প্রবীর বিকাশ সরকার
প্রাচীনকালের কথা বাদ দিয়ে যে শহরটি বৃটিশ-ভারতে ছিল সুপরিকল্পিত নগর এবং ব্যাঙ্ক, ট্যাঙ্ক আর স্বদেশী যুগের ‘অনুশীলন’পন্থীদের জন্য খ্যাতির শীর্ষে সেই শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিদ্যাপীঠ ‘ত্রিপুরা’ তথা আজকের কুমিল্লা নিজেই তার গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে ভুলে গেছে চরমভাবে! সুস্থ কোনো মানুষের পক্ষে যা মেনে নেয়া হবে উন্মাদ হওয়ার শামিল। একজন সামান্য লেখক হিসেবে এই শহরের দু-একটি সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ এখানে উপস্থাপন করব তাতেই বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারবে কী ছিল কুমিল্লা, কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে সে এরপর কোন্ দিকে যাবে?
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবিতার যুগে সেই ৩০-৪০ এর দশকে যে ক’জন তরুণ তুর্কী কবির আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁরা ছিলেন: জীবনানন্দ দাশ, কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, অজিত দত্ত, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় উল্লেখযোগ্য প্রধান। তাঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার অধিবাসী জন্মসূত্রে। এক বছরের হেরফেরে অগ্রজ বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) এবং অনুজ সঞ্জয় ভট্টাচার্য (১৯০৯-১৯৬৯)। কিন্তু তাঁরা ছিলেন সমসাময়িক কবি ও সাহিত্যিক। তবে তাঁদের মধ্যে কতখানি জানাজানি ছিল জানা নেই, তবে লেখালেখি নিয়ে যৎসামান্য ভুল বোঝাবুঝি, মনোমালিন্য ছিল।
বুদ্ধদেব ছেলেবেলা কাটিয়েছিলেন নোয়াখালির মামাবাড়িতে আর সঞ্জয় কুমিল্লা শহরে। বুদ্ধদেব ১৩ বছরের সময় ঢাকায় গিয়ে ঢাকা কলেজের ছাত্র হন এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ.ডিগ্রি নিয়ে কলকাতা চলে যান চিরতরে। সঞ্জয় ভট্টাচার্য কুমিল্লাতেই পড়ালেখা করেছেন, স্কুল জীবন বিখ্যাত ঈশ্বর পাঠশালা এবং ভিক্টোরিয়া কলেজে বি.এ.পর্যন্ত। তারপর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রাইভেট এম.এ. ডিগ্রি নিয়েছিলেন। তিনিও পরে চিরতরে কলকাতাবাসী হন।
যেহেতু কবি-সাহিত্যিক বলতেই আড্ডাপ্রেমী তাই তাঁরাও ব্যতিক্রম ছিলেন না। ‘কল্লোল’ কাগজ আধুনিক বাংলা সাহিত্য-সাময়িকীগুলোর আদিমাতা বলা যায়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গোকুলচন্দ্র নাগ এবং চট্টগ্রামের দীনেশরঞ্জন দাশ। অবশ্য সাহিত্যপত্র হিসেবে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪) এবং শ্রমিক স্বরাজ দলের সাহিত্যপত্র হিসেবে ‘লাঙ্গল’ (১৯২০) আধুনিকতার যুগল আদিপুরুষ। কিন্তু বনস্পতি-বাহু ছড়ানো ‘কল্লোল’ মাতৃস্নেহের অপার ভূমিকা গ্রহণ করেছিল ১৯২৩ সালে প্রকাশের পর থেকে। তারপর আরও কিছু কাগজ বেরিয়েছিল যেমন কালি ও কলম, শনিবারের চিঠি, প্রগতি, স্বদেশ, উত্তরা, পূর্ব্বাশা, পরিচয়, কবিতা, চতুরঙ্গ, কৃত্তিবাস উল্লেখযোগ্য। মাসিক এই কাগজগুলো দীর্ঘায়ু লাভ না করলেও ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল, খ্যাতি অর্জন করেছিল কিন্তু ‘কল্লোল’ ছিল খ্যাতির শীর্ষে।
