spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকসিরিয়া ইন এ নাটশেল

লিখেছেন : মীর সালমান শামিল

সিরিয়া ইন এ নাটশেল


মীর সালমান শামিল

ক.

আরব বসন্তের পরে সিরিয়াতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। সিরিয়ার জনগনের হয়ে সেই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলো আল নু-স-রা ফ্রন্ট। তারা আলাপ্পো, হামা, হোমস দখল করে রাজধানী দামেস্কাসের দিকে আগ্রসর হতে থাকে। প্রেসিডেন্টের বাস ভবনে পর্যন্ত হামলা চালিয়েছিলো। তখন হঠাৎ করে আবির্ভাব ঘটে বিতর্কিত গোষ্ঠী আই-সিসের। আই-সিস নুস-রার আধিকৃত এলাকা দখল করে এবং গৃহযুদ্ধের মূল খেলোয়াড় হিসেবে হাজির হয়। ফলে বিদ্রোহ দুর্বল হয়ে যায়। এবং দৃশ্যপটে বাশারের সাহায্যকারী হিসেবে আসে ইরান এবং রাশিয়া। টিকে যায় আসাদ।

আই-সিসের সদস্যের একটা বড় অংশ ছিল বিদেশী। বারাম ওবামার সাথে সাথে আই-সিসেরও পতন ঘটে। তখন নু-স-রা নিজেদের মধ্যে একটা বড় ধরনের সংস্কার চালায়। এই সংস্কারের মাত্রা তুলনা করা যায় ১৯৯০ সালের তালে-বান এবং ২০২৪ সালের তালে-বানের সাথে। তারা নতুন নাম নেয় হা-য়া-ত তাহ-রির আল শাম (এইচটিএস) এবং নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। তাদের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫০ হাজারের আশেপাশে [রেড অংশ তাদের দখলে ছিল]।

তবে সিরিয়ার বিদ্রোহে এইচটি একমাত্র খেলোয়াড় না। আল শামের পরে সিরিয়ার সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় হল ফ্রী সিরিয়ান আর্মি। ফ্রী সিরিয়ান আর্মির সাথে তুরস্কের খুবই ভাল সম্পর্ক। ফ্রী সিরিয়ান আর্মির সদস্য সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ হাজারের মত [ইয়েলো অংশ তাদের অধীনে ছিল]।

এছাড়া আল্লোপো এলাকাতে আছে সুলতান মুরাদ ব্রিগেড, নুরুদ্দিন আল জেংগি ব্রিগেড। এই দুইটাই অর্থোডক্স দল তাদের সদস্য ১০ হাজারের মত।

সিরিয়ার দক্ষিন সীমান্তে আছে দাড় আস সুয়াইদা এবং কুনেত্রা। এরা প্রথমে আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেও পরবর্তীতে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং এ আসে। তারা সরকারকে স্বীকৃতি দেয় বিনিময়ে সরকার তাদের ওই এলাকায় একটা সেমাই ইন্ডিপেন্ডন্ট দিয়েছে।

উত্তর-পূর্ব দিকে আছে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স। এরা মূলত অ্যামেরিকার সমর্থন প্রাপ্ত কুরদিশ বাহিনী। অন্যভাবে বলা যায় এরা সিরিয়াতে অ্যামেরিকার প্রধান সমর্থক। বর্তমানে রাক্কা শহর এবং তার আশেপাশের এলাকা এই দলের দখলে ছিল।

এই দলগুলোর বিভিন্ন মতাদর্শ এবং আদর্শ আছে। বাশার আল আসাদ সবাইকেই পদনত করে রেখেছিলো মূলত রাশা এবং ইরানের সাহায্যে।

গেল কয়েক মাসে রাশা সিরিয়া থেকে তাদের ট্রুপস এবং আর্টিলারির একটা বড় অংশ সরিয়ে ইউক্রেন ফ্রন্টে নিয়ে যায়। ইরান ব্যস্ত লেবানন এবং ইজ-রাইলকে নিয়ে।

এই গ্রুপগুলোর বিভিন্ন আইডিয়োলজি থাকলেও তাদের কমন এনিমি হল বাশার আল আসাদ। সেই কমন এনিমির বিরুদ্ধে সবাই সম্মিলিত জি-হা-দ শুরু করে।

এবং খুনী শেখ হাসিনার পরে তার বড় ভাইও দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।।

খ.

