মুহম্মদ মতিউল্লাহ্
যখন তাঁর ইচ্ছে করেছে কেবল তখনই তিনি লিখেছেন। ফলে সংখ্যার দিক থেকে কবিরুল ইসলামের কাব্য সংগ্রহ খুব বিস্ফারিত নয়। তাঁর কবিতা সংগ্রহের (প্রথম খণ্ড) ব্লার্ব থেকে এ তথ্যটুকু জানা যায়। কিন্তু তাঁর কবিতার নাতিদীর্ঘ সমগ্রতার দিকে তাকালে বোঝা যায় একজন সাধকের মতো প্রতিনিয়ত তাঁর যুক্ত থাকা; শিল্পের জগতে, কবিতার সঙ্গে। বোঝা যায় শুধু মরশুমে তাঁর পার্বণ নয়; নয় বারো মাসে তেরো পার্বণ। তাঁর পার্বণ প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। তিনি লেখেন ‘আমার তো কথিত কোনো বিগ্রহ নেই। সাকারে নেই, না, নিরাকারেও নেই।’ বিগ্রহ তো এক ধরনের প্রতিষ্ঠান। প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে থেকে যে পার্বণ আর ব্রত পালন সে তো নিভৃত এক প্রতিকূলতার পটভূমি। অন্তর্লীন এক বিপ্লব। ‘আমার পূজা শুধু শরৎকালে নয় / আমার পূজা প্রতিদিন।’ কী সেই পূজা, কবিরুল ইসলামের কাছে! অবশ্যই তাঁর দীক্ষা শিল্পের কাছে, কবিতার কাছে, শিল্পিত আধ্যাত্মিকতায়। আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেছিলেন ‘আধ্যাত্মিকতার সাধনা বলতে বুঝি সাহিত্য সংগীত দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস জনসেবা ইত্যাদির সাধনা, পর্বতগুহায় নিশ্চল বসে তপস্যা নয়।’ কবিরুল ইসলামের কবিতায় পূজাও তাই। এই শিল্পের জগতে, প্রতিদিনের অনুশীলনে, ‘ব্রত পালনের মতো’ দিনযাপনে কবি ভুলে যান না মানুষের কথা। তার নিভৃত ঘোষণা ‘মানুষ আমার বিগ্রহ / মানুষী আমার দেবপ্রতিমা।’
‘আমার পূজা শুধু শরৎকালে নয়
আমার পূজা প্রতিদিন
আমার বারো মাসে তেরো পার্বণ মাত্র নয় প্রতিদিনই আমার পার্বণ
আমার তো কথিত কোনো বিগ্রহ নেই
সাকারে নেই, না, নিরাকারেও নেই
মানুষ আমার বিগ্রহ
মানুষী আমার দেবপ্রতিমা
তাই আমার ব্যক্তিগত বিগ্রহের কোনও
বিসর্জন নেই
ফলত, প্রতিদিন আমার পূজা
প্রতিদিনই আমার পার্বণ।।
(‘প্রতিদিন’ – / কাব্যসমগ্র – ২য় খণ্ড)
কবিরুল ইসলামের কবিতার স্নায়ব প্রতিবেদনে সত্যিই তিনি আমাদের ব্যক্তিগত সংসারের একজন ব্যাকুল সদস্য। কবিরুল ইসলাম প্রাণপণে সংসারের সঙ্গে, ধূলিপৃথিবীর সঙ্গে তাঁর সহনাগরিকদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতোই তারও আত্মভাষণ ‘সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমু খাব।’
কবিরুল ইসলাম লেখেন:
‘আমার ছেলের সঙ্গে বাজি লড়ে
আমি হেরে যাই,
আমার মেয়ের সঙ্গে আড়ি করে
আমি ভাব চাই।
আমি দৌড়ে হাস্যে অমৃত ভাষণে
আমার শৈশব ফিরে পাই,
আমার বাবা-মা যেন পুনরাগমনে
আমি জিতে যাই।।
(‘হারজিৎ’ / ‘বিকল্প বাতাস’)
