আবু তাহের সরফরাজ
বাংলা সাহিত্যে ইসলামি কবিতার গৌরবমণ্ডিত ঐতিহ্য রয়েছে। বঙ্গদেশে ইসলাম ভূঁইফোঁড় কোনো ঐশী মতবাদ নয়। যুগে-যুগে অসংখ্য সুফি-দরবেশের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এই দেশে ইসলাম প্রসার লাভ করে। কোনো মুসলিম শাসকদের দ্বারা এদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়নি। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজ্য বিস্তার ও নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা। ফলে মুসলিম শাসকদের এ দেশে ইসলামের প্রতিনিধি ভাবলে মস্ত ভুল হবে। তবে ইতিহাসে কয়েকজন মুসলিম শাসককে দেখা যায় যারা রাজ্য শাসনের পাশাপাশি ইসলাম প্রচারেও বেশ আন্তরিক ছিলেন। ইসলামের মহৎ আদর্শ সাধারণ মানুষের ভেতর ছড়িয়ে দিতে বাংলা ভাষার অনেক কবিই কবিতা রচনা করেছেন। ১৪-১৫ শতকের কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর, শেখ ফয়জুল্লাহ, দোনাগাজী চৌধুরী, দৌলত উজির বাহরাম খান, সৈয়দ সুলতান, মুঘল আমলের কবি হেয়াত মাহমুদ, জৈনুদ্দিন, সৈয়দ আলাউল, নজরুল্লাহ খাঁ― এরকম অসংখ্য নাম উল্লেখ করা যাবে। এরপর কায়কোবাদ, কাজী নজরুল ইসলাম, আবদুল কাদির, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ ও আল মাহমুদসহ বাংলা কবিতার অসংখ্য দিকপালের নাম করা যেতে পারে যাদের কবিতার বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে ইসলামের গুণগান। দীর্ঘকাল ধরেই বাংলা কবিতায় ইসলামি ভাব ও আদর্শের জয়গান ছিল তুঙ্গে। বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের অভ্যুদয়ের পর থেকেই কেন যেন ইসলামি কবিতাচর্চার জোয়ার স্থিমিত হয়ে পড়ে।
কাজী নজরুল ইসলামের মাধ্যমেই ইসলামি কবিতা বাংলার মুসলিমের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। তার আগে ইসলামি কবিতার এ রকম গণজোয়ার আমাদের চোখে পড়ে না। ইসলামি কবিতাকে নজরুল কেবল জনপ্রিয়ই করেনি, ইসলামি কবিতাকে সুসংহত করেছেন। তাকে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বলা দরকার, নজরুলের ইসলামি সঙ্গীতগুলোও আসলে কবিতা। কবিতার পঙক্তি ও বিন্যাস সেসবে রয়েছে। তাতে সুর আরোপ করে কণ্ঠ দেয়ার কারণে সেগুলো সঙ্গীত হয়ে ওঠে। একটা সময় পর্যন্ত সঙ্গীত ও কবিতার ভেতর কোনোই পার্থক্য ছিল না। সঙ্গীতকে তখন বলা হতো গীতিকবিতা। মানে, যে কবিতাকে গীত করা যায়। আস্তে-ধীরে আমাদের মূর্খতা বাড়ার সাথে সাথে কবিতা হয়ে পড়লো এলোমেলো শব্দের কাঠামো। যা ইচ্ছে তা-ই প্রলাপের মতো লিখে সেই লেখাকে বলা হলো কবিতা। আর, সঙ্গীত হয়ে পড়লো চিৎকার চেঁচামেচি ও বাদ্যযন্ত্রের বেমক্কা আর্তনাদ। বাংলা ইসলামি কবিতায় নজরুল ছিলেন বিরাট মহীরুহ। তার দেখানো পথে ইসলামি কবিতার ধারাকে এগিয়ে নিয়ে চললেন বঙ্গের অনেক কবি। গোলাম মোস্তফা ও ফররুখ আহমদ ইসলামি কবিতার পাশাপাশি লেখেন অসংখ্য ইসলামি সঙ্গীত। বলা বাহুল্য, সেসব সঙ্গীত আঙ্গিকগত দিক থেকে আসলে কবিতা। ড. মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও আবু হেনা মোস্তফা কামালসহ অনেক গীতিকারের সঙ্গীত লিখিতভাবে পড়লে আমরা দেখবো, সেগুলো আসলে কবিতা। সুর আরোপের কারণেই কবিতা সঙ্গীত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই দেশে একটা পর্যায়ে কবিতা ও সঙ্গীতের বাণী ও আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য