আল মুজাহিদী
ছড়ার ইতিহাস মানবসভ্যতার মতোই সুপ্রাচীন। এমন ছড়াও লিখিত হয়েছে- মানুষের মুখে মুখে চলে এসেছে।
আদ্যিকালের আদ্যি মানুষ
ছড়া- পদ্যি কাটতো,
মুখে মুখে একের কথা
অপরেও যে ঘাটতো ॥
ছড়ার মিল, ছড়ার ভাব-ভাবনা কিংবা ভাবনাহীনতাই ছড়ার বৈশিষ্ট্য। ছড়ায় ছন্দের পক্ষীরাজ থাকে। সেই পক্ষীরাজে চেপেই তো শিশু-বুড়ো সবাই ঘুরে বেড়ায়- উপমহাদেশের প্রখ্যাতনামা ছড়াকার, বুদ্ধিজীবী অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন :
“ছড়া হয় আকস্মিক, ইররেগুলার। সেখানে আর্ট আছে। আর্টিফিসিয়ালিটির স্থান নেই। ছড়া হবে ইররেগুলার, হয়তো একটু আনইভেন। বাকপটুতা, কারিকুরি নয়।”
ছড়া নিঃসন্দেহে সুন্দর-শব্দশিল্প। এ শিল্পের রাজ্যটি আইন-কানুনহীন। এই শিল্পতন্ত্রের একক কোনো রাজা অধিপতি নেই। এর শাসনকাজ চলে সকলের হাতে। ছড়ার মধ্যে একটা আবহমানতা থাকে। এক ধরনের চিরন্তনতা থাকে। সেই চিরন্তন ভাবের অভাব ঘটলে ছড়ার ছড়াত্বেও একটা বড় রকমের ঘাটতি দেখা দেয়। এই ঘাটতি পূরণ করার কথা ছড়াকারদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। সেই কুঠুরি ভরে তুলতে হয় আপন আপন ঔদার্যে এবং চিত্তের সৌকর্যে। এটুক না থাকলে ছড়া ছড়া হয়ে উঠবে না। ছড়ার কাঠামোতে নিয়ম-রীতি থাকা অতি জরুরি। তবে নীতিকথার বালাই নেই। ছড়াকে হতে হবে অকৃত্রিম, সুন্দর, সাবলিল। স্বয়ংক্রিয় সংগীনের মতো অনেকটা। অন্নদাশঙ্কর মহাশয়ও ছড়ায় আর্টের কথাই বোধকরি বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর লোকসাহিত্য গ্রন্থ ছেলে ভুলানো ছড়ার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন :
“ছড়াগুলি আমাদের নিয়ত-পরিবর্তিত অন্তরাকাশের ছায়া মাত্র, তরল-স্বচ্ছ সরোবরের উপর মেঘক্রীড়িত নভোমন্ডলের ছায়ার মতো।… ইহারা আপনি জন্মিয়াছে।”
তাহলে ‘আপনি জন্মিয়াছে ‘বলতে আপনা-আপনি একা-একাই কি জন্মেছে? প্রকৃতির মতো? ওদের জন্মদাতা কিংবা জন্মদাত্রী কে, বা কারা? প্রথম জন্মস্থানই বা কোথায় সেকথাও ভেবে দেখতে হবে আমাদের। ছড়ার উৎপত্তি, বিকাশ ক্রমবিকাশের ধারার কথা নিয়ে পরে বিশদভাবে আলোচনার ইচ্ছা রইলো। বাংলাদেশের কবি, ছড়াকারেরা ছড়াশিল্পকে নানাভাবে, নানামাত্রায় সমৃদ্ধ করেছেন। সম্প্রতি সাজজাদ হোসাইন খানের ‘ছড়াসমগ্ ‘ বইটি তরুণ ছড়াকার রেদওয়ানুল হক কিছুদিন আগে আমাকে উপহার দিয়েছে। বইটি হাতে পেয়ে বেশ চমৎকৃত হলাম। এটি ছটি ছড়াগ্রন্থের সংকলন।
সাজজাদ মূলত: মুক্তধারার ছড়াশিল্পী। সমাজ সচেতনতাজাত মন-মানসের অধিকারী। তার মানসপ্রান্তরে দেশের মানুষ মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। সে মানুষজনই তার প্রিয় বিষয়। একান্ত আরাধ্য। জনগণের কথা বলতে গিয়ে সাজজাদ বলেন-