এই সময়কার ‘সকল কবি, সাহিত্যিক ও লেখকের প্রথম লীলাক্ষেত্র ছিল এই কাগজটি’, লিখেছেন ‘কালের পুতুল’ গ্রন্থে কবি বুদ্ধদেব বসু। একে ঘিরে তুমুল আড্ডা হতো। সেখানে যাঁদের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁরা হলেন: ‘নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র (মিত্র), শৈলজানন্দ (মুখোপাধ্যায়), অচিন্ত্যকুমার, প্রবোধকুমার (সান্যাল), হেমেন্দ্রকুমার (রায়), মণীন্দ্রলাল (রায়), মণীশ ঘটক (যুবনাশ্ব), পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, ধূর্জটিপ্রসাদ (মুখোপাধ্যায়), কালিদাস নাগ, নলিনী সরকার (গায়ক), জসীম উদ্দিন, হেমচন্দ্র বাগচী, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, ভূপতি চৌধুরী, সরোজকুমার রায় চৌধুরী, শিবরাম চক্রবর্তী, অজিত দত্ত, বিষ্ণু দে এবং আরও অনেকে।’ এই আরও অনেকের অদৃশ্য তালিকায় কবি ও সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের নাম ছিল কিনা জানি না, তিনি উল্লেখ করেননি। কবি থেকে দুজনেই পরে সম্পাদক হয়েছিলেন যথাক্রমে ‘প্রগতি’ ও ‘পূর্ব্বাশা’ কাগজের।
বুদ্ধদেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে ঢাকার কবিবন্ধু অজিত দত্তকে নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন সাহিত্য কাগজ ‘প্রগতি’ (১৯২৭-২৯)। পরে ১৯৩৫ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশ করেছিলেন আলোড়নতোলা বিখ্যাত কাগজ ‘কবিতা’, যা তাঁকে সম্পাদক হিসেবে অসামান্য সম্মান এনে দিয়েছিল। তাঁর বাসভবনকেই কাব্যসরস্বতীর মন্দির করে ফেলেছিলেন! অধ্যাপনা ও গবেষণার কারণে তিনি দেশ-বিদেশে প্রচুর খ্যাতির অধিকারী হন। নিঃসন্দেহে একজন সফল এবং কালজয়ী কবি ও সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু।
অন্যদিকে, সঞ্জয় ভট্টাচার্য বুদ্ধদেব বসুর মতো অত জনপ্রিয়তা বা খ্যাতি পাননি দুই বাংলাতেই। তবে কবির চেয়ে তিনি সাহিত্যিক ও সম্পাদক হিসেবে তাঁর সময়কার শীর্ষপুরুষ ছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু। বুদ্ধদেব বসুর পর তিনি সাহিত্য সাময়িকী ‘পূর্ব্বাশা’ প্রকাশ করেছিলেন কড়িৎকর্মা সাহিত্যকর্মী সত্যপ্রসন্ন দত্তকে সহ-সম্পাদক করে বৃটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে বহুদূরে অবস্থিত মফস্বল শহর কুমিল্লায়। নাটক, মঞ্চপাগল একদল শিক্ষিত বেকার তরুণ স্বদেশী আন্দোলন আর অভিনয়চর্চায় হঠাৎ করেই হতাশ হয়ে তৎকালে শহরের ভাঙা চায়ের দোকান ‘লক্ষ্মী কেবিন’—যার মালিক ছিলেন দীনেশ ও গনেশ দুভাই সেখানে আড্ডা দিতে গিয়ে এই কাগজটির জন্মদানের কথা চিন্তা করেন। এই দলে ছিলেন সুবীর সেন, সুধীর চক্রবর্তী, সুবোধ পুরকায়স্থ, অজিত গুহ, নারায়ণ চৌধুরী, অমিয় চৌধুরী, সত্যপ্রসন্ন দত্ত, সুনীল মজুমদার (পরে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক) অনুজ ননী মজুমদার, ত্রিদিব দত্ত প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বড়দা প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্যও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর লিখিত অনেক গানে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ত্রিপুরা রাজবংশের রাজপুত্র ভারতখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ শচীনদেব বর্মণ (১৯০৬-৭৫) সুর করেছেন। গীতিকার ও চিত্রপরিচালক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ‘অধিকার’, ‘শাপমুক্তি’, ‘নিমাই সন্ন্যাস’, ‘মহাকবি কালিদাস’ প্রভৃতি বিখ্যাত চলচ্চিত্রের কাহিনী ও সংলাপকার তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘রাতের রূপকথা’, ‘ঈগল ও অন্যান্য কবিতা’, ‘সৈনিক ও অন্যান্য কবিতা’ উল্লেখযোগ্য। দু’হাজার গান তিনি লিখেছিলেন। অনুবাদক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন।
