব নিয়ে কোন আক্ষেপ, অনুশোচনা বা গর্ব হয়?

ওমর বিশ্বাস: আপনার প্রশ্নটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং এর উত্তরও ব্যাপক। এক কথায় বা অল্প কথায় এর ব্যাখ্যা দেয়া কঠিন। জীবন কি? এ সম্পর্কে কয়েকদিন আগে একটি কবিতা লিখেছিলাম “জিরো পয়েন্ট” নামে। সেখানে বলেছিলাম, “মৃত্যুই জীবন”। আরেক কবিতায় লিখেছি, “জীবন তো নদীই– নদীর ভাব উপমার খেয়া/জীবনের চলার ভিতর দিয়ে ঝুলে থাকে জীবনের চোখ/ওপারের বারান্দায়” এটা লিখেছি, “চলছে জীবন স্টেশনের দিকে” কবিতায়। কাজেই আপনে বলতে পারেন, জন্ম হলেই একটা লক্ষ্য স্থির হয়ে যায় মানুষের। সেটা হলো মৃত্যু। সেই জন্ম থেকে মৃত্যু দিকে সময়ের সাথে চলাটাই হলো জীবন।

একথাগুলো আমি আমার মতো করে বললাম। জীবনের অনেক ধরনের সংজ্ঞা হতে পারে। আপনি আপনার জীবনবোধ থেকে অভিজ্ঞতার আলোকে আপনার মতো করে সংজ্ঞা দিতে পারেন। একেক জন একেক রকম সংজ্ঞা দেবে। জীবন কি? – এর ব্যাখ্যা একাডেমিক, দার্শনিক বিভিন্ন রকম হতে পারে। আসলে জীবনের সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেক রকম, যে যেভাবে উপলব্ধি করে। তবে জীবন শরীরের ভিতর একটা অদৃশ্য বস্তুর বসবাস, যা মানুষকে শরীরী উপস্থিতির মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান করে তোলে। এর মধ্যেই জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সব।

আমার বর্তমান জীবন, অবস্থান কীভাবে ব্যাখ্যা করব? আল্লাহ আমাকে অনেক ভালো রেখেছেন। আলহামদুল্লিাহ। আর কত কিছুই তো হতে চেয়েছিলাম। সবই কি হওয়া সম্ভব? আবার যা হয়েছে বা হয়েছি তার তো অনেক কিছুই আশা করিনি। কিন্তু যা পেয়েছি তা অনেক, অনেক। দুএকটা বিষয়ে কিছুটা আক্ষেপ থাকা স্বাভাবিক বলে মনে করি। তবে আক্ষেপ বা অনুশোচনা করে লাভ নেই। এই যে আমি লেখক হয়েছি – এটা তো কখনো ভাবিনি। এটা কি বড় প্রাপ্তি নয়?

আর অনুশোচনা আছে কিছু ক্ষেত্রে। যেমন, আমি প্রচুর সময় নষ্ট করেছি জীবনে আলসেমি করে। অনেক অনুশোচনা করেও এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। সব সময় ভাবি এর থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হবে, আরো আরো প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। কাজ করতে হবে। অনেক কাজ জমা হয়ে আছে যেগুলো আরো আগে করা উচিত ছিল। আমি যেহেতু কবি লেখক আমার প্রকাশনার দিকে আরো মনোযোগ দেয়া উচিত ছিল। এসব ভাবি আর কি।

২. আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে? কীভাবে কেটেছে? কোন অব্যক্ত কথা বা স্মৃতি কি মনে পরে? তাড়িত করে?

ওমর বিশ্বাস: আমার শৈশব-কৈশোরের মূল সময়টা কেটেছে খুলনায়। যেখানে আমরা থাকতাম সেটা এমন এক জায়গা যেখানে শহরের সমস্ত উপকরণ ছিল কিন্তু পরিবেশের ভিতরে গ্রামীণতা ছিল। চমৎকার পরিবেশ ছিল। সেটা ছিল একটা জাহাজ কারখানা। তার বাংলোতে আমরা থাকতাম। কারখানার সীমানার ভিতরেই আবাসিক এলাকাটা ছিল। বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল পুরো জায়গা। আমাদের সামনে ছিল নদী। আমাদের সামনে দিয়েই খুলনার ভৈরব নদী পশুর নদী নাম নিয়ে সুন্দরবন হয়ে সোজা বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। এই ভৈরব নদী আর নদীর জোয়ার ভাটা দেখতে দেখতে আমাদের সময়গুলো কেটেছে, আমরা বড় হয়েছি।

সেদিনগুলো আসলে সত্যি খুব সুন্দর ছিল। খেলাধুলার পরিবেশ ছিল। বড় বড় মাঠ ছিল। আমাদের কলোনি ছিল অনেক আধুনিক। সেই ছোটবেলা থেকে আমরা টেলিফোন ফ্রিজ গাড়ি ব্যবহার করা লোক। এই আধুনিক পরিবেশ তখন অনেক মানুষই দেখেনি। আবার সেখানে ধান লাগানো হতো। ধান কাটার পর ছাটাই করা খড়গুলো স্তুপাকারে জড়ো করে রাখা হতো। সেখানে আমরা খেলাধূলা করতাম। সারা গা চুলকাতো। গরু পালা হতো। খেজুরের গাছ কাটা হতো। প্রচুর খেজুর গাছ ছিল। আমাদের শৈশবের শীতকাল প্রকৃত অর্থেই শীতকাল ছিল। খুব সকালে আমরা সেই খেজুরের রসের আনন্দ পেতাম। এখন তো শীতই আসে না বা সেরকম আমেজ পাওয়া যায় না। নদীর কথা তো বললামই। সেখানে পুকুর ছিল। তবে সেটাকে ঠিক সেই অর্থে পুকুর বলা যায় না। মাছ চাষ হতো না। সেই পুকুরে আর নদীর যে অংশ নিরাপদে মূল শাখা থেকে আমাদের কলোনির ভিতর প্রবেশ করেছে সেখানে দিনের পর দিন রোদ-বৃষ্টির মধ্যে গোসল করে বাসায় ফিরতাম। চোখ লাল টকটকে হয়ে থাকত। পুকুরটা আবার নদীর সাথে সংযোগ ছিল। জোয়ার হলে পুকুরে পানি বাড়ত, আবার ভাটার সময় কমে যেত। আমরা এটাকে ডক বলতাম।

যাই হোক, সব মিলিয়ে বলা যায়, আমরা গ্রামীণ পরিবেশটাও পেয়েছি এবং তা উপভোগ করেছি। আমরা শহরের আবহের সাথে গ্রামের সংমিশ্রণে গড়া শহুরে পরিবেশে বেড়ে উঠেছি। এই মিশ্রিত রূপ নিয়ে আমাদের শৈশব। অনেকে ভাবেন আমরা গ্রাম সম্পর্কে জানি না। তবে সেটা প্রকৃত গ্রাম বা শতভাগ গ্রাম অর্থে ঠিক। আমরা কিছুটা গ্রাম সম্পর্কে জানতাম। আমাদের গ্রামে যাতায়াত ছিল। সেই হিসেবে গ্রামের পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের জানা ছিল। আমি গ্রামীণ চাষাবাদ, কৃষিকাজের সাথে হয়ত-বা জড়িত ছিলাম না, কিন্তু তা দেখা বা জানার সুযোগ হয়েছে।

শৈশব-কৈশোরের কত অব্যক্ত কথাই তো আছে। কত কথাই তো মনে পড়ে। তাড়িত করে। কিন্তু চাইলে কি আর ফিরে পাওয়া বা যাওয়া সম্ভব সেই সময়গুলোতে? সেসব এখন স্মৃতি। সেগুলো সব নস্টালজিয়া।

৩. সাহিত্যে এলেন কেন? কীভাবে এলেন? অর্থাৎ শুরুটা কীভাবে? কোথায়?

