spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যঅত:পর কবি শহীদ মিনারে এলেন, গুচ্ছ গোলাপের ভালোবাসায় বসন্তে বিপ্লবে

লিখেছেন : শাকিল মাহমুদ

অত:পর কবি শহীদ মিনারে এলেন, গুচ্ছ গোলাপের ভালোবাসায় বসন্তে বিপ্লবে


শাকিল মাহমুদ

সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে জয় করা প্রিয় বর্ণমালা বাংলা আমার। ভাষা শহীদদের স্মৃতি আকড়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সে দিনলিপি নিয়ে বহুল

প্রচলিত যে পংক্তিমালা-‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুর বেলার ওয়াক্ত বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায় বরকতেরই রক্ত’

এই অমর পংক্তিগুলোর রচয়িতা আধুনিক বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ। বসন্তের এক বিকেলে ভাষা শহীদদের স্মৃতির শহীদ মিনারে আল মাহমুদ এলেন। তবে এ আসা বিজয়ীর, অমরত্বের বিজয়ী বীরের বেশে আসা যাকে বলে। দলদাস স্বৈরতন্ত্রের তল্পিবাহক সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট একদিন যে আল মাহমুদের লাশ শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আনতে দেয়নি। আজ তারা সবাই গর্তে লুকিয়েছে। বিপ্লব বসন্তে চিরঞ্জীব আল মাহমুদ অদৃশ্য আসমান থেকে মিটি মিটি হাসছেন। খোদ সরকার বাহাদুরই এখন তাকে সম্মান জানাতে ব্যস্ত। এটাই কবির শ্রেষ্ঠত্ব, এটাই কবির বীরগাথাঁ, বীরত্ব। দিনটি ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, সাহিত্য সংগঠন কালের কলস এর আয়োজনে বসন্তের মিঠা রোদের এক বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হয় কবিতাপ্রেমীরা। কালের কলসের পক্ষ থেকে সবার হাতেই বাসন্তী উপহার হিসেবে প্রিয় কবি আল মাহমুদের প্রিয় লাল গোলাপ তুলে দেয়া হয়। এরপর এক এক করে মঞ্চের আসন অলংকৃত করেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারকী, কবি ফরহাদ মজহার, কবি আব্দুল হাই শিকদারসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা। কবি শাকিল মাহমুদ ও মুশফিকা নিপার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে জুলাই বিপ্লবে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় ফাতেহা পাঠ ও এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর কালের কলস সম্পাদক কবি আবিদ আজমের স্বাগত বক্তব্য। কবি আল মাহমুদের সঙ্গে দেড়দশকের পথচলা ছিলো কবি আবিদের। তাই স্মৃতি ও আবেগের ডালা ঝাপটে বেরিয়ে আসা অনেক উচ্চারণ। রাষ্ট্রীয়ভাবে কবির প্রয়াণ দিবস পালন না করায় ক্ষোভ জানিয়ে কবি আবিদ আজম বলেন, ‘বিগত স্বৈরাচারী সময়ে আল মাহমুদকে তুমুল অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করা হয়েছে। তার লাশ শহীদ মিনারে আনতে দেয়নি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, তার দাফন নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। অথচ আজ সসম্মানে নানা মত-পথের মানুষকে একত্রিত করে এই শহীদ মিনারে এনেছেন, এটাই কবি আল মাহমুদের শক্তি। আবিদ বলেন, জুলাই আন্দোলনেও আমরা দেখতে পাই আল মাহমুদ কতটা প্রাসঙ্গিক। তিনি যখন বলেন, আমাদের যাত্রা অনন্তের দিকে/ পৃথিবীতে যত গোলাপ ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত, তার সুগন্ধ আমাদের নিঃশ্বাস বায়ু। জুলাই বিপ্লবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন দেয়ালে শোভা পেয়েছে এই পংক্তিমালা। অবিলম্বে পাঠ্যপুস্তকে আল মাহমুদের কবিতা পুনর্বহালের দাবি জানান তিনি। অনুষ্ঠানে উদ্বোধক হিসেবে অংশ নিয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী বলেন, কবি আল মাহমুদের বাড়ি সংরক্ষণের প্রসঙ্গটি দাবি তোলার বিষয় ছিলো না, এটা মন্ত্রণালয় থেকেই হওয়া উচিত ছিল। পরিবারের সম্মতি পেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কবি আল মাহমুদের বাড়িতে স্মৃতি জাদুঘর ও মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হবে।
তিনি বলেন, কবি আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার রচনা বাড়ি স্মৃতি আগামী প্রজন্মের জন্য রাখা ও ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি। এই বিষয় আমাদের আগ্রহ আছে, ধীরে গতি হলেও এমন কাজ হয়। কিন্তু গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার এই কাজটি গুরুত্ব দিয়ে করবে। সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, আল মাহমুদ কোনো রাজনৈতিক দলের নন, তিনি পুরো বাংলা ভাষার।