সেদিনের আড্ডায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর কাগজের প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আদেশ বড়দাই সঞ্জয়কে দেন। যথাসময়ে শহরের জগৎসুহৃদ প্রেস থেকে ‘পূর্ব্বাশা’ প্রসবিত হয়ে বেরিয়ে এসে ত্রিপুরাবাসীকে অভিভূত করে! এই প্রেসের মালিক ছিলেন ‘যুগান্তর’ দলের দুর্ধর্ষ বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের অগ্রজ। তাঁদের পিতা দ্বিজদাস দত্ত ছিলেন বৈদিক সাহিত্যে সুপণ্ডিত, ব্রাহ্মসমাজের সভ্য এবং বিলেত থেকে আধুনিক কৃষিবিদ্যা অর্জনকারী প্রথম ভারতীয়। স্বাভাবিক কারণেই ‘পূর্ব্বাশা’কে তাঁরা স্বাগত জানিয়েছিলেন। এর প্রথম প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন ‘কল্লোল’ সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ। বলা বাহুল্য, অতি অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে কাগজটি সমগ্র বাংলায়। নিঃসন্দেহে তৎকালীন সময়ের জন্য দুর্দান্ত মেজাজী কাগজ প্রকাশের জন্য এটা ছিল একটি দুঃসাহসিক উদ্যোগ। ওই সময়কার মূলধারার প্রভাবশালী গুটিকয় কাগজের মধ্যে ‘পূর্ব্বাশা’ শীর্ষস্থান দখল করে। স্বয়ং রাশভারী কবি বুদ্ধদেব বসু একে ‘স্কুল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। একদা চূড়ান্ত খ্যাত মননশীল কাগজ ‘জিজ্ঞাসা’ সম্পাদক স্বনামধন্য লেখক ও গবেষক শিবনারায়ণ রায় ‘পূর্ব্বাশা’য় লিখেছেন এবং একে বলেছেন তখনকার একমাত্র ‘উচ্চমানের কাগজ।’ অবশ্যই এর জন্য সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের আগ্রহ, পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তাকে স্বীকার করতেই হয়। তৎকালীন সুপ্রতিষ্ঠিত বহু লেখক, সাহিত্যিক ও কবির লেখা তাতে প্রকাশিত হয়েছে। স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লিখেছেন। পরবর্তী সময়ে এটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক চলচ্চিত্র ম্যাগাজিনের রূপ নিয়েছিল। তিন পর্যায়ে কাগজটি প্রকাশিত হয়েছিল যথাক্রমে ১৯৩২-৩৯, ১৯৪৩-৪৭ ও ৯৬৪-৬৯ সালে।
প্রথম এক বছর কুমিল্লাতেই কাগজটি প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্য কাগজ হলেও এর বহুমুখী দিকও ছিল। যেমন অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্ম, বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা। সম্পাদকীয় নীতিতে অনেকটা বিদ্রোহী মেজাজ ছিল। সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের নিজেরও অনেক লেখা তাতে প্রকাশিত হয়েছে। কবি হিসেবে তাঁর রচিত কবিতা কবিগুরুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। গদসাহিত্যে তিনি পাশ্চাত্য কলাকৌশলও প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে, কাব্যগ্রন্থ: সাগর, পৃথিবী, সঙ্কলিতা, প্রাচীন প্রাচী, যৌবনোত্তর, অপ্রেম ও প্রেম, পদাবলী, মহাকাব্য, উত্তর পঞ্চাশ প্রভৃতি। উপন্যাস লিখেছেন কমপক্ষে তিরিশটি, উল্লেখযোগ্য হলো: মরামাটি, বৃত্ত, দিনান্ত, রাত্রি, কল্লোল, সৃষ্টি, স্মৃতি, মৌচাক, মুখোশ, প্রবেশ-প্রস্থান প্রভৃতি। মরামাটি ও সৃষ্টি দুটি বিখ্যাত উপন্যাস। ‘তিনজন আধুনিক কবি’ তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনাগ্রন্থ।
সঞ্জয় ভট্টাচার্য শুধু কবি বা লেখকই ছিলেন না, একজন প্রতিভাধর সমালোচক, ইতিহাসবিদ ও ছান্দসিকও ছিলেন। ‘পূর্ব্বাশা’ সাহিত্য কাগজকে কেন্দ্র করে গ্রাম, কৃষি উন্নয়নেও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ‘পূর্ব্বাশা’ কাগজ ছাড়াও এই প্রকল্পে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের দল প্রচুর আর্থিক সহযোগিতা লাভ করেছিলেন সেই সময়কার অগ্রণী পুরুষ কুমিল্লার অর্থশালী উকিল এবং ব্যাঙ্কার নরেশচন্দ্র দত্ত যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন লিঃ নামে একটি ব্যাঙ্ক। এটাই কি পূর্ববাংলা বা সমগ্র বাংলা অঞ্চলে প্রথম ব্যাঙ্ক? গবেষণা সাপেক্ষ। এই