তাঁর ব্যাকুলতা যুক্ত থাকার আকাঙ্ক্ষায়, তার ভয় সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতায়। যেমন আর্তিতে প্রেমে, তেমনি আছেন প্রতিবাদে, মানুষের সঙ্গে মানুষের পাশে। কিন্তু তাঁর এই আত্মসচেতন উপস্থিতির আর্তি কখনো উচ্চরোল নয়। তাঁর অস্তিত্ব পরিপার্শ্বকে কখনোই উচ্চকিত করে না। ঢেউ তোলে না কোথাও। স্তব্ধ শান্ত গভীরতাঋদ্ধ তাঁর উপস্থিতি। যাকিছু তাঁর বক্তব্য সবই আত্মভাষণ, স্বগতোক্তি। যেন নিজের সঙ্গে নিজেরই চলে তার গূঢ় সংলাপ। তাঁর বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন তাঁর কবিতা। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কুশল সংলাপ’ (১৯৬৭)-এ তিনি লিখেছিলেন :
‘বস্তুত কবিতা পাঠ ঈশ্বরেরই স্তব।
মনে হয়, এইসব শব্দ-বর্ণ-গন্ধের স্বভাবে
একদিন এ পৃথিবী আমাদের বাসযোগ্য হবে…
আমি কবিতার মধ্যে বসবাস করছি চিরদিন :
মনে হচ্ছে,আমি একটি বিশাল বাগানে শুয়ে আছি
বস্তুত একটি দেবালয়ে
এবং পাশেই একটি আলোকিত নদী বহমান।।
(‘আমি কবিতার মধ্যে’ / ‘কুশল সংলাপ’)
কবিরুল ইসলামের এই কবিতাটি পড়ে একদা বুদ্ধদেব বসু তাঁকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘তোমার কবিতা স্নিগ্ধ ও সরস, একটি সুকুমার ও সংবেদনশীল মনের পরিচয় দেয়। কবিতার প্রভাবে ‘পৃথিবী একদিন বাসযোগ্য হবে’ তোমার এই আশাবাদী উক্তিতে মন প্রতিবাদ করে, কিন্তু আশা করি জগৎ সংসার একই রকম কলুষিতভাবে চললেও তুমি কাব্যচর্চায় আস্থা হারাবে না।’ (৬.১২.৬৫)। না, কবি কবিরুল ইসলাম আস্থা হারাননি। বরং শিল্পের সমীপে তাঁর প্রণিপাত আরও নিগূঢ় হয়েছে প্রতিদিন। কখনো কবিতার নামে চমকের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। প্রসাধনহীন নিরুপম সরলতার কাছে তার স্বনির্বাচিত পরবাস এবং কবিতার কাছে—
‘শুধু একটি শব্দ চাই
একটি শব্দের জন্য প্রাণপাত করো
একটি শব্দের জন্যে কলম কামড়ে ধরো
শুধু একটি শব্দের জন্যে সাম্রাজ্যও দিতে পারা যায়
কিংবা আরও বেশি কিছু।’
(‘একটি শব্দের জন্য’ / ‘বিকল্প বাতাস’)
এই ‘প্রাণপাত’ এবং প্রণিপাত তাঁর কবিতার সত্যকে স্পর্শ করে। তাঁর কবিতার সত্য অবিরল সরলতা। কিন্তু প্রশ্নহীন বিস্ময়হীন সরলতা নয়। তার কবিতার সরলতা অনেকাংশে রহস্যস্পর্শী। একই সঙ্গে কবিরুল ইসলামের কবিতা স্খলন ও শিথিলতাহীন হয়ে-ওঠা, ফলে-ওঠা। কবিতা যখন আসে, তিনি লালন ফকিরের লোকায়ত মুদ্রায় বলতে পারেন :
যখন সে আসে, আসে:
কোনো আবাহন নেই গাড়িজুড়ি নেই
অদূর দুয়ারে কেউ প্রস্তুতও থাকে না
বাজে না রাত তিনটের এলার্ম—
কিংবা নোটিশ নেই এক মিনিটেরও।
সে যখন আসে, আসে
হঠাৎ রক্তাক্ত স্বয়ম্বর ঘটে গেলে
আত্মজা আড়ালে আয়োজনহীন
যখন সে আসে, না এসে পারে না।।
(‘সে আসে’ / ‘বিকল্প বাতাস’)