ওমর বিশ্বাস: আমার সাহিত্যে আসাটা অনেকটাই আকস্মিক। কীভাবে যে এলাম বলা মুশকিল। এই একটু আধটু লেখা শুরু করলাম। দিনে দিনে লেখার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকলো। লেখা বাড়তে থাকলো। লেখার প্রতি ক্রমেই ঝুঁকে পড়লাম। লেখা ছাপা হচ্ছে, মানুষজন পড়ছে। তার মানে আমার লেখা হচ্ছে। একসময় মনে হতে থাকল আমি লেখক। আমাকে কবি হিসেবে সম্বোধন করা হচ্ছে। এভাবে করতে করতে অনেক দূর চলে এলাম। যখন বুঝলাম আমি লিখতে পারি, আমি আর থামলাম না। পিছনে তাকিয়ে দেখি আর ফেরা যাবে না। সামনেই আমার পথ। আর থামা যাবে না। থেমে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি পুরো নিজেকে মনোবিবেশ করলাম লেখার প্রতি।

আমি ছোটবেলা থেকে লেখালেখি শুরু করিনি এবং একজন লেখক হবো এটা কখনো কল্পনা করিনি। কবি হবো এটা তো কোনদিনই ভাবিনি। স্বপ্নেও ছিল না। লেখালেখিতে আমার কোনোদিন কোনো প্রকার চিন্তায় ছিল না। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এদেশ, সমাজ নিয়ে ভাবতাম। আমাদের পরিবারটা হলো শিক্ষিত পরিবার। এখানে কবিতা চর্চা হতো, বই পড়া হতো। বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য পত্রিকা পড়া হতো। আমার আব্বা চিকিৎসক ছিলেন। মেডিক্যাল সায়েন্সের লোক। তাকে দেখেছি সারারাত ধরে পড়াশুনা করতে। ডাক্তারি পড়া বাদেও তিনি বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য পড়তেন। বাসায় প্রচুর বই ছিল। তিনি অনেক বই কিনতেন। আমার আম্মার লেখার প্রতি ঝোঁক ছিল। তিনিও বিভিন্ন ধরনের পড়াশোনা করতেন। আমার ভাই বোনদেরকেও দেখেছি পড়াশোনা করতে। হয়ত আমার জন্য এই পরিবেশটা অত্যন্ত উপযোগী হয়েছিল। এটাও আমার লেখালেখির ক্ষেত্র তৈরিতে সাহায্য করেছিল।

বয়স হলে লেখা শুরু করি। মূলত লেখা শুরু করি ইন্টারমিডিয়েটের পর থেকে। তখন আমরা ঢাকায় থাকি। লেখক সমাজ নিয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না, ভাবনা ছিল না। লেখকরা কেমন, সমাজে তাদের অবস্থান কেমন, তাদের মান মর্যাদা কেমন — এসব কোনো ধরনের বিষয় আমার মাথায় কখনো ছিল না। আমি এগুলো নিয়ে কখনো ভাবিনি। আমি খাইতাম-টাইতাম আর ঘুরে বেড়াতাম। ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতাম। খালি ঘুরে বেড়াতাম। এখানে সেখানে সকালে বিকালে দুপুরে রাত্রে কোনো ঠিক ছিল না। তবে মাঝে মাঝে দেশ জাতি নিয়ে ভাবতাম। সেটা হয়ত কাজে লেগেছে। সেই ছোটবেলা থেকে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস ছিল। এসব হয়ত পরবর্তীতে কাজে লেগেছে। সমাজ নিয়ে ভাবতাম। একসময় এসে লেখালেখি করলে কেমন হয় — তা নিয়ে ভাবলাম। প্রথম প্রথম পত্রিকায় দুইএকটি করে ছোট ছোট গদ্য লিখতাম, চিঠিপত্র লিখতাম। একটা দুটো বড় প্রবন্ধ। সাথে কবিতা। এভাবেই সেই থেকে এই যাত্রা শুরু, আর থামেনি, থামাতে দেইনি। লেখালেখির শুরুতে একসময় হুট করে একদিন এমনি বসে বসে কবিতায় হাত দিলাম। ধীরে ধীরে দেখলাম যে কবিতা আমাকে টানে। আমি কবিতা লেখা শুরু করলাম। কবিতা যখন আমার আসে সেই শুরু থেকে সনেটও সাথে সাথে আসে। অদ্ভুত ধরনের আচরণ শুরু করল সনেট। সেই প্রথম থেকে আমি সনেটে পারদর্শী হয়ে উঠলাম। কবিতা পত্রিকায় দিতে থাকলাম, দেখি ছাপা হয়। আমি কবি হয়ে উঠলাম। নানান বিষয়ের সাথে জড়িয়ে লেখক হিসাবে জড়িয়ে যেতে থাকলাম। দেখলাম আমি লিখতে পারি। এই যে লিখতে পারি, ভাবটা মনে জেকে বসল তখন থেকে আর থামিনি। লেখা কন্টিনিউ করলাম। আমি সমাজে লেখক হয়ে উঠলাম — এ কথা মানুষ বলতে থাকলো।

লেখালেখি আমার পরিবারের ঐতিহ্যের মধ্যেই ছিল এটা আমি পরে বুঝেছি। আমার আব্বা কিছু কিছু লেখালেখি করতেন। আমার আম্মা লেখালেখি পছন্দ করতেন। তার লেখার শখ ছিল। কিছু লেখাও ছিল। সেসবটা মিলেই আজ আমি এইখানে এসে দাঁড়িয়েছি।

৪. বাংলা ভাষার তথা বাংলাদেশের প্রধান কবিবৃন্দ যেমন : আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ– তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিলো? তাদের সাহিত্যকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন? আর কার-কার সঙ্গে আপনার সখ্যতা বা বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিলো বা আছে? তাদের স¤পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা বা তাদের সাহিত্য নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

ওমর বিশ্বাস: এ প্রশ্নের পুরোপুরি উত্তর না দেই। এটা বিশাল একটা উত্তরের বিষয়। সাহিত্যের মান সাহিত্যিকদের সাথে পরিচয়ের উপর নির্ভর করে না। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পরিচিত হলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায়। তবে বলব আল মাহমুদের কোন বন্ধু ছিল না। তিনি দুজনকে বন্ধু বলে মনে করতেন। আমি ছিলাম তাদের একজন এবং আরেকজন ছিলেন আমাদের বন্ধু সাংবাদিক সরদার ফরিদ আহমদ। আমরা যেখানে যেতাম আমাদের দুজনকে তিনি বন্ধু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতেন। আমাদের সম্পর্ক ছিল অনেক গভীর ও আন্তরিকতাপূর্ণ। এটা নিঃস্বার্থ ছিল বলে এর ভিতর কোনো খাদ বা লুকোচুরি ছিল না। আল মাহমুদের সাথে আমার শেষ পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। অনেক স্মৃতি অনেক কথা। শুধু একটু বলি, যদিও দুজনার অফিস একজায়গায় ছিল না কিন্তু আমরা দুজন বহুদিন একসাথে রাতে রিক্সা করে বাসায় ফিরতাম।

অন্যদের কথা ওইভাবে বলতে পারব না। সৈয়দ আলী আহসানকে অনেকবার দেখেছি। তার অনেক বক্তৃতা শুনেছি। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল না। আমিও খুব ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করিনি। এরকম চেষ্টা করিনি ফজল শাহাবুদ্দীনের সাথেও। যদিও তার সাথে আমার দুইতিনবার মাত্র দেখা হয়েছে। তেমন কোনো কথা হয়নি। হতে পারে এটা আমার সমস্যা। তবে আমার অনেক বন্ধুদের দেখেছি তার সাথে অনেক সখ্যতা ছিল। আমার সাহিত্য চর্চা শুরুর অনেক আগেই মারা যান আহসান হাবীব। বুঝতেই পারছেন তার সাথে লেখার মাধ্যম ছাড়া স্বশরীরে পরিচয়ের সুযোগ ছিল না। আবুল হোসেনের সাথেও আমার কোনো যোগাযোগ বা পরিচয় ছিল না।

