spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাকাঁচ ভাঙা শব্দ ও অন্যান্য কবিতা : আবু জুবায়ের

কাঁচ ভাঙা শব্দ ও অন্যান্য কবিতা : আবু জুবায়ের


…………
যদি সময়কে ওজন করা যেত
…………

প্রতিটি কেজির ভারে লুকানো
আমার সংগ্রাম, আমার ক্ষোভ
এটি হয়তো এক জীবনের
অদৃশ্য ভার
প্রতি মুহূর্তে
সূর্যের নিচে
সময় ভারী হয়ে উঠছে
সময় ভারী হচ্ছে
আর আমি হালকা হচ্ছি।

………
আমরা শুধু বেঁচে আছি, মরে গেছি বহু আগেই
………..

নীল আকাশে লাল লাশ ভাসছে
ধোঁয়া ওঠা রাস্তায়, হাঁটছি আমি, একা।
পায়ের তলায় শহরের শিরদাঁড়া ভেঙে যাচ্ছে
চায়ের কাপ ছুঁয়ে বিপ্লবের গল্প
তবু কেউ শোনে না, কেউ বোঝে না।
সিগারেটের ধোঁয়ার ভেতর, চোখের ভ্রু-ভঙ্গিতে
স্বপ্নেরা জ্বলছে, পুড়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে
রক্তমাখা প্রতিজ্ঞা, কিন্তু কেউ নেই পাশে
নেই কোন জেগে ওঠা কণ্ঠস্বর।
এই শহরে মৃতরা হাঁটে
আমাদের বুকের ওপর দিয়ে
গলির কোণায় থেমে থাকা রোদ মুছে দেয়
যত অজস্র কষ্টের স্মৃতি চিহ্ন।
আমরা সবাই যেন লাশ বয়ে বেড়াচ্ছি
তবু কেউ কিছু বলে না, কেউ জানে না
কীভাবে ভাঙতে হয় শেকল
কীভাবে তোলপাড় করতে হয় পৃথিবীর বুকে
আশ্রয় খুঁজে নেয় অন্ধকার।
জীবনের ধারে-পাশে, পাথরে লেখা
আমাদের ইতিহাস, লেপ্টে থাকা রক্তের দাগ
তবু একবারও কেউ ফিরে তাকায় না
কেউ কাঁদে না।
নিঃসঙ্গতা থেকে জন্ম নেওয়া কবিতার মতো
আমরা শুধু বেঁচে আছি, মরে গেছি বহু আগেই।

…………
কাঁচ ভাঙা শব্দ
…………

আমার জিভে আটকে আছে শব্দ
কথারা কাঁচের মতো ভেঙে পড়ে
আমি গিলি টুকরোগুলো
রক্ত মাখা শব্দেরা মুখ দিয়ে বেরোয়।
তুমি তাকাও
তোমার চোখের নিচে জমে থাকে
অনেকগুলো রাত
সব জানি,
কিন্তু বলি না
কথা মানেই তো
সব ছিঁড়ে ফেলা নয়।
তুমি পা বাড়াও,
রাস্তায় পড়ে থাকে
আমাদের খোঁজা মুখ
তোমার হাতে ধরা আয়নাটা
আর আজকাল কিছু দেখায় না।

………….
উল্টো স্রোত
………….

আমি কথা বলি পা দিয়ে
তুমি শোনো হাত দিয়ে
দেখা যায়, এভাবেই
শরীরেরা ভুলে যায় তাদের কাজ।
তোমার চোখে আমি জোয়ার দেখেছি
তুমি হয়তো আমায় স্রোত বলে ভাবছো
কিন্তু আমি তো উল্টো দিকেই যাই।
রাস্তায় পড়ে থাকা ধুলো
আমার নাম লিখে দেয় অচেনা হাতে।
তুমি দেখছো,
আমি কুড়িয়ে নিচ্ছি টুকরো টুকরো মুখ
আমার নিজেরটাও খুঁজছি।
পথের শেষে দাঁড়িয়ে আছি,
জানতে চাই
শরীরটা কি এবার জোড়া লাগল?
আমি বলি না,
তুমি বুঝে নাও।

………….
মলিয়েরের প্যাসেজ পেরিয়ে
…………..

মলিয়েরের প্যাসেজ পেরিয়ে
নিঃশব্দে বয়ে যায় সময়
পাথরের গায়ে জমা থাকে
নাটকের পুরনো ছায়া।
আমি হাঁটি
অতীতের মৃদু স্বর শুনি
দূরে দেখি কবিতার বাড়ি
শব্দেরা নিজে থেকে নতুন নাটক লিখতে বসেছে।

……………..
গভীর সংযোগ
……………..

তুমি কি জানো? সার্ত্রের মতে আমরা সবাই স্বাধীন
আমার স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করো না
আমাকে শেখাও
কীভাবে সেই স্বাধীনতার ভার আমি বয়ে নিতে পারি।
আমার নৈঃসঙ্গ্য দূর করো না
তোমার উপস্থিতি আমাকে মনে করিয়ে দেয়
একাকীত্বই আমাকে সত্যিকারের মুক্ত মানুষ বানায়।
তুমি আমি দুজনেই স্বাধীন
তবু, আমাদের ভেতরে গভীর সংযোগের এক অন্তঃসলিলা বয়ে চলে।
আমরা একে অপরের সৃষ্টি নই
তুমি আমার সত্তার অর্থ
তুমি সেই আয়না,
যেখানে আমি নিজেকে নতুনভাবে দেখি।

………
সম্পর্ক
……….

