আরিফ রহমান
হুমায়ূন আহমেদ যে কেবল শক্তিশালী লেখক ছিলেন সেটাই না। হুমায়ূনের একটা রাষ্ট্রকল্প ছিলো। নিজের জনপ্রিয়তা টের পাওয়ার পর বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে তিনি একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেছেন।
এবং পৃথিবীর ইতিহাসে উনি মনে হয় বিরলতম একজন মানুষ যিনি আক্ষরিক অর্থে নিজে জিন্দা থাকা অবস্থায় এবং মৃত্যুর এক যুগ সময় কালের ভেতর অন্তত দশ কোটি মানুষের জীবনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর নাগরিকের কালচারাল নর্ম নির্মাণের দায় কান্ধে তুলে নিয়েছিলো বাংলার আপমর সুশীল সমাজ, ইউরোপ আর হিন্দুস্তানের জেরক্স মেশিনে আম বাঙালির মাথাটা ধরে প্রগতিশীল বানানোর যেই মাৎস্যন্যায় শুরু হয়েছিলো– সেটার বিরুদ্ধে একলাই জে’হাদ করে গেছেন হুমায়ূন। একলা একজন কথাসাহিত্যিক কোন একটা গোটা রিজিয়নের কালচার শেইপ করতে এরকম সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছেন, এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো কোথাও দেখা গেছে কি-না আমি নিশ্চিত নই। রবীন্দ্রনাথ কিংবা ইকবালের কথাও কেউ যদি বলেন তবুও আমি বলবো পাঠকের সংখ্যা বিবেচনায় তাদেরও উৎরে গেছেন হুমায়ুন।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের ফ্যা’সিবাদে এসে একটা কাজের কাজ হয়েছে, দেশের বুদ্ধিজীবীদের মুখোশ খসে পড়ে গেছে। হঠাৎ আমরা আবিস্কার করেছি যাদের বুদ্ধিজীবী ভাবতাম তারা সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে গেছেন। এই বুদ্ধিজীবীশূন্য ভূখণ্ডে যারা এক কলম দু’কলম লেখেন তাদের লেখায় শান আনতে হুমায়ুনকে নিয়ে আরেকবার আলাপটা তোলা দরকার।
একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বোঝা যাক।
হুমায়ূনের মৃত্যুর কয়েক বছর আগের কথা। মা’দ্রাসার ছেলেরা বিমানবন্দর সড়কে লালন ভাস্কর্যটা ভেঙে ফেলল। সারাদেশে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি উদ্ভব হলো।
এই সময় প্রমিনেন্ট বুদ্ধিজীবীরা মা’দ্রাসার বিরুদ্ধে চটে গেলেন, আইন করে বন্ধের দাবী তুললেন, পুলিশি ফোর্স ইউজের কথা বললেন। অথচ অবাক করা বিষয় কেউ বিষয়টা আমলে নিয়ে সব্জেক্টটা জাতিকে বোঝানোর দায় নিলেন না।
হুমায়ূন আহমেদ তখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ওনার সেরা উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ নিয়ে নাটক বানাচ্ছেন। উনি লালন ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে নাটকের কাজ বন্ধ করে দিলেন। এরপর পত্রিকায় একটা কলাম লিখলেন। সেই লেখায় মাওলানা রুমি, শেখ সাদি সহ অসংখ্য ইসলামি স্কলার সহ নবীজির প্রথম জীবনীকারক ইবনে ইসহাকের বরাতে প্রমাণ করলেন ভাস্কর্য হা’রাম নয় হা’লাল।
এবারে ওনার এই লেখা সমস্ত মা’দ্রাসার ছাত্রদের মতামত পরিবর্তন করে দেয় নাই এটা সত্য কিন্তু ফ্লোটিং পপুলেশনকে এক ধরণের স্বস্তি দিয়েছে।
এই যে জনতাকে শিক্ষিত করবার দায়টা বুদ্ধিজীবীদের আছে এইটা আমাদের অর্থডক্স বুদ্ধিজীবীরা বোঝেন না। তারা বরং স্বাধীনতাকে জনতার মাথার ওপর ‘মাস্তানি করার চারনভূমি’ নেরেটিভের লাইনআপে গিয়ে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে মারতে পাঠান মা’দ্রাসার ছাত্রদের।
