spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যজহির রায়হানের ছোটগল্প প্রসঙ্গে 

লিখেছেন : নোমান প্রধান

জহির রায়হানের ছোটগল্প প্রসঙ্গে 

নোমান প্রধান

জহির রায়হানের ছোটগল্প নিয়ে আলোচনার শুরুতেই একটা কথা বলা উচিত বলে মনে করছি। কথাটা হলো–‘শুধু মাত্র সাহিত্যবোধ বা পুঁথিগত সাহিত্যজ্ঞান দিয়ে জহির রায়হানের লেখা গল্পগুলোর স্বাদ আস্বাদন সম্ভব নয়, প্রয়োজন গণমানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে ন্যূনতম বাস্তব অভিজ্ঞতা’। জহির রায়হান তাঁর গল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন মানুষের অধিকার, সচেতনা ও সংস্কারের বয়ানে। তাঁর দৃষ্টিতে যে সকল বিষয়কে কুপ্রথা বলে মনে করেছেন সেই সকল বিষয়াদিকে তিনি আঘাত করেছেন সাহিত্যের ভাষায়, নির্দ্বিধায়। অনেক গল্পকারের সাথে তাঁর পার্থক্য ও স্বতন্ত্রতার চিহ্নও রেখেছেন গণকন্ঠ হতে চেয়ে। তাঁর ছোট গল্পগুলো যেমন মেদমুক্ত, তেমনি সাবলীল। যতটা সাবলীল তাঁর ভাষা চয়ন ততটাই প্রবল যেন অন্তর্নিহীত উপলব্ধি।

জহির রায়হানের লেখা ছোটগল্প গুলো যেখানে শেষ হয়েছে সেখানেই জন্ম দিয়েছে প্রশ্নের। সেই প্রশ্ন পাঠকের বিবেকের কাছে। দেশ, মানুষের অধিকারের দাবী, সংগ্রাম, কুপ্রথা, ধর্মান্ধতা, ঐক্য, লড়াই ও বদলে যাওয়া নতুন দিনের আশাই তার গল্পগুলোর অন্যতম উপাদান। মানব-মানবীর প্রেম এসেছে প্রাসঙ্গিক হয়ে, মূলভাব হয়ে নয়। প্রকৃতি-পরিবেশ সম্পর্কে বিস্তর বিবৃতি নেই, আছে প্রয়োজনীয় সংকেত। উদাহরণ হিসেবে আনা যায় নয়াপত্তন গল্পের একটি অংশ। সময় ও পরিবেশ বুঝাতে গল্পকার লিখেছেন – “দুপুরের তপ্ত রোদে তখন খাঁ খাঁ করছিলো মাঠ ঘাট, প্রান্তর। দূরে খাসাড়ের মাঠে গরু চড়াতে গিয়ে বসে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলো কোন রাখাল ছেলে। বাতাসে বেগ ছিলো না। আকাশটা মেঘশুন্য।” তারপরের গল্প চলে গেছে প্রয়োজনীয় সংলাপে। অনেক গল্পে অবশ্য এতটুকু ন্যূনতম বিবরণ দেয়ারও প্রয়োজন বোধ করেন নি। গল্পের চরিত্রগুলোর মানসিক অবস্থা, সংলাপ ও কাহিনীর গতি নির্ভর করেই গল্পের আদি—অন্ত। গল্পের গতি স্বাভাবিক। চটুল, হাস্যরসাত্মক বাক্যের ব্যবহার নগন্য। তার গল্পে জীবন যেন খাঁ খাঁ রোদে করে পুড়ছে, শুধু অপেক্ষা বর্ষনের।

জহির রায়হানের গল্পের চরিত্রগুলো আজো সুপরিচিত। চেনা। আপন। হাত বাড়ালেই ধরা যাবে গ্রামে, গঞ্জে, নগরে। ঘরে ও বাহিরে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রতিদিন। দেনার ধারে ন্যুজ্ব মজুর-কৃষক, মধ্যবিত্ত কেরানী, পিয়ন, আয়া-বুয়া, গায়ে মাটি মাখা শিশু, মলিন পোষাকে ঢাকা কিশোরী, ত্যাগী স্কুল মাস্টার, তেঁতে থাকা ছাত্র, বাল্যবধু, কলুর বলদের মত খাটতে থাকা পিতা, স্বর্বস্ব বিলিয়ে দেয়া মা; এরা আছে একদিকে। গল্পগুলো তাদের জীবনের। অন্যদিকে আছে পুলিশ, মিলিটারী, পীর, সরকারী আমলা, জমিদার, জোতদার, অন্ধ মুরিদ, ধর্ম ব্যাবসায়ী সহ সমাজের উপর মহলের লোকজন। গল্পে তারা শোষক হয়ে আসে বারবার। তারা বদলায় নিজের স্বার্থে। মানুষের সাথে মানুষের দ্বন্দ যে মূলত স্বার্থান্বেষী মহলের সাথে সাধারণ জনতার, সেই দৃশ্য স্পষ্ট হয় জহির রায়হানের ছোটগল্পের চরিত্রগুলোকে দেখলে।

