spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যস্মৃতিতে ও সান্নিধ্যে : মনজুরে মওলা

লিখেছেন : আহমাদ মাযহার

স্মৃতিতে ও সান্নিধ্যে : মনজুরে মওলা

আহমাদ মাযহার 

নানা রকম স্বাস্থ্যগত দুঃসহতাকে বহন করেও কিভাবে সৃষ্টিশীলতার হাসি হাসা যায় কবি-প্রাবন্ধিক মনজুরে মওলা তাঁর অন্যতম দৃষ্টান্ত। কোভিড উনিশ তাঁর শরীরে হানা না দিলে হয়তো জরাকে বহন করেও আরো কিছুকাল সক্রিয়তার দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে রাখতে পারতেন তিনি! স্বাধীনতার অব্যবহিত-উত্তর কালে  বাংলাদেশের ব্যক্তি উদ্যোগের জাতীয় পুস্তক-প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারার বিজ্ঞাপনে তাঁর রচিত ‘নিমগ্ন কি করে পারো’ কবিতা-সংকলনের সূত্রে মনজুরে মওলার নাম কবি হিসেবে সাহিত্য মহলে প্রচারিত হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় বিষয়। চারণ কবির মতো অনর্গল বলে যেতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে! এমনকি কবিতায় ‘নিজেই তো গোরা তুমি’ সম্বোধনে তাঁর সুপরিচিত আত্মঘোষণার কথাও অবিদিত নয়! কিন্তু তিনি প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন আমলাতন্ত্রের প্রতিনিধি হয়েও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হওয়ার পর। সামরিক শাসনামলে মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও, এবং তাঁর কোন কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তিনি ব্যতিক্রমী কিছু কাজের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। এমনকি বাংলা একাডেমির বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করা মহাপরিচালকদের মধ্যেও তাঁকে বিশিষ্ট মনে করেন অনেকে! করোনা মহামারিকালে হারাতে হলো মনজুরে মওলাকে; এ এক গভীর অবহনীয় বিয়োগব্যথা, সময়ের অনিরাময়যোগ্য ক্ষত।

কবি হিসেবে তিনি ষাটীয় প্রধানদের সগোত্র! কবিখ্যাতিতে তিনি তাঁদের সমকক্ষ না হলেও তাঁর কবিকণ্ঠ ছিল প্রথম দিকে জীবনানন্দে আর্দ্র-দূষিত হয়েও স্বতন্ত্র! সরকারি আমলা হিসেবে শিখরস্পর্শিতা ও নানা ধরনের সাহিত্যিক কর্মতৎপরতা তাঁর কবিখ্যাতিকে কিছুটা ম্লান করলেও কবিতাপাঠকদের কাছে অপাঙ্‌ক্তেয় ছিলেন না! ঊন ছিলেন না কবিতার রচনাপ্রাচুর্যেও! তাঁর দ্বিতীয় কবিতা-সংকলন ‘মাটি হেরে যায়’ (১৯৮৩) বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নির্দেশনায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আশির দশকের প্রথম ভাগে একটা প্রকাশনা-অনুষ্ঠানের আয়োজনসূত্রে সংগঠক হিসেবে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। কাছাকাছি সময়েই তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান! সাহিত্য অঙ্গনের দাপুটে নিয়ন্ত্রক-পরিচালক হিসেবে তখনই তাঁর খ্যাতি ব্যপকতা পায়!  

তখন থেকেই সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর তৎপরতার ক্ষেত্রও হয় বিস্তৃত! আমরা মনজুরে মওলার নানাবিধ পরিচয় পেতে থাকি। তখন থেকেই বিচিত্র ধরনের গদ্যের তিনি রচয়িতা, কাব্যনাট্যের অনুবাদক ও মৌলিক নাট্যস্রষ্টা, রবীন্দ্র চর্চায় ভিন্ন মাত্রার উদ্ভাবক, ব্যতিক্রমী সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তরুণদেরও নৈকট্য লাভ করেন!