তাহলে কি এ-উচ্চারণ নির্মাণহীন স্বভাব কবির উচ্চারণ! নির্মাণহীন স্বভাবকবিত্ব? আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেও পারে পাঠকের। কিন্তু নিবিষ্ট পাঠে কবিরুল ইসলামকে সম্যক বোঝা যায়। কবিতার ‘হয়ে ওঠা’ ‘ফলে ওঠা’-র পাশাপাশি একই সঙ্গে আছে কবির শব্দ প্রয়োগ নৈপুণ্য, সচেতন নির্মাণ কুশলতা। কবিরুল ইসলামের কবিতা সামগ্রিক অর্থে এক আধুনিক, মনস্ককবির কবিতা। তাঁর মনন বৈদগ্ধ্যের পরিচয় কবিতার আন্তঃশরীরে অন্তর্লীন থাকে। কবিরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘কবিতা লেখার ব্যাপারে আমি একমাত্র প্রেরণায় পূর্ণ বিশ্বাসী। অনুশীলনও যৎকিঞ্চিৎ থাকতে হবে বৈকি, কিন্তু শুধু শ্রম পণ্ডশ্রমেরই নামান্তর।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি চেষ্টা করেছি কত সহজে এবং কত অল্প কথায় আমি আমার অনুভূত বিষয়কে ব্যক্ত করতে পারি।’ এর পাশাপাশি একই সঙ্গে তিনি জানান ‘কিন্তু কবিতায় আমার যা করবার আমি তা কখনোই খুব সচেতনভাবে করি না।’ অর্থাৎ একই সঙ্গে কবিরুল ইসলাম একজন রূপকল্প আধুনিক মানুষ যিনি কবিতার জন্য উপযুক্ত একটি শব্দের সন্ধানে প্রাণপাত করেন এবং প্রণিপাত জানান কবিতার অনায়াস হয়ে ওঠাকে। কবিরুল ইসলামের আধুনিক নাগরিক মানসতার মধ্যে একই সঙ্গে বাস করে এক মরমী বাউল। শব্দের নিপুণ আলোয় লোকায়ত একটি বীক্ষণ নিরাবেগ ভঙ্গিমায় বেজে ওঠে তাঁর কবিতায়। তাঁর চেনা শৈশব, গ্রামীণ সংস্কৃতি, বীরভূমের বাউল-বাতাস, আটপৌরে প্রসাধনহীন মানুষেরা এবং অবশ্যই নিসর্গলোক কবিরুল ইসলামের কবিতায় আলোবাতাস সঞ্চার করে। সেই সঙ্গে যুক্ত আছে কবির একটি রোমান্টিক অভিমানী মন। এইসব নিয়েই কবিরুল ইসলামের কবিতার জগৎ। এ-কথা ঠিক শব্দ দিয়েই তিনি নির্মাণ করেন কবিতা। কিন্তু শব্দ-উত্তীর্ণ শব্দহীনতার যে অনুভূতির জগৎ তাই তাঁর অভীষ্ট। কবিতায় তিনি রচনা করতে চান এক ‘রহস্যময় অস্পষ্টতা।’ তাই তাঁর কবিতা কখনো অতি পল্লবিত নয়, সংহত, সংক্ষিপ্ত তাঁর কাব্যশরীর। কবিতার নামে ‘অণৃত ভাষণ’ তার অপছন্দ। অপছন্দ প্রাণহীন ‘শব্দ লেখার বিকার’ কিংবা ‘ছদ্মবেশী আত্মজীবনী’। কবিতার নামে ‘হঠাৎ প্রক্ষিপ্ত দু-চারটে মুদ্রণ অযোগ্য শব্দ লেখার বিকৃত মজা’ থেকে কবিতাকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছেন। আমাদের মনে পড়ে যায় শঙ্খ ঘোষের সেই প্রবাদপ্রতিম উক্তি ‘সত্য বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার।’ কবিরুল ইসলামও তাঁর অভিমানী কণ্ঠে রোমান্টিক প্রতিবাদে লেখেন:
কবিতা কী শুধু দণ্ডদুই কারিগরী কুশলতা
চিত্র ও সঙ্গীতময় শব্দের মচ্ছব
কেবল ছন্দের সম্মোহন আর অণৃত ভাষণ?
হায়, তবে কি বাগান মানে শুধু অনর্থ গাছপালা
অযত্নে সাজানো, অর্থের গৌরবহীন একা
হে কবিতা কোথায় ট্রিগার?