সংলাপ খুব বেশী স্বাভাবিক। সাদাসিদে। প্রয়োজনে উচ্চারিত। অপ্রয়োজনে নীরবতা। আঞ্চলিক শব্দ ও কথ্যরীতিতেই গাঁথা অধিকাংশ সংলাপ। গল্পকারের হৃদয়ের কথাই যেন বলে তার গল্পের চরিত্ররা। তবে কখনো ভাবনা বিশদ। স্মৃতি রোমন্থন, আহ্লাদ, মানসিক চাপ, উৎকন্ঠা, ভীতি, আত্মপ্রসাদ, বর্তমান অভিব্যাক্তি সহ অনেক কিছু এক সাথে চলে এসেছে চরিত্রের ভাবনায়। হারানো বলয়, সূর্যগ্রহণ গল্পগুলোতে সংলাপ সংক্ষেপ কিন্তু চরিত্রদের ভাবনা বিশদ। আবার জিজ্ঞাসা, নয়াপত্তন গল্পগুলোতে সংলাপে সংলাপে ভর দিয়ে এগিয়েছে গল্প। আবার একই সাথে সংলাপ, দৃশ্যপট ও ভাবনা নির্ভর গল্পও আছে। ‘অতি পরিচিত’ নামক গল্পে শুরুটা এমন, “অসংখ্য বই-পুস্তকে সাজানো ট্রলির বাবার লাইব্রেরী। দেখে অবাক হল আসলাম। সত্যি, বাসায় এতবড় একখান লাইব্রেরী আছে, ট্রলি তো ভুলেও কোনদিন বলেনি তাকে। একটু হাসলেন ট্রলির বাবা। বললেন, দৈনিক কমপক্ষে ঘন্টা আটেক কাটে আমার। রীতিমত একটা নেশা হয়ে গেছে। কেবল পড়া পড়া আর পড়া। জীবনটাই বই পড়েই কাটালাম”।

এই গল্পের মাঝখানে, “ট্রলির বাবার পুরনো চাকরের সাথে আলাপ হলো বৈঠকখানায়। বুড়োকে দেখে কেন যেন জর্জ বর্নার্ড শ’র কথা মনে পড়ে গেল আসলামের। সুদূর বিলেতের মৃত বর্নাড শ’র সাথে অদূর রমনার বুড়ো ভৃত্যের আকৃতির সামঞ্জস্য সত্যি বড় অদ্ভুত ব্যাপার। কৌতুহলবশেই হয়তো জিজ্ঞেস করে আসলাম, কতদিন আছ এখানে?

তা সাহেব অনেক দিন। বুড়ো হেসে বললো, তা এই যুদ্ধের আমল থেকে।

বল কিহে। সেতো বছর দশেকেরও বেশী।

হ্যাঁ সাহেব। বছর দশেকের মতই প্রায়। বুড়ো বলল, তখন কিন্তু এদের অবস্থা অত ভালো ছিলো না। কলকাতায় সার্কুলার রোডের উপর রেশনের দোকান ছিলো একটা। গলাটাকে একটু খাঁকড়ে নিলো বুড়ো। এখন যা দেখলেন–এসব তো পাকিস্তান হবার পরেই–।”

একই গল্পের শেষাংশে, “কে, আসলাম? ট্রলির বাবার চমকে উঠা কন্ঠস্বরে বই থেকে মুখ তোলে তাকালো সে।

কখন এলে তুমি? উচ্ছসিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন ট্রলির বাবা।

এইতো মিনিট পনের আগে। ধরা গলায় উত্তর দিলো আসলাম।

কী পড়ছ ওটা? আরো কাছে এগিয়ে এলেন তিনি। তারপর বইটার উপর ঝুকে পড়ে বললেন, ও গীটাঞ্জলী? এ নাইস, নাইস বুক। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন দেশের ভাবী শিক্ষাকর্তা, ট্রলির বাবা। বললেন, গীটাঞ্জলী, ওহ! চমৎকার বই! মিলটনের একখানা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।” গল্পের বক্তব্য বইয়ানে চরিত্রকে নগ্ন ভাবে প্রদর্শন করেছেন জহির রায়হান, শৈল্পিক পন্থায়। চিত্রনাট্য লেখায় একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘সংলাপই চরিত্র’। জহির রায়হানের ছোটগল্প গুলোতে সংলাপই চরিত্র হয়ে উঠেছে বারবার।