তিনি জীবনের শেষ দিনগুলোতে দীর্ঘমেয়াদী রোগশয্যায় থেকেও কর্মক্ষম ছিলেন; সক্রিয় রয়েছেন বিচিত্র বিষয় ও মাধ্যমের রচনায়। সাহিত্যসৃষ্টি, সম্পাদনা, গ্রন্থ-পরিকল্পনার নানা কাজে তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। পেশাজীবনে পালন করেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব। তবে সাধারণ ভাবে দেখতে গেলে হয়তো সব ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় তাঁর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পরিচয়টি। এতে এক দিকে হয়তো তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতি আছে তেমনি অন্য দিকে আছে তাঁর অন্যান্য সৃষ্টিকে যাচাই করে না দেখাও।

আশির দশকে এক মেয়াদে প্রায় তিন বছর তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি মহাপরিচালক থাকা কালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বইমেলাটিকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে বৃহত্তর রূপ নেয়। প্রশাসক হয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঐতিহাসিক বর্ধমান ভবন সংস্কার, প্রথম জাতীয় ফোকলোর কর্মশালা আয়োজন, আরজ আলী মাতুব্বর বা খোদা বক্স সাঁইয়ের মতো লোকমনীষাকে ফেলোশিপ প্রদান, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’, ‘ডেভিডসনের চিকিৎসাবিজ্ঞান’ কিংবা আনিসুজ্জামানের ‘পুরোনো বাংলা গদ্য’র মতো বই প্রকাশে উদ্যোগ নিয়ে তা সম্পন্ন করেছেন তিনি। বিশ্বভারতীর ‘বিশ্ব বিদ্যাসংগ্রহ’ গ্রন্থমালার আদলে বাংলা একাডেমিতে তাঁর পরিকল্পিত ও বাস্তবায়িত কীর্তি ‘ভাষাশহীদ গ্রন্থমালা’র ১০১টি বই। এমন অনেক বই এ সিরিজে প্রকাশিত হয়েছে, যা বিষয় হিসেবে বাংলাদেশে ছিল নতুন উপজীব্য। এমন অনেকে এ সিরিজে লিখেছেন, যাঁরা পরে সে বিষয়ে অর্জন করেছেন বিশেষ পরিচিতি; বিশেষজ্ঞ লেখক হিসেবে এই তালিকায় তাঁর নাম জ্বলজ্বলে হয়ে আছে বলে পরেও তাঁর পরিচিতি অর্জনে ভূমিকা রেখেছে।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হয়ে প্রশাসক হিসেবে তাঁর যোগ্যতাকে জনসমক্ষে চিনিয়ে দিয়েছিল। গবেষক হিসেবে তাঁকে একটু স্বতন্ত্র লাগে। সম্পাদক হিসেবেও চলেছেন নিজের পথে। কবি ও নাট্যকার হিসেবে মনজুরে মওলা লিখেছেন দুটো কাব্যনাট্য ‘আমি নই’  ও ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’; আর অনুবাদ করেছেন ইবসেনের নাটক ‘ব্র্যান্ড’ (২০০৫), এলিয়ট ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়! এলিয়ট অনুবাদের সঙ্গে হাজির করেছেন নিজস্ব টীকাভাষ্যও। এলিয়ট নিয়ে তাঁর বই কয়েকটি! লিখেছেন বিশ্লেষণী পুস্তক ‘এলিয়ট-এর সময়’ (২০১৯),  নাটক অনুবাদ করেছেন টি এস এলিয়টের ‘সুইনি ও দ্য রক’ (২০১৯) এবং ‘গির্জায় খুন’ (২০১৯)। রবীন্দ্র-বিষয়ে তাঁর আর এক কীর্তি তাঁর পরিকল্পিত ‘রবীন্দ্র সার্ধশত বর্ষ গ্রন্থমালা’। সম্পাদক হিসেবে তাঁরই পরিকল্পনায় রবীন্দ্রবিষয়ক ১৫১টি বই প্রকাশ। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘দশমী’ বইটিকে কেন্দ্র করে ‘নষ্ট নীড়’ (২০১০) নামেও ভিন্নধর্মী একটি বই লিখেছেন মনজুরে মওলা। সৈয়দ শামসুল হকের প্রায় সমকালেই তিনিও কাব্যনাট্য রচনা করেছেন। কিন্তু সৈয়দ হকের তুলনায় তাঁর নাটকের স্বভাব ভিন্ন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর কাব্যনাট্যর নাট্যরূপটি আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। কাব্য ও মনোজগতের অন্তর্গত নাট্যগুণে সে সময়কার টিভি নাটকগুলোর সাধারণ রুচির সঙ্গেও এটির ছিল বিরাট ব্যবধান! ‘আমি নই’ (২০০০), ‘জালিনওয়ালাবাগ’ (২০০৫) তাঁর দুটি কাব্যনাট্যই তাঁর স্বমুদ্রাচিহ্নিত কাজ।