কবি আবদুল হাই শিকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, আল মাহমুদ যখন লিখলেন সোনালী কাবিন, তখন কাবিন শব্দটি ভীষণভাবে সিগনিফিকেন্ট হয়ে ওঠে। এটা ছিল নতুন রাজনৈতিক আওয়াজ। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে আল মাহমুদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্তমূলকভাবে হাজির হয়েছে। সবার মাঝে তার চিন্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। জুলাই আন্দোলনে প্রমাণ হয়েছে আমরা ঘুমিয়ে নেই, জেগে আছি। ফরহাদ মজহার বলেন, ফরহাদ মজহার বলেন, ৫ আগস্টের পর আমরা পূর্ণ বিজয় পাইনি। ‘২৪ এর বিপ্লব যেন বেহাত না হয় এজন্য সাংস্কৃতিক লড়াই অবধারিত, এই লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে শিল্পী, কবি, সংস্কৃতিকর্মীদের।

সভাপতির বক্তব্যে কবি আব্দুল হাই শিকদার বলেন, ৫ আগস্টের পর অনেক কিছু স্বাধীন হয়েছে, শুধু সংস্কৃতি অঙ্গন স্বাধীন হয়নি। তবে শহীদ মিনারে আল মাহমুদকে নিয়ে এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হওয়ায় সেই কষ্ট কিছুটা কমেছে। অবিলম্বে কবি আল মাহমুদের কবর রাষ্ট্রীয়ভাবে সংস্কারের দাবি জানান। কবির মৃত্যুর পর তাকে শহীদ মিনারে আনতে না দেওয়া এবং গণকবরে দাফন করা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান না জানানোর কড়া সমালোচনা করেন কবি আব্দুল হাই শিকদার। তিনি বলেন ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কতটা দুঃসময় ছিলো তা মনে করলে গা শিউরে ওঠে। কবি আল মাহমুদকে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনতে চাইলে তাতে বাদ সাধে তৎকালীন স্বৈরশাসকের তল্পিবাহক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ঐ সময়ের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর গংরা। আব্দুল হাই শিকদার বলেন, সেদিন কবি আবিদ আজম এবং তার বন্ধুরা অনেক চেষ্টা করেই ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে কবি আল মাহমুদকে দাফনের অনুমতি পাননি। এমনকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কবির নিজ বাড়ির আঙিনাতেও দাফন করতে দেয়া হয়নি। আল মাহমুদকে যে কবরে রাখা হয়েছে তার ওপরে আরো ৪টি লাশ কবরস্থ করা হয়েছে-এটা কবির জন্য চরম অবমাননাকর।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে একুশে পদকজয়ী আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন তার তোলা আল মাহমুদ ও শামসুর রাহমানের একটি যুগল সাদাকালো ছবির স্মৃতি তুলে ধরে বলেন, ভাষা সংগ্রামী আল মাহমুদকে তিনি চিনতেন বামপন্থী সময় থেকেই। তারপর তার বিশ্বাস বদলেছে ঠিক। রাজধানীর শ্যামলীতে শামসুর রাহমানের বাড়িতে সে ঐতিহাসিক ছবি তোলার স্মৃতিচারণ করেন, ঐ সময়ে বিশ্বাসের ভিন্নতা থাকলেও কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ ছিলো, যার প্রমাণ ঐ ছবিটা। কিন্তু এখন দিন দিন মতের ভিন্নতা হলেই শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। জুলাই বিপ্লব উত্তর নতুন বাংলাদেশে এসব বন্ধ হওয়া জরুরি। এমন এক পরিবেশ দরকার, যেখানে মুক্তমতকে সবাই শ্রদ্ধা করবে।-বিভাজন নয় ঐক্যবদ্ধভাবেই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

কবি জাকির আবু জাফর বলেন, আল মাহমুদ যখন বলেন, কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি, সে তো ভেসে ওঠা আমার মায়ের স্নান মুখ, নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি। এই চিত্রকল্পই আল মাহমুদের স্বকীয়তা। জাকির আবু জাফর বলেন, কবি আল মাহমুদ এদেশের মধ্যবিত্তের অবদমিত কাম-প্রেমের কথা তুলে এনেছেন বারবার। তিনি যখন বলেন-বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই/ দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর/লাঙল জোয়াল কাছে বায়ুভরা পালের দোহাই/ হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করেনা কসুর/। আল মাহমুদকে যতই অবজ্ঞা করা হোক, পুরো বাংলাদেশ, মাটি-মানুষকে এত কাতারে নিয়ে এসেছেন আল মাহমুদ। তিনি মাহমুদ চিরঞ্জিব হয়েই থাকবেন।

ড. কাজল রশীদ শাহীন বলেন, বইমেলায় আল মাহমুদসহ গুণীদের কীভাবে দেখা মূল্যায়ন হচ্ছে, এর মাঝে বুঝা যায় রাষ্ট্র সংস্কৃতি ধারণ করে কতটুকু। ফ্যাসিবাদী সরকারের আচরণের শিকার আল মাহমুদ। গণ অভ্যুত্থানের পরেও যদি আল মাহমুদ সেভাবে যথাযথ মূল্যায়িত না হয় তাহলে আমাদের শহীদের ত্যাগ কি জন্য? কবি শাহীন রেজা বলেন, বিরুদ্ধাবাদীরা যত চেষ্টাই করুক, কোনভাবেই আল মাহমুদের মতো শক্তিশালী একজন কবিতে অস্বীকার করতে পারবে না। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ড. কুদরত ই হুদা, ইতিহাসবিদ আশরাফুল ইসলাম ও কবি ইমরান মাহফুজ। বিপ্লব বসন্তে আল মাহমুদ নামের পুরো অনুষ্ঠানের ভিন্নতা এই যে এখানে শুধু আলোচনাই ছিলো না একটু আলোচনা, আবার একটু আল মাহমুদের গান, ফাকে ফাকে আল মাহমুদের কবিতা আবৃত্তি করেন দেশের তরুণ আবৃত্তিশিল্পীরা। অনুষ্ঠানে আল মাহমুদের গান পরিবেশন করেন শিল্পী আমিরুল মোমেনিন মানিক ও জান্নাতুন নাঈম পিংকী। আবৃত্তি পরিবেশন করেন শিমুল পারভীন, কামরুল ইসলাম জুয়েল, মুক্তা বর্মন, ফারাহ দোলন, কঠোর হাসান, মুসা আখন্দ, এম, তারেক হাসিব, মনিরুজ্জামান পলাশসহ আরো অনেকে। অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রায় ২ ঘণ্টা ধরেই অনুষ্ঠান মঞ্চে ছিলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কবিতার জন্য নির্বাসন
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