spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যস্বতন্ত্র ধারার কবি সায়ীদ আবুবকর

লিখেছেন : আল মাহমুদ

স্বতন্ত্র ধারার কবি সায়ীদ আবুবকর

আল মাহমুদ

আমি সুযোগ পেলেই কবিতা নিয়ে লিখতে চাই। লিখতে চাই এমন সব কবিকে নিয়ে, যারা বয়সে অত্যন্ত তরুণ এবং থাকেন ঢাকা থেকে অনেক দূরে। ঢাকার সাহিত্যের আবহাওয়ায় যে নোংরামি ঈর্ষাকাতরতা কয়েক দশক ধরে প্রবেশ করেছে, এর অবসান হওয়ার আপাতত লক্ষণ দেখি না। অথচ মফস্বলে বসবাস করেন এমন কয়েকজন কবির ওপর আমার যে গভীর আস্থা জন্মেছে, তা প্রকাশ করার একটা দায়িত্ববোধ অনুভব করি। সায়ীদ আবুবকর তাঁর কবি-জীবনের প্রায় সবটাই কাটিয়েছেন মফস্বল শহরে। এক সময় তিনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ইংরেজির লেকচারার ছিলেন। এখন আছেন ঝিনাইদহের একটি কলেজে। তাঁর কবিতা স্পষ্টভাবে ঢাকার বহমান কাব্যস্রোত থেকে একটু আলাদা, একটু স্বতন্ত্র। এমন কিছু বিষয় তিনি কবিতায় উত্থাপন করেছেন, যা আমাকেও গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। মোট কথা, শুধু প্রেমের নিরক্ত কবিতা দিয়ে এই কবি বাহবা পেতে চাননি।

সায়ীদ আবুবকরের একটা দেশ আছে। দেশটির নাম বাংলাদেশ। এই কবি বাংলাদেশের প্রকৃতির ভেতর উত্তমরূপে বিচরণ করেছেন। যেহেতু তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন, সে কারণে তার দৃষ্টিভঙ্গিটি স্বভাবতই ইউরোপ অভিমুখী। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, সায়ীদ আবুবকর নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, জনারণ্যে প্রচলিত ভাষার মহিমায় আবর্তিত করতে পারেন। আমার একটা ধারণা হয়েছে যে, কিছু কবির কবিতাকে, যা আমাকে ভেতর থেকে পুলকিত করতে সক্ষম তার বিষয়ে আলোচনা কিংবা ইঙ্গিত দিয়ে যাবো। সায়ীদ আবুবকর আমার বিবেচনায় অতি সম্প্রতিকালের একজন খুবই উল্লেখযোগ্য কবিপ্রতিভা। তাঁর কবিতা খুব সহজে আমাদের পাঠক সমাজে গ্রাহ্য হবে, এটা আমি ভাবি না। কারণ তিনি নিজের ব্যাপারে খুবই অন্তর্মুখী স্বভাবে আবৃত। তবে কবিরা সব সময় অনুদঘাটিত থাকার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁদের কারুকাজ প্রকৃত পাঠকদের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠতে থাকে। এর জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। যেটা আমার ব্যাপারেও ঘটেছে। আমি সায়ীদ আবুবকরের ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসের কথা জানি। তাঁর পড়াশুনার পরিধিও আমার অজানা নয়। এসব বিবেচনায় আমার ভবিষ্যদ্বাণী হলো, যদি তিনি আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার মর্মমূলে নিজস্ব অভিজ্ঞতা যোগ করতে চান, তাহলে তাঁকে নিজকে আড়াল রাখার স্বভাবটি পরিত্যাগ করতে হবে।

কবিতা কীভাবে নির্ণীত হয় তা কাউকে উপদেশ দিয়ে বোঝানো যায় না। নিশ্চয়ই সায়ীদ আবুবকর এটা জানেন। সব কবির রচনার পদ্ধতিটি ভিন্ন হতে বাধ্য। আমি সায়ীদ আবুবকরের কবিতার পঙক্তিমালা পাঠ করে প্রথম দিকে স্তম্ভিত হয়ে থাকতাম। পরে অবশ্য তাঁর সঙ্গে পরিচিত হলে বুঝতে পারি যে, ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর ব্যাপক পড়াশোনা আছে। চসার থেকে ইয়েটস পর্যন্ত তাঁর অবলীলায় বিচরণ আছে।

মাঝে মাঝে তাদের আক্ষেপ যে, তারা ঢাকায় নেই। ঢাকায় এলে এদের নিষ্ঠা এবং চর্চা হয়তোবা নিম্নগামীও হতে পারে। কারণ এখানে সাহিত্যের পরিবেশটা সম্পূর্ণরূপে অকবিরা দখল করে রেখেছেন। সাহিত্যের প্রকাশনার ক্ষেত্রগুলো যেমন-পত্রপত্রিকার সাহিত্যের পৃষ্ঠা, সাময়িকী ইত্যাদি অকবিদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আপাতত এর থেকে আমাদের সাহিত্যকে মুক্ত করা প্রায় অসম্ভব।

এসব অবস্থা থেকে সায়ীদ আবুবকরেরা অনেক দূরে অবস্থান করছেন এবং তাদের কবি-স্বভাবকে স্বতঃস্ফুর্ত করতে চেয়েছেন। আমাদের সাহিত্য-পৃষ্ঠার প্রায় সবক’টিই অক্ষমের হাতে বিপুল আয়োজনের দায়িত্বভার অর্পণের মতো। ফলে এদের হাত দিয়ে কবিতা ছাপা হলেও সত্যিকার কবিকে আবিষ্কার করা যায় না। এ কারণে আমাদের কবিতা দিন দিন তাৎপর্যপূর্ণ অনাধুনিক বিষয় হিসেবে পর্যবসিত হতে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের দেশে অভিজ্ঞ কবিরা কোনো প্রতিবাদ উচ্চারণ করেননি। প্রতিবাদ উচ্চারণ করে তাঁদের সমূহ ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি তাঁরা হিসাব করে দেখেছেন। আমি মাঝে-মধ্যে এর বিরুদ্ধে সুযোগ পেলেই লিখে থাকি এবং এই লেখার জন্য আমার বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তবুও আমি যতদিন বেঁচে আছি, কবিতার পক্ষে কথা বলতে নির্ভীকতাকে অবলম্বন করব।

আমারও দিন ফুরিয়ে এসেছে। আমার আগে যারা এসব বিষয় নিয়ে আপত্তি তুলতে পারতেন, তাঁরা তা করেননি। তাঁরা সব সময় নিজের ব্যক্তিস্বার্থে অকবিকে আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছেন এবং তার কিছু দুর্ভোগ পুহিয়ে গত হয়েছেন। আমি তা কখনো করিনি। আমি অকবিকে মুখের ওপর অকবি না বললেও লিখিতভাবে তার কোনো স্বীকৃতি দিইনি। অথচ সায়ীদ আবুবকরের মতো কবিদের বিষয় আমাদের পাঠকদের কাছে উত্থাপিত না হলে সাহিত্যের সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না বলে আমার ভয় হয়।

শুক্রবার ১৭ নভেম্বর ২০০৬, ঢাকা।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