এবারে এই বুদ্ধিজীবীরা বোঝে না যে শক্তিশালী রাষ্ট্র কেবল মা’দ্রাসাকে কো-অপ্ট করেই চুপ থাকে না। কারাগারে যায় সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট, মারা যায় মুশতাক, জেল খাটে কিশোরী খাদিজা। এইসবকিছুর একুমিলেটেড দায় যে আজকের বুদ্ধিজীবীদের, সেইটা এই শালারা টেরও পায় না।
এভাবে খেয়াল করলে দেখবেন মিউজিকের প্রশ্নে, শহীদ মিনারের প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে এক্স’ট্রিমিস্টরা যেই ঘূর্ণিপাকে মুসলমানদের ফেলে দেন, সাধারণ মুসলমানদের নিজেদের ধর্মের প্রতি কোমল জায়গা ধরে রেখে এসব কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার ভেতর একটা রিলেজিয়াস বাধা চলে আসে। এই বিষয়গুলো সহজ করে আলাপে এনে একলা লড়ে গেছেন হুমায়ূন। তার গল্পে একটা ছোট্ট মেয়ে রঙ নিয়ে খেলা করতে চায়, পরহেজগার মা একটা গান শুনতে খুব পছন্দ করেন, এইভাবে গুটি গুটি পায়ে উপন্যাসে, কলামে, ছোটগল্পে সবখানে উনি ধর্মের নরম জায়গাটাকে প্রবেশ করিয়েছেন।
সৌদির পেট্রো ডলারে যখন পথে পথে এক্সট্রিমিজমের ডাক। বাংলা ভাই অমুক ভাইরা যখন জেলায় জেলায় রিক্রুটে ব্যাস্ত, সামরিক শাসন কিংবা সামরিক বাতাবরণের শাসন যখন চলমান, সেইসব সময়ে একলা খেলে গেছেন হুমায়ুন।
অথচ সেই সময়ের কনটেম্পরারি বুদ্ধিজীবীদের দেখবেন মু’সলমানদের সেন্টিমেন্টকে নালিফাই করে, বাতিল করে, জোর করে একটা জড় সেকুলারিজমের আইডিয়া (যেটা পরে দেখে গেছেন তারা অনেকে নিজেরাও বোঝেন না) আরোপ করে গেছেন। মানুষ কেবল এসবে কনফিউজডই হয়েছে।
অথচ হুমায়ূন কখনো নিজের মুসলিম আইডেনটিটি নিয়ে কুন্ঠিত বোধ করেন নাই, যেমনটা তার সময়ে বুদ্ধিজীবীরা করেছিলেন, সেকুলার সাজাকে ফরজ গণ্য করেছিলেন। এই দেশের মুসলিম আইডেন্টিটির পলেটিক্সটা হুমায়ূন ধরতে পেরেছিলেন এবং একজন বাঙালি মুসলমানের চোখে উনি দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধকে দেখে এই সবগুলো মুভমেন্টে বাঙালির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, এবং সেই অবস্থানের পক্ষে যুক্তি খাড়া করার দায়িত্বটা কষ্ট করে কান্ধে নিয়েছিলেন। এইটাও এখানে কোন বুদ্ধিজীবীর বিচারে খুব বিরল বিষয়।
আমাদের এখনকার সময়ে প্রতিটা লিটারেচার তুলে নিলে দেখবেন, একাত্তর নিয়ে আলাপ হবে কিন্তু মুসলিম আইডেন্টিটিকে তুলোধোনা করা হবে না, এটা হতেই পারে না। এই তুলোধোনা না করতে পারলে আপনি বুদ্ধিজীবীই না। এইখানেও একলা লড়ে গেছেন হুমায়ূন।
মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ এট্রোসিটি সম্পর্কে আমি অনেক বছর কাজ করেছি। এই আমার প্রাইমারি সূত্রধর কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ। আমি খুব পরিষ্কারভাবে বলতে পারি ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ না পড়া হলে ‘ত্রিশ লক্ষ শহিদ: বাহুল্য নাকি বাস্তবতা’ লেখা হতো না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে সেটা আমি জানতাম, কিন্তু সেসব আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায় নাই, কেবল সংখ্যা মনে হয়েছে। আমার হৃদয়ে ধাক্কা দিয়ে বারবার সেই সংখ্যাকে একটা চেহারা দিয়েছেন হুমায়ূন।
