spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধঅনিঃশেষ মুগ্ধতার শিল্প : রহমান হেনরীর কবিতা

লিখেছেন : আমিনুল ইসলাম

অনিঃশেষ মুগ্ধতার শিল্প : রহমান হেনরীর কবিতা

আমিনুল ইসলাম

ভালো-মন্দের সিদ্ধান্তে না গিয়ে একটি কথা প্রায় নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, আশির দশকে বাংলাদেশের কবিতা থেকে বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া বিদায় নিয়েছে মোহমুগ্ধতার ঐর্শ্বয । এই সময় থেকে কবিতা হয়ে উঠতে থেকেছে কবির ব্যক্তিগত আলাপ বিলাপ প্রলাপ যার মধ্যে পাঠকের জন্য আছে ধাক্কাগর্ভ হতাশা আর কবির জন্য গন্তব্যহীন আত্মরতির অন্ধ প্ররোচনা । আজকালকার অকিাংশ কবিতা অর্থহীন শব্দের খোয়াড় । তাদের অভিযোগ এখনকার কবিতার মধ্যে রাজনীতি নেই, প্রেম নেই, প্রকৃতি নেই, এমনকি উপভোগযোগ্য একটি উপমাও নেই । এসবই হচ্ছে শব্দ নিয়ে এলোমেলো খেলা যে খেলায় না আছে উত্তেজনা আছে হারজিৎ, না আছে কোনো নান্দনিক সৌর্ন্দয।

লেখক ও পাঠক দুপক্ষের মধ্যে আগের মতো সেতু রচনায় ব্যর্থ এখনকার কবিতা । পাঠক তাই কবিতা পড়তে বসলে সেই রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ-শামসুর রহমান-আল মাহমুদ-শক্তি চট্টোপাধ্যায়-আবুল হাসান-র্নিমলেন্দু গুণ- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার বই নিয়েই বসেন। এই বিদ্ঘুটে স্রোতের বিপরীতে দু’একজন কবি রচে চলেছেন প্রাণময় সবুজ কবিতার বাগান যেখানে প্রবেশ করলে পাঠক অক্সিজেন পান, ছায়া পান, মায়া পান, শুনতে পান পাখির ডাক আর নদীর কলতান। রহমান হেনরী ইতিবাচক অর্থে এই সময়ের তেমনি একজন ব্যতিক্রমধর্মী কবি। রহমান হেনরীর কবিতায় প্রকৃতি আছে, রাজনীতি আছে, প্রেম আছে, পরিহাস আছে। তবে তার কবিতার সবচেয়ে বড়ো ও কমন ঐর্শ্বয হচ্ছে- অনিঃশেষ মুগ্ধতার শৈল্পিকতা। তার যে কবিতা পড়ে একটি অর্থগত বা ভাবগত গন্তব্যে পৌঁছানো যায়, সে-কবিতার শব্দ উপমা -উৎপ্রেক্ষা-তুলনা-রূপক-প্রতীক পাঠককে মাঝে পথেই মুগ্ধ করে তোলে। আর তার যেসব কবিতা রহস্যময়তায় জড়ানো, কোনো কোনো পাঠকের কাছে কিছুটা দুর্বোধ্য, সেসব কবিতায় ব্যবহৃত কাব্যালংকার এবং সৃষ্ট কাব্যরসও পাঠককে একধরনের গভীর তৃপ্তির স্বাদ উপহার দেয়। ফলে কবিতার ভাবগত বা অর্থগত গন্তব্য নিয়ে পাঠকের মাথাব্যথার কিংবা হতাশার কারণ ঘটে না । রাস্তার পাশে যদি গাছের ছায়া মেলে , তবে সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেও সুখ । নদীর পাশে বসে থেকে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসতেও তো একধরনের আনন্দ পাওয়া যায় যদিও তা কোনো গন্তব্য নিয়ে যায় না। রহমান হেনরীর কবিতা কখনো সেই ছায়াবৃক্ষ শোভিত পথ, কখনো শেষবিকেলের নদীপাড়, কখনো-বা বাগানবাড়িমুখী সংযোগ সড়ক । আরেকটি কথা শুরুতেই বলে নেয়া দরকার যে, রহমান হেনরী শুধু বুদ্ধির কসরৎ করে কবিতার নামে নিস্প্রাণ শব্দের খোয়াড় নির্মাণ করেননি । তিনি বিধাতা প্রদত্ত কাব্যমেধা, অর্জিত জ্ঞান আর সংবেদনশীল হৃদয়ের সম্মিলিত বিনিয়োগে সৃষ্টি করেছেন শিল্পের বেড়াহীন বাগানবাড়ি। তিনি তার অনুভবকে মোহময়তায় ও জাদুময়তায় মিশিয়ে উপস্থাপন করেন। পড়লে ভালো লাগে। বুঝলে ভালো লাগে। আধেক বুঝলেও ভালো লাগে। না বুঝলেও ভালো লাগে। এই ভালো লাগা কিন্তু অঃনিশেষ। তিনি কবিতায় যে মায়া বা ঘোর রচনা করেন, তা তার কবিতাকে অনিঃশেষতার ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ করে তোলে। উপভোগত্যার ঐশ্বর্যে তার কোনো কবিতাই অসচ্ছল নয়, দীনদরিদ্র তো নয়ই। বিষয়টা এভাবেও বলা যেতে পারে যে, কোনো শিল্পীর কণ্ঠ গভীরভাবে সুরেলা হলে তিনি সুরে গাইলে ভালো লাগে, বেসুরে গাইলেও ভালো লাগে, গানের বাণী সমৃদ্ধ হলে ভালো লাগে, বাণী দুর্বল হলেও ভালো লাগে , এমন কি তিনি আবোল তাবোল শব্দসমষ্টিকেও সুরেলা উচ্চারণে পরিণত করতে পারেন। কবি হিসেবে রহমান হেনরীকে সেই শিল্পীর সঙ্গে তুলনা করা চলে। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

নিজেই তো ভারনত; উপরন্তু ভোরের কুয়াশা চিরে
স্কুলের পোশাকে দ্রুত ধাবমান বালিকাকে পাঠ্যপুস্তকবাহী
ট্রাক মনে হয়। এত জ্ঞান কোথায় রাখো গো মেয়ে!
আমার সামান্য বোধে মনে হয়, তোমার তো জ্ঞানস্ফীতি ঘটে!
অধিকন্তু স্তন্যপায়ীপ্রাণীবিদ্যাবিষয়ক বিপুল জিজ্ঞাসা নিয়ে
প্রাইভেট শিক্ষা নিতে গেলে, কতই না অভিজ্ঞতা হয়! ফলে
বিস্ময়ের কাছে তুমি থরোথরো খুলেছ যন্ত্রণা, যে রকম
নদীগুলি নানা বাঁকে অধীর-উন্মুখ হয়ে থাকে …
(‘বালিকা বিদ্যালয়’, সার্কাসমুখরিত গ্রাম)

রহমান হেনরীর কবিতা যখন রহস্যের মোড়কে আবৃত থাকে, তখন তার ভেতরে সবটুকু প্রবেশ করা না গেলেও তার উপরি-অংশের সৌর্ন্দয, রূপ ও রস পাঠককে একধরনের তৃপ্তি দেয় । ফলে তার কবিতাকে দুর্বোধ্য বলে দূরে সরিয়ে রাখার বিরক্তি বাসা বাঁধে না মনে; বরং যতটুকু পাওয়া যায় তা-ই পাঠকচিত্তকে আকৃষ্ট করে নেয়। সমুদ্রের গভীরে ডুব দেওয়ার সামর্থ্য থাকে না; কিন্ত সৈকতে অথবা জাহাজের পাটাতনে বসে তার স্রোত আর ঢেউয়ের খেলা দেখার যে আনন্দ, তার দিগন্তছোঁয়া বিশালতায় দৃষ্টি মেলে বিম্মিত হওয়ার যে শিহরন, তা মহার্ঘ্য । রহমান হেনরীর কিছু কবিতা পড়ে তেমনিভাবেই শিহরিত ও আনন্দিত হওয়ার অভিজ্ঞান লাভ হয় । এটা ঠিক যে,– রহমান হেনরীর অনেক কবিতায় আলো-আঁধারির আড়াল অথবা রহস্যময়তার ছায়া আছে। কিন্ত তিনি কবিতাকে দুর্বোধ্য করে তোলার পণ্ডশ্রম করেন না; একজন জাতকবি হিসেবে তিনি জানেন, দুর্বোধ্যতা অক্ষমতার ফসল, শক্তিমত্তার স্মারক নয় । কিন্তু জানা ও অজানা, বুঝা ও না বুঝা, চেনা ও অচেনা,— এসবের মাঝামাঝি যে আলো-আঁধারির প্রকাশ ও আড়াল, তা-ই সফল কবিতার প্রকৃষ্ট পন্থা, শৈল্পিক ঐশ্বর্য । হেনরী তার কবিতায় এই আলো-আঁধারি সৃষ্টি করতে পেরেছেন বলেই তার কবিতা জোছনারাতের খোলা প্রান্তের মতো সম্মোহিত করতে পারে শিক্ষিত সাহসী পাঠককে।

সংস্বপ্নের ঋতু থেকে মুছে যাচ্ছে ঢেউ … হায় শেকড়প্রদাহ!
অনৃতগন্ধের দিকে ধাবমান নদী বয়ে চলো; বলো কী প্রকার
ধ্বংসের উদ্ধৃতিচিহ্নে রেখে এ জীবন, প্রচারপ্রবাহে প্রাজ্ঞ মৃত্যুকলা
রপ্ত করা হলো? বলা যায় , হাহাকারও পর্যাপ্ত প্রাচীন .. তবু
সুপ্রাচীন অন্ধকারে এইদিন লিপ্ত হতে হতে সাপের ফণার মতো
আকস্মিক জেগে উঠেছিল; বিষ ছিল, অথচ চুম্বনরীতি বন্ধুতেরই দিকে!
প্রাচীন জলের কাছে যাও , মানুষেরই ঘ্রাণ শুধু পাবে
মেঘ ও রোদের কাছে নতজানু প্রণতি জানাও, তারা জানে গুপ্ত ইতিহাস …
(‘অথবা গান’, প্রকৃত সারস উড়ে যায়)

একজন শক্তিমান কবি নানা ধরনের কবিতা লেখেন, নানা ঢঙের কবিতা লেখেন। প্রয়োজন ও সময় তাকে নগদ দাবি পূরণের কবিতাও লিখিয়ে নেয় কখনো সখনো। তবে উৎকৃষ্ট কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মর্মবাণীর বহমুখী সম্ভবনা । অনেকগুলো পর্দা থাকে। এটা পাঠকের জন্য বাড়তি ভাবনার বা প্রাতিস্বিক কল্পনার জায়গা রচনা করে। কবিতা পড়ার সাথে সাথে তার সবটুক অর্থ জানা হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার পড়ার প্রয়োজন ও টান দু-ই হারিয়ে যায়। উৎকৃষ্ট কবিতা আড়াল রচনা করে রাখে যা পাঠককে দেয় রুচি ও জ্ঞানভেদে ভাবনার অকাশ, কল্পনার সমুদ্র, অনুমানের বনভূমি। এই গুণটি পাঠককে ধরে রাখে, সময়ান্তরে পাঠক বারবার ফিরে আসে সেই কবিতার কাছে। শিল্প হিসেবে– সৃষ্টি হিসেবে ফতুর মানুষের মতো কবিতা ফুরিয়ে যায় না পাঠকের কাছে। রহমান হেনরীর বহু কবিতা পাঠকের নিজস্ব ভাবনা ও কল্পনার অবকাশ সৃষ্টিকারী দুর্লভ ঐশ্বর্য ধারণ করে আছে। কিন্তু হেনরী কবিতায় কৃত্রিমভাবে রহস্যময়তা সৃষ্টি করেননি, এটা তার কবিতায় এসেছে সাবলীলভাবে, সহজাত সচ্ছলতায়। ফলে তার এধরনের কবিতা কোথাও আড়ষ্ঠতা দোষে দুষ্ট হয়ে ওঠেনি,— অক্ষমের কোষ্ঠকাঠিন্যময় কল্পনায় নিষ্প্রাণ ধাঁধাতে পরিণত হয়নি। তার গভীর আলোছায়া রচনাকারী কবিতাগুলোও সমানভাবে সপ্রাণ ও মুগ্ধতাসঞ্চারী।

জ্যোতির্ময় প্রতিটি প্রকোষ্ঠ আর দালান-দেয়াল, ধসে গেছে;
প্রাসাদের অন্ধকারে পড়ে আছে সময়ের স্তুপ রাশি রাশি, ভাঙা ইট,
কুচি কুচি মার্বেল পাথর, চুন সুড়কি… যেন এক পুরনো শতাব্দী এসে
মুখ-থুবড়ে পড়ে আছে পরবর্তী শতাব্দীর পায়ে। এর নাম হতে পারে-
হরপ্পা কি মহেঞ্জোদারো; এর নাম হতে পারে- হালাকু খানের তীব্র
উল্লাসের পর, ক্লান্ত ব্যবিলন;’
(‘ব্রজসুন্দরীর কথা-৩৯’, ব্রজসুন্দরীর কথা)

কোনো সৃষ্টিকে মনোগ্রাহী ব্যঞ্জনায় সরস ও সচ্ছল করে তোলার অন্যতম অব্যর্থ উপকরণ বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরস ও পরিহাস। কোনো শিল্পকর্ম দেখে অথবা কোনো সৃষ্টির পাঠ নিয়ে দর্শক-পাঠক মূলত আনন্দ পেতে চান । কিন্ত অধিকাংশ বাঙালি কবি-কথাকারের পরিহাসজ্ঞান খুবই কম। কাজী নজরুল ইসলাম গানে, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ কবিতায় এবং সৈয়দ মুজতবা আলী কথাসাহিত্যে উন্নত রুচির বুদ্ধিদীপ্ত পরিহাস রসের উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন । কিন্তু পরবর্তীতে সে-ধারা তেমনভাবে এগিয়ে নিতে পারেননি বাঙালি কবি-কথাশিল্পীগণ । বাঙালির রসবোধ ও পরিহাসকৌশল আসলেও কম। এমন প্রেক্ষাপটে এটা নিঃসন্দেহে সুখের বিষয় যে, রহমান হেনরী একজন পরিহাসপ্রিয় কবি। তিনি প্রেম, রাজনীতি ,অর্থনীতি, এনজিও, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়কে অনুষঙ্গ হিসেবে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তিনি কখনোই বিষয়কে তুচ্ছজ্ঞান করেননি। বিষয়রিক্ত কবিতা নেই তার। কিন্ত তার প্রকাশশৈলী মাঝে মাঝে এত বেশি পরিহাসনিবিড় ও হাস্যরসসিক্ত যে কবিতার বিষয়ভাবনার চেয়ে কাব্যালংকারের রূপরসগন্ধ পাঠকমনকে আপ্লুত করে তোলে বেশি ।

আমাদের একটি প্রধান মনোরোগ হচ্ছে সকল বিষয়ে অন্যকে গায়েপড়ে অথবা পদাধিকারবলে জ্ঞানদানের প্রবণতা। যিনি যে বিষয়ে অভিজ্ঞ নন , তিনি সেই বিষয়েও নিজেকে জ্ঞানী বলে জাহির করতে চান; এদেশে টেলিভিশন টকশোগুলোতে সাহিত্যের অধ্যাপক রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন ; বিজ্ঞানের অধ্যাপক শিশুদের জন্য লেখেন ভূতের কাহিনি; পদার্থবিজ্ঞানী ধমর্গ্রন্থের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণের সূত্র খোঁজেন ; অকবি ফতোয়া দেন কাব্য বিষয়ে ; বাণিজ্যমন্ত্রী কথা বলেন স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে এবং এমন অনিঃশেষ। বাঙালির এই রোগটি ধরেছেন হেনরী অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতো সবার মাঝে নিজেকে সর্ববিষয়ে জ্ঞানী ভাবা এবং সেটাকে সর্বত্র জাহির করার বদাভ্যাস নিয়ে রহমান হেনরী ‘জ্ঞান উপদ্রুত ’শিরোনামে একটি দারুণভাবে সাবলীল কবিতা লিখেছেন । কিন্ত তার সেই কবিতা জ্ঞান বিতরণ না হয়ে উপভোগ্য সৃষ্টি হয়ে উঠেছে হেনরীর নিবিড় রসবোধ ও দুরন্ত শিল্পশৈলীর অনন্যতায় । তার কবিতায় উদ্ভাসিত বাঙালি দীনতাহীনতা সম্পর্কে নতুন করে জেনে তাৎক্ষণিকভাবে হাসি পায়, ব্যথা জাগে, মন খারাপ হয়; কিন্ত পরক্ষণেই হেনরীর রসবোধ ও কাব্যভজনা কবিতাপিয়াসী মন ও মেধাকে সম্মেহিত ও বিমোহিত করে তোলে।

জ্ঞানপ্রবাহের মাঝে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। ভাসিতেছি…
এত জ্ঞান! যুক্তির প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হলে
বিজ্ঞান শিক্ষক এসে খালি খালি ধর্ম শেখাতে চায়;
বিশ্বাসের প্ররোচনা করে ।
(‘জ্ঞান উপদ্রুত’, সার্কাসমুখরিত গ্রাম)

অনুরূপ শৈলীতে ও সাফল্যে তিনি তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি , নির্বাচন, অপরাজনীতির ধূর্ত মারপ্যাচে জনগণের ক্ষমতাহীনতা নিয়ে রচনা করেছেন ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’, ‘গণতন্ত্র : ক্ষেপণযোগ্যতা, রপ্তানিযোগ্যতা’, ‘চা-খানার গণতন্ত্র’, ‘ঢোল সম্প্রাদায়’; এনজিওদের কর্মকান্ড নিয়ে ‘গরু চুরি; হাইস্কুলের মাত্রাতিরিক্ত ভারী সিলেবাস নিয়ে ‘ বালিকা বিদ্যালয় ’ এবং এমনতর আরও বহু কবিতা । তিনি রংপুরের বদরগঞ্জ এলাকার বহুদিনের ব্যাপক সাামাজিক অপরাধ—গরু চুরিকে আখ্যান হিসেবে নিয়ে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার সহযোগে এনজিওদের অসৎ কর্মকান্ডকে অত্যন্ত সুকৌশলে তুলে ধরেছেন । কাহিনির নাটকীয় অবতারণা, সংলাপের সরসতা , পরিহাসের তীব্রতা, আঞ্চলিক ভাষার সুপ্রয়োগ এবং বুদ্ধিদীপ্ত উপসংহার ‘গরু চুরি’ কাবিতাটিকে অতুলনীয় শিল্পসফলতা দান করেছেন । রংপুরের লোকজন এবং এনজিও কর্মীরা এই কবিতা পড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতেই পারেন ; কিন্তু কবিতার শিল্পরস তাদেরকেও অব্যর্থভাবে গভীরে গভীরে সিক্ত করে তুলবে বলে আমার গভীর বিশ্বাস ।

হেনরী অতিরিক্ত ও অনেকটাই অপ্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তকের আধিক্যভিত্তিক হাইস্কুল সিলেবাসকে পরিহাসের তীর ছুড়ে যখন বলেন , ‘নিজেই তো ভারানত; উপরন্তু ভোরের কুয়াশা চিরে/ স্কুলের পোশাকে দ্রুত ধাবমান বালিকাকে পাঠ্যপুস্তকবাহী/ ট্রাক মনে হয় । এত জ্ঞান কোথায় রাখো গো মেয়ে?’, তখন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট একটি জাতীয় সমস্যা আমাদের ক্ষয়ে-যাওয়া ভোঁতা উপলব্ধিতে আঘাত হানে সজোরে কিন্তু তারচেয়ে বেশি আপ্লুত করে কবিতার নান্দনিক রস ও শৈল্পিক সৌর্ন্দয। আবার সংঘটিত সামাজিক দায়বদ্ধতার মনকে তীব্রভাবে কষাঘাত করে , আলোড়িত করে, জাগিয়ে তুলতে চায়; তবে সবকিছুর আগে এবং সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে, বিমোহিত করে কবিতার আখ্যান র্নিমাণকৌশল ও উপস্থাপনাভঙ্গি যা একান্তভবেই রহমান হেনরীর নিজস্ব । আরেকটি কথা উল্লেখযোগ্য, হেনরী মেধাবী কবি— সুশিক্ষিত বুদ্ধিমান কবি, তবে একইসাথে তিনি হৃদয়বান কবিও । তার কবিতায় মেধা ও বুদ্ধির বিনিয়োগ আছে সত্য, পাশাপাশি আছে সংবেদনশীল হৃদয়ের দান । সেজন্যই তার কোনো কবিতাই নিষ্প্রাণ র্নিমাণে পর্যবসিত হয়নি,– হয়নি অসংযত আবেগের ফেনায়িত উচ্ছ্বাস । বরং মেধা ও হৃদয়ের সম্মিলিত দানে সেসব হতে পেরেছে বাগানবাড়ির মতো প্রাণবন্ত সৃষ্টি ।

রহমান হেনরী অজস্র ও অসংখ্য প্রেমের কবিতার কবি। তাঁর প্রেমের কবিতা আল মাহমুদের প্রেমের কবিতার মতোই জীবন্ত এবং রিরংসাময় অনুভবময়তায় সুনিবিড়। ব্যক্তিগত প্রেমের অভিজ্ঞতা আর বৈশ্বিক প্রেমের কবিতার পঠনপাঠনলব্ধ অভিজ্ঞতার সংশ্লেষ ও সম্মিলন হেনরীর প্রেমের কবিতাকে জীবনঘনিষ্ঠ ও শিল্পসমৃদ্ধ ঐর্শ্বয দান করেছে। অধিকন্তু বাঙালি জাতির প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস বিষয়ক জ্ঞান , প্রকৃতির অভিজ্ঞান এবং প্রকাশভঙ্গির প্রাতিস্বিকতা তার প্রেমের কবিতাকে প্রাণবন্ত ,অনভবনিবিড়, র্স্পশসুখের শিরহনঘন ও সুস্বাদু করে তুলেছে। তার প্রেমের কবিতার পক্ষে বলা যায়, বিপক্ষে বলা যায় কিন্তু সেসব কবিতাকে এতটুকুও উপেক্ষা করা যায় না, কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ফলে হাতের কাছে হেনরীর কবিতার বই থাকলে তা পড়ে দেখতে ইচ্ছা হবেই। তার কবিতায় মন আছে, শরীর আছে , যৌনতা আছে , তবে সবই আছে সরস বুদ্ধিমত্তা ও গভীর হৃদয়াবেগের সংশ্লেষে। তার প্রেমের কবিতায় কোনো স্থূলতা নেই ; তার ভাষা কখনো উলঙ্গ হয়ে পড়েনি । কিন্তু রোমান্টিক শুচিবায়ুগ্রস্ততাকেও পাত্তা দেননি তিনি। তার প্রেমের কবিতাগুলো সক্ষম যৌবনের চিরন্তন পিপাসার মেধাদীপ্ত, জীবন্ত ও তরতাজা সৃষ্টি যা প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে তোলার সক্ষমতায় সচ্ছল। হেনরীর অসংখ্য প্রেমের কবিতা থেকে সবচেয়ে রিরংসানিবিড় একটি কবিতা। এখানে হুবহু তুলে দিতে চাই।

