কাজী জহিরুল ইসলাম
জাতীয়তাবাদ যেহেতু কিছুটা উগ্র দেশপ্রেম তাই এই বিষয়টিকে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের অল্পশিক্ষিত, অল্পজ্ঞানী মানুষ পছন্দ করে। হয়ত ভাবতে পারেন, হিটলারের জাতীয়তাবাদ জার্মানির লোকেরা ব্যাপকভাবে পছন্দ করেছিল, ওরা কি অশিক্ষিত? হ্যাঁ, একটা সময় পর্যন্ত ওরা জাতীয়তাবাদের, আর্য রক্তের শুদ্ধতার ঘোরের মধ্যে ছিল। কিন্তু সেই জার্মান জাতি আস্তে আস্তে শিক্ষিত হয়ে উঠেছে, প্রাজ্ঞ হয়ে উঠেছে, এখন কেউ হিটলারের নীতি মানে না, বহুজাতের, বহুচিন্তার মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই এখন ওদের বিশ্বাসের কেন্দ্র, এটিই ওরা আজ মেনে চলে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ একটি ভ্রান্ত জাতীয়তাবাদের কথা বলেছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশে তারা সর্বদাই অনৈক্য, বিভেদ তৈরি করেছে। বিএনপি যথার্থই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা গণমানুষের সামনে নিয়ে এসেছে, এই ধারণা পাহাড় ও সমতলের মধ্যে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ঐক্য তৈরি করতে পেরেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিস্তার লাভ করেছে। এদেশের মানুষের মনে এই সন্দেহ তৈরি হয়েছে যে ভৌগোলিকভাবেও বাংলাদেশ একদিন ভারতের অধীনস্ত একটি অঙ্গরাজ্য হয়ে যাবে, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজের পতাকাটি তারা অচিরেই হারিয়ে ফেলবে। এই সন্দেহটিকে ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর করেছে আওয়ামী লীগ, বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে। তদের ভারত তোষণ নীতি এবং ভারতের অনুলিপি পররাষ্ট্র নীতির মধ্য দিয়ে দেশকে ক্রমশ ভারত-নির্ভর করে ফেলা বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেয়নি। এদেশের মানুষ তাই বিকল্প শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে বেছে নিয়েছে।
বিএনপি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জোরালো কণ্ঠ হিসেবে দলটির অবস্থান নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে। এবং কালক্রমে, বিএনপির নেতৃত্ব বুঝুক আর না বুঝুক, দলটির মূল পুঁজি হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের আগ্রাসন বিরোধী অবস্থান।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে মধ্য দিয়ে ৫ আগস্টে হাসিনাসহ ফ্যাসিস্ট সরকারের পলায়নের পর বিএনপি কিছুটা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এর মূল কারণ, তারা যা পারেনি ছাত্ররা তা কীভাবে করে ফেলল, তাহলে কি বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপরিহার্যতা হারিয়ে ফেলেছে, অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে? এই ঘুর্ণাবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে তাদের জাহাজ গিয়ে নোঙ্গর করে ভারতের বন্দরে। জনসম্পৃক্ততার যে শক্তি, এই বিষয়ে তারা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, ভীত হয়ে পড়ে, নিজেদেরকে নিজেরাই সন্দেহ করতে থাকে। ঠিক সেই সুযোগটিই নেয় ভারত। বিএনপিকে ভারত সম্ভবত বোঝাতে সক্ষম হয় যে ক্ষমতায় যেতে হলে এবং ক্ষমতায় থাকতে হলে ভারতের সাহায্য তাদের লাগবে। তারা বিএনপিকে আরও বোঝাতে সক্ষম হয়, এই মুহূর্তের বিজয়ী শক্তি ছাত্র-জনতাই তাদের প্রতিপক্ষ, তাদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়াতে হলে ভারত বিরোধিতা নয় বরং ভারতের পক্ষেই তাদের থাকতে হবে এবং ভারতও তাদের পাশে থাকতে রাজী আছে। শুধু কথা দিতে হবে ভারতের পরম অনুগত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। এই টোপ বিএনপি গিলেছে। এই বিষ গলাধঃকরণ বিএনপির জন্য সন্দেহাতীতভাবেই আত্মঘাতী হয়েছে। ভারতের প্রতি নমনীয় আচরণ বিএনপির জন্য রাজনৈতিক আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। কর্মী, সমর্থকদের বাইরে বিএনপির যেটুকু গণমানুষের সমর্থন এখনও আছে তা ভারত বিরোধীতার কারণেই। প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসনামল ছাড়া, অতীতে বিএনপি সরকার এমন কোনো ভালো কাজ করেনি, যার জন্য দেশের মানুষ তাদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে। এখনো তাদের দুর্নীতি, রাষ্ট্র পরিচালনায় নানান ব্যর্থতা, ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার ফন্দি-ফিকির মানুষের স্মৃতিতে দগদগে ঘায়ের মত জ্বলছে।