(‘হে কবিতা কোথায় ট্রিগার’ / ‘বিদায় কোন্নগর’)
কবিরুল ইসলামের আত্মপ্রকাশ পঞ্চাশের দশকে। তবু বাংলা কবিতার ইতিহাসে তাকে ষাটের কবি হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এর কারণ হয়তো তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কুশল সংলাপ’ (১৯৬৭) প্রকাশিত হয় ষাটের দশকে। এই বইটির প্রকাশ উপলক্ষে সেকালে সঞ্জয় উট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে সম্প্রতি কবিরুল ইসলাম তার প্রথম কবিতা সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করলেন। ইদানিংকার কবিদের মধ্যে এমন ধৈর্য্য দুর্লভ। যদিও সংকলনের কবিতাগুলোর রচনাকাল ১৯৬১-১৯৬৫ এবং এ গ্রন্থের কবি হিসেবে কবিরুল ইসলামকে ষাটের দশকের কবি বলাই উচিত, তবু আমরা জানি ১৯৫০ থেকেই তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কবিতা লিখে আসছেন। কাজেই সতেরো বছর অপেক্ষা করে তবে তিনি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশে আগ্রহী হয়েছেন। ষাটের দশক পার হতে না হতেই যারা যাটের কবি বলে প্রচারিত হয়ে থাকেন, গ্রন্থ প্রকাশে তাঁদের ধৈর্য নেই বললেই চলে।’ অর্থাৎ পঞ্চাশের দশক এবং অর্ধেক ষাটের দশক পেরিয়ে এসে কবিরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হল। প্রথম গ্রন্থের নামকরণ থেকেই চিহ্নিত হয়ে গেল তাঁর কবিতা প্রকৃতপক্ষে অন্তর্লীন এক কুশল সংলাপ, কুশল বার্তা বিনিময়। তাঁর কবিজীবনের সূচনালগ্নে পঞ্চাশের দশকের কবিদের হাতে তুমুল এক আন্দোলন হয়ে গেছে। কৃত্তিবাসী কবিদের আত্মজৈবনিক বা স্বীকারোক্তিমূলক কবিতার যে আলোড়ন, তা তাঁকে স্পর্শ করেনি। ষাটের দশকের কবিতার ‘হাংরি’ ‘অ্যাংরি’ ইত্যাকার বিষয়সমূহ কবিরুলের মনোজগতকে ছুঁতে পারেনি। বরং বলা যায় অমিয় চক্রবর্তী থেকে আলোক সরকার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, কালীকৃষ্ণ গুহ অবধি বাংলা কবিতার যে আত্মউজ্জীবনমূলক চিরকালীন কবিতার ধারা— কবিরুল ইসলাম সেই ধারার কবি। কিন্তু অমিয় চক্রবর্তী কিংবা আলোক সরকার বা কালীকৃষ্ণ গুহ এদের কাব্যগত উচ্চারণ আর কবিরুল ইসলামের উচ্চারণ এক নয়। কবিরুল ইসলামের কবিতাও এক অর্থে আত্মজৈবনিক কবিতা এবং একই সঙ্গে আত্মচৈতন্যের কবিতা। এক অর্থে তাঁর সমগ্র কাব্যজীবনের সাধনা যা কিছু কবিতা নয় তাঁকে কবিতা থেকে বাদ দেওয়ার সাধনা। কবিরুল ইসলাম কবিতায় ‘ছদ্মবেশী আত্মজীবনী’ রচনা করেননি। ‘অযোগ্য শব্দ লেখার বিকৃত মজা’ থেকে তাঁর হাত বিরত থেকেছে। কবিরুল ইসলামের কবিতায় অন্তত প্রথম তিন দশকের কবিতায়, জীবনের নিবিড় লিরিক এক ধ্বনিময় শব্দহীনতায় বেজে উঠেছে। লিরিক কবিতা সেকালে নিন্দিত অপগুণ হিসেবে চিহ্নিত জেনেও কবিরুল ইসলাম সংক্ষিপ্ত কাব্যশরীরে, সংহত আবেশে লিখে গেছেন একের পর এক লিরিক কবিতা। কবিতাকে কদাচ তিনি অকারণে দীর্ঘ করেছেন। ফলে কবিরুল ইসলামের কবিতা সমগ্রত একটিই কবিতা। অখণ্ড একটি ভাবনাবৃত্ত তার এক একটি কবিতার সমগ্রতাকে ছুঁয়ে থাকে। তাই সমগ্র কবিতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোনো পংক্তিকে উদ্ধৃতিযোগ্য করা যায় না। সংবাদের শিরোনাম হিসেবে তার কবিতা ব্যবহৃত হতে চায় না। বস্তুত বিচ্ছিন্ন ছত্র নয় তাঁর সমগ্র কবিতাই একটি কবিতা। বাক্যবন্ধের এবং ভাবনার এই সংহতিবোধ – কবিরুল ইসলামের নিজস্ব সম্পদ। একক অর্জন তাঁর। ভালোবাসা তাঁর কবিতার মহার্ঘ সম্পদ। কবিতায় আছে ভালোবাসা নিয়ে ঢের যুদ্ধ, আছে ঐশ্বরিকতা, আছে মৃত্যু বিষাদ, আছে আপাত আস্তিকের ঘরে ফেরা, আর আছে মানুষের কথা।