১। সিরিয়ার মানুষ আজ ১০০ বছরের কারাগার থেকে মুক্তি পেল। আলহামদুলিল্লাহ।

২। এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছে এইচটিএস। এদের সাথে আইকিউয়ের একটা ভাল সম্পর্ক আছে। তবে সংস্কার করেছে। এদের মতাদর্শ প্রেজেন্ট ছাত্রদলের মত। এইচটিএসের নেতা কিছুদিন আগে নিজেদের ছাত্রদের সাথে তুলনা করেছিলো।

৩। আরব রাজ পরিবারগুলো সিরিয়ার পরিবর্তনে খুশি কারন আসাদ ছিল ইরানের এলাই। তবে কিঞ্চিৎ ঝামেলাও আছে। সিরিয়ানেরা আরবের মধ্যে স্মার্টেস্ট। সিরিয়ার বিপ্লব অন্যদেশে রপ্তানি হলে…। কুইনাইন তো জ্বর সারিয়েছে, কুইনাইন সারাবে কে!?

৪। আমেরিকা এবং ইসরাইল অখুশি না। কারন আসাদের পতনে ইরান এবং রাশা দুর্বল হয়েছে।

৫। নেপথ্যে মূল খেলা খেলেছে সুলতান এরদোয়ান। আর উচ্ছাসিত কাতার।

৬। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে হামাস আরো খানিকটা দুর্বল হবে। তবে সিরিয়ার মানুষ বাড়াবাড়ি রকমের প্রো-হামাস। প্রাথমিকভাবে একটু অসুবিধা হলেও আল্টিমেটলি ফিলিস্তিনের জন্য এটা লাভজনক।

গ.

পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত শহর হল দামাস্কাস। গত দশ হাজার বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে এই শহরে মানুষ বসবাস করে চলছে। ৬৩৪ সালে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. দামেস্কাস জয় করেন। তখন থেকেই দামেস্কাস মুসলমান খেলাফতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরের একটা।

প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার অটোমান খেলাফতের সাথে আরবদের ঝামেলা তৈরি করতে একজন গোয়েন্দা নিয়োগ দেয়। তার নাম ছিল থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স (Thomas Edward Lawrence)। এই থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স পরে অত্যান্ত বিখ্যাত হয়ে যায়। Lawrence of Arabia নামে একটি বিখ্যাত হলিউড মুভিও রয়েছে। মুভিটি মূল ঘটনার একটি বিকৃত রোমানটি-সাইজ ভার্সন।

এই কাজে সে আশাতীত সফল হয়। সে মক্কার প্রধান হোসাইন ইবনে আলীকে অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজি করে ফেলে।

[ Fyi, দুঃখজনক অংশ হল এই হোসাইন ইবনে আলী সাহেব ছিলেন রাসুল পাক সা. এর সারাসরি বংশধর (৪০ তম)। ]

১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার হোসাইন ইবনে আলীর সাথে গোপন আলোচনা শুরু করে। ব্রিটিশ সরকার বিল আলীকে প্রতিশ্রুতি দেয় তিনি যদি ব্রিটিশদের অটোমান খেলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করেন এবং যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী জয় লাভ করে তাহলে তাকে পুরো জাজিরাতুল আরবের খলিফা বানানো হবে। শরীফ হোসাইন ইবনে আলী এতে রাজি হয়ে যায় এবং মুসলমান খেলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ১৯১৫ সালের অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখ একটি চুক্তি সম্পাদিত হয় যা হোসাইন-ম্যাকমোহন চুক্তি নামে পরিচিত। এই হেনরি ম্যাকমোহন ছিলেন মিশরে ব্রিটিশ সরকারের হাই কমিশনার। [২য় ছবি]

একই সময়ে ব্রিটিশ সরকার মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আরও একটি অত্যন্ত গোপন চুক্তি করে যা সাইক-পিকো এ্যাগরিমেন্ট নামে পরিচিত। মহাযুদ্ধে জিতলে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়া; মধ্যপ্রাচ্যের কে কোন অংশটুকু পাবে তা নিয়ে এই চুক্তি। ১৯১৫ সালের নভেম্বর মাসে তারা এই আলোচনা শুরু করে। [একটু আগেই আমরা দেখলাম এর একমাস ব্রিটেন ইতিমধ্যে শরীফ হোসাইন ইবনে আলীকে পুরো জাজিরাতুল আরব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ব্রিটিশদের হিপোক্রেসির উপর ত্রিপল পিএইচডি আছে।]