উপমহাদেশে ভারত একটি বৃহৎ শক্তি সন্দেহ নেই কিন্তু ভারত তার শক্তি নিয়ে কখনোই স্বস্তিতে ছিল না, এখনও নেই। কাজেই ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশে তারা চাইলেই যা খুশি তা করতে পারবে না, যদি মেধাবী, দক্ষ এবং জনসমর্থনপুষ্ট একটি সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকে। চায়না এবং পাকিস্তানের সাথে ভারতের যে টানাপোড়েনের সম্পর্ক এই ডাইনামিক্সকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সব সময় কৌশলী এবং সচেতন থাকতে হবে, তাহলেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত নাক গলাতে পারবে না। যে কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ড. ইউনূস সরকার প্রথম দিন থেকেই করছেন। অমেধাবী এবং দুর্বল নেতৃত্বের পক্ষে এই ডাইনামিক্স বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। এ-কারণেই অমেধাবী নেতৃত্ব ক্ষমতায় থাকার জন্য সর্বদা সোজা রাস্তা খোঁজেন, যে রাস্তা তাদের দেখানোর জন্য ভারতের সফট পাওয়ার দিনরাত ব্যস্ত থাকে, আর সেটি হচ্ছে ভারতের বশ্যতা স্বীকার, ভারতের কাছে নতজানু থাকা।
ফিরে আসি বিএনপিতে। গণমানুষ মুখ ফিরিয়ে নিলেও নিজস্ব কর্মী সমর্থকদের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর যে শক্তি বিএনপির আছে তার ধারে কাছে যাওয়ার সামর্থ্যও অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেই। কিন্তু দলের দ্বিতীয় সারির বয়োবৃদ্ধ নেতারা যেভাবে ক্রমাগত ভুল বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, যেমন মির্জা আব্বাসের ক্ষমতায় গিয়ে সংস্কার বদলে ফেলার হুমকি, ফজলুর রহমানের ভারত ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠিত বয়ানের প্রতি সমর্থন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ‘নির্বাচন’ জেকের, সালাহউদ্দিন আহমেদের দাম্ভিক উচ্চারণ, সর্বোপরি দল হিসেবে সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান, তাদেরকে অতি দ্রুত দুর্বল করে ফেলছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও দলটি আস্থার সংকটে পড়বে।
বিএনপির যিনি একমাত্র কাণ্ডারী, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন, তাকে কথায় নয় কাজে প্রমাণ করতে হবে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার একজন যোগ্য নেতা হয়ে উঠেছেন, ভারতের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবেন, ড. ইউনূসের পরে তিনিই হবেন দেশের সবচেয়ে যোগ্য নেতা। এই কাজটি করার জন্য এখন তার সামনে দুটি পথ খোলা আছে। ১৮ মার্চ আমি এই বিষয়ে লিখেছিলাম, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন করে তিনি সেই সরকারের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হতে পারেন, ইউনূসের পাশে থেকে তিনি একই সঙ্গে বিশ্বমানের শিক্ষাটা পাবেন, সেই সঙ্গে বিশ্বসভায় ক্রমশ ব্যাপক পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবেন। এই বিষয়ে আরো পরিস্কার করে ডাক্তার পিনাকী ভট্টাচার্য পরে একটি ভিডিও কন্টেন্টও তৈরি করেছেন। তিনি অবশ্য জাতীয় সরকারের ফর্মেই ‘ট্রানজিশলান সরকার’- এর কথা বলেছেন। রূপরেখা যাই হোক বিষয় এবং লক্ষ্য একই।