মুক্তিযুদ্ধে বহুত্বের অবদানকে উনিই প্রমিনেন্ট করে তুলেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে জনগণ কিংবা পাবলিক ইন্ট্যারেকশনকে আমাদের সমরনায়কেরা আর আওয়ামী লীগারেরা যেভাবে তুচ্ছ করে দেখায়, যেভাবে দেখায় সব তারাই করেছে, হুমায়ূন সেখানে মুক্তিযুদ্ধে পাবলিকের ট্রু অংশগ্রহণটা দেখিয়েছেন।
এরপর স্বাধীনতার পরের বাঙালির সমাজ দেখাতে গিয়েও উনি বারবার সমাজে বিদ্যমান বহুত্বকে পুঁজি করেছেন। ডি-ক্লাস মানুষ ওনার গল্প-উপন্যাসের সেন্ট্রাল কারেক্টার হয়ে বারবার ফিরেছে।
এবারে সেই ফেরা কখনো আরোপিত ফেরা না। জায়গা করে নিয়ে ফেরা।
তার উপন্যাসের মসজিদের ইমামটা হন একজন সুন্দর মনের মানুষ। তার উপন্যাসের কাজের লোকটা এমন দার্শনিক কথা বলে বসেন যেটা ভাবা যায় না। তার নাটকে একজন পয়সাওয়ালা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা রিটায়ার করার পর মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা বের করতে গ্রামে চলে যান। এবং সেই চলে যাওয়ার দৃশ্যে যেই আবেগ সেটা দর্শকদের স্পর্শ করে যায়।
তার সিনেমায় লাজুক হিন্দু গৃহবধূ নারীটি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ নিয়ে বুকে বুলেট পেতে নেয়। তার গল্পের হিমু র্যাবের গু’ম আর ক্র’সফায়ার নামের বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডকে হাসি ঠাট্টা করে বুঝিয়ে দেয় কি ভয়াবহ সর্বনাশা আলাপ দিচ্ছে তখনকার সরকার। তার টিয়াপাখি কোন আপোষ ছাড়া দেশে জরুরী অবস্থা চলার সময়ে ‘তুই রাজাকার’ বলার সাহস করে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি রাবেয়ার ধ’র্ষণ-হ’ত্যার মিমাংসা করে পাগলাটে মন্টু ফাঁসি কাঠে ঝোলা। এলাকার মাস্তানেরা তার গল্পে প্রেমে পড়ে সুন্দর মানুষ হয়ে যায়। তিন মামা-ভাগিনার নানা ব্যাবসার চিন্তাভাবনা এই সবকিছুতেই আপনারা দেখবেন ঘটনার গভীরে হুমায়ূন আহমেদ অংক শেখাচ্ছেন, দর্শন শেখাচ্ছেন, এম্পেথেটিক হতে শেখাচ্ছেন, ঘটনাকে ভিন্ন ন্যারেটিভে দেখার দৃষ্টি দিচ্ছেন।
একটা কপট হেয়ালির মোড়ক বিবর্জিত কিন্তু উইটি, উন্নাসিক, বুদ্ধিজীবী, সমাজ সচেতন, স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড, বহুত্বকে এম্ব্রেস করতে পারা মানুষকে বারবার আপনি খুঁজে পাবেন হুমায়ূনের ক্যারেক্টারে।
নিৎসে যেই উবারম্যানের কথা বলেন হুমায়ূন মূলত সেই উবারম্যান।
বহুত্বকে বুকে নিয়ে একটা এম্পেথির বাংলাদেশ নির্মাণে বাঙালি মধ্যবিত্তকে নাড়া দিতে পেরেছেন যদি এরকম একজন মহান দার্শনিকের কথা আমাকে বলতে বলা হয়– আমি নিঃসন্দেহে হুমায়ূন আহমেদের কথা বলবো।
আজ দেশে দীর্ঘ একনায়কের শাসনামলে এই সমাজটাতে যেই বুদ্ধিজীবী শূন্যতা তৈরি হয়েছে- সেই ভ্যাকুয়াম ফিলাপ করতে যুগপৎ আগ্রাসি হয়ে আছে সা’লাফি মোল্লা আর টিকটক প্রজন্ম।
এদের হাত থেকে দেশটাকে বাঁচাতে হলে, বহুমতকে এম্ব্রেস করে সমতার সমাজকে বিনির্মাণ করতে হলে– নতুন প্রজন্মের বুদ্ধিজীবীদের পঠনে হুমায়ূন আহমেদকে যুক্ত করতে হবে।
শুভ জন্মদিন প্রিয় কথা সাহিত্যিক!
🖤🇧🇩