ব্রিটেনের পক্ষে বিখ্যাত কূটনৈতিক মার্ক সাইক (Mark Sykes) এবং ফ্রান্সের পক্ষে ফ্যান্সিস জর্জ পিকো (Francois Georges Picot) এই আলোচনায় অংশ নেন। ১৯১৬ সালের মে মাসে এই চুক্তিটি সম্পাদন করা হয়। এখানে মজার বিষয় এই যে, যারা আলোচনায় অংশ নিয়েছিল তারা কেউ মধ্যপ্রাচ্যে সশরীরে যায় নি। তারা লিটারেলি মানচিত্রের উপর ভাগাভাগি করেন। মানচিত্রেই স্বাক্ষর করেন। এই সাইক-পিকো এ্যাগরিমেন্ট বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের ম্যাপের আকার ঠিক করে দেয়। [৩য় ছবি]

প্রশ্ন আসতেই পারে কিভাবে আমরা এমন অতি গোপনীয় চুক্তির খবর পেলাম? ১৯১৭ সালে বলশেভিকরা জারদের হটিয়ে রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে। এরপর তারা জারদের দুর্নীতি জনগণকে দেখানোর জন্য অনেক গোপন দলিল ফাঁস করে দেয়। সেই সব গোপন দলিলের মধ্যে সাইক-পিকো এ্যাগরিমেন্ট ছিল অন্যতম।

বিশ্বযুদ্ধে মিত্র শক্তি জেতার পর সাইক-পিকো এ্যাগরিমেন্ট অনুসারে মধ্যপ্রাচ্য ভাগাভাগি হয়। ফ্র্যান্স পায় সিরিয়া এবং তার আশে পাশের এলাকা। ফ্র্যান্স প্রথমেই যে অপকর্মটি করে তা হল সিরিয়াকে ভাগ করে ফেলে জাতীয়তা, ফেরকা, এবং গোত্র অনুসারে, divide & rule

লেবানন নামে আলাদা দেশই বানায় আরব খ্রিস্টানদের জন্য [যদিও এখন লেবানন এখন একটি বহুধর্মীয় দেশ]। দ্রুযিদের জন্য আলাদা অংশ করে নাম স্টেট অব জাবাল দ্রুযি, আল অয়াতি উপজাতিদের জন্য স্টেট অব আল অয়াতি, সুন্নিদের জন্য স্টেট অব দামাস্কাস এবং স্টেট অব আলাপ্পো। [৫ম ছবি]

ফ্র্যান্স প্রায় ৩০ বছর সিরিয়া এভাবে শাসন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে সিরিয়ান বিপ্লব হয় এবং সিরিয়ানরা ফ্রেঞ্চদের বের করে দেয়, তবে লেবাননকে আর ধরে রাখতে পারে না। লেবানন আলাদা রাষ্ট্রই থেকে যায়।

ফ্রেঞ্চরা শাসনের সময় আল অয়াতি উপজাতি গ্রুপকে বেঁছে নিয়েছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের উপর ফ্রান্সের হয়ে পুলিশি করতে। এই আল অয়াতি উপজাতিরা ছিল সিরিয়ার সবচেয়ে নিষ্ঠুর, ডাকাত, অশিক্ষিত এবং অনেকটা বর্বর সম্প্রদায়। ইতিহাসে আল অয়াতি উপজাতিদেরকে একটি ডাকাত সম্প্রদায় হিসেবেই দেখা যায়। তারা পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় বাস করতো এবং সুন্নিদের গ্রাম এবং শহরগুলোতে ডাকাতি করতো। সুন্নিরা এই আল অয়াতিদের ভয় পেত।

ফ্রেঞ্চরা এসে এই আল অয়াতিদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে এবং প্রচুর সামরিক সহায়তা করে। ফলাফল ৩০ বছর পর যখন ফ্রান্স সিরিয়া ছেড়ে চলে যায় তখন এক আল অয়াতি জেনারেল হাফিজ আল আসাদ সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত হাফিজ আল আসাদ ক্ষমতায় ছিল৷। তারই ছেলে বাশার আল আসাদ। হাফিজের মৃত্যুর পরে ২০০০ সালের জুলাই মাসের ১৭ তারিখে বাশার মসনদে বসে। ৭ ডিসেম্বর জনতার বিপ্লবে বাশার আল আসাদ দেশ ছাড়ে। সিরিয়া মুক্ত হয় ১০০ বছরের গোলামির জিঞ্জির থেকে।।

…………
লেখক : গবেষক, ব্রেমেন ইউনিভার্সিটি, জার্মানি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on দু’টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on পাখিমানুষ