কৃষ্ণবর্ণ গাভীর ওলান থেকে সাদা দুধ বের করো তুমি
লোকে জানে কী ভীষণ জাদুকরী, দক্ষ গোয়ালিনী!
আমার তো দুগ্ধতৃষ্ণা, জানো তুমি, যৌবনের মতই মৌসুমী;
সহাস্যে প্রকাশ্যে এক দুগ্ধরাজ, অন্য দুধ কিনি।
সরল সামান্য গাছে আচানক দেখা দিলে সুবিশাল ফল ৎ
নিজে কী অবাক হবো! আরও বেশি সমাজের চোখ;
ফলের প্রসঙ্গে আজ অবোধ শিশুও দেখি পর্যাপ্ত চঞ্চল
কাজেই যুগল লাউ দৃশ্যপটে উদ্ভাসিত হোক!

দুগ্ধ পান করি বটে,অধিক আনন্দ হয় ডুবালে শরীর
দুগ্ধপসারিণী জানো? কামধেনু খোলে কেন উদার ওলান?
ফল তো খেতেই চাই, সৌর্ন্দয-তৃষ্ণায় দুই চক্ষু হয় স্থির
পেয়ে গেছি অপুষ্পক সেই এক সুপ্রসিদ্ধ ফলের সন্ধান।
দুগ্ধরসিক জানে, শ্যামলা গাইয়ের দুধ মিঠা হয় অতি ;
আমিও খাঁটিই পাই…শ্যামলা হে গোয়ালিনী, তুমি তো যুবতী!
(‘কামধেনু’, গীতঅর্নায)

রহমান হেনরী এমন একজন শক্তিমান ও সহজাত প্রতিভাধর করি যিনি একটি সাধারণ ঘটনা বা নিতান্ত আটপৌরে বিষয়কেও হৃদয়জয়ী কবিতা করে তুলতে পারেন। কাব্যকৌশলের চমৎকারিত্বে এবং নির্মাণশৈলীর মনোহারিত্বে তার অতিসাধারণ বিষয়কেন্দ্রিক কোনো কবিতাও স্বাদে ও আকর্ষণে অসাধারণ হয়ে ওঠে । আসলে একই কৌতুক একজন বলে দর্শকশ্রোতাদের মাতিয়ে তোলেন, কিন্তু সেই কৌতুক অন্যেরা বললে কেউই আনন্দ পায় না; কেউই হেসে ওঠে না । উপস্থাপনাভঙ্গি, বাকচার্তুয ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ একজন কৌতুক অভিনেতার সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। অনুরূপভাবে একজন কবিরও প্রধান অস্ত্র বাকপ্রণালি ও উপস্থাপনাশৈলী। এই অস্ত্র নিজ আয়ত্তে থাকায় রহমান হেনরী একজন অসাধারণ শক্তিমান কবি হতে পেরেছেন। কোনো একজন কবির অথবা ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ ও আলাপ এবং তার হারিয়ে যাওয়া চিঠির ঘটনাকে কেন্দ্র করে হেনরীর লেখা ‘প্রতীক্ষা: বৃষ্টির মতো’ পাঠ করতে করতে মনে হয়- কী অনায়াস কাব্যশক্তি থাকলে একটি ঘটনাকে এমনভাবে রসময়, প্রাণময় ও আবেদননিবিড় শিল্প করে তোলা যায়! মানবপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, নরনারীর প্রেম, কাব্যপ্রেম , শিল্পপ্রেম, ইত্যাদি সম্মিলিত সৌন্দর্যে একাকার হয়ে উঠেছে এই কবিতায় । আর কবিতায় অবতারিত গল্পের মধ্যে সৃষ্ট ভাঁজ , খাদ আর আড়াল থাকার কারণে বারবার পাঠ করেও পাঠপিপাসা সবখানি মোচিত হয় না পাঠকের। হেনরীর হাতে এভাবেই এক অনিঃশেষ আনন্দপানের পাত্র হয়ে ওঠে কবিতা।

তবুও তোমার জন্যে স্বপ্নের সারাটা দুপুর আজও কেটে গেছে
ঠাকুর বাড়িতে; দক্ষিণের ত্যাজ্য বারান্দায় ; দোয়েলের ঠোঁট থেকে
টুপটাপ খসে পড়া হিরন্ময় সংগীতের মতো ঝমঝম বৃষ্টি ঝরেছে
বিরাটী ও আশোক নগরে, বনগাঁয়ে … দু‘পাড়ের কাস্টমস অফিসে ।
পাসপোর্ট নেই, তবু বৃষ্টি দেখো কী রকম অনায়াসে দুই দেশে নাচে!