লেখক বা কবি সাহিত্যিকদের সাথে আমার যোগাযোগ অনেক কম। এটা এখনো অনেক কম। কোনো কোনো লেখকের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল। আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে অনেক সুন্দর সম্পর্ক ছিল। অনেক স্মৃতি আছে। উনাকে একজায়গায় ফালুদা খেতে নিয়েছিলাম। যেখানে গেছি সেখানে যাওয়াটা তার কাছে অন্যরকম মনে হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, বাহ্! তুমি তো অনেক জায়গা চেনো। সেদিন তিনিই আমাকে জোর করে তার গাড়িতে নিয়েছিলেন। তিনি তখন নজরুল ইনিস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক। তার অফিসের গাড়ি পুলিশ রিকিউজিশন করেছিল। আমাকে ছাড়াতে হবে। তার বিশ্বাস আমি নাকি এ কাজটা পারব। তিনি আমাকে বিশ্বাসও করতেন ভালোও বাসতেন। একদিন বাংলা একাডেমির এক কর্মকর্তা আমার কাছে একাডেমির কাজ নিয়ে অনেক রাগ ঝারলেন তার উপর। একাডেমিতে একটা কাজে গিয়েছিলাম। তারপর তার অফিসে তার সাথে এমনেই দেখা করার জন্য গিয়েছি। কাজটা শেষ করতে অনেক দেরি হচ্ছিল। আমি তার অফিসে বসা। আমাকে বললেন, তিনি এখন আসবেন। আমি থাকব কিনা জানতে চাইলাম। তিনি অসুবিধা নেই বলে জানালেন। তাকে বললাম আমি কি উনাকে (আবদুল মান্নান সৈয়দকে) কিছু বলব। তিনি বললেন, না থাক। আপনি বললে খারাপ দেখায়। বলতে বলতে তিনি চলে আসলেন। আমরা দুজন গল্প শুরু করে দিলাম। সেই কর্মকর্তা আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। কাজের কথা সেভাবে আর তুলতেই পারলেন না মান্নান সৈয়দের সামনে। পরিস্থিতি একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

৫. আপনি একাধারে একজন কবি-সম্পাদক-সাহিত্যবিশেষক অর্থাৎ বহুমাত্রিক। আপনার অভিজ্ঞতা ও বিচরণ ক্ষেত্র ব্যাপক ও বর্ণিল। বিচিত্র। এই সামগ্রিক সত্তাকে কিভাবে দেখেন? কিভাবে উপভোগ করেন?

ওমর বিশ্বাস: দরুণভাবে উপভোগ করি। কারণ আমার পেশার সাথে এই নেশার মিল নেই। বলতে গেলে দুইটা একসাথে যায় না। দুইটা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী জিনিস। আমি ব্যাংকে চাকরি করি। নিরামিষ। টাকা-পয়সা গোনাগোনির কাজ। সেটা একটা কষ্টকর কাজ। লেখালেখি করে আজকে আমার এই পর্যন্ত আসতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। কষ্ট হয়েছে। আমি থেমে থাকিনি। পেশা ও নেশা দুটোকেই সমান্তরালে এগিয়ে নিয়ে গেছি। লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত দিনের পর দিন পরিশ্রম করে আজ এই পথে এসেছি। আমাকে জীবিকার জন্য ১০ থেকে ১২ ঘন্টা এমনকি ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় ব্যয় করতে হয়েছে। এখনো হয়। বাকি আর কয় ঘন্টাই বা থাকে দিনের? এর থেকে সময় বের করতে হয়েছে। অধিকাংশ সময়ে এর পেছনে ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে থেকেই আমি নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছি। আল্লাহ পুরোটাই রহম করেছে।

মূলত আমার দুটো লক্ষ্য ছিল, লেখা চালিয়ে যাওয়া আর লিখতে যে জানি তা মানুষকে জানানো। লেখক হিসেবে আমাকে কেউ যেন অবজ্ঞা না করতে পারে। আমি লেখালেখিকে আঁকড়ে ধরবো, নিয়মিত লেখা চালিয়ে যাব। যে বিষয় লিখব, সে যে বিষয় হোক, আমি চাই মানুষ বুঝুক আমার লেখা হয়। কেউ যেন বলতে না পারে যে, আমি যা লিখছি তা লেখা হয় না। মানুষ জানুক আমি লিখতে পারি। সেজন্যই আমি নানা বিষয়ে হাত দিয়েছি। কখনো সম্পাদনা করেছি, কখনো উপন্যাস লিখেছি, কখনো গদ্য লিখেছি। এসবে আমার এখনো বিচরণ আছে। এজন্য আমাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। সময় বের করে কাজ করতে হয়েছে। অন্যদিকে একজন সংগঠক হিসাবে আমি বেশ কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছি। সেগুলো আজ অতীত। আমার মনে হয় আমি সেগুলো সফলভাবেই করতে পেরেছি আল্লাহর রহমতে। এখন সংগঠক হিসেবে কাজ করি না বললেই চলে। তবুও বলব, যদি কখনো করি ভালোভাবে করব। আমি পারি না সেটা কেউ যেন না বলতে পারে। আমার কাজ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছাড়া নেগেটিভ বা বিরূপ মন্তব্য করতে না পারে।

এই পর্যন্ত এসেছি, কতটুকু পেরেছি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সেটা বলতে পারব না। মূল্যায়নের দায়িত্ব আমার না। আমার পেশার সাথে যেহেতু নেশা মেলে না, আমি ঠিক করেছিলাম এখানে আমি লেগে থাকব, এই পথটাকে কখনো ছাড়বো না। এই যে লেগেছিলাম, যার ফলে আজ এখানে এসে পৌঁছাতে পেরেছি। এর বিনিময়ে অর্জন কতটুকু সেটা মানুষ বলতে পারবে। আমি সে বিষয়ে বলতে চাই না। আমি সেই শুরু থেকে লিখেছিলাম এখনো এখানে লেগে আছি, আমি পরিশ্রম করার চেষ্টা করি, লেখা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করি। তবে এর ঠিক উল্টো দিকে বলব, আমার মতো অলস লেখকদের হওয়া উচিত না। আমার ভিতরে যে অলসতা বাস করে আমি তার থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। ভাবি আমি যদি আলসেমি না করতাম, অলসতা না থাকত তাহলে হয়ত এ পথ আমার জন্য আরো সুন্দর হতো, আরো ব্যাপক হতো। তবে সেটা বলে লাভ নেই। এর থেকে মুক্তি চাই। আল্লাহর পানাহ চাই।

৬. আদি বাংলা তথা চর্যাপদ থেকে আজ অবধি বাংলা সাহিত্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে–আপনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণে?

ওমর বিশ্বাস: চর্যাপদের কাল থেকে আজ অবধি কম পানি তো গড়ায়নি। এই পানি গড়ানোর সাথে সাথে বাংলা সাহিত্য আজ বিশ্বমানের হয়েছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। এর ব্যাখ্যা দেয়া বা বিশ্লেষণ করা তো বিশাল একটা কাজ। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এদিকে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার মতো কবিতা কই? পৃথিবীতে দেখান কোথায় আছে? আমরা যতটুকু কবিতা পড়েছি বা খবর রাখি তাতে এ মানের কবিতা পৃথিবীতে বিরল। নানাধরনের কবিতা লেখা হয়েছে কিন্তু দ্বিতীয় বিদ্রোহী কি আর লেখা হয়েছে? আমি আরেকটা বিদ্রোহী লেখার কথা বলছি না, আমি এই মানের কবিতা লেখার কথা বলছি। তাছাড়া আমাদের সাহিত্যে গল্প উপন্যাস প্রবন্ধের দিকে খেয়াল করে দেখুন, সে এক বিশাল ভাণ্ডার। অনেক ভালো ভালো সাহিত্য রচিত হয়েছে। তুলনামূলক বিশ্লেষণে যদিও আমরা বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে পারছি না। সে হিসেবে পিছিয়ে আছি। কারণ আমাদের সাহিত্য অনুবাদ হয়নি ওভাবে। আমরা বাংলায় লেখি বলে সবখানে সেটা পৌছায় না। আমরা তো বিশ্বমানের সাহিত্য পড়ি, আমাদের লেখকদের লেখাও পড়ি। আমাদের বহু লেখকের লেখা, সাহিত্যকর্ম পরিবেশনের সময় চমকে উঠেছি।। তাহলে? এদিকে আমাদের কবিতা অনেক উত্তীর্ণ। সে সব তো ফোকাস হয় না। আসলে আমাদের ভালো সাহিত্য আছে কিন্তু আমরা বিশ্বের দরবারে সেভাবে পৌঁছাতে পারছি না। সেটা তুলে ধরার অভাব আছে। আমাদের ব্যর্থতা এই জায়গাতেই।

তারপরও বলতে হয়, কথাটা যদিও বিপরীত শোনাবে। উপরের কথাগুলো সাথে সাংঘর্ষিক মনে হবে। সত্য কথা হলো, আমাদের এখনো মানসম্মত লেখকের অভাব আছে। এর একটা কারণ হচ্ছে আমাদের লেখকদের মধ্যে পঠন-পাঠনের বড় অভাব। তারা মোটেই পড়তে চায় না, কিন্তু লিখতে চায়। পরিশ্রম করতে চায় না, লেখক হতে চায়।। জ্ঞান অর্জন করতে চায় না, নাম চায়। অধ্যবসায়ী হতে চায়, ভাব নিতে চায়। আসলে আমরা সস্তায় লেখক হতে চাই। এটাই নির্মম সত্য। সাহিত্য নিয়ে পাগলামি করার লোকের অভাব নাই কিন্তু সবার হাত দিয়ে কি ভালো মানে সাহিত্য বের হচ্ছে?

