ড. মাহবুব হাসান
আমাদের মৌণতার ফাঁক গলিয়ে কবিতায় ঐতিহ্যিক উপাদান আর দেশি-বিদেশি পুরাণ ঢুকে পড়ে। এ-কথায় মনে হতে পারে কবি সচেতনভাবে তার কবিতা রচনা করেন না। আসলে তা নয়। আমি বলতে চাই কবির অন্তরে পুরাণ ও ঐতিহ্য এমনভাবে ওতপ্রোত যে তা আপনা থেকেই উঠে আসে চিন্তার অরবিটে, লেখার পঙক্তিতে। লোকপুরাণ, লোকজ উপাদান যেমন প্রবাদ-প্রবচন, লোকবিশ্বাস, সংস্কার-কুসংস্কার ইত্যাদি আমাদের জীবনের প্রতিটি ভাঁজে লেগে আছে। ভারতীয় মিথ ও গ্রেকো-রোমান-আসিরীয়, সেমেটিক মিথ আমাদের শিক্ষা রুচির ভেতর দিয়ে উঠে আসে কবিতায়, সৃষ্টিশীলতার ধারায়। ভারতীয় মিথের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এলাকা আমাদের মনো-জগতের বাইরের উপকরণ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে ভারতীয় মিথ, যাকে আমরা হিন্দু পুরাণ বলেও জানি, যেহেতু হিন্দুদের ধর্মদর্শন ও ধর্মীয় কাহিনীগুলোরই বিন্যাস, তাই ওই মিথিক্যাল পরম্পরা এতদাঞ্চলের জনজীবনের অংশ, আমরা প্রায়শই প্রতিবেশের কারণে অটোমেটিক্যালি সে-সব জেনে যাই। সামাজিক জীবনে হিন্দু-মুসলিমের বসবাসের এলাকা এক, প্রতিবেশ বিশ্ব এক, পরিবেশ বিশ্ব এক এবং যাপিত জীবনাচারের ভাষিক ও মানসিক প্যাটার্নও এক হওয়ায়, ওই অটো-কায়দায় ভারতীয় লোক–মিথ কমবেশি জানা হয়ে যায় আমাদের। বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকায় ‘শিবজাল’ বলে মাছ ধরার একরকম জাল আছে। আবার সেই এলাকারই কিছু কিছু লোক শিবজালকে ‘ধর্মজাল’ হিসেবেও ডাকে বা চেনে। শিব যেহেতু হিন্দুদের দেবতা, তাই কেউ কেউ ওই জালের নাম পাল্টে ধর্মজাল রেখেছে। শিব আর ধর্ম তো সমার্থক অনেক হিন্দুর কাছে। দুটোই এক। কিন্তু ব্যবহারের কারণে তা নতুন কনোটেশন পেয়েছে। তো, সামাজিক জীবনের এই প্রেক্ষাপটে আমরা পাচ্ছি লোকপুরাণের উপাদান যা লোকসমাজের সম্পত্তি। এই সম্পদ সৃষ্টিশীল কবি-সাহিত্যিকরা ব্যবহার করেন তার সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান থেকে। আর কে না জানে, সংস্কৃতির কাজ অতীব সূক্ষ্ম। তার গতায়াত নিয়ন্ত্রণ কঠিন। সে মৌণতার ফোঁকড় গলিয়ে কবির চিন্তার ভেতরেই কেবল মাথা ঢোকায় না, পঙক্তির সজ্জায়ও তার কারুকাজ আঁকে। এ-কারণেই আমি বলেছি কবির মৌণতার ফাঁক গলিয়ে অবলীলায় ঢুকে পড়ে পুরাণ বাংলা কবিতার অন্তরমহলে, অন্দরমহলে।
শামসুর রাহমানের কবিতায় পুরাণের ব্যবহার আছে এক কথায় ব্যাপকভাবেই। প্রায় অধিকাংশ কবিতায় লোকপুরাণের উপাদান-উপকরণের ব্যবহার আমি দেখেছি। গ্রেকো-রোমান-আসিরীয়-সেমেটিক মিথের ব্যবহার মোটামুটি থাকলেও, আশ্চর্যজনক হলো তার কবিতায় ভারতীয় মিথের ব্যবহার অনেকটাই কম। কেন তিনি প্রতিবেশ বিশ্বের এক সহোদর মিথিক্যাল পরিপ্রেক্ষিতকে এড়িয়েছেন বা ব্যবহার করেননি, সেটা এ-রচনার লক্ষ্য নয়। তবে, আমি বিবেচনা করি, শামসুর রাহমান কেন ভারতীয় মিথের ব্যবহার এতো কম করেছেন, তার কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে। আর সেই অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে তার সামাজিক-মানসিক মনোভূমির প্রেক্ষাপটটি। একজন কবিকে চেনার জন্য এই তথ্য-উপাত্তের অন্তর্নিহিত কারণ অনেকটাই কাজে লাগে। আমি বলবো, কবির মানসভূম ও মননপটের অনুপুঙ্খ জানা গেলে তার কবিতার বিষয় ও বক্তব্যের ভেতরে নিহিত উদ্দেশ্য জানা যেতে পারে। কবিতা বিচারে-বিশ্লেষণে এর চেয়ে উপযোগী পথ আর কি হতে পারে?