ভোর এর সাথে আলোর কোন সম্পর্ক নেই।
আলো তার নিজস্ব সত্তা, অনির্বাণ চেতনা
সমস্ত অস্তিত্বের গভীরে নিহিত সেই জ্যোতি
যা অপেক্ষা করে না কোনো শুরুর জন্য।
ভোর—এক উপলব্ধির নাম
সময়ের প্রবাহের মাঝে এক ক্ষণিক বিরতি
মনে করিয়ে দেয়
জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আসলে আলোর বিপরীত।

………….
আমার গ্রামের পথে
…………..

মেঠো পথের ধারে কাঁটাগাছের ঝোপ, ফাঁকে ফাঁকে টেঙরামাছ খোঁজে বাচ্চারা কাদা মেখে। খড়ের ছাউনি দেওয়া কুড়ে ঘর, ঘরের পেছনে বাঁশঝাড়ের সারি। মাটির চুলায় শেকেছে রুটি, মায়ের হাতের গন্ধ মাখা সেই সাদা ধোঁয়া উঠছে আকাশে। পুকুর পাড়ে নারকেল গাছের ছায়া, কলার থোড় ভেঙে গরু খাওয়ায় রাখাল।
দূরে তালগাছের ডগায় বসে বসে শালিক ডাকছে, গামছা বাঁধা কাঁধে, খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে গৃহস্থ ছেলে মাঠের পথে। পাশ দিয়ে বয়ে যায় কচুরিপানায় ঢেকে থাকা খাল, ভ্যানে করে হাটের দিকে যাচ্ছে তেলেভাজার দোকানী। গাছের ডালে ঝুলে থাকে ঢেঁকি, ধানের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে।
গাভীর বাচ্চা দৌড়ে যায় উঠোনে, বউ-ঝিরা ঢেঁকিতে পাড় দেয়, ঝিমঝিম রোদে দাওয়ায় বসে পিঠা বানায় বুড়ি। ভোরের আজানের ধ্বনি মিশে যায় মোরগের ডাকে, আর সন্ধ্যার বেলায় কুপির আলোতে জমে ওঠে গ্রামের আড্ডা, মোড়লদের গল্পে শোনা যায় বৃষ্টি হবে কি না—তার হিসাব।
এই গ্রামে মাটির গন্ধে মাখা মানুষ, তাদের জীবনে জোয়ার ভাটার সুর। শীতের সকালে খেজুরের রস, আর দুপুরের কাঠফাটা রোদে বটগাছের নিচে হাডুডু খেলার ডাক।

প্যারিস, ১৬ অক্টোবর ২০২৪

…………
অসীমে
………….

অজ্ঞেয়তার অবিনশ্বর মহিমা
জটিলতার অন্তঃসলিলা প্রবাহে রূপ নেয় এক অনির্বচনীয় সত্ত্বায়।
অস্তিত্বের প্রতিটি বিন্দুতে নিহিত থাকে অদেখার অনিবার্য ছাপ
বিচ্ছিন্নতার মধ্যে সংযুক্তি শব্দহীনতার গভীরে স্পন্দনের প্রতিধ্বনি তৈরি করে ।
জ্ঞানসীমার পারিপার্শ্বিকতায় ঘূর্ণায়মান এক প্রাচীনতম প্রশ্ন
যার উত্তর নেই কোনো জড়তায় বাঁধা
শূন্যের গভীরতম স্তরে বন্দী সম্ভাবনার অসীম বিস্তার।
নিরাকার চিন্তনের প্রান্তে জন্ম নেয় এক উপলব্ধি
স্থিরতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন গতি,
শক্তির কণায় কণায় সঞ্চারিত এক অস্পষ্ট ব্যাখ্যা
যা যুক্তিহীনতায় অনুপ্রাণিত করে সৃষ্টিকে।
ধারণার মূলে আচ্ছন্ন এক বিভ্রম
যার দৃশ্যায়ন অনাকাঙ্ক্ষিত বোধের সীমারেখায়।
গূঢ় অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে
মৌলিকতার মোহ, যা সময়ের গর্ভে লীন হয়
কঠোর পাথরের স্তরে স্তরে সঞ্চিত এক ইতিহাস।
নিরন্তর এক প্রকাশ যা চোখের আড়ালে,
তবু প্রতিটি কণা তারই সাক্ষ্যবাহী,
মুক্তির অন্বেষা, যার সীমারেখা অদৃশ্য।
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণিকায় নিহিত এক মহাবিশ্ব
অনুধাবনের অযোগ্যতাকে অতিক্রম করার প্রয়াসে
যেখানে ভাবের পরিসর নির্ধারিত নয়,
অথচ প্রতিটি মুহূর্ত সৃষ্টি করে নতুন এক অসীমতা।

প্যারিস, ১৫ অক্টোবর ২০২৪।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমির মুখোস উন্মোচন
কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমি এবং আমার গ্লানি
কাজী জহিরুল ইসলাম on ‘প্রথম আলো’র বিকল্প
পথিক মোস্তফা on মানবিক কবি ফররুখ আহমদ