‘কেউ এসে বলে গেলো : এসো মানুষ এসেছে— বলো, ভাই এক মানুষ এসেছে।
ঐ মানুষের কাছে এসো
মানুষের মতো।’
কবিতা কবিরুলের কাছে ‘ঘরোয়া কথোপকথন’। স্বগত এক কুশল সংলাপ। ঘরোয়া এইসব কবিতার উপকথনে কবির নিজস্ব যাপিত জীবন উঠে এসেছে নিবিড় এক অত্মময়তায়। তাই অনেক সময় তাঁর কবিতা Escape from Personality-র কবিতা নয়। বরং তাঁর কবিতা ব্যক্তিত্ব চিহ্নিত কবিতা। নিসর্গলোক তাঁর কবিতার ঐশ্বর্য, প্রেম তাঁর কবিতার নিদান। মানুষ জগৎ সংসারকে যে ‘আমি’ দেখছে, সেই ‘আমি’ তাঁর কবিতার মুখ্য সঞ্চালক। এক ঐশ্বরিক নিরীশ্বরতা গোপন ছন্দে তার কবিতায় বেজে ওঠে। প্রেমে প্রতিবাদে বিষাদে বিশ্বাসে, তৃষ্ণায় ব্যর্থতায় কবিরুল ইসলামের কবিতা নিজস্ব মুদ্রায় ব্যক্তিত্ব চিহ্নিত। ‘যা কিছু ব্যত্তিগত তাই পবিত্র’ বলেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। কাব্যভুবনে একবার, মাত্র একবারই জীবনানন্দের সুর। বাকি কাব্যভুবন তাঁর নিজের সৃষ্টি। একবারই সে সুধীন্দ্রিয় স্বর:
‘বন্ধু এখানে ইতিহাস নিজকক্ষে
পুনরাবৃত্ত বৈচিত্র্যের ঢেউ
আসে না কখনো হাসে না তাপিত চক্ষে,
জোয়ারের জলে ভাসে না অকূলে কেউ।’
(‘বন্ধু, এখানে’ / ‘কুশল সংলাপ’)
একবার শুনেছি জীবনানন্দ দাশের কণ্ঠস্বর:
‘আজন্ম অমৃতে সাধ
বড় সাধ ভালোবেসে সমুদ্র হবার
একটি আশ্চর্য মুখ কি রকম ভালো!
পৃথিবী মানুষ মাটি
আকাশে সূর্যের শস্য
রৌদ্র জল হাওয়া—.এইসব ভালোবেসে জ্যোৎস্নার প্রান্তর হতে বড় সাধ ছিল’
(‘সহোদর, হে আমার উন্নিদ্র বিষাদ’ / ‘কুশল সংলাপ’)
সূচনালগ্নে ঐ একবারই দেখেছি আমরা, তাঁর কবিতায় তিরিশের কবিদের প্রভাব।
তিরিশের কবিদের থেকে প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রথম অভিভাবকত্ব পেয়েছিলেন ঠিকই। বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। এখনও আমরা দেখেছি, তাঁর বসার ঘরে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একটি স্মিতহাস্যমেদুর আলোকচিত্র মাথার উপরে শোভা পাচ্ছে, বোধহয় দত্ত কবির দেওয়া উপহার। তিরিশের কবিদের মহার্ঘ অভিভাবকত্ব আত্মস্থ করেই কবিরুল ইসলাম তৈরি করে নিয়েছেন তাঁর নিজস্ব কাব্যের জগৎ। সেই স্বরচিত কাব্যভুবনে তিনি বাস করেন একা একা। তাঁর আভরণহীন কবিতা সমগ্র জীবনের সমগ্রতাকে ছুঁতে চেয়েছে এবং ছুঁতে পেরেছে। জীবনের খণ্ড খণ্ড মুহূর্তের আবেগ-আহতিবোধ, সাফল্য ব্যর্থতা, প্রেমের মায়াবী আলোক তাঁকে নিয়ে গেছে রোদ্দুরের দিকে। তার পরিপার্শ্বের চেনা অচেনা ভুবনের সঙ্গে কবিরুল চেয়েছেন যোগযুক্ততা। তিনি যে আমাদের চেনা সংসারের একজন সদস্য— প্রতিটি উচ্চারণে তার প্রকাশ—
১.
‘হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি, চলো :
অন্ধকারে মুখের মতন কথা বলি
কণ্ঠের উত্তাপে ফুটবে ফুলের বাগানে
খুব অনায়াসে তুমি বুঝতে পারবে না
আছে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি চলো—
হেঁটে যাই, সন্নিকট সূর্যোদয়ে যাই।’
(হাঁটতে হাঁটতে / কুশল সংলাপ)
২.
কে আছে তোমার মতো?