একটি আরেকটি থেকে আলাদা হয়ে গেল। ফলে প্রলাপের মতো শব্দ ও বাক্য অনেকেই পেয়ে গেল কবি খ্যাতি। পাশাপাশি, সঙ্গীতের কথাগুলো শিল্প-সৌন্দর্য হারিয়ে হয়ে উঠলো চটকদারি। বাংলা কবিতা ও সঙ্গীতের ভাঙনের এই যুগপর্বে কয়েকজন কবি প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে স্থির রইলেন শিল্পের প্রতি আন্তরিক সততায়। তারা কবিতা ও সঙ্গীতকে আলাদা করলেন না। নজরুলের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে লিখে চললেন ইসলামি কবিতা ও সঙ্গীত। বলতে কী, প্রথাবিরুদ্ধ হলেও তাদের কারো কারো বাণীপ্রধান সঙ্গীত হয়ে উঠলো তুমুল জনপ্রিয়। বাংলাদেশের সাধারণ মুসলিম সেইসব সঙ্গীতের কথা ও সুরের মূর্ছনায় বিহ্বল হয়ে গেল। এসব কবিদের মধ্যে যার নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয় তিনি মতিউর রহমান মল্লিক। বাংলাদেশে ইসলামি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামি কবিতার ধারা মূলত তার মাধ্যমেই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দেশীয় কবিতায় আমরা তার আগপর্যন্ত দেখে এসেছি মার্কসীয় সাম্য-বন্দনা, যৌনতা কিংবা নারী দেহের শৈল্পিক বর্ণনা।
আমরা জানি, কবিতা আসলে নিজের অনুভূতি ও আদর্শ প্রকাশ করার শিল্পমাধ্যম। বেশির ভাগ কবি কবিতায় অন্তর্জগতের অনুভূতিকে পুনর্নিমাণ করেন। সমাজ ও মানুষের প্রতি তাদের বিশেষ কোনো দায় থাকে না। কিন্তু যেসব কবির ভেতর জীবন ও জগৎ বিষয়ে দার্শনিক প্রজ্ঞা ক্রিয়াশীল সেসব কবি কবিতায় কেবল অনুভূতিরই প্রকাশ ঘটান না, একইসঙ্গে তাদের আদর্শেরও প্রকাশ ঘটে। কেননা, মানুষ হিসেবে তারা চান পাঠকের ভেতর সুসংহত জ্ঞানকে উজ্জীবিত করে তুলতে। মতিউর রহমান মল্লিক ইসলামি আদর্শের ভেতর জীবন ও জগতের গূঢ়সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। আর তাই ইসলামি চেতনাকেই তিনি ধারণ করেন নিজের শিল্পসত্তার প্রকাশ ঘটাতে। মাওলানা আবুল আলা মওদুদির কয়েকটি কথা মল্লিক দৃঢ়ভাবে নিজের ভেতর প্রতিপালন করতেন। সেই অনুযায়ী নিজের জীবন ও সাহিত্যকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। কথাগুলো হচ্ছে: ‘আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে যে স্বীকার করে নিয়েছে, আল্লাহর সামনে নিজের ইচ্ছা, শক্তি ও স্বাধীনতাকে সমর্পণ করেছে, সর্বোপরি নিজের জীবনকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালনার জন্য নিজেকে বাধ্য করেছে, সেই ব্যক্তিই সত্যিকার অর্থে মুসলমান। এই সমর্পণ করার নামই ইসলাম।’
বলতেই হয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই ইসলামি মূল্যবোধ ধীরে-ধীরে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি থেকে বিদায় নিচ্ছিল। এর পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল বিশেষ একটি চক্র। তারা নিজেদেরকে সুশীল ও প্রগতিশীল হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতো। এখনো করে থাকে। ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়ায় মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদের কী রকম শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল, সেই বাস্তবতা সকলেই জানেন। এরপর আল মাহমুদের বিরুদ্ধে কিভাবে বিষোদ্গার করা হয়েছিল, এখনো হয়, সে খবরও আমাদের অজানা নয়। জনগণের সত্যিকারের মুক্তি কিসে, সেই বার্তা নিয়ে কবিতা লেখার কবি আমরা তেমনভাবে খুঁজে পাই না। বরং ধর্মনিরপেক্ষতার বয়ানে কবিতাকে আদর্শচ্যুত করার প্রয়াস আমাদের চোখে পড়ে। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। মানুষের জীবনে হাগু-মুতু থেকে শুরু করে রাষ্ট্র-পরিচালনা, সকল বিষয়েই কোরআন ও হাদিসে পুঙ্খানুপঙ্খ নির্দেশিকা দেয়া আছে। কাজী নজরুল, গোলাম মোস্তফা ও ফররুখ আহমদদের কবিতায় ইসলামকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার প্রেরণা আমরা পেয়েছি। কিন্তু সেসব প্রেরণা স্থায়ীভাবে আমাদেরকে উজ্জীবিত করেনি। বিচ্ছিন্নভাবে মুসলিমদের ভেতর ইসলামি চেতনাকে সঞ্চারিত করেছে। তাদের উত্তরসূরী হিসেবে মতিউর রহমান মল্লিক ইসলামি কবিতাকে সাংগঠনিকভাবে সুসংহত করেন। তার পারিবারিক পরিমণ্ডল ছিল ইসলামি সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। পিতা মুন্সি কায়েম উদ্দিন ছিলেন কবি। তিনি জারি গান লিখতেন। মল্লিকের চাচারা সেই গান গ্রামে-গ্রামে গিয়ে পরিবেশন করতেন। মল্লিকের মা কথায় কথায় ছড়া কাটতেন। মল্লিকের বড় ভাই আহমেদ আলী মল্লিক ছিলেন কবি। তার চারটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর থেকেই মূলত মতিউর রহমান মল্লিক কবিতায় বিশেষভাবে মনোযোগ দেন। সেসব কবিতায় নিজে সুর আরোপ করতেন। এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতেন। তার দরদি কণ্ঠে ইসলামি সঙ্গীতে দর্শক আপ্লুত হয়ে পড়তো। ইসলামি জীবন ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থাই ছিল তার দর্শন। ফলে নিজের দর্শনকে মল্লিক তার কবিতায় নানা ব্যঞ্জনায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। তার স্বপ্ন ছিল, একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থায় প্রত্যেক মুসলিম জীবনযাপন করবে। মল্লিক লিখেছেন:
দাও খোদা দাও হেথায় পূর্ণ ইসলামী সমাজ
রাশেদার যুগ দাও ফিরায়ে দাও কোরানের রাজ।
কোটি কোটি মানুষ যেথায় বঞ্চিত রে বঞ্চিত
বাতিল মতের জিন্দানে হায়, লাঞ্ছিত রে লাঞ্ছিত।
লক্ষ্যণীয় যে, গণমানুষের ভাষাকে ধারণ করেই মল্লিক কবিতা লিখেছেন। ভাষার সারল্যে ও ছন্দের আশ্চর্য কারুকাজে তার কবিতা পাঠকের হৃদয়কে মথিত করে ফেরে। আর সেসব কবিতায় সুর আরোপ করে মল্লিক গেয়েছেন অসংখ্য সঙ্গীত। নব্বইয়ের দশকে সেসব সঙ্গীত বাংলার ঘরে-ঘরে ধ্বনিত হতো। ইসলামের মহান বাণীকে এইভাবে মুসলিমের অন্তরে অনুরণিত করতে পেরেছে, এমন কবির দ্যাখা ফররুখ আহমদের পর আর আমাদের চোখে পড়েনি। তিনি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর। তাই, আল্লাহর দেয়া বিধানই পারে পৃথিবীর বুকে মানুষের শান্তির জীবন নিশ্চিত করতে। তাই তো তিনি লেখেন, ‘মানুষের গড়া যত মতবাদ/দলেপিষে পায়ে করি বরবাদ/পতাকায় আজ আঁকতেই হবে শাশ্বত কোরআন।’ এই বিধান বাস্তবায়ন করতে হলে জরুরি হচ্ছে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। কবিতার মাধ্যমেই তিনি সেই বিপ্লবের ঝাণ্ডা উড়িয়েছেন বাংলার আকাশে। ইসলামি চেতনায় উজ্জীবিত হতে তিনি আহ্বান করেছেন বাংলার মুসলিমদেরকে। আমরা জানি যে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই মানুষের অন্তর্লোকের চিন্তাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। এই সত্য উপলব্ধি করেই মল্লিক ইসলামি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়ন করেন। তারই প্রেক্ষিতে সুললিত কথামালা শোনান বাংলার মুসলিমের কর্ণ-গহ্বরে।