“গণতন্ত্রের আশিস ধারা/ চলছে দেশ বল্গাহারা
সত্য কথা কইতে গেলে/ হতেই হবে দেশটা ছাড়া।
ভাতের কথা পড়লে মনে/ বুঝাপড়া মরার সনে
কাপড় দেশে নেই তাতে কি/ এবার সবাই চলছি বনে।
লিখতে গেলে মাথার খুলি/ হঠাৎ করে পড়বে ঝুলি
কইতে গেলে মনের কথা/ জিবটা টেনে আনবে তুলি।
ন্যায় কথায় পড়বে মারা/ দালাল বলে ভরবে ‘কারা’
ধন্য রাজার ধন্য দেশে।/ গণতন্ত্রের এমনি ধারা।”
[ছড়াসমগ্র : পৃ: ১৪]
বাংলাদেশের আবির্ভাব- অভ্যুদয়- অর্থাৎ স্বাধীনতার পরপরই রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামোতে- প্রজাতন্ত্রের পরিসরে নেমে আসে- স্বেচ্ছাতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্রের দত্যিদানো। সাজজাদ হোসাইন খান তখন লেখেন, ‘স্বৈরাচারের ঐরাবত’ ছড়াটি। এখানে তার দৃপ্ত উচ্চারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
“স্বৈরাচারের ঐরাবত
বাব্বারে কি তাগড়া
সব কামেতে বাগড়া।
আমের আঁটি জামের বাটি
দিন-দুপুরে করছে মাটি
ঝুলিয়ে গলায় নাগড়া
বাড়ি কি তার আগরা?
স্বৈরাচারের মত্ত হাতি
নাই পরনে ঘাঘরা।”
[ছড়াসমগ্র : পৃ:-৪৮]
সাজজাদ স্যাটায়ার করতে বেশ পটু, দক্ষ, নিপুণ। তাই তিনি লিখলেন : ‘স্বৈরাচারের ঐরাবত/ বাব্বারে কি তাগড়া/ সব কামেতে বাগড়া/। … স্বৈরাচারের মত্ত হতি/ নাই পরনে ঘাঘরা।’ স্বৈরাচার তো আপাত: দৃষ্টিতে খুবই তাগড়া, তেজীয়ান। কিন্তু‘ এই পাগলা হাতিকে বশ মানাতেও পারে দেশমানুষ। জনগণ। এটা এ জাতির ইতিহাসে এক পরীক্ষিত অধ্যায়। স্বৈরাচার প্রথমে আসে নেপথ্যের কুচক্রি হিসেবে, লুকোচুপি করে। কিন্তু‘ ক্রমাগত তার আস্ফালন, দাপটে দেশ, দেশবাসী পিষ্ট, পীড়িত হতে থাকে।
ছড়াকে কখনও কৃত্রিম করা যাবে না। আহ্বান কালের ধারায় প্রবহমান থাকতে হবে। ছড়া কখনো কখনো ‘নিয়মহীন ইচ্ছানন্দময় স্বর্গলোক’ থেকে নেমে এসেছে। এসেছে ফল্গুধারার মতো বয়ে। সেই যে কালস্রোত সেটা প্রবল, সচল, সচ্ছল।
‘তেলে তালে’ ছড়া থেকে আরও উদ্ধৃতি তুলে দিচ্ছি :
“তিল থেকে তেল হয়/ দুধ পঁচে দৈ
বিয়ে বাড়ি অকারণ/ শুধু হৈ চৈ।
বই পড়ে বড় হয়/ ধনী গোনে টাকা
রিক্সায় কিলবিল/ রাজধানী ঢাকা।
পাট পঁচে আঁশ হয়/ ধান পিশে চাল
তিলে তালে মিশে গেলে/ সব গোলমাল।”
[ছড়াসমগ্র : পৃ:-৬৫]