কাকে
সব কথা বলা যায়, প্রসাধনহীন
ভালোবাসা, মধ্যবিত্ত দিন
সমর্পণ করা যেতে পারে
সব, দ্বিধাহীন।
কে আছে তোমার মতো দুঃখিত সংসারে প্রসাধনহীন মুখ দেখাতাম যাকে
কে আছে, আছো কে
মধ্যদিন চোখের আলোকে
কে আছে তোমার মতো আদিগন্ত আদি অন্তহীন।।
(‘সমর্পণ’ / বিবাহবার্ষিকী)
কবির ব্যক্তিগত দিনরাত্রি, তাঁর সংহত শান্ত জীবনযাপন কিন্তু কখনো তারও আছে উড়াল আড়াল, পরিপার্শ্বের সঙ্গে যুক্ত থাকার আকাঙ্ক্ষা। তাঁর চেনা রাস্তা পথঘাট, বাউল মন, রাঙাপথের ধুলা-খোয়াই অজয়। মফসস্ ল শহরের পথ ‘সাজানো আকাশ’ সবকিছুই তার চেতনার সঙ্গে যুক্ত। নিচের কবিতাটি পাঠকের মনে হতে পারে কবি নিজের ঠিকানার পথ নির্দেশ দিচ্ছেন। অবশেষে কবিতার একটি স্পেস পেরিয়ে এসে বোঝা যায় – তার তীর্থক্ষেত্র কিংবা গন্তব্য আসলে শান্তিনিকেতন।
পুলিশ প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌঁছলে
সামনেই সাজানো আকাশ
অদূরে স্টেশন, ব্রিজ দুবরাজপুর রোডের ওপর দু-একটি ট্রেন আসে, যায়।
ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডে বসো কিংবা হেঁটে যাও
চাঁদমারির টিলা, ওধারে অক্ষয়বট,পুলিশ লাইন
প্রবেশ নিষেধ।
শান্তিনিকেতনের বাস এই মাত্র ছেড়ে গেলো।’
(‘সিউড়ি পেরিয়ে’ / বিবাহবার্ষিকী)
শান্ত নিরাবেগ বর্ণনা কবিতাটিকে যেমন সংহতি দিয়েছে, তেমনি শেষ ছত্রটিতে ‘শান্তিনিকেতনের বাস এইমাত্র ছেড়ে গেল’ — সংবাদ জ্ঞাপনে কবিতাটি এক বহুমাত্রিকতা অর্জন করল—যা কেবল আর একটি স্টেটমেন্ট থাকল না। এ যেন রাবীন্দ্রিক ‘বলাকা’-র পক্ষবিধুনন গতির সমীপে। বোলপুর শান্তিনিকেতনের মাটি —প্রকৃতি তাকে হাতছানি দেয়, তার অনেক কবিতাতেই আমরা দেখেছি—
‘হঠাৎ দুদিন মুক্তি! কে জানতো বোলপুরে
কী হবে কে যাবে?
বলা নেই কওয়া নেই ডাকবাংলোর মাঠে
অপ্রস্তুত—
বন্ধুতার সুনীল স্বদেশে কয়েকজন
জ্যোৎস্নার সিংহাসনে জড়ো।
হঠাৎ কী হবে?
এই হাওয়া
যেন হাওয়ার সন্ন্যাসে কবিতার বীজ
বুনে গেলো।’
(‘সুনীল স্বদেশে’ / ‘তুমি রোদ্দুরের দিকে’)
বীরভূমের সুনীল আকাশ, রৌদ্রে নীলে ভরা আশ্বিন, শিশিরে শিশিরে সচ্ছল সংবাদ ১৯৭১-তে প্রকাশিত ‘তুমি রোদ্দুরের দিকে’ কাব্যগ্রন্থে কবি দাবি করতে পারেন ‘ব্যস্ততার বর্ম ছিঁড়ে ভান ছেড়ে তোমার সহজ হওয়া চাই / বীজের খোলস ছিঁড়ে রোদ্দুরের দিকে যাওয়া চাই।’ ষাট-সত্তরের দশকের ঝঞ্ঝাটবিধ্বস্ত সময়েও কবিরুল ইসলাম এমন সুনীল দৃষ্টিতে দেখতে পেরেছেন আকাশ-আলো-পৃথিবীকে।
‘হে ডাক পিওন,
তুমি আশ্বিনে আশ্বিনে
চিঠি এনো
আকাশে আকাশে,
চিঠি এনো
বাতাসে বাতাসে
নীল রৌদ্র চিঠি!
