spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাঅগ্রিম মৃত্যু ও অন্যান্য কবিতা : আমিনুল ইসলাম

অগ্রিম মৃত্যু ও অন্যান্য কবিতা : আমিনুল ইসলাম

…………….
অগ্রিম মৃত্যু
……………..

বিতর্কিত আসমান সাক্ষী, সাক্ষী মহাকালদর্শী আদমসুরুত
একদিন আমি ছিলাম ফারাক্কাপূর্ব প্রেমতলীর পদ্মা
স্রোত আর ঢেউ
পাল আর ভাটিয়ালি
কি বোশেখে কি শ্রাবণে উথাল দুপুর পাথাল রজনী!
আর আজ আমার বুকে হাহাকার তোলে উজানের
অভিশাপে গড়ে ওঠা চরের তপ্ত নিঃশ্বাস ;
এই বুকে আর ভাসে না কোনো সওদাগরী বজরা
ঢেউয়ের তালে তালে
বেজে ওঠে না কোনো নৃত্যরত পায়ের নূপুর;
দুপুরের ক্যাম্পাসে বিকালের রাস্তায় একদিন আমি ছিলাম
স্বপ্নের মশাল মিছিল, আমাকে নিয়ে বেজে উঠতো
বাতাসের রক্তচাপ বাড়িয়ে দেওয়া স্লোগান:
‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়!’
আজ আমি একটি সুবিধাবাদী নীরবতা,
বজ্রপাতের আকাশ ফাটানো শব্দেও জেগে উঠতে পারি না;
অথচ আমি কুম্ভকর্ণও হয়ে যাইনি।
ও বৈশাখী বাতাস,
এই আমাকে কেন শোনাতে আসো বিদ্রোহী কবির গান:
‘মোরার ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল’ !
আমার নামের ঘষা লেগে বাতাসের সেলুলয়েডে
বেজে ওঠে গোপাল ভাঁড়ের এইচএমভি হাসি।

অথচ একদিন আমি ছিলাম অপদেবতার চোখে বুড়ো আঙুল
দেখানো আপসহীন প্রেমিকপ্রাণ ; আমার অন্যায্য মৃত্যু
অনুমোদনে ভয় পেয়েছিলেন দেবতাশ্রেষ্ঠ ইন্দ্র;
গার্ল ফ্রেন্ডকে সঙ্গে নিয়ে স্বর্গ কাঁপিয়ে ফিরে এসেছিলাম
করতোয়ার তীরঘেঁষা শিমুল পলাশের ভিটায়;
আর আজ এই আমার প্রতিটি লোমকূপে ছোটো ছোটো
অজস্র মৃত্যুর সীল;
জোড়া লাগানো পা নিয়ে দাঁড়াতে চাওয়া রোগীর মতো
আমি সাহসে ভর দিয়ে উঠতে গেলেই জানালায়
খুক খুক করে কেশে ওঠে জগৎশেঠ-মীরজাফরের সম্মিলিত কণ্ঠ;

সম্রাটের বেতনভুক গুণ্ডাবাহিনী তো দূরের কথা,
আমার গলা শুনে ভয় পায় না কোনো ছিচকে চোর,
ধ্বস্ত পকেটমার কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ গাঁজা খেয়ে
বকবক করতে থাকা সন্ধ্যার শাহবাগ।
আমার উঁচানো হাত দেখে হাসে আমারই বইয়ের
তাকে নৃত্যরত ফিনিশ প্রুফ তেলাপোকা।

আমি বুঝি, ইউডি মামলায় অভিজ্ঞ থানাকে দিয়ে হবে না ;
তো ও গুম কমিশন, এই অগ্রিম মৃত্যুর তদন্ত করবে কে?

……………..
মীরজাফর
……………..