আশির দশকে মনজুরে মওলা সম্পাদনা করতেন ‘শ্রাবণ’ (১৯৮৬-৮৭) নামের একটি ব্যতিক্রমী সাহিত্যপত্রিকা। এ ছাড়াও রয়েছে তাঁর সম্পাদিত দুটি কবিতা-সংকলন যথাক্রমে ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা (২০১৭) এবং ‘বাংলাদেশের কবিতা ১৯৪৭-২০১৭’ (২০১৮) যা তাঁর নিজের উৎকৃষ্ট কবিতারুচির চিহ্নবাহী। গোয়েন্দা-গল্পের ইতিহাস নিয়ে ‘পড়তে চাই গোয়েন্দা গল্প’ পরে নাম বদলে ‘গল্পর গোয়েন্দা’ (১৯৯৩) বই লিখেও পাঠকপ্রিয় হয়েছেন। লিখেছেন সাহিত্য সমালোচনার বই ‘গ্রহণ করেছো যত’ (২০১২), রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছেন ‘একজন কবি বিষয়ে’ (২০০৮), ‘অল্প একটু রবীন্দ্রনাথ’ (২০১১); রয়েছে আরেকটি প্রবন্ধ-সংকলন ‘সত্য যে কঠিন’ (২০১০) ।

‘জোরে শ্বাস নাও’ (২০২০) ছিল কবি মনজুরে মওলার শেষতম কাব্য। কোভিড উনিশ-আক্রান্ত সময়ের কথা আছে এ বইয়ে! কবিতার বইয়ের নামগুলো আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় খুব সাদামাঠা; কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে এর ব্যতিক্রমী স্বভাব বোঝা যাবে! সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের যাপন-জিজ্ঞাসার মধ্য থেকে জেগে ওঠে মনজুরে মওলার কবিতা! পুড়ে পুড়ে (১৯৮৫), শ্যাওলা ও ডিঙি (১৯৮৫), ‘এই দিন মিথ্যে‘ (১৯৮৬), ‘বন্দনা বৃষ্টির’ (২০০০), ‘না হয়’ (২০০৩), খা খা (২০০৪), ‘সুচিত্রা সেনের জন্য’ (২০০৫), ‘পেয়েছো কি’ (২০০৬), ‘তুমি’ (২০০৮), ‘হাউই’ (২০১৭), ‘তার একটু ঘুম প্রয়োজন’ (২০০৭), ‘বাঘ ও খুনী’ (২০১০), এখনও বিশ্বাস করি আমরা আপনাকে’ (২০১২), ‘সামান্য মানুষ আমি’ (২০১৬), ‘শিখিয়েছিলাম’ (২০১৭), ‘আকাশ যেমনই হোক’ (২০০৫), ‘অকবিতা-কবিতা’ (২০১৪), ‘ও দেয়াল সাদা’ (২০০৮), কী উত্তর দেবো’ (২০১২), ‘তুমি’ (২০১৫), ‘জয়তু বৈশাখ’ (২০১৬), ‘কী হবে রাগ করে’ (২০১৯), একবারটি ভাবো (২০১৮), ছোটদের ছড়া দিয়ে লেখা গল্প-সংকলনও আছে একটা ‘বাঘ ভূত বেড়াল ও মশা’ (২০১৯), ‘বাঘ কি তা জানে’ (২০১৪)–এই নামগুলোর মধ্য থেকেই তাঁর কবিতার অভিমুখ বোঝা যায়! আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, জীবনের শেষ কুড়ি বছর ধরে তিনি কবিতাও লিখেছেন প্রচুর, বলা যায় যৌবনের সংরাগের চেয়ে বার্ধক্যের প্রজ্ঞা প্রাণিত করেছে তাঁকে!

আমলা হিসেবে সরকারী দায়িত্ব থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি শুধু কবিতাই নয়, নিমগ্ন ছিলেন সাহিত্যের নানামুখী কাজের গভীরেও! এখন আমাদের চালানো দরকার তাঁর রচনাকর্মে তন্নিষ্ঠ তল্লাশী; তা থেকে যেমন মূল্যবান মণিমুক্তো আমরা পাবো তেমনি এর মধ্য দিয়েই জানানো হবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাও!

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