(‘রৌদ্রে নীলে আমার আশ্বিন’ / ‘তুমি রোদ্দুরের দিকে’)
কবিরুল ইসলাম যখন এ-সব লিরিক লিখছেন, ষাটের দশকের সেই সময়ে কবিতাকে
‘অ্যান্টি পোয়েট্রি’-র সমীপে উপস্থিত করার চলছে এক তুমুল আন্দোলন। ষাটের দশকের সেই সময়ে কবিতার বইয়ের নামকরণ হচ্ছে ‘গামছা ও অন্যান্য কবিতা’ (মানিক চক্রবর্তী), প্রেমিকার মুখের তুলনা করা হচ্ছে সাদা বেসিনের সঙ্গে, (দ্রঃ তুষার রায়ের ‘ব্যান্ডমাস্টার’)। কবিরুল ইসলাম তাঁর প্রেমের উচ্চারণে কখনো তাঁর রোমান্টিক মেজাজটিকে বিসর্জন দিতে চাননি। বরং অনায়াসে তিনি বলতে পেরেছেন ‘আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার।’ একদা তিনি যে রোমান্টিক চিঠি চেয়েছিলেন আকাশে আকাশে, সুনীল রৌদ্রে সে পত্রপ্রসঙ্গ পরবর্তী সময়ের কবিতাতেও আমরা উল্লেখিত হতে দেখি, রোমান্টিকতার শমিত লাবণ্যে। টেলিফোন নয় চিঠিপত্র তাঁর বেঁচে থাকার আনন্দ ও আশ্বাস। এই প্রায়-আশি বছর বয়সেও তিনি তরুণ অনতি তরুণদের বলেন ‘মাঝে মাঝে অন্তত একটি পোস্টকার্ড লিখো’। এই সেদিনও টেলিফোনে পেলাম তার সমাচ্ছন্ন নির্দেশনা। সুতরাং পত্রজীবী এই কবি অনায়াসে লিখবেন :
‘আমার চিঠি আমি নিজের হাতেপোস্ট করতে চাই যেমন প্রেমিকার কাছে যেতে চাই
যেমন চিকিৎসকের কাছে যাই
এ তো আর বারোয়ারি ক্লাস নয় যে
প্রক্সি দেওয়া যাবে।।
(‘আমার চিঠি’ / ‘কবিতা সমগ্র-২’)
এ উচ্চারণ যেমন ২০০২-এ প্রকাশিত ‘অবলম্বন’ কাব্যগ্রন্থের, তেমনি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কুশল সংলাপ’-এও। পার্থক্য এই, প্রথম দিকের আবেগ ক্রমশ অবসিত হয়ে এসেছে শেষের দিকে। ‘যেদিন সকালে কিছু চিঠি আসে, ভালো থাকি / খুব ভালো লাগে। (‘যেদিন কয়েকটি চিঠি’ / ‘কুশল সংলাপ’)। শুধু চিঠি নয়। সমগ্র চিঠির অতিরিক্ততা, প্রাপ্তির উপচে পড়া থাকে ‘পুনশ্চ’ অংশে। একদা তিনি পান করতে চেয়েছেন এই ‘পুনশ্চ’-এর উপচে পড়া ঐশ্বর্য। পুনশ্চের এই অতিরিক্ততা প্রেমের মহার্ঘতায় সমহিম :
‘একদা যেমন ভালো ছিল
তোমার মূল চিঠির চাইতেও পুনশ্চের সেইসব আমূল ডালপালা
প্রথম বয়স দু-হাত উপুড় করে বলে, নাও আমাকে লুণ্ঠন করো
আজ আমি শুধু অনভিপ্রেত সাক্ষী হয়ে পড়েআছি যে যা দেয়, বেলা ঘুরে যেতে না যেতেই কেড়ে নেয় তার হাজার গুণ বেশি
ফলত, সে চিঠি নেই, সে পুনশ্চও আর নেই।।
(‘পুনশ্চ’ / ‘বিকল্প বাতাস’)
প্রাপ্তির অতিরিক্ততা, সে তো জীবনের বহতা স্রোেত নয়, সে কেবল ব্যক্তিগত অর্জন। অনুভূতির গভীর থেকে উঠে আসা আলো, অভিজ্ঞতার সত্যাশ্রয়ী অগ্নিবেশ সে তো পরমার্থ হয়ে ওঠে প্রেমের স্পর্শে। কিন্তু সেই প্রাপ্তির কোনো ধারাবাহিকতা থাকে না। সে একজীবনে একবারই শুধু। বাকিটুকু অনুরূপতা, ফলত একরূপতা। অভ্যাস বহু ব্যবহৃত হতে হতে ক্লিশে হয়ে যায়। প্রেমের কবিতার পাঠককে শেষ পর্যন্ত এই দার্শনিক সত্যে পৌঁছে দেন কবি—