ওহো অরণ্যের মেয়ে দেখো, প্যাপিরাসে লেখা হচ্ছে সংগুপ্ত বাসনা,
তোমার চোখের মদে লিপিবদ্ধ সমুদ্রের মতো মোহময়!
(‘প্রতীক্ষা: বৃষ্টির মতো’, তোমাকে বাসনা করি)

রহমান হেনরী কথায়-ছন্দে-উপমায় অলংকারনিবিড় সৌর্ন্দয সৃষ্টি করেন যা পাঠকচিত্তকে গভীরভাবে আকৃষ্ট ও সম্মোহিত করে তোলে। হেনরী বিষয়হীন কবিতা লেখেন না ; তার সব কবিতারই একটি ভাবকেন্দ্র বা ভাবনাকেন্দ্র থাকে। সেটা কখনো ধরা যায়, কখনো যায় না। যেখানে তা ধরা যায় না , সেখানেও পাঠকমন ঠকে না। তার কবিতার শরীরে ও প্রাণে সৃষ্ট শিল্পসৌর্ন্দয গুণী পাঠকের জন্য প্রথম প্রাপ্তি হয়ে যায় এবং অনেক কবিতায় সেটাই হয় পাঠকের জন্য প্রধান ও পরম পাওয়া । তার কবিতার সৌন্দর্যে অবগাহন করতে করতে পাঠক এমনই সম্মোহিত হয়ে ওঠেন যে, কবিতার বক্তব্য বা ভাবনার কেন্দ্র নিয়ে পাঠকের ভাবনা তার মগজ থেকে উধাও হয়ে যায়। কবিতার সৌর্ন্দয জোছনার মতো পাঠকের মনকে মুগ্ধ করে তোলে। তখন জোছনার উৎসে পোঁছানোর প্রয়োজন গৌণ হয়ে ওঠে। হেনরী তার কবিতায় শব্দে ও ছন্দে , অলংকারে ও প্রসাধনে , রূপে ও রসে অপরূপ শিল্পসৌর্ন্দযের নন্দনকানন রচনা করেন যেখানে একবার প্রবেশ করলে তা থেকে প্রস্থান করতে চায় না সৌর্ন্দযরসপিয়াসী পাঠকমন।

অতএব বাকি আছ তুমি, তুমি মানে তোমার শুশ্রুষাগান ,
প্রণয়ের মর্মার্থসংগীত। তুমিও কি নিপুণ যন্ত্রণা?
তুমিও কি জলধাঁধা, জ্যোৎস্নার অদৃশ্য আগুন?
শব্দের শরীরও আমি ভেঙেচুরে, ময়নাতদন্ত করে
দেখেছি অনেক– সভঙ্গশ্লেষের মধ্যে মানবিক যন্ত্রণার
রক্ত ও অনল; কাকে তবে উপমান-উপমিত করি!
কাকে তবে বাঁধি এই চন্দ্ররূপক–এ ! বিহিত বুকের মধ্যে
বহুকাল নির্বাসিত নদী হয়ে– গান হয়ে– চিত্রকল্প হয়ে—
রিনিঝিনি সুরে বয়ে গেছো …পূর্ণগ্রাস গ্রহণের চাঁদ;
(‘চন্দ্রলিপিকা’, খুনঝরা নদী)

এই কবিতার মূল বক্তব্য কী একথা না জানলেও ক্ষতি নেই পাঠকের; কবির প্রাতিস্বিক অনুভব সৌর্ন্দযের স্রোত হয়ে ছন্দে তালে ঢেউ তুলে জলকলরব নিয়ে বয়ে চলেছে, এটা দেখেই নয়ন জুড়ায়, এই কলরব শুনে প্রাণে আকুলতা জাগে । একটি কবিতার কাছ থেকে এই তো অনেক পাওয়া! রহমান হেনরী এমন অজস্র কবিতার কবি।

হেনরী সব ধরনের ছন্দে সাবলীলভাবে কবিতো রচনা করেছেন। এই ক্ষমতা তার সবখানি আয়ত্ব। স্বভাবতই অক্ষরবৃত্তে রচিত কবিতার সংখ্যা বেশি তার। তিনি একইসঙ্গে মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, মিশ্রছন্দ, টানা গদ্যগন্ধী ছন্দ ইত্যাদি সকল ফর্মেই কবিতা লিখেছেন। ছন্দের খেলায় তিনি একজন অলরাউন্ডার। আজকাল অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা লেখা হয় খুবই কম। এই ক্ষমতাও একটি আনকমন ব্যাপার। অন্ত্যমিলে কবিতা লেখার একটা বড় ঝুঁকি হচ্ছে এই যে অন্ত্যমিলযুক্ত শব্দ খুঁজতে গিয়ে কবিতার শরীর শিথিল হয়ে যেতে পারে, কবিতা হয়ে উঠতে পারে রোমান্টিক যুগের অনুসারী। কালসচেতন কবি হিসেবে হেনরী সেটা মোকাবলিা করেই অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা লিখেছেন এবং তা সংখ্যায় ও পরিমাণে প্রচুর। হেনরীর বিশিষ্টতা এই যে, তার অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতাগুলোও দুর্দান্তভাবে সাম্প্রতিকতম রুচির অনুকূলে সৃষ্টি এবং দারুণভাবে উপভোগ্য। এসকল কবিতায় বিষয়ভাবনায় ও চিত্রকল্প নির্মাণে তিনি কখনো কিছুটা আল মাহমুদীয় ঘরানার, কখনো-বা সবখানি প্রাতিস্বিক।