শহরের আরেকজন কৃতী ও ধনাঢ্য ব্যক্তি ইন্দুভূষণ দত্তও সাহায্য করেছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে আগত কুমিল্লার প্রভাবশালী চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ ক্যাপ্টেন নরেন দত্ত যিনি শ্রীকাইল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল ইউমিনিটি’র বিজ্ঞাপন দিয়ে ‘পূর্ব্বাশা’কে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় ভারতী প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ‘পূর্ব্বাশা’কে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছিলেন উদারভাবে। ভারতী প্রেসে আপন খেয়ালে ‘পূর্ব্বাশা’ মুদ্রিত হতো। জন্মলগ্ন থেকেই আর্থিকভাবে দুর্বল মাসিক ‘পূর্ব্বাশা’ একসময় অর্থাভাবে অনিয়মিত হয়ে গেলে কখনো মাসে কখনো দুমাসে কখনো আরও বিলম্বে প্রকাশিত হতো সেজন্য নরেন দত্ত ঠাট্টা করে একে ‘না মাসিক না বার্ষিক যখন ইচ্ছে বের হয় তাই এটা ইচ্ছায়িক’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, কুমিল্লার প্রখ্যাত আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ এবং মন্ত্রী কামিনীকুমার দত্ত তাঁরই অগ্রজ।
বিত্তবানদের আর্থিক আশীর্বাদে ধন্য সেই সঞ্জয় ভট্টাচার্য ইংরেজিতেও বহু লেখা লিখেছেন। ছাত্র জীবন থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, জীবনে কোনো পরীক্ষাতেই দ্বিতীয় হননি। মনে হয় অতিপ্রতিভাবানদের ক্ষেত্রে অনেক সময় যা ঘটে থাকে তাঁরও মানসিক বৈকল্য ছিল। আত্মহত্যাপ্রবণ ছিলেন প্রচণ্ড—আর এই প্রবণতাটা ছিল তাঁর বংশানুক্রমিক।
একই শহরে জন্ম ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এঁরা দুই দিকপাল নিঃসন্দেহে, যদিওবা বুদ্ধদেব বসুর মতো খ্যাতি সঞ্জয় ভট্টাচার্য অর্জন করতে পারেননি কিন্তু তাঁর অবদান কোনোভাবেই ক্ষুদ্রমাপের নয়, বরং অসামান্য। এহেন দুজন অগ্রসর ও আধুনিক ব্যক্তির জন্মশতবর্ষ চলে গিয়েছে নীরবে। কোনো আয়োজনই হয়নি কুমিল্লায়।
কবি বুদ্ধদেব বসুর জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হয়েছে দেশে-বিদেশে, স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে, অল্পবিস্তর লেখালেখিও হয়েছে কিন্তু ২০০৯ সালে তাঁরই সমসাময়িক সাহিত্যযোদ্ধা সঞ্জয় ভট্টাচার্যের জন্মশতবর্ষটি নিঃশব্দে অতিক্রান্ত হয়েছে। আশ্চর্য যে এই দুজনের আপন জন্মশহরই তাঁদেরকে বিস্মৃত হয়ে গেছে একেবারেই! মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রচলিত কুমিল্লার ইতিহাসে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের নামটি যেমন নেই ‘পূর্ব্বাশা’র কথাও নেই! এত রঙিন ঝলোমলো পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে এই শহরে যা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায় সেগুলোর কোনোটাতেই কেউ তাঁর প্রসঙ্গে লিখেছেন এমনটি চোখে পড়েছে বলে স্মরণ করতে পারছি না। আমরা এও জানি না যে, কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসা শতাব্দিপ্রাচীন ‘সিংহ প্রেস’ও জড়িত ‘পূর্ব্বাশা’ কাগজের সঙ্গে। সিংহ প্রেসেও কাগজটি মাঝে মাঝে মুদ্রিত হয়ে কলিকাতায় যেত। মহেশাঙ্গনের রামমালা গ্রন্থাগারে ‘পূর্ব্বাশা’র অনেকগুলো সংখ্যা একবার দেখেছিলাম। সাহিত্যচর্চা, প্রকাশনা ও মুদ্রণের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস বহন করছে কুমিল্লা। বহু পত্রিকা, সংকলন ও গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এই শহরে বিগত শতবছরে। কাজেই একটি সাহিত্য ও মুদ্রণ বিষয়ক নান্দনিক জাদুঘর গড়ে তোলা সময়ের দাবি বলে মনে করি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য।