মতিউর রহমান মল্লিকের কবিতার বৈশিষ্ট্য গীতলতা। গীতল কবিতা যে পাঠক সহজেই আপন করে নেয়, বাংলা কবিতার তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। সত্যি বলতে কী, গীতলতাই আসলে কবিতার প্রাণ। গদ্য ছন্দের কবিতাতেও কিন্তু অন্তর্নিহিত গীতলতা থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাকে আমরা উদাহরণ হিসেবে টানতে পারি। গীতলতার আবেশ ছড়িয়ে মল্লিক তার কবিতায় আবহমান বাংলার লোকজ ঐতিহ্যকে তুলে আনেন কবিতায়। আধুনিক যন্ত্র-সভ্যতার যান্ত্রিক জীবন থেকে কিছু সময়ের জন্য পাঠক আস্বাদন করেন হারিয়ে যাওয়া মাটি-ঘেঁষা জীবনকে। মূলত ঐতিহ্যের অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই মল্লিক বাঙালি মুসলমানকে স্মরণ করিয়ে দিতে চান মূল গন্তব্যকে। কবিতা ছিল তার কাছে প্রার্থনার মতো ধ্যান। তাই তো দ্যাখা যায়, তার কবিতার বিষয়বস্তু হয়ে ঈমান ও মানবতা। কবিতার প্রতিটি শব্দ, বাক্য, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও আঙ্গিক নির্মাণে তিনি নির্মাণ করে নিয়েছিলেন স্বকীয় ভাষাশৈলী। সুললিত শব্দের ব্যঞ্জনায় তার কবিতা হয়ে ওঠে অনন্য, অসাধারণ। সুখপাঠ্য ও সুখশ্রব্য।
মতিউর রহমান মল্লিকের কবিতার বই পাঁচটি। এগুলো হচ্ছে: নিষন্ন পাখির নীড়ে, আবর্তিত তৃণলতা, তোমার ভাষার তীক্ষ্ণ ছোরা, অনবরত বৃক্ষের গান ও চিত্রল প্রজাপতি। এসব বইয়ের প্রতিটি কবিতার ভাঁজে-ভাঁজে ছড়িয়ে রয়েছে দেশ-জাতি ও মানবতার প্রতি মল্লিকের দায়বদ্ধতার শৈল্পিক চেতনা। পাঁচটি কবিতার বই ছাড়াও রয়েছে বেশ কয়েকটি ইসলামি সঙ্গীতের বই। আগেই লিখেছি, মল্লিকের কবিতা ও সঙ্গীতের ভেতর সুর আরোপ করা ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই। প্রত্যেকটি কবিতায় মল্লিকের বিশ্বাসী অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় আমরা পাই।
আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে পাঠিয়েছেন তার প্রতিনিধি হিসেবে। প্রতিনিধির কাজ মালিকের আনুগত্য করা। ফলে, প্রতিটা মুসলমানের প্রধান কর্তব্য, আল্লাহর প্রশংসা করা এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করা। যারা সৃষ্টিশীল তারা আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ প্রজ্ঞার অধিকারী। রাসূলের (স.) সময়ে যেসব সাহাবি কবিতা লিখতেন তারা প্রধানত আল্লাহ ও রাসূলের প্রশংসা বর্ণনা করেই কবিতা লিখতেন। বিশ্বাসীদের উত্তর-পুরুষ হিসেবে মতিউর রহমান মল্লিক লেখেন:
দৃষ্টি তোমার খুলে রাখো দীপ্ত সৃষ্টির জন্য
দেখবে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ কত না অনন্য।
বিহঙ্গ তার পক্ষ দোলায় দূর বিমানে শূন্য
ঝুলায় কে রাখে ভাসিয়ে তারে ভাবনা সামান্য।
সমতল আর পর্বতমালা
এই কোলাহল ওই নিরালা
কার মহিমা জড়িয়ে রাখে গহনও অরণ্য।