আমাদের সমকালীন বিষয়কে ধারণ করে লেখার অভাব আছে। আমরা ঐতিহ্যনির্ভর, শিকড় সন্ধানী গবেষণা সাহিত্য, গল্প, উপন্যাস সেভাবে কি লিখতে পেরেছি? তবে কবিতায় এবিষয়গুলো কমবেশি পাওয়া যায়। যেটুকু লেখা হয়েছে তার আলোকে আমি একটা সামগ্রিক কথা বললাম। এসব থেকে ভালো লেখাগুলো বাছাই করে দেখুন তার সংখ্যা একেবারে কম হবে না।

৭. সাম্প্রতিক বাংলাদেশে, শিল্প-সাহিত্যচর্চায় কোন-কোন চ্যালেঞ্জ বা সুবিধা-অসুবিধা আছে বলে আপনার মনে হয়? কীভাবে এগুলি মোকাবিলা করেন?

ওমর বিশ্বাস: চ্যালেঞ্জ তো আছে এবং এটা অনেক ধরনের। এবং এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাও কঠিন। তবে সম্ভব। এটা এককভাবে কারো পক্ষে মোকাবিলা সম্ভব না। একজন লেখক হয়ত তার নিজের প্রতিভার জোরে উঠে আসবে কিন্তু সামগ্রিকভাবে সমস্ত লেখকরা শিল্প-সাহিত্য চর্চার সুবিধাগুলো পাবে না। এখানে লেখক তৈরির চ্যালেঞ্জ আছে। লেখার ক্ষেত্রের অভাব আছে। সেই ক্ষেত্র তৈরির চ্যালেঞ্জ আছে। এখানে ব্যক্তিপ্রীতি, গোষ্ঠীপ্রীতি প্রবল। ফলে ভালো লেখকরা নিজেকে গুটিয়ে রাখে। পরিচিতি না থাকলে ভালো লেখকের লেখা ছাপাতে সমস্যা হয়। এখানে ভালো লেখক ও লেখার কদর দেয়ার লোকের বড় অভাব। আপনাকে দমিয়ে রাখতে চাইবে। এখানে লেখকের সাথে যোগাযোগ করা হয় না, লেখককে উপযাজকের মতো যোগাযোগ করতে হয়। সম্পাদকের পিছনে ধরণা দিতে হয়। লেখক হিসেবে সম্পাদকের সাথে খাতির না থাকলে সম্পাদক আপনাকে চিনবেই না।

আবার আমাদের সামনে প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ আছে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব তো আছেই। এরকম নানাধরনের চ্যালেঞ্জ আছে এবং এগুলোকে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হচ্ছে একজন লেখককে। বৃহৎ অর্থে সাহিত্য পাতাগুলোর সংকুচিত সংস্কৃতি ও মানসিকতার চ্যালেঞ্জ তো আছেই। সামগ্রিকভাবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির বিপরীতে মানুষকে সাহিত্য নিয়ে টিকে থাকা বড় কঠিন হয়ে পরেছে। আমাদের প্রচুর মানসম্মত লেখক দরকার ছিল কিন্তু সেটা তৈরি হচ্ছে কই? যারা লেখালেখি করেন তারা প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের প্রচারণায় ব্যস্ত বেশি। কাজেই ভালো লেখক তৈরি না হওয়ার পিছনেও এসব কারণ দায়ী।

এদিকে মানুষ আজ বড় বেশি ঝুঁকে পড়েছে বৈষয়িক দিকে। শিল্প সাহিত্যের জগত বৈশ্বিক জগতের থেকে অনেক ঊর্ধ্বে বলা যায়। এটা অনেক কমনীয় একটা পথ। এ পথ থেকে বস্তুবাদের পথে চলতে গেলে সমস্যা তো হবেই। এটা একটা দ্বিমুখী বিষয়। কেননা শিল্প সাহিত্যের জগত বস্তুবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। আধিপত্যবাদ ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচয় করিয়ে স্বকীয়তা বজায় রাখার বোধ, বিবেকবুদ্ধি জাগ্রত করে। অথচ আমরা সেগুলোকেই জড়িয়ে রাখি, ধরে রাখি। সেখানে তো আমার লেখায় মানবিক মূল্যবোধ, মনুষ্যবোধের অভাব তো হবেই।

এখানে প্রাকটিক্যাল হলো থিওরির বিপরীত। এই বৈপরীত্য একটা বড় সমস্যা। এখন সমস্যা হলো এই সমস্যাগুলো বোঝার বা উপলব্ধি করার লোকের বড় অভাব। তাহলে এই সমস্যাগুলো দূর হবে কীভাবে?

তাহলে একজন লেখক কিভাবে এসবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে? কিভাবে এ পথ মসৃণ করবে যেখানে নিজের চিন্তা চেতনাতেই বৈপরীত্য। অথচ একটা সুন্দর সমাজ নির্মাণের জন্য তাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে, তাকে স্বপ্ন দেখাতে হচ্ছে। সে মানুষকে পথ দেখায় অথচ বর্তমান সময়ে এসে সে নিজে বৈশ্বিকতার সাথে তাল মিলিয়ে এর সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করে। তার নিজের লেখা চর্চার সাথে ব্যক্তিজীবনের চর্চার মিল পাওয়া যায় না। এর প্রভাব তো সাহিত্যে, সমাজে পড়বেই।

এখানে লেখক তৈরি করতে এবং নিজেকে লেখক হতে হলে অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। তাকে পাড়ি দিতে হয় সাত সমুদ্র তেরো নদী। অথবা পাহাড়ের বাধা ডিঙিয়ে কষ্টের পথ অতিক্রম করতে হয়। এখানে সাধারণত কেউ কাউকে সহযোগিতা করে না। এখানে প্রতিভাবানদের খুঁজে বের করা হয় না। বরং প্রতিভাবানদের যেকোনোভাবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। তা না করলে অযোগ্যরা মঞ্চ দখল করবে কীভাবে? এখানে লেখক তৈরি হবে কীভাবে? – যেভাবে নিজেদের প্রশংসা পাওয়ার জন্য প্রচার প্রপাগাণ্ডায় ব্যস্ত হয়ে পরছে লেখক নিজেই। তিনি নিজেই নিজেকে জাহির করছেন। এখন পদকের জন্য সময় ব্যয় করে অথচ সেই সময়টা লেখালেখির জন্য করা হয় না।

৮. আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?

