spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যবাংলাদেশ প্রশ্ন

মীর সালমান শামিল

বাংলাদেশ প্রশ্ন

মীর সালমান শামিল 

১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলায় একটা পতাকা ও সংবিধানের জন্ম এবং একটা রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘটে। গত ৫২ বছরে বাংলাদেশ একটা পলিটিক্যাল টেরিটোরিই রয়ে গেছে কিন্তু একটা রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে নাই। 

১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হয়েছিলো মুসলমান জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে বের হয়ে যায়। ইসলামি প্রজাতন্ত্র থেকে নাম বদলিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী হয়, সংবিধান থেকে মুসলমান জাতীয়তাবাদের সবকিছু ঝেটিয়ে বাদ দেওয়া হয়। 

তাহলে এই নতুন দেশের মূলসূত্র কি? জিজ্ঞেস করুন, কেউ বলতে পারবে না। কেন ২০২৪ সালে এই অঞ্চল একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে থাকবে, তার জাস্টিফিকেশন কি ?

আপনার মূলনীতি এবং ভারত প্রজাতন্ত্রের মূলনীতির মধ্যে তো কোন বিরোধ নেই, ইতিহাসের কোন একটা সময়ে এই ভূখণ্ড আলাদা কিছু ছিল না, ভারতের বিভিন্ন অংশের সাথে যুক্ত হয়ে ছিল। আপনারা বাংলায় কথা বলেন, ভারতেরও প্রায় ১৫ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। আপনাদের গান এক, নাটক এক, সিনেমায় একই মানুষ অভিনয় করে, একই লেখকের লেখা বই পড়েন, পাঠ্যবই ভর্তি ভারতীয় লেখকের লেখায়, একই ভাবে বৈশাখ পালন করেন। তাহলে মাঝখানে কেন এই কাঁটাতার!? 

এই প্রশ্নের উত্তর কারো কাছেই নাই। জোড়াতালি দেওয়া উত্তর পাবেন। হয়ে গেছে একভাবে এবং এখনো আছে এই ধরনের। এবং আমাদের জাতীয় জীবনেও এই জোড়াতালির প্রতিফলন দেখতে পাবেন প্রতিটি পরতে পরতে। 

বাংলাদেশের কোন মোরাল কোড নাই, মূল্যবোধ নাই, নিজস্ব সংস্কৃতি নাই। গত ৫২ বছরে একজন বড় কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, লেখক, শিল্পী, ভাস্কর বা গবেষকের জন্ম হয় নাই। একটা সুন্দর মসজিদ কিংবা একটা সুন্দর ভবনও কেউ বানাতে পারে নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যান। বাংলাদেশ আমলে যে ভবনগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলো দেখুন, আর তার আগের ভবনগুলো দেখুন। কিছু কনক্রিটের জঞ্জাল তৈরি করা হয়েছে। “দেশসেরা” ভাস্কর মৃণাল হকের বানানো ভাস্কর্যগুলো দেখে আসুন তার সংগ্রহশালা থেকে, গুগল করলেও দেখতে পাবেন, সেগুলো যে গার্বেজ এটা বোঝার জন্য আপনার শিল্পবিশারদ হতে হবে না।

বাংলাদেশের এই ৫২ বছরের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ২৩ বছরে তুলনা করেন। মাত্র ২৩ বছরে কি পরিমান শিক্ষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীর জন্ম হয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীতে। ভাবা যায়! ঢা.বি লাইব্রেরির রেফারেন্স সেকশনে যান, দেখুন সেই ৫২ বছরে আগে কি কি কেনা হয়েছিলো আর এখন কি আছে। কেন এমনটা হল? টাকা তো আপনাদের কম নাই। আগের চেয়ে ঢের বেশি। তারপরও কেন সংসদ ভবনের মত একটা ভবন বানাতে পারলেন না? দেশসেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পালনের সাজসজ্জা দেখবেন। কিছু ব্যানার আর লাইট টানানো; সব ব্যানারে, লাইটে বড় বড় করে লেখা নগদ। মানে ফকিন্নি মনে করে কয়েকটা বাতি জ্বালালে আর ব্যানার টানালেই সেটা কিছু একটা হয়ে গেল।

টাকা দিয়ে আপনি সৌন্দর্য কিনতে পারবেন না। এটা আত্মস্থ করার বিষয়, আরাধনা করার বিষয়। এজন্য প্রথমে একটা কিছুকে সৌন্দর্যের পরমরূপ হিসেবে কল্পনা করতে হবে। এরপর নিজেকে তার কাছে যাবার চেস্টার মাধ্যমে সৌন্দর্যের বিকাশ হয়। প্রায় হাজার বছর আগের ষাট গম্বুজ মসজিদ বা তারো আগের কান্তজির মন্দির দেখুন, তার দেয়াল, গম্বুজ, খিলানগুলো। খুব বেশি সফিসটিকেটেড উপরকণ বা অনেক ব্যয় করে এগুলো তৈরি করা হয়নি। কিন্তু এখনো আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়, কি অসম্ভব সুন্দর!! কারণ তাদের কাছে এটা ছিল একটা উপাসনা, একটা ইবাদত। বর্তমানে আমাদের মধ্যে সেই আধ্যাত্মিকতা অনুপস্থিত। এবং এভাবে চললে আগামি কয়েক হাজার বছরেও এর ধারের কাছে কোন স্থাপনা বানাতে পারবেন না, কয়েক হাজার গুণ বেশি টাকা দিয়েও। 