জহির রায়হানের ছোটগল্পের একটি বিষয় প্রবল ভাবে ধরা দেয়, পাকিস্তান আমল। সময়টা জহির রায়হানের, সেই অর্থে জহির রায়হানের সময়টাই প্রবল ভাবে ধরা দেয় তার গল্পে। দুঃশাসনের কথা, অরাজকতার কথা, স্বজনপ্রীতির কথা এবং মানুশষের মুক্তির দাবী তিনি তার কর্মে উচ্চারণ করেছেন অকপটে, নির্ভয়ে। শাসকের খড়গের ভয় করে তিনি কলাকৈল্যবাদে আটকে থাকেন নি বরং নিজের আদর্শ ও বোধকে নিয়ে এসেছেন সাহিত্যের মাঝেও। শিল্পের জন্য শিল্প তিনি যতটা করেছেন, তারচেয়েও বেশী করে শিল্পকে করেছেন তিনি হাতিয়ার।

জহির রায়হান

ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার মজুপুর গ্রামে, মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ও সৈয়দা সুফিয়া খাতুনের ঘর আলো করে পৃথিবীতে আসেন জহিরুল্লাহ। অনেক পরে নিজের নামের সাথে রায়হান যোগ করে তিনি জহির রায়হান নামে খ্যাত হন। দিনটি ছিলো, ১৯৩৫ সালের ১৯শে আগস্ট। জহির রায়হানের পিতা ছিলেন কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক যিনি পরবর্তীতে ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগে, কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউটে ও আলীয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেন জহির রায়হান। দেশ ভাগের পর স্বপরিবারে নিজ গ্রামে চলে আসেন। ১৯৫০ সালে আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করে ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হন। আই এস সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন তিনি। জুন মাসে দ্বিতীয় দফা গ্রেফতার হয়ে তিনমাস কারাভোগ করেন।

১৯৫০ সালেই তনি কর্ম জীবনের প্রবেশ করেন। যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু। পরে খাপছাড়া, যান্ত্রি, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকায় কাজ করেছেন। ১৯৫২ সালে, ভাষা আন্দোলনের জড়িত থাকার কারণে কারাভোগ করে বের হন। কারামুক্ত হয়ে তিনি চলে যান কলকাতায়, ভর্তি হন প্রমথেশ বড়ুয়া মেমরিয়াল ইনস্টিটিউট অফ সিনেমাটোগ্রাফি’তে। অর্থাভাবে ফিরেও আসেন ছয় মাস পর। ১৯৫৬ সালে সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন প্রবাহ পত্রিকায়। এরপরে সিনেমায় হাতেখড়ি। ১৯৫৭-৫৯ মেয়াদে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘সংস্কৃতি সংসদে’র সভাপতি ছিলেন তিনি। জাগো হুয়া সাভেরা নামক সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু। বাংলা সিনেমা অঙ্গন পেয়ে যায় বৈপ্লবিক এক সিনেমা নির্মাতাকে। সাল ১৯৬১, ‘কখনো আসেনি’ চলচিত্রের মাধ্যমে অভিষেক ঘটে পরিচালক জহির রায়হানের। পাকিস্তানের প্রথম রঙিন সিনেমা, ‘সঙ্গম’ নির্মান করেন ১৯৬৪ সালে। সিনেমাটি নির্মিত হয় উর্দু ভাষায়। পরিচালক হিসেবে তিনি নির্মাণ করেছেন কুড়িটির বেশী সিনেমা। উল্লেখ্যযোগ্য – কখনো আসেনি (১৯৬১), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), সঙ্গম (১৯৬৪), আনোয়ারা (১৯৬৭), জুলেখা (১৯৬৮), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) সহ আরো বেশ কিছু সিনেমা তিনি নির্মান করেছেন।

৩০ জানুয়ারী ১৯৭২। বাঙালীর জীবনের, হারানোর কান্না নিয়ে এসেছিলো দিনটি। সেদিন সকালে জহির রায়হান সংবাদ পান যে তার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার সহ অনেককে বিহারিরা আটকে রেখেছে, মিরপুর ১২ নম্বরে। সেনা ও পুলিশ বহরের সাথে তিনি ঘটনাস্থলে চলে যান। বিহারিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হলে কালাপানি পানির টাঙ্কিরসামনে বিহারিরা সেনা ও পুলিশের দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। জানা যায়, সেখানেই গুলিবিদ্ধ হন বাংলার সূর্য সন্তান জহির রায়হান।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