‘রূপালি স্নান’ কবিতায় একটি মাত্র মিথিক্যাল চরিত্র বা ধর্মজাত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, সেটা ‘যেসাস’। খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে যেসাস ঈশ্বরপুত্র, আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিতপুরুষ বা নবী বা রাসুল। আর মুসলমানদের কাছে যেসাসের সেমেটিক নাম ইশা [আঃ] নবী। তার ওপর নাজিল হয়েছিলো ইঞ্জিলগ্রন্থটি। খ্রীষ্টান সম্প্রদায় যাকে বলে ওল্ড টেস্টামেন্ট বা বাইবেল। তো, এই মহাত্মার নামটিই কেবল শামসুর রাহমান ব্যবহার করেননি এ-কবিতায়, তার ক্ষমার বিশেষত্বটিও মেলে ধরেছেন এখানে। ‘সত্তাসূর্যে যেসাসের ক্ষমা মেখে নিয়ে শুধু গড়ি উজ্জ্বল কথার মিছিল’। এই বাক্যে শামসুর রাহমান যেসাসের ক্ষমা মেখে নিয়ে যে কথার মিছিল গড়ে তোলার কথা বলেছেন, তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছেন বিশেষণের মাধ্যমে। সেই বিশেষণ হচ্ছে ‘উজ্জ্বল’। আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে জন্মগ্রহণকারী হযরত ইশার [আঃ] মানুষের ধর্ম-চিন্তা-ভাবনা আর আদর্শ-নৈতিকতা তৎকালের আরবের সামাজিক জীবনকে যে সত্য আর সুন্দরের পথ দেখিয়েছিলো, ক্ষমার যে পথ তিনি প্রদর্শন ও প্রশস্ত করেছিলেন, তারই উত্তরসাধক, ৫৭০ বছর পর পৃথিবীতে এসেছিলেন সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ [সাঃ], ক্ষমার সুবিস্তারিত পরিমন্ডল ও মানবতার সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। যেসাসের ক্ষমা তার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে পারলৌকিক জীবনে প্রত্যাগমন করেছে। আর মানব জাতির নবী মুহম্মদ [সাঃ] সংঘাতময় আরবের সামাজিক পরিস্থিতিকে কেবল নিয়ন্ত্রণই করেননি, তিনি তাদের মনে ও বিশ্বাসে রোপন করেছেন রহস্যময় জগতের সৃষ্টিকর্তার এক অনন্য নিরাকারের ছবিও। এ-ভাবে এই দু’জন মহাত্মা বাস্তব পৃথিবীর ক্ষণজীবী মানব সন্তান থেকে দীর্ঘজীবী মানবিক মানুষে বা অতি-মানবে পরিণত হয়েছেন। এরই ফলে এ-দু’জন মানব থেকে মিথিক্যাল চরিত্রের সেরা আকর হয়ে উঠেছেন।
‘পরী’কে আমরা মিথ চরিত্র বলবো না-কি লোকগল্পের নায়িকা হিসেবে ধরবো? মানবাকৃতি নারী এই চরিত্রটিকে মুসলমানেরা মনে করে আল্লাহর অন্যতম সৃষ্টি। জিন ও পরী আগুনের তৈরি। এরা বর্তমান। লোকগল্পেও আমরা পাই জিন-পরীদের ব্যাপক উপস্থিতি। যে-কোনো অসম্ভব কাজ তারা সম্পন্ন করে নিমেষেই। জিন-পরীরা অলৌকিক, আগুনের উপাদানে সৃষ্ট বলে এরা মানুষের চেয়ে ক্ষিপ্রগতির ও ক্ষমতাশালী। আমি নিজেও আমার বহু কবিতায় পরীদের ব্যবহার করেছি। শামসুর রাহমানের কবিতায় সেই অলৌকিক পরী নানামাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে। ‘তার শয্যার পাশে’ কবিতায় লিখেছেন তিনি ‘ দেয়ালে আলোর পরী’। এখানে পরী হচ্ছে পড়ন্ত বিকেলবেলার সোনালু রোদ। কবির মনে হচ্ছে ওই কোমল রোদ পরীর মতো রুপসী ও রহস্যময়। পরী যে রহস্যময়ী অলৌকিক নারী, এই চেতনা থেকেই কবি এই মিথিক তুলনাটি নির্মাণ করেছেন। এ-কবিতায় আছে ‘অপদেবতা’ শব্দটি। এটিও লৌকিক শব্দ। লোকসমাজ অপদেবতা, ভূত-প্রেত ইত্যাদিতে বিশ্বাস করে। ফলে এরা মিথ চরিত্রের মধ্যে পড়লেও এদেরকে পন্ডিতেরা লোকপুরাণের আওতায় ফেলেছেন। যদিও আমার ধারণা মিথ-লোকপুরাণ সবই লৌকিক সমাজসৃষ্ট। অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতিজাত। শামসুর রাহমান লিখেছেন ‘ছায়াচ্ছন্ন অপদেবতার অমর্ত্য চোখের নিচে রাত’। রাতকে বিশেষায়িত করেছেন অমর্ত্য অপদেবতার সাংস্কৃতিক চরিত্রের প্রেক্ষণ থেকে। এটিও লোক বিশ্বাসের অন্তর্গত। প্রকৃতপ্রস্তাবে, শামসুর রাহমানের কবিতায় গ্রেকো-রোমান-মিথের ব্যবহারের প্রথম কাজটি ‘ টেলেমেকাস’ কবিতায়। গ্রীক মিথের অন্যতম চরিত্র অডিসিউসের পুত্র টেলেমেকাস। অডিসিউস ইথাকার রাজা। ট্রয়যুদ্ধে তার পরিকল্পনার জন্য গ্রীকরা দশ বছর ধরে যুদ্ধ করার পর বিজয়ী হতে পেরেছে। যুদ্ধশেষে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় সমুদ্রদেবতা পোসাইডনের কোপে পড়ে পথভ্রষ্ট হন অডিসিউস এবং কুহিকিনী শার্শিকে বিয়ে করে সেখানে বসবাস করতে বাধ্য হন। শিশুপুত্র টেলেমেকাস পিতার প্রত্যাবর্তন নিয়ে দুর্ভাবনাতাড়িত। সেই কাহিনীই এ-কবিতার উপজীব্য। হোমার তার অডিসি মহাকাব্যে টেলেমেকাসকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। এ-কবিতা ছাড়াও ডেডেলাস, ইকারুসের আকাশ, ইলেক্ট্রার গান, একিলিসের গোঁড়ালি, হোমারের স্বপ্নময় হাত– এ-সব কবিতাকেই গ্রেকো-রোমান মিথের নামবাচক বলে চিহিৃত করা যায়। এ-ছাড়া আরও কিছু কবিতায় মিথের ব্যবহার আছে, কিন্তু এতোটা উত্তুঙ্গ নয়। কয়েকটি স্তবক উদ্ধৃত করে শামসুর রাহমানের মিথপ্রীতির উল্লেখ করা যাক।
তুমি নেই তাই বর্বরের দল করেছে দখল
বাসগৃহ আমাদের। কেউ পদাঘাত করে, কেউ
নিমিষে হটিয়ে দেয় কনুই-এর গুঁতোয় আবার
‘দুধ খাওগে হে খুকুমণি’ বলে কেউ তালেবর
দাড়িতে বুলোয় হাত। পিপে পিপে মদ শেষ, কতো
ঝলসানো মেষ আর শুয়োর কাবার, প্রতিদিন
ভাঁড়ারে পড়ছে টান। থমথমে আকাশের মতো
সমস্ত ইথাকা, গরগরে জনগণ প্রতিষ্ঠিত
অনাচার, অজাচার ইত্যাদির চায় প্রতিকার।
[টেলেমেকাস/ নিরালোকে দিব্যরথ]