শোকের শেকড় ছেড়ে উঠে এসো অনার্য যুবতী
পাহাড়ের পাদদেশে আবার উঠুক নেচে রাত…
শ্রম ও শস্যের সেই সেতুবন্ধ, প্রকৃত প্রতিভা
অবাক সাহসে খোলো উর্বরতা, তৃষ্ণার্ত ভূ-বতী।
আমিও শিল্পের দিকে তুলে আছি প্রত্যাখাত হাত
তুমি সেই শিল্প হও, পাহাড়িয়া প্রাচীন প্রতিমা:
আবার উঠুক নেচে পূর্ণিামার প্রিয় সোমরস
পাহাড়ে থামুক নিদ্রা, দেহ হোক বাসনার বশ..’
(‘অনার্য বন্দনা’, প্রণয় সম্ভার)

‘ও বিরহ বল তো আমার এমন কেন হয়?
অনেক সাহস গিলতে থাকে এক চিলতে ভয়…
খিল এঁটে খুব যাচ্ছি সেঁটে অনুল্লেখ্য ঘরে
চাঁদ থেকে আজ প্রলোভনের জ্যেৎস্না ঝরে পড়ে
আজ তো আবার স্পর্শ মানা! একটু পরেই গ্রহণ
জ্বর নামছে শরীর জুড়ে, হৃদয় জুড়ে দহন…
বল তো ও জ্বর, এমন গভীর গ্রহণ যে জন জানে
তার সাথে এই অদর্শনের হেতুটা কোন্ খানে?’
(‘গান: মনের খসড়া থেকে’, প্রণয় সম্ভার)

পনশ্চ উল্লেখ্য, রহমান হেনরী সব ধরনের ছন্দেই সাবলীল ভঙিমায় কবিতা লিখে গেছেন। কোথাও কোনো ছন্দপতন ঘটেনি। এমনই তার ছন্দজ্ঞান ও ছন্দ প্রতিভা । হেনরীর সকল কবিতায় যে-গুণটি ব্যতিক্রমহীনভাবে বিরাজমান তা হচ্ছে নিটোল ছন্দের দোলা এবং কাব্যভাষার সাবলীলতার স্রোত । একবার পড়া শুরু করলে , কবিতাই টেনে নিয়ে যায় সবখানি পথ। থামতে হয়, দম নিতে হয় , কিন্তু কোথাও হোঁচট খেতে হয় না । পাহাড়ী নদীর মতো,কখনো-বা ঝরনার মতো, এঁকেবেঁকে চলে তার কবিতা; কিন্তু কোথাও গতি হারিয়ে ফেলে না। এই সাবলীল গতিময়তা তার কবিতাকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে যা পাঠকের ভালো লাগার অন্যতম প্রধান কারণ। আর কবিতা যদি ঘোড়া হয়, তবে রহমান হেনরী সেই ঘোড়ার এমনই এক দক্ষ সোয়ার– যিনি সাহসী পাঠককে পেছনে বসিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে চলে যেতে পারেন প্রান্তরে, পাহাড়ে, নদীতীরে, সমুদ্রসৈকতে, বাস্তবতার রোদেলা রাজধানীতে কিংবা রূপকথার জোছনালোকিত মাঠে। তিনি সুদক্ষ বাজিকরের ন্যায় ঘোড়ার পিঠে চড়ে খেলতে পারেন চোখধাঁধানো মনভোলানো খেলা প্রতিযোগিতাপূর্ণ শিল্পের ঘোড়দৌড়ের ময়দানে। আর চারপাশ থেকে বেজে ওঠে হাততালি। তার কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েই সেটা দেখানো টানা যাক:

বল্গাহারা ঘোড়ার খুরের ছন্দে রাত্রি গেল অনিদ্রার পথে,
প্রতুষ্যেই কার্য শুরু হলো; মনে রেখো, পাক্কা বাজিকর আমি,
তেমন ঘোড়ার জন্য আমার স্বপ্নকে ছাড়া সবকিছু বাজি ধরতে জানি;

আর আজ– জুয়ার বাজিতে হেরে, পানপাত্র ভেঙে, টলতে টলতে
হেঁটে যাচ্ছি সংর্কীণ গলির সেই কাফন-মোড়ানো-অন্ধকারে–
অথচ আর্শ্চয যে, তেমন ঘোড়ার জিন আমি কিন্তু বহুবার
স্বপ্নে নয়— বাস্তবে ছুঁয়েছি…
(‘দুধশাদা ঘোড়া’, গোত্রভূমিকাহীন)