মীরজাফরকে ঘৃণা করতে শিখেছিলাম অবুঝ সেই ছোটোকালেই ; পদ্মার জল ছুঁয়ে ভেসে আসা লালগোলার বাতাসে দোলায়িত আমাদের গ্রামাঞ্চলে মীরজাফর শব্দটি গালি হিসেবে ব্যবহৃত হতো বিশ্বাসঘাতক, বেঈমান, ইবলিশ– এমন আর পাঁচটা গালির ন্যায় । কিন্তু মানুষের নাম কেন অমন খারাপ গালি হবে? কেন? কেন !
মাচায় বসে আরব্য উপন্যাস পড়ায় ব্যস্ত মানুষটিকে ফারাক্কাপূর্ব পদ্মার ঢেউয়ের মতো কৌতূহলে একবার জিজ্ঞাসা করে বসি: মীরজাফর কী আব্বা ? মীরজাফর কি কোনো দৈত্য-দানব ? নাকি চল্লিশ চোরের সর্দার ?

যারা শুধু নিজের লাভের জন্য দেশের সাথে বেঈমানী করে তাদের মীরজাফর বলে বেটা; আগে বড়ো হও, তখন তুমি সব বুঝতে পারবে.. ।

আব্বাকে কবরে শোয়ায়ে রেখে এসে আজ আমি বড়ো হয়ে গেছি,—অনেক বড়ো, অনেক অনেক বড়ো ;
সেই শিশুকাল তো নেই-ই; আমাদের গ্রামটিও ভেসে গেছে ফারাক্কা পরিচালিত শ্রাবণের পদ্মায় ;

তবে এখন আমি মীরজাফর শব্দটির ইতিহাস জেনে গেছি ; ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পলাশীর আম্রকানন দেখা হয়নি বটে কিন্তু এখন সকালে– সন্ধ্যায়—-রাতে– প্রায়ই দেখতে হচ্ছে মীরজাফরের বহুরূপী মুখ– টেলিভিশনের পর্দায়, সংবাদপত্রের বুকে, ইন্টারনেটের দেওয়ালে সাঁটা ফেসবুকের নির্লজ্জ আয়নায় ;

মারবেল খেলা কৈশোরে বেত হাতে ইয়ার পণ্ডিত স্যার শিখিয়েছিলেন: ‘চোরের মায়ের বড় গলা।’
আমার হাতের তালুতে সেই বেতের দাগ আজও লেগে আছে কাঁসার থালায় পানির দাগের মতন।

কিন্তু ও পণ্ডিত স্যার, কবর থেকে একবার উঁকি দিয়ে দেখুন,— মীরজাফরেরা শুধু লোভীই নয়,
রৌদ্র ঝলসিত হাটের ভিড়ে উলঙ্গ হয়েও এদের কোনো লজ্জা নাই।অবশ্য আমার আগেই এদের দেখে ফেলেছিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী !

আর এখন আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও যতবারই দেখে ফেলি,– লীনার সতর্ক বার্তাকে পাশ কাটিয়ে আমার মুখ ফসকে বের হয়ে আসে: তুই মীরজাফর! তোরা মীরজাফর !

………….
রিকশার পাদানিতে রক্তমাখা ঝুলে বাংলাদেশ
………….

এখনো তো জান আছে, নড়ছে দ্যাখেন ! যেতে দিন!
হাসপাতালে নিয়ে যাই গো স্যার !

যাওয়া যাবে না, চটজলদি রিকশা ঘুরাও !
ঘুরাও বলছি !
আন্দালন? পাছার মধ্যে ঢুকিয়ে দিবো সবখানি !
যত শালার নতুন রাজাকার !

অধম মানুষ! নিজেই নিজের শত্রু হলে তুমি,
ক্ষণস্থায়ী একজীবনে এত তোমার লোভ!
তোমার চেয়ে কুকুর ভালো। শেয়ালও ভালো।
—-ঝুঁকে এসে আয়োনোস্ফিয়ারে
নীলচোখ—রোদের ভাষায় আকাশ জানায় ক্ষোভ!

হাসপাতালে হয়নি যাওয়া; লোহু ঝরে পিঠ বেয়ে…
নাফিজের প্রাণটুকু ফোঁটায় ফোঁটায় হয়ে আসে শেষ
হায় আল্লা কোথায় যাবো !— নুর মোহাম্মদ;
কাঁদে প্রাণ….
রিকশার পাদানিতে রক্তমাখা ঝুলে বাংলাদেশ।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