spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যনতুন ভাষাভঙ্গির শৈল্পিক সংহতি আছে তার কবিতায়

লিখেছেন : আল মাহমুদ

নতুন ভাষাভঙ্গির শৈল্পিক সংহতি আছে তার কবিতায়

আল মাহমুদ

মহিবুর রহিম একজন কবি। দীর্ঘদিন ধরেই আমি তার কবিতার সঙ্গে পরিচিত। তার কবিতার সম্ভাবনাময় দিকগুলো নিয়ে আমি পূর্বেও বলেছি। এখনও বলছি, মহিবুর রহিম নব্বই দশকের প্রতিভাবান কবিদের একজন। শুধু সফল সার্থক কবিতাই তিনি লিখেছেন না, কবিতা নিয়ে বিভিন্ন রকম পরীক্ষা নিরীক্ষাও আছে তার। একজন সচেতন কবির মধ্যে যে গুণগুলো সচরাচর লক্ষ্য করা যায়, মহিবুর রহিমের মধ্যে তার লক্ষণ গুলো আমি দেখেছি। তিনি কবিতায় আন্তরিক ও নিবিষ্টচিত্ত। কবিতায় নিজস্বতা ও নতুনত্ব আনার প্রয়াস তার কবিতাকে উপভোগ্য করেছে। 

আমি দীর্ঘদিন ধরে বলে এসেছি বাংলা কবিতার একটা নতুন যুগের সূত্রপাত হওয়া প্রয়োজন। বাংলা কবিতার বাঁক বদলের একটি গুরুত্ব সময় আসন্ন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে শক্তিশালী কবির আগমন হচ্ছে না। একটি নতুন যুগ তৈরির জন্যে যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি প্রয়োজন, সাম্প্রতিক কবিদের মধ্যে আমি তা দেখছি না। তবে আশার কথা নব্বই দশক থেকে বাংলা কবিতার যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তা কিছুটা পূর্ণতা পেতে শুরু করেছে। আমি আশা করছি এ সময় কয়েক জন শক্তিশালী কবির আবির্ভাব ঘটবে। যারা আমাদের কবিতার নতুন যুগের পরিবর্তনকে সূচিত করবেন। 

আমি তেমন  প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন কবিদের বিষয়ে আশাবাদী। যেমন আমি আশাবাদী আমার দেশ ও জাতির বিষয়ে। আমি জানি, বাংলাদেশের মানুষ এক হার না মানা জাতি। মাথা নত না করাই তাদের স্বভাব। বাংলাদেশের কবিরা এই জাতির উত্তরাধিকার বহন করছে। এদেশের কবিদের লেখায় প্রেম ভালবাসার পাশাপাশি আশা ও দ্রোহের বিদ্যুৎ বহমান। মহিবুর রহিমের অনেক কবিতা শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমি তো বলেছি মহিবুর রহিম আমাদের ভবিষ্যতের কবি প্রতিভা। তার কবিতা আশা, প্রেম, প্রতিশ্রুতি ও আনন্দের স্বতস্ফূর্ততায় গতিময়। এরই মধ্যে তার কবিতায় দ্রোহ ও প্রতিবাদের যে ধ্বনি আমি শুনতে পাচ্ছি তা শুধু ক্ষণ কালের শ্লোগান বা উচ্ছ্বাস নয়। নতুন ভাষাভঙ্গির শৈল্পিক সংহতি আছে তার কবিতায়। মহিবুর রহিমের নতুন কবিতা গ্রন্থের নামকরণ করেছেন ‘হৃদয়ে আমার কোন মন্দা নেই’, কারণ দীর্ঘদিন ধরে যে নেতিবোধ আমাদের কবিতাকে আস্তগামী করে রেখেছিল, এই কবিতাগ্রন্থে সেখান থেকে টার্ন করার ইঙ্গিত আছে। কয়েকটি উদ্বৃতি থেকে তা বুঝা যাবে—

            ‘পরাহত প্রাচীনের কার্নিশ ফাটিয়ে 

নির্ভয় গুল্মের মতো ডানা মেলে মানুষের গান

পাথর নিশ্চলে তার রক্ত ঢেলে

শতাব্দীর সত্যগুলো খুঁজে পায় নতুন ঠিকানা

না কোন পরাজয় নেই

মানবিক চেতনা মরে না সহজে 

কালের পৃষ্ঠায় 

নতুন দিনের গান সে স্পর্ধায় লিখে যায়।’ 

      (ইতিহাস/হৃদয়ে আমার কোন মন্দা নেই)

‘এখন আমার কন্ঠে সাদামেঘ আর নীরব দুঃখের সুরলোক 

হাতে আছে খসে পড়া রৌদ্রের মহৎ পালক 

আমার জন্যে বর্শাবিদ্ধ স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে জীবনবাদী চাষীরা 