সমাজজীবনের প্রবাহরেখায় অনেক অপ্রত্যাশিত কাঁকর গড়িয়ে পড়ে। কাঁটা ও কন্টকে আকীর্ণ হ’য়ে পড়ে পথ-প্রান্তর। কতো যে সামঞ্জস্যহীনতা সমাজটাকে অস্থির করে তোলে। ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খান সমাজের মানুষের আচরণরীতি ও আচরণবোধ অতি সহজভাবে শনাক্ত করতে পারেন। ‘পাট পঁচে আঁশ হয়/ ধান পিশে চাল/ তিলে তালে মিশে গেলে/ সব গোলমাল।” এখানেই একজন শিল্পীর দায়বদ্ধতা ও অঙ্গীকারকে নির্দেশ করে।
সাজজাদ বোঝেন, উপলব্ধি করেন ছড়া একটা শিল্প। ছড়ার জগত বয়নে, বুনোনে, ব্যঞ্জনায় যখন বাঙময় হয়ে ওঠে তখনই সেখানে স্থিাপত্য দৃশ্যমান হয়। বর্ণমালা ও শব্দপুঞ্জে সৃষ্টি হয় শিল্পের আরেক ভুবন। সাজজাদ সেই ভুবনের-ই এক প্রত্যয়ী বাসিন্দা।
“বৃষ্টিরা’ এই ছড়াটি এখানে উদ্ধৃত হচ্ছে অন্য একটি তাগিদে।
বৃষ্টিরা ঝরছিল টুপটাপ
হাঁসগুলো ডুব দেয় ঝুপঝাপ।
হাওয়া লেগে দোল খায় আম-জাম
এই দিনে নেই কোনো কাজ-কাম।
আম্মার চোখ তাই ঘুম ঘুম
কী যে করি আমি আর কুমকুম
বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে টুপটাপ
ঘর থেকে বার হই চুপচাপ।
কলাগাছ ঝোপঝাড় পিঠে সব
পাখিদের দাপাদাপি মিছে সব
আম চাই কাঁচা আম ছুটে যাই
গিয়ে দেখি গাছতলে কিছু নাই।
ঘরে ফিরি হতাশায়, খালিহাত
বৃষ্টিরা ঝরেছিল সারারাত।
[ছড়াসমগ্র : পৃ:-৬৮]
বৃষ্টি, মেঘমালা, পশুপাখি, গাছপালা সকল কিছুই প্রকৃতির নিয়মে চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাবিভাগের সাবেক অধ্যক্ষ, উপমহাদেশের প্রখ্যাতনামা ধ্বনিতত্ত্ববিদ প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাই বলেছেন,
‘… মধ্যযুগেই কাব্য-সাহিত্যের আলোচনাক্রমে সেই যুগের বৈশিষ্ট্যবর্জিত অথচ প্রাকৃত সাহিত্যের উপাদান সমন্বিত একটি সাহিত্যশাখার নাম করা যাইতে পারে- তাহা ছড়া ও গ্রাম্য কবিতা।’
আমার অত্যন্ত সৌভাগ্য যে, অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকও বটে। এ উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে গিয়ে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাও নিবেদন করছি। তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই। এক অপ্রত্যাশিত মৃত্যু তাঁর সৃজনশীল পথের সকল সম্ভাবনার দরোজা চিরতরে রুদ্ধ করে দিয়েছে। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ এক অপূরণীয় ক্ষতি ও শূন্যতার সৃষ্টি করে। ছড়াসাহিত্য নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তত্ত্বকথা লেখেন তারাও কিন্তু‘ শৈশবে, কৈশোরে ছড়া পাঠ করেছেন আনন্দের আতিশয্যে। এখনও বেঁচে থেকে তারা ছড়া পাঠ করেন।’
‘দুনিয়ার মাল্লা’ নিয়ে ছড়াটি একটি সুন্দর আধ্যাত্মিক আবহ সৃষ্টি করে। সাজজাদ যেমন লিখেছেন :
“তুমি আমি আম্মা/ খালু চাচি মাম্মা
ফুল পাখি বৃষ্টি/ কার বলো সৃষ্টি?