রাজাশূন্য রাজ্যের কি অবস্থা হতে পারে, টেলেমেকাসের বর্ণনায় সেই সত্যই উঠে এসেছে। অডিসিউস দেশে না থাকায় ইথাকা এখন প্রতিবেশি রাজাদের দ্বারা নানা ভাবে আক্রান্ত। স্থানীয় জোতদাররা নানা কৌশলে লুটে নিয়ে যাচ্ছে সব কিছু। ভাঁড়ারের খাদ্যও শেষ হবার পথে। সেই সাথে টেলেমেকাসের সতী-সাধ্বী মা পেনেলোপীকে উত্যক্ত করছে প্রাণীপ্রার্থীর দল। কিন্তু পেনেলোপী প্রোষিতভর্তৃকা নারী। তিনি স্বামীর আগমনের প্রতীক্ষায় কাতর।
এই মিথিক কাহিনী কেন কবিতায় আনলেন শামসুর রাহমান, সেই সংগুপ্ত অভীপ্সা জানা জরুরি। ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ কাব্যগ্রন্থটির রচনাকাল পাকিস্তানি শাসনামলের শেষ দিকে। দেশে চলছে নৈরাজ্যকর সামাজিক ও রাজনৈতিক হানাহানি। জনগণ এই সব অনাচার অজাচারের প্রতিকার চায়, কিন্তু তা না পেয়ে তারা হতাশ। কিশোর টেলেমেকাসের জবানিতে ফুটে উঠেছে সেই সময়কার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি—-
‘ভাবি লম্পট-জোচ্চোর আর ঘাতকের বীভৎস তান্ডব/ কবে হবে শেষ? সূর্যগ্রহণের প্রহর কাটবে/ কবে? জননীর মতো চোখ রাখি সমুদ্রে সর্বদা।’
এ-প্রতিবেশ তো গত শতকের ষাটের শেষ দিককার বাংলাদেশের প্রতিবেশের রাজনৈতিক অভিঘাত! থেকেই নির্মিত হয়েছে।
‘নো এক্সিট’ কবিতার কয়েক পঙক্তিতে পাওয়া গেলো গ্রেকো-রোমান মিথের পরোক্ষ ব্যবহার। ‘এতদিনে জেনে গেছি / আমার কর্কশ অভিশাপে / কোনো নারী গাছ কিংবা প্রতিধ্বনি হবে না কখনো,’– এই পঙক্তিটিতে শামসুর রাহমান দুটি গ্রেকো মিথের সমীকরণের সাহায্যে নিজের মনোবাসনার বর্ণনা করেছেন। সাইপ্রাসের রাজা সাইনিরাসের কন্যা মিরা নিজের রূপের অহংকারে দেবী আফ্রোদিতিকে অসম্মান করলে দেবীর অভিশাপে সে মিরবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়। শামসুর রাহমান এই মিথিক পারম্পর্যের সাথে ইকোর পরিণতিকেও মিশিয়েছেন দুর্ভাগ্যের নমুনা হিসেবে। স্বর্গদেবতা জিউসের স্ত্রী দেবী হেরার অভিশাপে পর্বত পরী ইকো তার বাকশক্তি হারায়।
‘ইকারুসের আকাশ’ কবিতায় শামসুর রাহমান এক তরুণের স্বাধীনতার ইচ্ছা-স্বপ্নকেই রূপায়িত করেছেন, যা গ্রেকো মিথের ইকারুসের ছিলো। যে কোনো তরুণ চায় বাবা-মায়ের শাসন আর নিয়ন্ত্রণের শেকল ছিঁড়ে ‘স্বাধীন’ হতে। ইকারুসও চেয়েছিলো। তবে তার প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিলো। গ্রীক পুরাণের বিখ্যাত কারিগর ডীডেলাসের অন্যায় কর্মের শাস্তিস্বরূপ ক্রীটরাজ মাইনস তাকে ও তার পুত্র ইকারুসকে বন্দী করে রাখেন লিবিরিন্থ নামক এক গোলক ধাঁধার ফাঁদের মধ্যে। ডীডেলাস তার উদ্ভাবনী প্রতিভাবলে নিজের ও পুত্রের জন্য পাখির পালক দিয়ে দু’জোড়া পাখা তৈরি করেন, যাতে লেবিরিন্থ থেকে উড়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অন্য রাজ্যে যাওয়া