দ্বিতীয় উপায়টি হলো, তাকে অতিদ্রুত দেশে ফিরে আসতে হবে এবং দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দিয়ে পরিস্কার করে বলতে হবে, ইউনূস সরকারের প্রতি বিএনপির পূর্ণ আস্থা আছে, তারা বিশ্বাস করেন এই সরকার সঠিক সময়ে নির্বাচন দিয়ে গণমানুষের নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তুলে দেবেন [এই সত্য তারা নিজেরাও ভালো করেই জানেন]। নির্বাচন নিয়ে তারা সরকারকে কোনো রকম চাপ প্রয়োগ করবেন না। ইতোমধ্যেই রাষ্ট্র পরিচালনায় ইউনূস সরকার যে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে সেজন্য সরকারকে অভিনন্দন জানাবেন। তিনি আরো নিশ্চিত করবেন এই সরকারের সকল কর্মকাণ্ডকে তার দল শর্তহীন সমর্থন দেবে এবং পাশে থাকবে, কারণ তারা নিজের দলের ক্ষমতার জন্য নয় রাজনীতি করেন দেশের ও দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য। সেই সঙ্গে সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো পুনর্বিবেচনা করে অধিকাংশের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাবেন, অধ্যাদেশের মাধ্যমে যেন সেগুলো আপাতত বাস্তবায়ন করা হয়। ভবিষ্যতে যদি বিএনপি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে তারা এইসব অধ্যাদেশ সংসদে পাশ করার ব্যবস্থা করবেন। তারেক রহমান এই ভাষণ দেবার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির জনপ্রিয়তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে যাবে, জামায়াত কিংবা এনসিপিকে যারা বিএনপির বিকল্প ভাবছিলেন তারা সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করবে।
বিএনপিকে কেন তাদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে? করতে হবে এজন্য যে অতীতে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় গিয়ে জনগণকে দেওয়া তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি, তাই দেশের মানুষ আগে ক্ষমতায় ছিল এমন কোনো রাজনৈতিক দলকে বিশ্বাস করে না। হাসিনার শাসনামলে ৩১ দফার একটা দুর্বল সংস্কারের রূপরেখা বিএনপি দিয়েছিল। তখন তারা ভেবেছিল নিকট ভবিষ্যতে তাদের যেহেতু ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ নেই কাজেই একটা কিছু দিয়ে জনগণকে সজাগ রাখি। এখন তারা ক্ষমতার খুব কাছাকাছি এসে ভাবছেন, খাইছে, ৩১ দফার প্যাচে ফেসে গেলাম তো, ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল বুঝি? তাই নিজেদের ৩১ দফারই বিরোধিতা করতে শুরু করেছেন। তারাই বলেছিলেন পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়, প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা নয়, সংসদের উচ্চকক্ষ ইত্যাদি, অথচ এইসব বিষয়ে এখন তারা দ্বিমত প্রকাশ করে দল হিসেবে মানুষের আস্থা হারিয়েছেন এবং একটি দুর্বল ও বিশ্বাসঘাতক দলে পরিণত হয়েছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে এখন মানুষ তারেক রহমানের ভাষণ কেন বিশ্বাস করবে? করবে এজন্য যে এখন তাদের ভালো কথা প্রমাণ করার একটা সুযোগ আছে, সুযোগটি হচ্ছে সংস্কার প্রস্তাবে সমর্থন জানানো এবং অধ্যাদেশের মাধ্যমে সেগুলো বাস্তবায়নে সরকারকে অনুরোধ করা। এটিই গণমানুষের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণের একমাত্র পথ।
আমি মনে করি এই দুটি পথে যদি বিএনপি, মানে তারেক রহমান, হাঁটেন তাহলে সেটি হবে দেশ, দেশের মানুষ, বিএনপি এবং তারেক রহমান সকলের জন্য উইন উইন উইন উইন গেইম। আমি উইন শব্দটি চারবার বললাম এজন্য এটি একটি ডাবলস ম্যাচ, একদিকে দেশ ও দেশের মানুষ, অন্যদিকে বিএনপি ও তারেক রহমান। এই খেলায় দুই দল এবং চার খেলোয়াড় সকলেই বিজয়ী হবেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার এই কথাগুলো গ্রহণ করতে ড. ইউনূস সরকার বিন্দুমাত্রও দ্বিধা করবেন না, খুশি হবেন দেশের অন্য রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ, বল এখন বিএনপি তথা তারেক রহমানের কোর্টে। এই একজন মানুষের সুমতি হলেই বাংলাদেশ এক বিপুল সমৃদ্ধির মহাসড়কে উঠে দাঁড়াবে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৪ এপ্রিল ২০২৫