জাসমিনা খাতুন
……………
আর্তনাদ
……………
এই যে মাটি, এই যে নদী, এই যে গাছ—
তারা কি কথা বলে?
না, তারা শুধু স্থির থাকে,
নীরবতার মন্দিরে আর্তনাদে গুমরে মরে,
ধৈর্যের শেকলে বাঁধা থাকে শতাব্দীর দীর্ঘশ্বাস।
গাছের শাখায় বাতাস বয়,
তবু কোনো অভিশাপ নয়,
পৃথিবীর বুকে ঝড়ে ঝরে পড়ে ফুল,
তবু কোনো অভিযোগ নয়।
মাটির গভীরে শিকড় ধরে থাকে আষ্টেপিষ্টে আঁকড়ে,
তবু কখনো মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নয়।
তবে কেন আমি হলাম না
একখণ্ড নির্বাক মাটি,
যে শুধু বৃষ্টি সয়ে নেয় নিস্পৃহতার গভীর অভিব্যক্তিতে?
কেনই বা হলাম না একা দাঁড়িয়ে থাকা নাম না জানা কোন গাছ,
যার শরীরে পাখির ছায়া পড়ে,
কিন্তু সে কারও স্পর্শে কাঁপে না?
আমি তো কল -কল কল্লোলিন কোলাহলের নদীতে ভাসি,শহরের অনন্ত ব্যস্ততায় প্রতিটি রাস্তা হয়ে উঠি।
একটি গল্পের কফিন,
যেখানে শব্দ গুমরে মরে,
স্মৃতিরা ধুলোর নিচে চাপা পড়ে থাকে।
আমি সেখানে,
আকাশচুম্বী জানালায় মুখ রাখা স্বপ্নগুলো
দিন শেষে আলো-অন্ধকারের সন্ধিক্ষণে
রুপোলি পর্দায় আঁখি হয়ে দেখি—
নিজেই নিজের ছায়া হয়ে যায়।
বুক ফাটানো যন্ত্রণাগুলো ছড়িয়ে দিই
কবিতার আকাশে,
বাতাসের শিরায়,
জোছনার স্তব্ধ মেঘে,
সমুদ্রের নোনাজলে,
যেন এই আর্তনাদ নিঃসঙ্গ না থাকে,
ব্যস্ত শহরের নীরবতায়
কেউ একজন কোন একদিন তা শোনে।
তবু, কোনো-কোনো দিন ইচ্ছে করে—
আমি যদি হতাম নিস্তব্ধ বৃক্ষ,
অনাঘ্রাত মাটি,
পথহীন নদী—
যে শুধু বয়ে চলে,
শব্দহীন, অথচ চিরকাল সব অনুভূতি দিয়ে বোঝে।
রামপুরহাট, বীরভূম, ভারত।
31/01/2025
…………..
নিখোঁজ তারা
……………
একটা তারা নিখোঁজ আজ, নিখোঁজ আমাবস্যার ঘন তমসায়।
যে তারা প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা,সে কেন হারালো গহন ছায়ায়..?
বিহঙ্গ তো গায় রক্তিম গীতি,
উষার দ্বারে তোলে জাগরণ প্রীতি।
পুষ্প হাসে সুবাস বিলায়,
মৌমধ্যে জাগে প্রাণের স্পন্দন।
তবে সে তারা লুকালো কোথায়?
কোন মোহের ফাঁদে পড়ে?
যে আলো ছিল দীপ্ত তপোবলে,
সে কেন নিবে গেল ছায়ার ঘোরে ঘোর অন্ধকারে?
তুমি কি জানো? জানো প্রিয় জানো, সে তারা আমিই!
তোমার ব্যথায় একদিন দীপ্ত,
প্রেমের মশাল জ্বালিয়েছিলাম দুটি হৃদয় হয়েছিল সিক্ত,আজ নির্বাপিত, নীরব, ক্লান্ত।
বিচ্ছেদের গহন রজনীতে,
আমি যেন ম্লান চন্দ্রকান্ত!
তোমার স্বরে ওঠে বিদ্রোহী হাহাকার,তবু কি ফিরে আসিব অবান্তর?
হয়তো কোনো ভোরের রঙে,
নবীন সুরের বীণা বাজবে।
তোমার শূন্য নীড়ের ব্যথা ঘুচিয়ে,
আবারও তারার মিছিলে অন্য তারা সাজবে।
রামপুরহাট ,বীরভূম, ভারত।
1/02/2025
………….
চাঁদ
………….
চাঁদ আজ উঠবে না বাঁশবাগানের মাথার উপর,
পুকুরপাড়ে কাঁপবে না তার দুধসাদা আলো।
আমি চাঁদ দেখেছি ফুটপাতে শুয়ে,
এক টুকরো কাঁথায় নির্বস্ত পড়ে আছে,
শীতের রাতে তার মা পাশে বসে,
ছোট্ট ছোট্ট চুমু এঁকে দিচ্ছে মুখে।
ওই চাঁদের হাসি—
সমস্ত আকাশের চাঁদকে দিয়েছে ফাঁকি!
আমি চাঁদ দেখেছি হাসপাতালের বারান্দায়,
সাত দিনের এক শিশু অপারেশনের অপেক্ষায়।
ওর মা দাঁড়িয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে,
চোখে এক সমুদ্র ভয়, অথচ বুকের গভীরে বিশ্বাস।
ডাক্তার এলে তিনি দু’হাত জোড় করে বললেন—ডাক্তার বাবু”আমার চাঁদ, ওর কিছু হবে না তো?”
ডাক্তারের চোখে নীরবতা,
শুধু সময়ের টানটান উত্তাপ।
আমি চাঁদ দেখেছি গঙ্গার ঘাটে,
এক বাবা তার মেয়ের শবদেহ সাজিয়ে দিচ্ছে,
সিঁদুরের টিপ লেগে আছে এখনো কপালে,
আগুনের শিখায় যেন এক চাঁদের লুকোচুরি।
আমি চাঁদ দেখেছি ট্রাফিক সিগন্যালে,
এক শিশু ফুল বিক্রি করে হাসে,
হয়তো তার মায়ের ওষুধ কেনার টাকা হবে।
চাঁদ কি শুধুই আকাশের বুকে?
চাঁদ কি শুধুই আলোয় ভরা?
না, চাঁদ আমাদের মাঝেই আছে,
কখনো ফুটপাতে, কখনো হাসপাতালে,
কখনো বা শ্মশানের শুষ্ক ছাইয়ে—
এক টুকরো আলো হাতে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অন্ধকার জীবনে সুন্দর কোজাগরির মত হাসছে তারা!
রামপুরহাট বীরভূম ভারত।
৩/০২/২০২৫
রুচিশীল ও সাহিত্যমূল্যে অসাধারণ একটি অনলাইন সাময়িকী