ওমর বিশ্বাস: আমার প্রথম বইয়ের নাম “নারী পুরুষ মৃত্তিকা”। কবিতা বই। প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ছিল দারুণ। নিজে লেগে থেকে করেছিলাম। কিন্তু বন্ধু-বান্ধবের উৎসাহ ছিল ব্যাপক। প্রচ্ছদ করে দিয়েছিলেন কবি গোলাম মোহাম্মদ। তাকে দিয়ে দু তিনটে প্রচ্ছদ করানোর পরে একটি বাছাই করা হয়। তিনি অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে প্রচ্ছদগুলো করেছিলেন। বিরক্ত হননি মোটেও। এখন প্রচ্ছদে ছবি লাগবে, ছবি তুলতে গেলাম স্টুডিওতে। সেদিনই ছবি তুলতে হবে ভাবি নাই। আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হলো সেদিন ছবি না তুললে দেরি হয়ে যাবে। টি-শার্ট বা গেঞ্জি পরা ছিলাম, তাতে ভালো ছবি আসবে না। সাথে যারা ছিলেন তাদের কাছে থেকে শার্ট নিয়ে পড়তে থাকলাম, কিন্তু কারোটা গায়ে লাগে না ঠিকমত। সবাই আমার থেকে গায়ে গতরে স্বাস্থ্যবান। আমি নিজে শুকনা মানুষ, যেটা পরি সেটা শুধু বড়ই না বেশ বড়। তবুও ঠিক হলো সবার শার্টেই ছবি তোলা হবে আর যারটা ভালো লাগবে সেটা কাজে লাগাবো। শেষমেষ যে শার্টের ছবি ব্যবহার করলাম সেটা ছিল সাংবাদিক, সাহিত্যিক সরদার ফরিদ আহমদের। অনেক বড় শার্ট, তবুও সেটা পরে সবাই মিলে সিস্টেম করে ছবি তুললাম। কথাসাহিত্যিক রফিক মুহাম্মদের শার্টও পরে ছবি তুলেছিলাম। স্টুডিওর ফটোগ্রাফার আমাদের পরিচিত। সে অনেক যত্ন করে ছবিগুলো তুলে দিল। কয়েকটা ছবির মধ্যে থেকে একটা বাছাই করে বইয়ের প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়।

এর মধ্যে আরেকটা কথা বলি। মনটা খুব ফুরফুরে। বই বের হচ্ছে, টাকা-পয়সা খরচ হচ্ছে। রাতে আড্ডা দিয়ে ঘরে ফিরি। এরকম একটা সময়ে একদিন রাতে ছিনতাইকারী ধরল। টাকা-পয়সা চাইল। অনেক ডিমান্ড তাদের। বলল, তাদের রাতে একটা অভিযান আছে। সেখানে কত খরচ হবে শুনে আমার ভিতর তখন কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। বিশাল এমাউন্টের বাজেট। ভয় লাগেনি। ভয় লেগেছিল পরে যখন তাদের হাত থেকে ছাড়া পাই। অংকের পরিমাণও পরে বুঝে অবাক হয়েছিলাম, এত টাকা! তারপর থেকে বহুদিন সেই পথ দিয়ে যাইনি। বিকল্প পথ দিয়ে বাসায় ফিরতাম।

৯. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?

ওমর বিশ্বাস: আমাদের সাহিত্য আজ হঠাৎ করে এপর্যায় আসেনি। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলমান ছিল এবং এখন আছে। এটা আলাওলের আমল থেকে আজ ২০২৪ সাল পর্যন্ত এসেছে। এর মধ্যে একটা বিশাল চেইন তৈরি হয়েছে। সাহিত্য পরম্পরায় আমরা এপর্যন্ত এসেছি। আপনি আমিও সেই চেইনের অংশ। এখন দেখেন এখানে কারা কারা ছিল? কারা অবদান রেখেছে? কারা কারা আপনার চিন্তা, চেতনা আর ইতিহাস-ঐতিহ্য বহন করেছে? আপনার সাহিত্যকে সত্যিকার অর্থে নিবেদিত থেকে বাংলা সাহিত্যের জন্য কাজ করেছে। এখন কারা সক্রিয় থেকে মূলধারায় সাহিত্যের জন্য কাজ করে যাচ্ছে? এখানে তাদের সবার অবদানই কমবেশি আছে। এই সাহিত্যে বঙ্গীয় মুসলামদের বিশাল অবদান আছে। তারাই আমাদের পূর্বসূরি। তারাই সাহিত্যে একটা পথ তৈরি করে গেছে। আমরা সেই পথে চলছি সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করতে। আরো বিস্তৃত করতে। সে সবই উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতার ভিতর অন্তর্ভুক্ত। কাজেই এককভাবে কোনো নাম বলার সুযোগ এখানে নেই। এই সাহিত্য একটা সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। স্বভাবত আমার চিন্তা, চেতনা কৃষ্টি-কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য যার সাথে মেলে আমিও তো সেই পথে নিজের সৃষ্টিগুলো সাজাতে চাই।

১০. এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?

ওমর বিশ্বাস: আমার এপর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সম্পাদনা বই সহ বিশটি। নিজের সব কাজই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সেভাবেই লেখালেখির চেষ্টা করি, বই বের করার চেষ্টা করি। আমি শুধু সংখ্যার দিকে তাকাই না, মানের দিকেও খুব ভালো করে লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করি। আর আমার বইগুলো বিভিন্ন বিষয়ের উপর। আমার কবিতা বই আছে। ছড়া বই আছে। গল্প বই আছে। আমার সম্পাদিত আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার বইটি বেশ পরিচিত ও প্রশংসিত হয়েছে। আমার ঋতুভিত্তিক একটা গদ্য বই আছে, এরকম বই সেভাবে আর আছে কি না আমার জানা নেই। একটা বই আছে ছন্দবিষয়ক। তা বেশ চলেছে, এখনো চাহিদা আছে। অপরিচিত বহুজনের কাছে শুনেছি, তারা বইটি পড়েছে এবং উপকৃত হয়েছে। ভালো হিসেবে সবাই স্বীকৃতি দিয়েছে। অনেকে এই বইটিকে গুরুত্বপূর্ণ একটা বই বলে মনে করে। নবীনদের জন্য বেশ উপযোগী। রহস্য উপন্যাস সিরিজে এপর্যন্ত পাঁচটা বই বের হয়েছে। এটার সত্যি খুব ভালো প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। সেই হিসেবে নিজের বইগুলো উল্লেখযোগ্যই মনে হয়। আমি বিদেশি অনুবাদ বইয়ের সম্পাদনাও করেছি। এসবের সম্পাদনার কাজে অগ্রজদের কাছ থেকে ভালো মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি পেয়েছি।

১১. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।

ওমর বিশ্বাস: আমার একদম লেটেস্ট বই হলো আমার সম্পাদিত “কবি গোলাম মোহাম্মদের নির্বাচিত কবিতা” বইটি। অনেক যত্ন নিয়ে বইটিতে কাজ করার চেষ্টা করেছি। কবির মৃত্যুর পরে একটি বই বেরিয়েছিল আর তার রচনাবলির ১ম খণ্ড। আর কোনো বই বের হয়নি। এটি কবি গোলাম মোহাম্মদের গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত কবিতার নির্বাচিত সংকলন। বইটির ভূমিকা আমি নিজেই লিখেছি। বইটির জন্য অনেক পরিশ্রম করেছি এবং আন্তুরিকভাবে চেষ্টা করেছি দ্রুত সময়ে ভালো কিছু করার। এত দ্রুত আমি নিজের বইও করিনি কখনো। দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করেও আমি নিজের একটা কবিতা বইয়ের পাণ্ডুলিপি গোছাতে পারিনি। আসলে এখানে একটা আবেগ কাজ করেছিল। গোলাম মোহাম্মদ ছিলেন আমাদের সিনিয়র, আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী কবি। খুবই আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তার সাথে আমাদের। অনেক সখ্যতা ছিল। একজন ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। ভালো-মন্দের বিচার অন্যরা করবে। কিন্তু কাজের একটা আনন্দ থাকে। তার কবিতা নিয়ে এই কাজটি করে খুব তৃপ্তি পেয়েছি।

১২. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?