Transcendental metaphysics ছাড়া আপনার জীবন কখনোই অর্থপূর্ণ হবে না, নিজস্বতা তৈরি হবে না। 

কোন মননশীলতা নেই, কোন দর্শন নেই, কোন চিন্তাভাবনা নেই। আছে শুধু নকল, পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মত কেন চলিস। ঠিক এইভাবে তারা মঙ্গলযাত্রা করেন কারণ তারা জানে ওপার বাংলায় কোলকাতার বাবুরাও ঠিক এমন কিছু করতেছে। নাটক বা মঞ্চ নাটকে যান, স্টেজের সাজসজ্জা ঠিক কোলকাতার কপি। ও পারে হচ্ছে মীরাক্কেল তা দেখে তারা বানাচ্ছে হা-সো। এরা বাংলাদেশ আইডল করছে কারন পাশের দেশে ইন্ডিয়ান আইডল হচ্ছে। 

গত ৫০ বছরে দেশের সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্রকার হলেন তারেক মাসুদ। কিছু দিন আগে তারেক মাসুদ আর মৌসুমী ভৌমিকের একটা কথোপকথন দেখলাম, যশোর রোড গানটা কিভাবে হলো তা নিয়ে। তারেক মাসুদের কথা শুনলে মনে হবে না যে পূর্ব বাংলার কেউ কথা বলছে, একেবারে কোলকাতার বাবুদের মত ভঙ্গিমা, সর্বনাম পদ এবং ক্রিয়াপদের ব্যবহার, একই রকম শব্দ চয়ন। 

শিল্প বা সিনেমা হল সমাজের প্রতিচ্ছবি। গত ৫২ বছরে একটা সিনেমা দেখাতে পারবেন না যেখানে প্রোটাগোনিস্ট একজন ধার্মিক। একটা সিনেমা (বা উপন্যাসও) পাবেন না যেখানে মসজিদ, তারাবি, শবে বরাত, শবে কদর বা রমজান মাস আছে। কারণ ঐ যে, পরিচালক কোলকাতার বাবুদের সিনেমাতে যে এসব দেখে নাই! 

ইসলামপন্থীদের অবস্থা আরো খারাপ। সে জানে উপমহাদেশে গান্ধার থেকে আরাকান পর্যন্ত মুসলমানদের মোরাল কোড এক, জাতীয় বীর এক, উস্তাদ এক(একই উস্তাদের কাছে পড়েছে সবাই বা অনুসরণ করে), তারা একই গান শোনে, একই ধরনের স্বপ্ন দেখে, একই ধরনের খাবার খায়, ঘুমানোর আগে মায়েরা একই ধরনের গল্প বলে, কিন্তু সে এটা উচ্চারণ করতে পারে না। ভয় পায়। কারন সুশীল সমাজ বসে আছে বলবে তুই একাত্তরের চেতনার বিরোধী, রাজাকার। ভয়ে জর-সর হয়ে থাকে। তাদের কাছে কুরআন আছে কিন্তু এরপরেও এতবেশি হীনমন্যতায় ভোগে যে কল্পনারও বাইরে। খুঁজে খুঁজে বের করে ২/৪ টা দাড়িওয়ালা ১৯৭১ সালে হিন্দুস্তানে গিয়েছিলো কিনা তাই দিয়ে বই লেখে “আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে”। 

দেশের ফকিন্নি যারা কি-না ভারতকে নকল করেছে ইসলামপন্থী গান্ডুরা তাদের নকল করে চোখ বন্ধ করে, নকলেরও নকল। কে হতে চায় কোটিপতি দেখে এরা বানায় ইসলামি তারকা, ক্লোজআপ ১ দেখে ভয়েজ অব রমজান, গণিত অলিম্পিয়াড দেখে ইসলামি অলিম্পিয়াড, লক্ষ টাকার বই পুরস্কার। স্টেজ সাজানো থেকে শুরু করে বিচারকের বসার জায়গা, সবই নগ্নভাবে কপি করা। মানে ফকিন্নি চিন্তা করে আমার কাছেও তো টাকা আছে আমিও করি এগুলো। ভাই, এভাবে নকল করে তো আপনি মহৎ কিছু হতে পারবেন না, বড়জোর একটা হরবোলা হতে পারবেন। হয়ও তাই, কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন। দুই দিন পরে তারা নিজেরাই  নিজেদের বানানো গারবেজ ত্যাগ করে এবং অপেক্ষা করে এরপর কোনটা নকল করবে। 

রাষ্ট্রকে একটা হায়ার বিংয়ের সাথে যুক্ত থাকতে হবে, সেটা ঈশ্বর হোক বা কোন মতাদর্শ হোক। প্রতিটি নাগরিককে সেই সাপেক্ষে নিজের অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত থাকতে হবে। রাষ্ট্রের মূল্যবোধ দরকার, মূলসূত্র দরকার, একটা স্বপ্ন থাকতে হবে। আপনি এবং আপনার শত্রুও একই স্বপ্ন দেখবে, একই গল্প শুনবে, একই আদর্শ লালন করবে এবং একই নায়কের ভক্ত হবে। তবেই একটা রাষ্ট্র গড়ে উঠবে।

………

লেখক : গবেষক, ব্রেমেন ইউনিভার্সিটি, জার্মানি। 

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

খান কাওসার on দীর্ঘ কবিতা : কসম
মেজু আহমেদ খান on দীর্ঘ কবিতা : কসম