                               আর ঢেউয়ের মন্ত্রে আমার ভেজা চোখ ছুঁয়ে আছে নদী। 

        (ভেজা চোখ ছুঁয়ে আছে নদী/হৃদয়ে আমার কোন মন্দা নেই) 

অত্যন্ত শক্তিশালী ভাষাভঙ্গি আর ছন্দের গতিতে মহিবুর রহিম তার আশাবাদকে গ্রন্থিত করেছেন। মনে হল, তার ভাষাভঙ্গি এবং কাব্য চেতনা উজানের স্রোতের মতো অগ্রসরমান। প্রবল বৈরীতার বিরুদ্ধে, মন্দার বিরুদ্ধে, যুদ্ধ, ক্ষয় ও অগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নৈতিকতা তিনি অর্জন করেছেন। একজন সাহসী, আত্মত্যাগী, মানবপ্রেমী কবির পক্ষেই তা সম্ভব। মহিবুর রহিম রবীন্দ্রনাথের প্রশস্তি লিখেছেন। কারণ রবীন্দ্রনাথের লেখায় আশা ও আশ্বাসের নির্ভরতা আছে–

‘বিশাল আকাশে তার চেতনার মেঘ ভেসে চলে

খুঁজে ফেরে তপোবন যক্ষের প্রাণের আকুলতা

শুভ্রতায় ছেয়ে আছে ইহলোক তার করতলে

অমরাবতীর গান গেয়ে ওঠে যত নীরবতা।’ 

(রবীন্দ্রনাথ/ হৃদয়ে আমার কোন মন্দা নেই)

‘হৃদয়ে আমার কোন মন্দা নেই’ নিঃসন্দেহে আমাদের কাব্য জগতে একটি নতুন সংযোজন। এই কবিতাগ্রন্থের মূল সুর মানবতার প্রতি কবির পূর্ণ আস্থা। রবীন্দ্রনাথ যেমন ‘দুঃসময়’ কবিতায় বলেছিলেন– 

‘তবু বিহঙ্গ, ও রে বিহঙ্গ মোর

এখনি, অন্ধ, বন্ধ ,করো না পাখা’ 

মহিবুর রহিমও এমনি শক্ত আশাবাদে তার ভিত্তি গড়ে তুলেছেন। এ কবিতা গ্রন্থে তার দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্বচ্ছ, মানবিক প্রত্যয় দৃঢ়তায় উত্তীর্ণ। সাম্প্রতিক কালের অনেক কবিদের লেখায় যা দেখা যায় না। বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের একচেটিয়া খেলায় মানুষের আস্থার জায়গাগুলো যখন ছিন্ন ভিন্ন তখন মহিবুর রহিম দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন—-

‘বিশ্বমানবতাবাদের আগ্রহী ছাত্র আমি

ডান-বাম উগ্রবাদে সমান অনাগ্রহী

আমার হৃদয়ে কোন মন্দা নেই

স্নায়ুযুদ্ধের কোন শীতলতাও নেই’

সব রকম উগ্রবাদে অনাগ্রহী কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও মহিবুর রহিম নতজানুও নন। বরং দ্রোহী, প্রতিবাদী এক চেতনাকে তিনি অবলম্বন করেছেন। এখানে তার কবিতার বিষয় ভিন্ন রকম এক প্রেরণার গতি লাভ করেছে। 

                             ‘যা কোন দিন প্রত্যাশা করি না যুদ্ধ লুন্ঠন শোষণ 

ভণ্ড বিশ্বনীতির ডামাডোল রাজনীতির কূটচাল 

যন্ত্র মৃত্যু মারণাস্ত্র– দানবিক সমরতন্ত্র

যার ভয়ে বিবশ বিবর্ণ আজ মানুষের পরম প্রত্যাশা 

(নববর্ষ ১৪২১/ হৃদয়ে আমার কোন মন্দা নেই)

আমার কাছে সবচেয়ে ভাল লেগেছে মহিবুর রহিমের দ্রোহী চেতনাটি এখানে তাকে অসাধারণ স্বকীয় মনে হয়েছে। ভাষাভঙ্গি এখানে দারুণ মহৎ। যেমন–

                       ‘কেন খামোখা তুমি ভীত হও

কেন শুধু — উৎপাদন করো ক্ষয়ের টক্সিন

জীবনকে সহজ সত্যের ময়দানে যেতে দাও

যে ময়দানকে করা হয়েছে নিয়তির শস্যক্ষেত্র’

(সভ্যতার পত্রিকা/ হৃদয়ে আমার কোন মন্দা নেই)

কিংবা, 

           ‘মৃত্যু মতবাদ মারণাস্ত্র কোন কিছুই তোমাকে ক্ষান্ত করার ক্ষমতা রাখে না 

                তুমি সময়কে মুঠোতে ভরে এগিয়ে যাও চেতনার গভীরে।’ 

                 (শহীদ কারবালা/ হৃদয়ে আমার কোন মন্দা নেই) 

২০১৫, ঢাকা, বাংলাদেশ। 

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা