কাজী জহিরুল ইসলাম
একটি দেশের উন্মেষকাল থেকে আমি সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রশাসন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সে দেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বেও ছিলাম। মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলাম, কথাটি এখানে এজন্য উল্লেখ করলাম, তাতে বুঝতে সুবিধা হবে যে আমি দেশটির রাষ্ট্রপ্রশাসন ও রাজনৈতিক ডাইনামিকসের খুব ভেতরের অনেক কিছুই জানি। দেশটির নাম কসোভো, সময়কাল ২০০০ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৩ সালের এপ্রিল। কসোভো তখনো স্বাধীন দেশ হয়নি। স্বাধীন দেশ না হলেও একটি স্বাধীন দেশের মতোই কসোভোর সব কিছু পরিচালিত হত। দাপ্তরিকভাবে কসোভোকে বলা হত টেরিটোরি। এই টেরিটোরির চারপাশে যে সীমান্ত ছিল সেই সীমান্তকে বলা হত জাতিসংঘ সীমান্ত, কারণ দেশটির বা টেরিটোরিটির সকল প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করত জাতিসংঘ। ২০০১ এ নির্বাচন হয়, জাতীয় সংসদ গঠিত হয় এবং ১০ সদস্যের একটি মন্ত্রী পরিষদও গঠিত হয়। সাংবিধানিকভাবে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করলেও, অর্গানোগ্রামে দেখানো হত, সংসদের ওপরে রাষ্ট্রপতি, এবং তারও অনেক ওপরে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি। জাতিসংঘের যিনি প্রধান, কসোভোতে, তিনি চাইলে প্রেসিডেন্টকেও বরখাস্ত করতে পারেন, সংসদও ভেঙ্গে দিতে পারেন। আমি তখন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রশাসক। মন্ত্রীর অবর্তমানে কয়েকদিন ছিলাম মন্ত্রীর দায়িত্বে।
সংস্কৃতি, ক্রীড়া, যুব এবং প্রবাসী বিষয়ক ডিপার্টমেন্ট, চারটি সরকারী ডিপার্টমেন্টকে চার জায়গা থেকে তুলে এনে তৈরী করা হলো একটি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ে গঠন করা হল একটি নতুন কেন্দ্রীয় প্রশাসন বিভাগ, যার প্রধান ছিলাম আমি। এই গঠন প্রক্রিয়াটিও আমিই পরিচালনা করি। আমার প্রধান কাজ ছিল একটি ‘হতে যাচ্ছে’ দেশের সরকারী প্রশাসন তৈরী করা। একেবারে স্ক্রাচ থেকে শুরু করে এই মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন ব্যবস্থা দাঁড় করিয়ে দিই মাত্র এক বছরে। আমার বস ছিলেন ভারত সরকারের সচিব, চিরকুমার বিয়ালা পাপা রাও, তিনি লিয়েন নিয়ে যোগ দেন জাতিসংঘের কসোভো মিশনে। রাওয়ের সহায়তায় আমি একটি সফল প্রশাসনিক অবকাঠামো দাঁড় করাতে সক্ষম হই। এক বছর পরে ইওরোপিয় ইউনিয়ন এবং ইউএনডিপি যৌথভাবে কসোভোর দশটি মন্ত্রণালয়ের নবগঠিত প্রশাসনিক অবকাঠামো মূল্যায়ন করে এবং একটি রাষ্ট্রীয় কনফারেন্সে ঘোষণা করে সংস্কৃতি, যুব, ক্রীড়া ও প্রবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন হচ্ছে মডেল প্রশাসন। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে রিকোমেন্ড করা হয়, তারা যেন এই মডেল অনুসরণ করে। এটি আমার পেশাগত জীবনের একটি বড় সাফল্য।
মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কসোভোর ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি জ্ঞান ক অক্ষর গো মাংস। ৮৫ শতাংশের মাতৃভাষা আলবেনিয়ান আর ১৫ শতাংশের সার্বিয়ান। তাঁরা ইংরেজিতে কথা বলতে গেলে দাঁত ভেঙে যায়, লিখতে গেলে কলম ভেঙে যায় অবস্থা। আর এই অবস্থা ছিল বলেই হয়ত আমার মতো স্বল্প ইংরেজি জানা মানুষ সেখানে গিয়ে হিরো হয়ে যেতে পেরেছিলাম। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সান্নিধ্যে থেকে তাঁরা কিন্তু ইংরেজি ভাষাটা শিখে ফেলে। যারা ইংরেজি ডকুমেন্ট দেখলে মূর্ছা যেত, কোনো মিটিংয়ে কথা বলতে ডাকলে গায়ে জ্বর উঠত, তিন বছর পর আমি যখন দেশে ফিরি তখন দেখি সেই তাঁরাই খুব ভালো না হলেও স্বচ্ছন্দে ইংরেজিতে যোগাযোগ করতে পারছে। আর অনেক বছর পরে, এখন, জাতিসংঘের মিশনে বা সদর দফতরে যখন কোনো কসোভারকে দেখি, অবাক হয়ে যাই তাঁদের ইংরেজি উচ্চারণ এবং ফ্লুয়েন্সি দেখে।
এই প্রসঙ্গটি এজন্য এখানে আনলাম, আমাদের, বাঙালিদেরও ভীষণ রকম ইংরেজি ভীতি আছে। এই ভীতির কারণে যথেষ্ঠ মেধাবী হওয়া সত্বেও আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারে আমরা পিছিয়ে আছি। যারা চাকরি পাচ্ছি তারাও নিজের দপ্তরে ইংরেজি ভীতির কারণে খুব এগোতে পারছি না। এবার আসি শিল্প-সাহিত্যের জায়গাটিতে। শুধু বাংলা ভাষায় ভালো সাহিত্য রচনা করলেই হবে না, আজকের দিনে সাহিত্য দিয়ে বিশ্ব জয় করতে হলে লিখতে হবে ইংরেজিতে। দেশের ভেতরে ১৭ কোটি, বাইরেও তো অনেক, প্রায় এক কোটি। এই এক কোটি বাঙালির প্রত্যেকের যদি একজন করে ইংরেজি জানা বন্ধু থাকে তাহলে তাদের সংখ্যাও এক কোটি। সেই এক কোটি লোক নিশ্চয়ই তাদের বন্ধুর দেশের শিল্প সাহিত্যের খোঁজ নেয়, পড়তে চায়। কিন্তু তাঁদের হাতে তুলে দেবার মতো বলতে গেলে তেমন কিছুই নেই আমাদের। এই বিড়ম্বনায় আমিও পড়েছি বহুবার। বাংলাদেশিদের লেখা ইংরেজি বই ক’টা আছে? আপনি হাতের কড়েই তা গুনে ফেলতে পারবেন। ইংরেজিতে সাহিত্য করার প্রতি আমাদের কিছুটা বিদ্বেষও আছে, এই বিদ্বেষের উৎস হচ্ছে ভীতি। আর কথায় কথায় আমরা মাইকেলের ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরি। অথচ ভারতে এখন কয়েক’শ লেখক আছেন যারা ইংরেজিতে নিয়মিত সাহিত্য রচনা করছেন। ভীতি দূর করে আমাদেরও শুরু করতে হবে। হয়ত প্রথমদিকে দূর্বল হবে, তাতে কি, দূর্বল ইংরেজি লিখতে লিখতেই একসময় সবল হয়ে উঠবে। আমি একবার আদ্দিস আবাবায় গিয়ে সেই দেশের লোকজ সাহিত্য ইংরেজিতে খুঁজছিলাম। ট্যাক্সি নিয়ে শহরের সব কটি বড় বইয়ের দোকান ঘুরে একটিমাত্র চটি বই পেয়েছি এবং তার ইংরেজি এতোই দূর্বল যে তাকে সাহিত্য পদবাচ্য বলা যায় না। কিন্তু আমি যা খুঁজছিলাম তা কিন্তু ঠিকই পেয়েছি। ইথিওপিয়ার লোকজ বিশ্বাস, লোকজ ভাবনা, গল্প ইত্যাদি। সেখান থেকে রসদ নিয়ে আমি বেশ কিছু লেখা লিখেছি।
আগস্টের ২০ তারিখে ৩৭ জন বাঙালি কবি, যারা দেশের বাইরে থাকেন, তাঁদের সাড়ে তিন’শ কবিতা নিয়ে ৫৫৪ পৃষ্ঠার একটি ইংরেজি কবিতার অ্যান্থলজি বের করি। বইটি আমি অন্য কোনো প্রকাশককে না দিয়ে সরাসরি অ্যামাজনে প্রকাশ করে দিই। বইটির নাম ‘আন্ডার দ্য ব্লু রুফ’। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এটি প্রকাশ করতে পেরেছি কারণ ৩৭ জন কবির সকলেই আমাকে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। আর একজন মানুষের নাম আমাকে নিতেই হবে, যার সহযোগিতা ছাড়া এই কাজটি করতে পারতামই না, তিনি সিদ্দিক মাহমুদ। সিদ্দিক ভাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই বইয়ের প্রায় অর্ধেক কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিয়ে একটি মহৎ কাজ করেছেন।
বইটি আমি এই স্বপ্ন নিয়ে করেছি যে বাঙালি কবিরা ইংরেজিতে লিখতে উদ্বুদ্ধ হবেন, নিজের কবিতা নিজেই ইংরেজিতে অনুবাদ করে বই বের করতে আগ্রহী হবেন। হয়ত আগামী বছর এই ৩৭ জনের প্রত্যেকের একক ইংরেজি কবিতার বই বেরিয়ে যাবে। আজ থেকে পাঁচ বছর পরে, যদি তাঁরা ইংরেজিতে লেখা চালিয়ে যান, হয়ত এখান থেকে ৪/৫ জন বড় মাপের কবি বেরিয়ে আসবেন যারা ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দে কবিতা লিখতে পারছেন। এতে করে সুবিধাটা হবে বিদেশে বড় হওয়া আমাদের পরের প্রজন্ম বাংলাদেশের কবিদের চিন্তাকে জানতে পারবে, বাংলাদেশকেও জানতে পারবে। বিশ্বসাহিত্যে আস্তে আস্তে আমরা আমাদের জায়গা করে নিতে পারবো। যদি আমাদের ৫ হাজার ইংরেজি বই থাকে, ভালো মন্দ যাই হোক একটা উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারবো, যে আমরা আছি। চর্চা অব্যাহত থাকলে একদিন আমাদের লেখকদের হাত থেকে ভালো ইংরেজি সাহিত্য বেরিয়ে আসবেই, কারণ বাংলাদেশের লেখক তথা মানুষের মেধার ওপর আমার আস্থা আছে।
নিউইয়র্ক। ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