ওমর বিশ্বাস: আমি ৯০ দশক থেকে লেখালেখি করি। সে হিসাবে আমাকে ৯০ দশকের কবি বলতে পারেন। আবার আমার প্রথম কবিতা বই ৯০ দশকে প্রকাশিত হয় সে হিসাবেও ৯০ দশকের কবি বলতে পারেন। এই দশকেই আমার লেখালেখি শুরু আর এই দশকেই প্রথম বই প্রকাশিত হয়। তবে লেখালেখি শুরু করার পর থেকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে কবিদের কোনো দশক থাকে না। আমরা লিখতে লিখতে এপর্যায়ে এসেছি। এখনো তো লিখছি। আপনি যদি নিয়মিত লিখে থাকেন, সেই যে যাত্রা শুরু করেছিলেন আর থামেননি, আপনি দশকের পর দশক পেরিয়ে এই সময়ে এসে উপনিত হয়েছেন। তাহলে দশকেরবৃত্তে আবদ্ধ থাকবেন কেন? এটা হলো আপনি কোনদিন থেকে লেখালেখি শুরু করেছেন বা আপনার প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে সে হিসেবে আপনার একটা পরিচিতি। এছাড়া আর কিছু না। তবে লেখককে বোঝার, জানার সুবিধার্থে এই পরিচিতিরও দরকার আছে। নাহলে একজন পাঠক লেখক সম্পর্কে জানবে কেমন করে? আপনার সময়কে বিবেচনা করে আপনার কবিতার বিচার-বিশ্লেষণের জন্য একটা কাল বা দশক বিবেচনায় আসতে পারে। সেটা লেখালেখিল শুরুর কাল। কবে থেকে লেখেন, সেই হিসেবে এটাকে একজন লেখকের জন্য বিবেচনায় নেয়া যায়।

১৩. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।

ওমর বিশ্বাস: আমাদের সময়কাল অখণ্ড ব্যস্ততার সময়কাল। এখানে মানুষ শুধু দৌড়ায় আর দৌড়ায়। আমরা সাহিত্যের জন্য একসময় প্রচুর কাজ করেছি। চোখ-কান-মুখ বন্ধ করে পাগলের মতো। ধীরে ধীরে এপ্রবণতা কমে আসতে দেখি। এখন মানুষ গাড়ি বাড়ির পিছনে দৌড়ায়। সুখ শান্তির জন্য দৌড়ায় না। মানুষ ভাবে টাকা-পয়সা সব। এখানেই সুখ। লেখক, সাহিত্যিকদের মধ্যেও এটা বাসা বেধেছে। ফলে আজকের দিনে সাহিত্যিকরাও শুধু প্রাপ্তির জন্য দৌড়ায়। কে কাকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে পারে – এটাই মানুষের চাওয়া পাওয়া। সে শুধু ছুটছে আর ছুটছে। এইজন্য মানুষ বই খাতায় চিত্তের খোরাক খোঁজে না, হাওয়া বাতাসের মধ্যে গাড়ি বাড়ি করার টাকা পয়সা খোঁজে। সে পরিশ্রম করে অর্থের জন্য, সে তার জীবন-মানের জন্য বই পড়ে না। তবু সে ব্যস্ত ভীষণ ব্যস্ত। সে তার সময়কাল নিয়ে ভাবে না। তার জাতিকে নিয়ে ভাবে না। তার দেশকে নিয়ে ভাবে না।

তবে এসবের পিছনে কারণ রয়েছে। কোনো না কোনোভাবে তাকে একইসঙ্গে এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তার মন চিন্তা চেতনাকে ভুলিয়ে রাখা হয়েছে। তার সামনে দেখানো হয়েছে বিশাল পথ যে, এই করলে এই এই হবে। এই করলে গাড়ি বাড়ি হবে। এই এই করলে অর্থবিত্ত হবে। তাকে বোঝানো হচ্ছে অর্থই সব। আবার এই করলে স্বপ্ন দেখা যাবে। তাই এখন মানুষ শুধু প্রাপ্তি খোঁজে। ত্যাগ বোঝে না। মানুষের জন্য মানুষের দরদ নেই কান্না নেই। সাহিত্যিকরাও এর থেকে বাইরে না। তারাই বা বাইরে থাকবে কেন? যার জন্য নতুন নুতন লেখক সাহিত্যিক, ভালো সাহিত্য খুঁজে খুঁজে বের করতে কষ্ট হয়। তবে আশার কথা হলো, মানুষের ভিতর সম্প্রতি ব্যাপক ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের পথটা ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট ২০২৪ এ মানুষের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। মানুষ আবার জীবনের মানে খুঁজে বের করে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার দিকে এগিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।

১৪. আপনি কবিতায় মিথ, ধর্ম ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করা বিষয়ে কি ভাবেন? বিশেষত ইসলামিক বিষয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি ব্যবহার করা বিষয়ে।

ওমর বিশ্বাস: ইসলামে মিথ বলে কিছু নাই। ইসলামে আছে ইতিহাস ঐতিহ্য। ইতিহাস ঐতিহ্যে কল্পনা বা পুরাণিক কাহিনীর সুযোগ নেই। ইতিহাস কল্পনার আলোকে লিখিত হয় না। ঐতিহ্যতেও কাল্পনিক কিছু থাকতে পারে না। যে যার ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করতে পারে। একজনের লেখা ইতিহাস-ঐতিহ্যে আশ্রিত হতে পারে। ধার্মিক লোকের লেখায় তার ধর্মের কথা আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা আসাটাই স্বাভাবিক। ইসলামে মোজেজা, কারামত আছে। নবী-রাসূলদের বহু মোজেজার কাহিনী আছে। যেমন, মুসার (আ.) লাঠি, নূহের (আ.) নৌকা, ঈসা (আ.) কর্তৃক অন্ধদের দৃষ্টি দেয়া। আমাদের সবচেয়ে বড় মোজেজার উদাহরণ হলো আল্লাহ কর্তৃক প্রিয় নবীজিকে কোরআন দেয়া।

কাজেই এসব বিষয় কারোর লেখায় আসাটাই স্বাভাবিক যদি প্রসঙ্গের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়। এটা আপনার ভিতরে এমনি এমনি আসবে। লেখার সময় আসবে, মনে মনে আসবে, কাজে-কর্মে আসবে। এটা বিশ্বাসের অনুষঙ্গ। একে আপনি জোর করে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন না। কেউ কেউ অবশ্য এগুলো নিয়ে অযাচিত বিতর্ক করে নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা করে। আপনি যে ধর্মের অনুসারী, যে ধর্ম আপনি ছোটবেলা থেকে শিখেছেন, বেড়ে উঠেছেন, সেটা চর্চা করেছেন, সেটা তো হুট করে দূরে সরিয়ে ফেলতে পারবেন না। কিংবা যেটা এখনো চর্চা করে যাচ্ছেন তার থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখবে কীভাবে? এখানে বিশ্বাসই প্রকৃত শক্তি। সেই লালিত বিশ্বাসকে আপনি কীভাবে দূরে সরিয়ে রাখবেন? তাছাড়া সামান্য সামাজিক দৃষ্টিপাতে সেগুলো অবজ্ঞা করা বা দূরে সরিয়ে নিজেকে প্রগতিশীল ভাবানোর চেষ্টা করা কতটুকু হাস্যকর সেটা কি মানুষ বোঝে না। অবশ্যই বোঝে।

বরং আপনি যা তাই প্রকাশ করুন। নিজের মনের সততা দিয়ে সাহিত্য চর্চা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করুন। মানুষ আপনার সততার জন্য আপনাকে সম্মান করবে।

কাজেই আপনার লেখালেখিতে আপনার ধর্ম, বিশ্বাস, মূল্যবোধ এগুলো আসবে। এটাই স্বাভাবিক। এখানে জোড়াজুড়ির কিছু নাই। তবে এখানে একটা বিষয় আছে জোড়াজড়ির, সেটা হলো কেউ জোর করে একে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় আর কেউ কেউ জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়। জোর করে শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলতে চায়। এই দুইটাই সাহিত্যের মান ক্ষুণ্ণ করে বলে আমার ধারণা। কেননা আমরা যখন কোনো জিনিস জোর করে আনতে চাই তখন তার গতি স্বাভাবিকভাবেই ব্যাহত হয়। সহজতা বা স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়। এখানে স্বতঃস্ফূর্ততার বিষটিই মুখ্য। জোর করে কোনো জিনিস আনা বা ব্যবহার করা সাহিত্যের ক্ষেত্রে ঠিক না। তেমনি কেউ জোর করে দূরে সরিয়ে রাখলেই সেটা থেকে থেকে দূরে থাকা যায় না। সাময়িক সময়ের জন্য হয়ত কিছু সম্ভব হয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু শেষমেষ তা টেকে না। পাঠক বা দর্শক ঠিকই বুঝবে আপনি কোনটা কি উদ্দেশ্য ব্যবহার করেছেন বা করছেন। এটা আমাদের লেখক সমাজ, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতকর্মীদের মনে রাখতে হবে।

১৫. আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা বলতে আপনি কি বোঝেন? বাংলাদেশের কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