সৃষ্টির ভেতরই স্রষ্টার ক্রিয়া-নৈপুণ্য লুকিয়ে থাকে। সেই দিকে আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করতে ইঙ্গিত দিচ্ছেন মল্লিক। আল্লাহ কিভাবে কত নিখুঁত পদ্ধতিতে অসীম এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেই রহস্য এখনো আমাদের অজানা। বিজ্ঞানীরা বলেন, মহাবিশ্বের শতকরা চার ভাগ রহস্য এখ পর্যন্ত মানুষ জানতে পেরেছে। সৃষ্টির এই অপার কৃৎকৌশল অনুভব করতে পাঠককে অনুপ্রাণিত করছেন মল্লিক। এরপরই তিনি আমাদের উৎসাহিত করছেন সৃষ্টির ভেতর দিয়েই স্রষ্টার প্রতিচ্ছবি ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে। বলা দরকার, মল্লিকের কিছু কিছু কবিতায় সুফি মতবাদের প্রভাব রয়েছে। সুফি মতবাদের কেন্দ্রবিন্দু আল্লাহ। শকিক বলখি, ইব্রাহিম আদহাম, রাবিয়া বসরি প্রমুখ সুফিদের মতে, সৃষ্টিজগৎ আল্লাহর ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ। আবার কোনো কোনো সুফির মতে, স্বীয় মহিমার মুকুর রূপে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন মহাবিশ্ব। সৃষ্টির মুকুরে নিজের রূপ নিজেই প্রত্যক্ষ করছেন নার্সিসাসের মতো। মতিউর রহমান মল্লিক লিখছেন:
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
নেই কেহ নেই আল্লাহ ছাড়া
পাখির গানে গানে
হাওয়ার তানে তানে
ওই নামেরই পাই মহিমা হলে আপনহারা।
আল্লাহ নামের গান গেয়ে দেখ
কেমন লাগে নামের সুর
ওই নামে যে যাদু রাখা
ওই নামে যে শহদ মাখা
পান করে দেখ কী মধুর।
আল্লাহ নামের উচ্চারণে ও তার রূপ মহিমায় কবি লীন হয়ে গেছেন। আত্মবিস্মৃত হয়ে একাত্ম হয়ে গেছেন পরম সত্তার সাথে। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানে কবি কেবল আল্লাহর রূপ-সৌন্দর্যই অবলোকন করছেন। আল্লাহর সৃষ্টি-কুশলতায় কবিকে বিমুগ্ধ করছে। নিজের ভেতরকার আত্ম-উপলব্ধিকে কবি শব্দের শিল্পে প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি কবি বলেই শিল্প-মাধ্যমে এটি প্রকাশ ঘটাতে পারছেন। আমরা জানি, রাবিয়া বসরিসহ অনেক সুফিই কবি ছিলেন। তাদের কিছু কিছু কবিতা আমরা পড়েছি। সেসব কবিতায় আল্লাহর মহিমায় নিজের ব্যক্তিসত্তাকে বিলীন করে দিয়েছেন সুফিকবিরা। তাদের উত্তরসূরী হিসেবে মতিউর রহমান মল্লিক বাংলা কবিতায় সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন। ফলে দ্যাখা যায়, আদর্শিক চেতনা বহন করায় তার সঙ্গীত বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠির কাছে খুব দ্রুত আদরণীয় হয়ে ওঠে। তার সঙ্গীতের কথাগুলো মিষ্টি ভাষায় রচিত। সেসব কথা খুবই চিত্তাকর্ষক। ইসলামের ভাবাদর্শের সেসব বাণী সুরেলা কণ্ঠে ধ্বনিত হওয়ায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠি সহজেই তা আপন করে নেয়। বলতে কী, শব্দ ব্যবহারে ভীষণ কুশলী ছিলেন মল্লিক। তিনি জানতেন, কোন ভাষারীতিতে কোন বাণী পাঠক কিংবা শ্রোতা সহজেই আপন করে নেবে। সেই উপায়েই তিনি লিখতেন শব্দ ও বাক্য। গ্রাম বাংলার লোকজ উপাদান, ফুলপাখি ও প্রকৃতির বৈচিত্র্য, নদীর কলতান, উদার আকাশ, শহুরে জীবনের জৌলুশ ও কদর্যতা, মানবতাবাদী জীবনবোধ, সবকিছু তার কবিতায় স্বমহিমায় ঠাঁই করে নিয়েছে। মতিউর রহমান মল্লিক প্রয়াত। কিন্তু আমার বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের ইসলামি কবিতার ধারায় তিনি কালজয়ী কবি হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন। আমরা যদি তাকে ভুলে যেতে চাই তাহলে রাস্তার ধারে ধর্ষণের পর খুন করা পাঁচ বছরের শিশুর মুখের দিকে চেয়ে আমাদের মনে পড়বে মল্লিকের বিখ্যাত সেই বাণী:
এখনো মানুষ মরে পথের ’পরে
এখনো আসেনি সুখ ঘরে ঘরে
কী করে তাহলে তুমি নেবে বিশ্রাম
কী করে তাহলে ছেড়ে দেবে সংগ্রাম!