রহমান হেনরীর কাব্যভাষা মোহমুগ্ধকর এবং নিজস্বতায় সমৃদ্ধ। তিনি চিত্রকল্প রচনা, উপমা নির্মাণ এবং শব্দ নির্বাচনে অনন্য শক্তিমত্তার পরিচয় রেখেছেন যা তার কবিতাকে একইসঙ্গে উপভোগ্যতায় উত্তীর্ণ ও ব্যঞ্জনায় ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছে। ‘ অসীমিত এক বাক্স রাত’, ‘নিহত সন্ধ্যা’, ‘মগজের মোম’, ‘বুড়ি চাঁদের উঠোন’, ‘ গহন গদ্যের গান’, ‘ সংকল্পের পৃষ্ঠা থেকে উড়ে যাচ্ছে মুদ্রণকৌশল’, ‘ উন্মাতাল বাণিজ্যের হাট’, ‘দুধের বিজ্ঞাপনে পুরুষেরও ক্লান্তি থাকা চাই’, ‘শুয়োরের মতো অন্ধকার’, ‘ প্রলোভনের জ্যোৎস্না’, ‘ মিডিয়ার পসারিণী’, ‘যুক্তির প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হলে বিজ্ঞান শিক্ষক এসে খালি খালি ধর্ম শেখাতে চায়;’,‘বিশ্বগ্রামে সাইবার নগরী’, ‘ পাঠ্যপুস্তকবাহী ট্রাক’, ‘খণ্ডিত হবার নামে বেড়ে যাচ্ছ জ্যামিতিক জেদে’, ‘গণতন্ত্রের এবং মুক্তিরও রপ্তানিযোগ্যতা’, ‘দিয়াছ দুঃখের ভার বাঙলার বিবাহিতা নদী, অধমেরে একা!’, ‘শরীরের জিয়াফত দিয়াছ ইঙ্গিতে’, ‘ তখন আমার দুঃখ মাধ্যমিক, আর তুমি নিম্নমাধ্যমিকে–’, ‘তোমাকে দেখতে যাব অনুতপ্ত স্মৃতিসম্মেলনে’, ‘নদীরা দুর্বোধ্যভাষ্যে গান গেয়ে ওঠে, পাখিরা বধির’, ‘রাধিকার ঘাটে কোনও শ্যাম নয়–ধ্বনিমন্ত্রে শিহরিত বিনয়ে ও কামে, এই পোড়া শরীরও মন্দির হেয়ে যায়..’, ‘ বিপ্লব ও বুদ্ধিজীবিতার অন্ধকারে প্রগাঢ়তা পাচ্ছে রাত’, ‘হয়তো বিশ্বব্যাংকের ফাইন্যান্সে গরু চুরির এমন অযুহাত করে।’, ‘এস্রাজে বেজে ওঠা একটি দুপুর’, ‘জোনাকির যাজক আলোক’, ‘সুখের সকল নদী ছুঁয়েছে শ্মশান’, ‘জানালায় উদাসী উদ্বিগ্ন চোখ’, ‘মেঘের মুখ কুয়াশার ছদ্ম নেকাবে ঢাকা’, ‘নারীর নিতম্বে বিছার মতো ছড়ানো নদীগুলি’, ‘বিলুপ্ত নদীর সাবেক স্রোতচিহ্ন’, ‘বাদুড়ের মতো ঝুলন্ত আশা’, ‘চা-খানার গণতন্ত্র’, ‘রূপসীর নির্ধারিত বয়স থাকে না’, ‘ষড়যন্ত্রের প্রখ্যাত মুখপাত্র’, ‘মধ্যদুপুরের সমুদ্ররঙ’, ‘যেন জেদি চণ্ডীদাস পুনর্জন্ম লভে আজও সিন্ধু-সভ্যতার নব্য-অভিলাষে।’, ‘ মহাত্মা গান্ধীর মতো অহিংসতা মেলে ধরে ব্যাপ্ত অন্ধকার’, ‘ নিম্নচাপ-কবলিত সমুদ্র-ঢেউয়ের মতো হাসি নিয়ে তুমি এলে না–অতি-শীতোষ্ণ সন্ধ্যায়’, ‘বহু হৃদয়ের এক আশ্চর্য যাদুঘর তুমি’, ‘থরে ও বিথরে কত প্রেমিকের মৃতদেহ শোভা পাচ্ছে তোমার হৃদয়ে!’, ‘শৃঙ্খলাভঙ্গের আনন্দ বা অসুখটাই খুবই ছোঁয়াচে ধরনের !’, ‘ধাঁধাশীল অভিমান’, ‘ ইঙ্গিতপ্রসূত ভঙ্গিমা’, ‘ এসেছি নির্জনমেঘ, নির্দ্বিধায় সিক্ত করো দাহ্যমান শাড়ি!’, ‘আমিষচিত্রিত শারীরিক উন্মাদনা’, ‘ঊরুর স্নেহ’, ‘ মৃদুছন্দ আয়াতের মতো’, ‘দুনিয়ার চুলে চিরুনি চালানো মাতাল বাতাস’, ‘ঘুমেরও কান আছে’,‘ বিদ্যাচূর্ণ মাখিয়ে দিচ্ছো উস্কোখুস্কো চুলে’, ‘রাত্রির শব্দ সঙ্গম’, ‘নান্দনিক নটিনীর ক্ষমা’, ‘স্বপ্ননীল প্রলোভন’, ‘সুখের সংজ্ঞার মতো দশটি আঙুল’, ‘প্রেমিকসম্মত দুষ্টুমি’ –প্রভৃতি এবং এরকম আরও প্রচুর সংখ্যক শব্দবন্ধ, সমাসবদ্ধ শব্দ, উপমা, চিত্রকল্প, বাক্যাংশ প্রমাণস্বরূপ হাজির করা যেতে পারে যা কবি হিসেবে রহমান হেনরীর অনন্য সৃজনশীল শক্তিমত্তা ও প্রাতিস্বিকতার সোনালি ছাপ বহন করে। একজন কবির শক্তিমত্তা ও স্বকীয়তার সবচেয়ে বড় প্রমাণক হচ্ছে একটি নিজস্ব কাব্যভাষা যা শব্দের ব্যবহার, উপমার অভিনবত্ব, চিত্রকল্পের নতুনত্ব ও উপস্থাপনা কৌশলের নান্দনিক সৌকর্য নিয়ে তৈরী হয়। রহমান হেনরী সেমতেই একটি নিজস্ব কাব্যভাষা অর্জনে সক্ষম ও সফল হয়েছেন। রহমান হেনরীর অর্জিত নিজস্ব কাব্যভাষা আমাদের আকর্ষণ করে, মুগ্ধ করে এবং পাঠে ধরে রাখে।
—–০০০—-


আমিনুল ইসলাম
কবি ও গবেষক

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

Leave a Reply to খান কাওসার কবির Cancel reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম on শিপা, আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতে পারিনি
কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা
এড. শাহানারা স্বপ্না on লেট ফ্যাসিজম