যায়। মোম দিয়ে তৈরি বলে ডীডেলাস ইকারসকে সতর্ক করেন এই বলে যে বেশি উপর দিয়ে যেন সে না ওড়ে। আবার বেশি নিচ দিয়েও যেন সে না ওড়ে। কারণ তাতে তার পাখার মোম সূর্যের তাপে কিংবা সমুদ্র তরঙ্গের ঝাপটার পানিতে গলে যেতে পারে। পিতার ওই সতর্কবানী তরুণ ইকারুস রক্ষা করেননি। আকাশে ওড়ার আনন্দ তাকে এতোটাই মুগ্ধ করে যে তিনি অনেক উপর দিয়েই উড়ে যাওয়ার আনন্দবোধ করেছিলেন। আর সেই অপরিণামদর্শিতাই তার মৃত্যুর কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইকারুসের সেই ইচ্ছা-স্বপ্ন বাস্তবায়নের অপ্রতিরোধ্য উচ্চাভিলাষের ছবিই শামসুর রাহমান সৃষ্টি করেছেন এ-কবিতায়।
‘তাই কামোদ্দীপ্তা যুবতীর মতো / প্রবল অপ্রতিরোধ্য আমার উচ্চাভিলাষ আমাকে অনেক / উঁচুতে মেঘের স্তরে স্তরে / রৌদ্রের সমুদ্রে নিয়ে গেলো।…অর্জন করেছি আমি অকাল লুপ্তির বিনিময়ে / সবার কীর্তনযোগ্য গাঁথা, / যেহেতু স্বেচ্ছায় / করেছি অমোঘ নির্বাচন / ব্যাপ্ত জ্বলজ্বলে, ক্ষমাহীন, রুদ্র নিজস্ব আকাশ।’
[ ইকারুসের আকাশ]
ইকারুসের এই স্বনির্বাচিত আত্মহননের কারণ তার জবানিতেই মেলে। ঈগলের মতো আকাশে উড়ার দুর্নিবার সাধ আর উপরে উঠার উচ্চাভিলাষই ইকারুসের এই অকালে ঝরে পড়ার পরিণতি। এ-জন্য উচ্চাভিলাষ ভালো নয়। অভিলাষ থাকা ভালো, যা বাস্তব আর সাধনযোগ্য, পাখির মতো উড়ার শখ, পাখির পালকের ডানা দিয়ে, তা আত্মহননেরই সামিল।
‘ইলেকট্রার গান’ গ্রেকো-মিথের এক এরিনিজ চরিত্র। এরিনিজরা পিতামাতার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের এই চরিত্রে উপনীত করেছে। ইলেকট্রা এই এরিনিজ চরিত্রে নিজেকে রূপায়িত করে নেয় পিতৃহন্তার কারণে। ইলেকট্রার পিতা ট্রয়যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আগামেমনন স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর পরই স্ত্রী ক্লাইটেমনেস্ট্রা ও চাচাতো ভাই এজিস্থাসের হাতে নিহত হন। পিতৃহন্তার প্রতিশোধ নেবার জন্য ইলেক্ট্রা তার ছোটো ভাই ওরেস্টসকে উত্তেজিত করে মা ক্লাইটেমনেস্ট্রা ও এজিস্থাসকে হত্যা করার জন্য। এ-কাজে ওরেস্টস সফল হয়। মাকে হত্যার অপরাধে এরিনিজ কন্যাত্রয় ওরেস্টসকে ধরার জন্য ধাওয়া করে। শেষে ওরেস্টস দেবী আর্টেমিসের পরামর্শে এরিনিজদের নামে একটি মন্দির নির্মাণ করে নিজেকে রক্ষা করেন। মন্দিরের নাম রাখা হয় ইউমেনিডিস বা দয়ার দেবী।
নন্দিত সেই নায়ক অমোঘ নিয়তির টানে
গরীয়ান এক প্রাসাদের মতো বিপুল গেলেন ধসে।
বিদেশি মাটিতে ঝরেনি রক্ত ; নিজ বাসভূমে,
নিজ বাসগৃহে নিরস্ত্র তাঁকে সহসা হেনেছে ওরা।
নিহত জনক, এ্যাগামেমনন, কবরে শায়িত আজ।
[ ইলেক্ট্রার গান / ইকারুসের আকাশ]