তিনি এক আল্লা/ দুনিয়ার মাল্লা।”
[ছড়াসমগ্র : পৃ:-৮৩]
‘জোসনামাখা চাঁদ’ এই ছড়াটিও বেশ সুখপাঠ্য।
“ফুল নাই পাখি নাই ঘর নাই কুঁড়ে
হাওয়া নাই পানি নাই দীঘি নাই দূরে,
কোকিলের গান নাই স্বপ্নীল সুরে
তবু রাত-দিন আসে সারা চাঁদ জুড়ে।
সেই চাঁদ ঝলোমলো জোসনায় মাখা
আকাশের পিঠে যেনো ফুটবল আঁকা”
[ছড়াসমগ্র : পৃ:-৮৮]
আকাশের বিমলকান্তির ঝলোমলো চাঁদকে জ্যোস্নাবিম্বিত ফুটবলের একটি চিত্রকল্পের রূপ দিয়েছেন। এই প্রতীকায়ন শিশুমনে দোলা দেবে। শিশুকে করবে প্রাণস্পন্দিত।
বক্ষ্যমাণ ছড়ায় আমরা লক্ষ্য করবো- দেশের বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক স্খলন। মনসিক ধৈর্য, বিকোলন এ সবই সুশীল সমাজের মধ্যে লক্ষ্যণীয়।
‘বুদ্ধিজীবীর বদ্ধঘরে’ এই সমকালীন-
“ইচ্ছে করে বুদ্ধিজীবী হই/ ঘরের কথা পরের কাছে কই
চোয়ালটাকে শক্ত করে/ উড়াই কথার খৈ।
বুদ্ধিজীবীর বদ্ধঘরে/ হরেক জিনিস নড়ে চড়ে/
হঠাৎ রাজা/ একটা যদি লই।
খায়েশ জাগে বুদ্ধিজীবী হই/ মিলবে নাকি বৈদেশীয়া সই?
[ছড়াসমগ্র : পৃ: – ৯৩]
‘একাডেমির চত্বরে’এই ছড়াটিতে সাজজাদের-
‘বইমেলাতে টাপুর টুপুর/ একাডেমির চত্বরে/
আউলা কেশে সুন্দরী কোন/ খ্যামটা নাচে মত্ত রে?
ভাষার নামে ব্যবসা করে/ বুদ্ধিজীবী ফক্করে/
বঙ্গভাষা রঙতামাশা/ রাম ঘোষালের চক্করে।’
[ছড়াসমগ্র : পৃ:-৯৭]
ড: নির্মলেন্দু ভৌমিক ‘ছড়া’ প্রসঙ্গে বলেন, “কোনো ছড়ার মৌলিক প্রতিসাম্যই হলো সে ছড়ার সূচনাংশ। ভাবগত, শিল্পকলাগত দিক থেকেই একটি ছড়ার সূচনা ও পরিণতি গড়ে ওঠে।”
‘তারার গগন’ ছড়াটি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। ছড়াকার সাজজাদ এই ছড়াটিকে অধিকতর পরিণতির দিকে টেনে নিয়েছেন।
আমি শুধুই কবি আর আল্লা’র প্রিয়দের একজন
আমার ছড়ার শব্দ চোখে চমকায় তারার গগন।
সরিষা ফুলের হলুদ হিরণে পদ্যেরা করে খেলা
ভাষার জাজিমে চাঁদের সুষমা ভাসে বালিহাঁস ভেলা।
বাতাসের দোলায় খুশির পতাকা স্বপ্নেরা টানটান
কথার হৃদয়ে হাঁটে চুপচাপ প্রজাতি-জাফরান।
আমার কবিতা উধাও আকাশ রোদেরা ঝিকমিক
নয়নসায়রে নায়রির নাও সুরমারা চিকচিক্।
ঝুরঝুর ঝরে কাঁঠালীচাঁপা গোলাপের কুমকুম
কাব্য উঠানে রংধনু নাচে নীলপরী ঘুমঘুম।
দাপাদাপি করে অযুত পাখিরা জবা ফোটে টুকটুক
মাখামাখি দেখো হরফে হরফে মানুষের সুখদুখ।
আমি শুধুই কবি আর আল্ল’রর প্রিয়দের একজন
আমার ছড়ার ছন্দ চোখে চমকায় তারার গগন।
[ছড়াসমগ্র : পৃ:-১১৪]
একটি কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। সাজজাদ কখনও কখনও তার ছড়াকে কবিতার দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :
‘যতিকে কেবল বিরতির স্থান না দিয়ে তাকে পূর্তির কাজে লাগাবার অভ্যাস আরম্ভ হয়েছে আমাদের ছড়ার ছন্দ থেকে। ছড়া আবৃত্তি করবার সময় আপনি যতির যোগান দেয় আমাদের মনে। … ছড়ার রীতি এই যে, সে কিছু ধ্বনি জোগায় নিজে, কিছু আদায় করে কণ্ঠের কাছ থেকে; এ দুইয়ের মিলনে সে হয় পূর্ণ।…
‘উড়াও ভালবাসা’ আরও একটি দেশ-মৃত্তিকার ছড়া যেমন :
“দেশের মাটি কামড়ে থাকো/ খামছে ধরো ভাষা
হৃদয়টারে উদাম করে/ উড়াও ভালবাসা।
স্বপ্নে মাখা অতীতটারে/ বর্তমানে মিশাও
অন্ধকারের দ্বন্দ্ব যত/ আলোর সাথে পিশাও।”
[ছড়াসমগ্র : পৃ:-১১৭]
অতীতের স্থান- স্থবিরতা থেকে নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়েছেন সাজজাদ। এই আশাবাদ নিঃসন্দেহে একজন স্বাপ্নিক শিল্পীর। ‘জীবন- এই ছড়ায় মানবজীবন সঞ্চয়িত পুষ্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন সাজজাদ।
জীবনটারে ভাবো যদি ফুল
উড়াল দেবে তিক্ত কালো ভুল
জীবনটারে ভাবো যদি নদী
সুখের ধারা বইবে নিরবধি।
আঁধারগুলো কাটবে দেখো ত্বরা
দুধের মতো ফর্সা হবে ধরা।
[ছড়াসমগ্র : পৃ:-১৩৮]
‘সাজজাদ জীবনকে নদীর উপমায় লিখেছেন- ‘জীবনটারে ভাবো যদি ফুল/ উড়াল দেবে তিক্ত কালো ভুল/ জীবনটারে ভাবো যদি নদী/ সুখের ধারা বইবে নিরবধি।’
নদীর প্রবহমানতার মানবজীবনের গতিও প্রসার সঞ্চারিত হয়েছে। নদীর জলধারার ওপর জীবনের রশ্মি ঠিকরে পড়ে যখন আঁধার কেটে যায়। নদীও বাহিত হয় নিরুদ্দেশের দিকে।
সাজজাদ হোসাইন খান সমাজসচেতন শিল্পী। সমাজের দৃশ্যপট অবলোকন করেন চোখের আলো ফেলে। আবার বিশ্বপটও দৃশ্যমান করে তোলেন রাজনৈতিক নিরিখে।
তার ‘কবর’ লেখাটিও বিশ্বরাজনীতির অবস্থানকে জ্বাজ্বল্যমান করে তুলতে সক্ষম।
“খবর এল রয়টারে/ কীসের আবার ভয়টারে
ব্রাশ ফায়ারে কম্মকাবার/ ডাক্কু সেনা ছয়টারে।
খবর এল মজার খবর/ তাতে নাকি ভয়টা জবর
ভিয়েতনামে লড়তে এসে/ মার্কিনীদের জুটল কবর।”
[ছড়াসমগ্র : পৃ:-১৪২]
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা দিয়েই আমার এ সামান্য সংক্ষিপ্ত লেখাটি শেষ করতে চাই।
“ছেলে ভুলানো ছড়ার মধ্যে …. একটি আদিম
সৌকুমার্য আছে; সেই মাধুর্যটিকে বাল্যরস
নাম দেওয়া যাইতে পারে। তাহা তীব্র নহে,
গাঢ় নহে, তাহা অত্যন্ত স্নিগ্ধ সরস এবং যুক্তি সংগতিহীন।”
সাজজাদের ছড়া একদিকে ছেলে ভুলানো। অন্যদিকে মানুষজনদের জাগানোর জন্যেও। ছেলেরা জুজুর, ভূত-প্রেতের ভয়ে কখনও কখনও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সেখানে সাজজাদ আগুন দিয়ে সল্তে জ্বালিয়ে ভূত-প্রেতের কাল্পনিক মুখ ও মুখোশ পড়িয়ে খাক করে দিতে সক্ষম। আবার আলোর মশাল হাতে পথ দেখাতে পারেন। সেই অর্থে সাজজাদ পথের পথিক, পদাতিক শিল্পী।
সাবলীল আলোচনা।
পাঠ করে ভালো লাগলো।