ওমর বিশ্বাস: প্রথমত বলি, আমি আধুনিকতার উত্তর আধুনিকতা নিয়ে কবিতা চর্চা করি না। আমি নিজেকে কবি মনে করি, কবিতা লিখি। আধুনিকতা বা উত্তর আধুনিকতার বাহাস আমাকে কখনো টানেনি। তাই এগুলো নিয়ে মাতামাতি ও দৌড়ঝাপ আমার দ্বারা হয়নি। আমি এটা বুঝিও কম। আসলে যারা উত্তর আধুনিকতা নিয়ে চর্চা করে তারা এর প্রকৃত ব্যাখ্যা পরিষ্কার করে দিতে পারেনি। এটা আমার কাছে মনে হয়েছে। তাদের একেক জনের কাছে এর কনসেপ্ট একেক রকম। এটা তো বিশ শতকের পশ্চিমাদের একটা আন্দোলন। এটা নিয়ে সংশয়বাদীদের ঘুরপাক খেতে দেখেছি আমাদের দেশে। যদিও উত্তর আধুনিক মতবাদে বা ধারণাপত্রে নিজেই সংশয়বাদ মিশে আছে। আমি কবিতা লেখি, উত্তর আধুনিকতার ধারণা নিয়ে খুব একটা বেশি কিছু জানি না। তবে তাদের বিষয়টি অনেক বোঝার চেষ্টা করেছি।

এটাকে আধুনিকাতাবাদ বিরোধী একটা ধারণা বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু আধুনিকতা না থাকলে আধুনিকতা উত্তর আসে কি করে? আসলে আধুনিকতা কেন আসে। আপনি বর্তমান সময়কে কি নামে আখ্যায়িত করবেন? সে ব্যাপারে আপনার ধারণা ক্লিয়ার করতে হবে। বর্তমান সভ্যতার স্তরকে তো আপনাকে একটা নাম দিতে হবে। ধরেন সেটা আধুনিকতা। তাহলে, অতীতের প্রতিটি মুহূর্ত তখনকার আধুনিকতা ছিল। সে সময়ের উন্নতি, অগ্রগতির, উৎকর্ষতার একটা মান ছিল – সময়কে চিহ্নিত করার আয়োজন ছিল। সেসব বাদ দিয়ে এখন এই সময়ে এসে আপনি উত্তর আধুনিকতার নামে আধুনিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস লক্ষ্য করে থাকবেন।

চলমান সময়ের কোল থেকে প্রাগ্রসর ভাবনা নিয়ে সুদূর ভবিষ্যতকে সামনে তুলে আনা যেতে পারে। এটা হয়ও। এর দ্বারা আধুনিকতার সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের জন্য সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম হতে পারে। এবং এই লড়াই তো হচ্ছে। তাহলে বর্তমানের যে সমস্যা আছে তার থেকে বেরিয়ে আসা কি উত্তর আধুনিকতা? উত্তর আধুনিকতার ধারণা রাষ্ট্রদর্শনে, সাহিত্যে কি এক রকম? আপনি লক্ষ করবেন, যারা এই আন্দোলন করে তারা রাজনীতি ও সাহিত্যে দুই জায়গায় দুই রকম ব্যাখ্যা করে। আপনি যখন রাষ্ট্রভাবুকদের সাথে কথা বলবেন, তারা আপনাকে একরকম ধারণা দেবে। আবার যখন লেখক সাহিত্যিকদের সাথে কথা বলবেন, যারা এটা লালন করে, তারা আপনাকে যে ধারণা দেবে তার সাথে আপনি রাষ্ট্রভাবুকদের মতবাদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিল পাবেন না। আসলে এসব আন্দোলনের একক ধারণাগত বস্তুপত্র বলে কিছু নেই। একেক জায়গায় একেক রকম। দেশকাল ভেদেও আমরা ধারণাপত্রের ভিন্নতা দেখি। প্রকৃতপক্ষে যারা কনসেপ্ট থ্রো করে, আর যারা এটা গ্রহণ করে দুই গ্রুপের মধ্যে কাজের ধরন-ধারণে, ধারণাগত বিষয়ে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। যারা গ্রহণ করে তার নিজেদের সুবিধামতো এর সংজ্ঞা তৈরি করে ফলে মূল কনসেপ্টের সাথে এর মিল খুব কমই দেখতে পাবেন। এজন্য এটা নিয়ে এতো বিভ্রান্তি দেখা যায়।

আমি সময়কে ধারণ করতে পারছি কিনা, আমার কবিতা কবিতা হয়ে উঠছে কিনা আর এর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু – এসব বিষয়ে মাথায় রাখি বেশি। কবিতা যদি কবিতাই না হয়ে উঠল তাহলে আধুনিকতার আর উত্তর আধুনিকতার দিকে তাকিয়ে থেকে কি আসে যায়। আমি এসব ভাবতে গিয়ে কবিতা সাথে উত্তর আধুনিকতার তালগোল পাকিয়ে ফেলি।

১৬. আপনার লেখালেখিতে দেশি-বিদেশি কবি/ সাহিত্যিকদের কারো কোন প্রভাব কি আছে?

ওমর বিশ্বাস: আমি বলতে পারবো না আমার কবিতায় কার বা কাদের প্রভাব আছে। প্রভাব আছে কি না সেটাও বলতে পারব না। তবে আমি কারোর অনুসরণ করি না বা করার চেষ্টা করি না এবং অনুসরণ বা অনুকরণ করে লেখার চেষ্টা করি না। কাজেই দেশি-বিদেশি প্রভাব আছে কিনা সেটাও আমি বলতে পারব না। এটার বিচারের ভার পাঠকের উপর। সাহিত্যে বিভিন্ন প্যাটার্ন আছে। যেমন, লিমেরিক, রুবাই, সনেট ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি সেরকম সব ক্যাটাগরিতে লেখার চেষ্টা করেছি। কারোর অনুকরণ করিনি।

১৭. কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।

ওমর বিশ্বাস: আমি ঢাকায় থাকি। পৈত্রিক বাড়ি বা বাপ-দাদার ভিটা বলতে যেই বাড়ি বোঝায় সেই গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়াতে। পেশা হিসেবে আমি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করি। আমার দুই ছেলে, একটা ক্লাস এইটে পড়ে এবং আরেকটা আশা করি কয়েক মাস পর স্কুলে যাবে। আমার বউ গৃহিনী। এই তো আর কি।

১৮. আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।

ওমর বিশ্বাস: আমি সম্পাদনার ক্ষেত্রে ব্যাপক কাজ করেছি। পত্রিকা বা লিটল ম্যাগ বলেন, সংকলন সম্পাদনা বলেন বা যে কোনো ধরনের সম্পাদনা বলেন সবক্ষেত্রেই আমার অভিজ্ঞতা আছে। আমি বেশ কয়েকটি পত্রিকা করেছি। ‘চাঁড়ুলিয়া’, ‘নাবিক’ ও ‘প্রয়াস’ নামে পত্রিকা করেছি। এর মধ্যে সবচেয়ে উলেখযোগ্য পত্রিকাটি হচ্ছে ‘চাঁড়ুলিয়া’। এটির ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে তিনটি সংখ্যা করার পর আর বের হয়নি। তবে বের করার চিন্তা এখন পর্যন্ত মাথা থেকে বের করতে পারিনি। নাবিকে’র কয়েকটি সংখ্যা বের হয়েছিল। আর প্রয়াসে’র একটি মাত্র সংখ্যা বের হয়েছিল। সবশেষে ‘কালক্রম’ নামে আমি একটি পত্রিকা বের করার চেষ্টা করছি। আশা করি খুব শিগগির এটা বের হবে ইনশাআল্লাহ। প্রস্তুতি প্রায় শেষ। এটাও অনিয়মিত হবে এবং লিটিলম্যাগের চরিত্র প্রকাশ পাবে। এছাড়া বিভিন্ন সংকলনসহ গ্রন্থ ও অন্যান্য ধরনের সম্পাদনা তো আছেই।

১৯. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।

ওমর বিশ্বাস: ঘরের খেয়ে পরের মহিষ তাড়ানোর পর যে জিনিস আপনাকে সম্মান এনে দেয়, সাহিত্যে আপনার একটা অবস্থান তৈরি করতে সাহায্য করে, সেই জিনিস হলো লিটল ম্যাগাজিন। আমরা সংক্ষেপে একে লিটল ম্যাগ বলে থাকি। এটা ক্ষেত্র বিশেষে আর্থিক মূল্যে অলাভজনক হলেও আখেরে অন্য একপ্রকার সাহিত্যি বিনিয়োগ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেউ কেউ, ভাগ্য ভালো যাদের, তারা আর্থিকভাবে লিটল ম্যাগাজিন করে লাভবান হয় না যে তা নয়। কাজেই লিটল ম্যাগ হলো বাহ্যিক দিক দিয়ে আপাতত অলাভজনক সাহিত্যি বিনিয়োগ যা কালক্রমে সাহিত্য সম্পদে পরিণত হয়ে একজন লেখক বা সাহিত্য কর্মীকে খ্যতিমান করে তুলতে সাহায্য করে।

আমি এখনো নতুন নতুন নামে লিটল ম্যাগাজিন করতে চাই। এটা একটা নেশার মতো। এই নেশাটা আজকের লেখকদের মধ্যে কমে যাচ্ছে। এই সময়ে এসে লিটল ম্যাগ বের করার প্রবণতা অনেক কমে গেছে বলে মনে হয়। এটা সাহিত্য আন্দোলনের জন্য খুব জরুরি। এই আন্দোলনকে জোরদার করা দরকার। বেশি বেশি লিটল ম্যাগাজিন বের হোক এটা আমি চাই। তবে পকেটের পয়সা খরচ করে ম্যাগাজিন করার আগ্রহ মানুষের কমে যাওয়ায় তা একধরনের ক্ষতি হচ্ছে সাহিত্যের। এটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। এটা কাটিয়ে উঠা দরকার। এ ব্যাপারে আমি সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানাই, বিশেষ করে তরুণদের প্রতি যারা সাহিত্যের জন্য, কবিতা, লেখালেখির জন্য কাজ করছে এবং করতে আগ্রহী। তবে তরুণদের অবশ্যই প্রতিশ্রুতিশীল হতে হবে। এর জন্য তাকে ত্যাগী মানসিকতার হতে হবে। কমিটেড হতে হবে। পাশাপাশি পৃষ্ঠপোষকতার বিষয় আছে। যাদের সামর্থ্য আছে তাদেরও বৃহৎ স্বার্থে এগিয়ে আশার দরকার।

২০. অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?

ওমর বিশ্বাস: এটাও সাহিত্য চর্চার একটা মাধ্যম। আমি এটাকে পজিটিভলি দেখার চেষ্টা করি। সাহিত্যকে ছড়িয়ে দিতে আমরা যেকোনো মাধ্যম ব্যবহার করতে পারি। এখন অনলাইনে চর্চার মাধ্যমেও সাহিত্যের অনেক কাজ হচ্ছে। লেখক তৈরি হচ্ছে। এখানে একটা বিষয় আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, সেটা হলো, এর মান নিয়ে। অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন যেহেতু ওপেন, যে কেউ এটা করতে পারে। তাই এটা নির্ভর করবে কে এটা করছে তার উপর। মানের ভালো-মন্দ তার হাত দিয়েই আসবে। ভালো হাতে পড়লে মান ভালো হবে না হলে যাচ্ছেতাই অবস্থা হবে। এটাই স্বাভাবিক। অনলাইনের একটা সমস্যা হচ্ছে, আরো সমস্যা আছে, যেহেতু এই প্লাটফর্ম উন্মুক্ত কাজেই এখানে অনেকে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করে থাকে, তারা মানের দিকে তাকায় না। এমনকি অনেকে মানটা কি তাই বোঝে না। সমস্যা হলো, আমরা তো এখন অনেক কিছুই বুঝতে চাই না। বুঝতে পারি না। সে বোধশক্তিও নাই। কারো পরামর্শ শুনতে চাই না। নিজেরা নিজেদের সম্পাদক হতে পারি না।

এটা যেহেতু অনেকটা উন্মুক্ত মাধ্যমে, এখানে প্রতিভার বিষয়টি সামনে চলে আসে। পত্র-পত্রিকা বা ম্যাগাজিনের উপর, অর্থাৎ প্রিন্টেড মাধ্যমগুলোর উপর একপেশে হওয়ার কোনো কোনো অভিযোগের বিপরীতে অনেকেই এই স্বাধীন মাধ্যমকে কাজে লাগাচ্ছে। এই মাধ্যমকে আরো কার্যকর ব্যবহার করতে পারলে, ছড়িয়ে দিতে পারলে এটা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলেই আমার মনে হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা করবে কে? কে এটাকে কীভাবে ব্যবহার করছে কতটুকু দক্ষতার সাথে করতে পারছে তার উপর এর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

২১. আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে? আপনার কল্পনায়।

ওমর বিশ্বাস: আমি সাহিত্য নিয়ে আশাবাদী মানুষ। ব্যক্তিগতভাবেও আশাবাদী মানুষ। তাই বলতে চাই, মানুষ আবার সাহিত্যের দিকে ফিরে আসবে। মানে মানুষ দিনকে দিন যেভাবে প্রযুক্তি নিয়ে অস্থিরতায় ভুগছে তাতে সাহিত্যের কাছেই তাকে ফিরে আসতে হবে। শুধু এটাই না, বর্তমান সময় মানুষের ভিতর অস্থিরতা তৈরি করছে। এটা কালক্রমে বেড়েই চলছে। এরও তো একটা শেষ আছে। সাহিত্যিই পারে এর থেকে মানুষকে বের করে আনতে। মানুষে মস্তিষ্কের চিন্তায় চেতনায় সুস্থ প্রভাব বিস্তার করতে। তার মনকে পরিবর্তন করতে।

মানুষের শেষ চাওয়া একটু শান্তি। সারাদিনের পরিশ্রমের পর দিনশেষে পুরুষেরা ঘরে ফেরে। কর্মজীবী নারীরা ঘরে ফেরে। বিশ্রাম নেয়। ঘরের নারীরাও বিশ্রাম নেয়। বইও তাদের বিশ্রামের সঙ্গী। কেননা বই তাকে আগামীকালের জন্য উজ্জীবিত করে। জীবনীশক্তি জোগায়। সে অবসরে সঙ্গ দেয়। বিনোদনের একটা মাধ্যম হয়ে কাজ করে। বই দিতে পারে মন ও শরীরের খোরাক। এখন প্রযুক্তির যুগ। এর থেকে মানুষের মন একসময় উঠে যাবে। আগামী দিনের সাহিত্যকে তাই মানুষ আরো ভালোভাবে গ্রহণ করবে বলে আমার মনে হয়। তবে এর জন্য আরো কিছুটা সময় লাগবে। প্রযুক্তি, ভার্চুয়াল জগত থেকে মানুষকে মুক্তি পেতে হবে। সে মুক্তি চাইবে। এখনই মানুষ নিজের, ছেলে-সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তারা অনেক সময় সন্তানের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিতে পারছে না। কিন্তু একথা তাদের ভিতর ঢুকে গেছে যে মোবাইলের যত্রতত্র ব্যবহার সন্তানদের ভবিষ্যৎ সমস্যাগ্রস্ত করছে। কাজেই সেই সময়টা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করে যেতে হবে। তবে সে সময়ের অপেক্ষায় আমাদের সাহিত্যের কাজ থামিয়ে রাখা যাবে না।

২২. কেমন পৃথিবী দেখতে চান?

ওমর বিশ্বাস: এক কথায় সুন্দর পৃথিবী দেখতে চাই। লোভহীন পৃথিবী দেখতে চাই। এতো সুন্দর পৃথিবী কেন কলুষিত হবে, রক্তাক্ত হবে। এমন পৃথিবী দেখতে চাই, যেখানে টনকে টন বোমা ফেলে শিশু-বৃদ্ধ সহ ৩৫ হাজার লোককে একসাথে মেরে ফেলা হবে না। গণহত্যা চালানো হবে না। দেশে দেশে শক্তির মহড়া হবে না। ফ্যাসিবাদের উত্থান হবে না। এরকম পৃথিবী দেখতে চাওয়া কোনো সাধারণ মানুষের কাম্য হতে পারে না। কবির কাম্য তো নয়ই।

০৩.১০.২০২৪
ঢাকা, বাংলাদেশ।

………….
গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমির মুখোস উন্মোচন