উদ্ধৃত পঙক্তিগুলো পড়লেই বোঝা যায় শামসুর রাহমান কি কথা বলতে চাইছেন। ট্রয় যুদ্ধ জয়ের মহানায়ক আগামেমনন নিজ বাসগ্রহে স্ত্রী ও এজিস্থাসের হাতে নিহত হলেন। তার আপন লোকেরাই তাতে হত্যা করলো। এই গ্রেকো-কাহিনী যেন অবিকৃতভাবে ফলেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জীবনে। তিনি নিহত হয়েছেন তারই রাজনৈতিক সহকর্মী, বন্ধুদের হাতে, সপরিবারে-প্রায়। কেবলমাত্র দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও রেহানা বাদে তার বংশ নিশ্চিহ্ন করেছে ঘাতকেরা। শামসুর রাহমানের এ-কবিতার আবহ বা পটভূমি বাংলাদেশের। আর শেখ হাসিনা হচ্ছেন সেই ইলেকট্রা, যিনি পিতৃহন্তারকদের বিরুদ্ধে নিয়োজিত। তিনি রাজনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে [ ইলেকট্রা করেছিলেন ছোটো ভাই ওরেস্টসকে ] হত্যাকারীদের বিচারের সম্মুখীন করেছেন এবং তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে প্রতিশোধ তুলেছেন। মানতেই হবে, বঙ্গবন্ধু হত্যার শোধ পুরোপুরিই তুলেছেন তিনি। এবং তা যথার্থই করেছেন। মা ক্লাইটেমনেস্ট্রাকে হত্যার অপরাধে এরিনিজ কন্যারা ওরেস্টসের পিছু নিয়েছিলো, শেখ হাসিনার কিন্তু সেই দায় এখানে নেই। শামসুর রাহমানও সেই কাহিনীর রাজপথ ধরে হাঁটেননি। জাতির কাঁধে যে অপরাধের চাপটি ছিলো, আজ তা নেমে গেছে।
‘ডেডেলাস’ কবিতাটি মূলত ইকারুসকে হারানোর পর পিতার আত্মবিলাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আবার তিনি গর্বিত ছেলে ইকারুসের উচ্চাভিলাষে, স্বাধীনতার চেতনায়।
কিন্তু সে তরুণ, চটপটে,ঝকঝকে, ব্যগ্র, অস্থির, উজ্জ্বল,
যখন মেললো পাখা আমার শিল্পের ভরসায়,
গেলো উড়ে উর্ধ্বে, আরও উর্ধ্বে, বহুদূরে,
সূর্যের অনেক কাছে, প্রকৃত শিল্পীর মতো সব
বাধা, সতর্কতা
নিমেষে পেছনে ফেলে, আমি
শঙ্কিত অথচ মুগ্ধ রইলাম চেয়ে
তার দিকে, দেখলাম তাকে
পরিণাম বিষয়ে কেমন
উদাসীন, ক্রুর, রৌদ্রঝলসিত, সাহসী, স্বাধীন।
[ডেডেলাস/ ইকারুসের আকাশ]
শামসুর রাহমান নিজেও উচ্চাভিলাষী ছিলেন। আমার ধারণা প্রত্যেক নির্মাতাই উচ্চাভিলাষী, তবে সবসময় সতর্ক তার রচনা ও সৃজন নিয়ে। ইকারুসের আকাশ নামটি যেমন সেই উচ্চাভিলাষকে আমাদের মগজে ঠাঁই দেয়, তেমনি ডেডেলাস, সেই উচ্চাভিলাষকে নিশ্চিত করে যে শামসুর রাহমানের চিন্তার বড় অংশ জুড়েও ছিলো স্বাধীন-সত্তার উচ্চাভিলাষ, ছিলেন তিনি ‘স্বাধীনতার’ অপার রহস্যময় প্রাকৃত সত্তার অধিকারী।
আরও বহু কবিতায়ই গ্রেকো-রোমান মিথের মিশ্রণ আমরা শামসুর রাহমানের কবিতায় পাবো, তবে, যে উদ্যম আর লক্ষ্য নিয়ে তিনি
এ-গুলো সৃষ্টি করেছেন, তার মূল্যায়ন অবশ্যই করা উচিৎ।