‘এক জন্মে একবারই সম্ভব শুধু
এক জন্মে মাত্র একবার
বাকি সব আধময়লা ঢিলে পাজামার মতো
বিবর্ণ অভ্যাসমালা
চুম্বন চুম্বন নয়,
আলিঙ্গন নয়।
একবারই শিশির ঝরে একজন্মে মাত্র একবার।’
(‘একজন্মে’ / ‘বিকল্প বাতাস’)
কখনো কখনো আমরা তাঁকে দেখেছি, তাঁর ব্যক্তিত্বের বিনম্র স্তব্ধতায়, সংবেদী বৈদগ্ধ্যে, গভীর দৃষ্টির ভেতর নিমগ্ন একাকীত্বে আমাদের কারো সঙ্গে কখনো মত বিনিময় করছেন, কথা বলছেন, মনে হয়েছে আমাদের, শ্রোতার উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে নিরন্তর চলছে নিজের সঙ্গে নিজেরই তাঁর বোঝাপড়া। স্বরাট তাঁর শিল্পের সংসার। তিনি রচনা করে চলেছেন ঘরের ভেতরে ঘর, বাড়ির ভেতরে নিজস্ব বাড়ি—
‘আমি নিত্য বাড়ির সন্ধানে আছি
আমি বাড়ির ভেতরে বাড়ি
ঘরের ভেতরে ঘর চাই’ —
এই উচ্চারণ আমাদের পৌঁছে দেয় তাঁর কবিতার বহুমাত্রিক দরজায়। তখন একটি দরজা হয়ে ওঠে ‘হাজারদুয়ারি’। অজস্র পথ ক্রমশ এসে মিলিত হয় অন্তর্ভেদী একটিমাত্র পথে।
‘একটাই দুয়ার আছে বেরোবার
হাজার দুয়ার খুলে ধরো।
একবার ঢুকে পড়লে আর সব দুয়ার বন্ধ হয়ে যায় গোলক ধাঁধার মধ্যে একবার ঢুকে গেলে
বেরোবার জন্যে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে
তোমার দুয়ার হাতড়ে মেলে। …’
(‘হাজারদুয়ারি’ / ‘বিকল্প বাতাস’)
এই প্রেমমহিম দার্শনিকতার ভেতর অন্তর্লীন রোমান্টিকতা কবিরুল ইসলামের কবিতার, অন্তত প্রথম পর্বের কবিতার এক উদ্দীপক উপাদান। আশির দশকে আমাদের স্কুল-কলেজ জীবনে তাঁর এমনতর বহু পংক্তি আমরা মুখস্থ বলতে পারতাম—
১.
‘আমার ঘরের মধ্যে যেটুকু উঠান
উঠানের মধ্যে যে বাগান
তুমি তার সবটুকু জুড়ে
রোদ্দুরে রোদ্দুরে
তোমারই সমান।’
২.
‘ভালোবাসা নিয়ে ঢের যুদ্ধ হয়ে গেছে
এই যুদ্ধ প্রাণের গানের
ভালোবাসা নিয়ে আরও ঢের যুদ্ধ হবে
এই যুদ্ধ মানাভিমানের।
এই যুদ্ধে জয় নেই, পরাজয়ও নেই
চলো যাই উৎসে উজানের
ভালোবাসা নিয়ে আরও ঢের যুদ্ধ হবে
এই যুদ্ধ আবহমানের।।’
৩.
’ফুরোলে পঁয়ত্রিশ বয়স
বাঘের মত তেড়ে আসে
শুধু দূর্বাঘাসে আর অসুখ সারে না।
মোড়ে মোড়ে ওড়ে শিস
ঠোঁটে ঠোঁটে হয়ে যায় রিলে
একটিমাত্র তিলে আর
সাম্রাজ্য কাড়ে না।’
পরিণত বয়সের অভিজ্ঞতায় এই কবি লেখেন ‘কী ঈশ্বর কিংবা নারী কাউকে আজীবন ভালোবাসা অসম্ভব…’। কবিতাটির শেষে তিনি বলেন ‘দু দণ্ডেই ধূলিসাৎ রাজ্যপাট সিংহাসন আদি / তবে কেন বৃথা আয়োজন …’ কবি জানেন ‘তবু আয়োজন’। তবু মানুষ ভালবাসতে চায় নারীকে, মানুষ প্রণত হয় ঈশ্বরের কাছে এবং কখনো সে হতে চায় ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী। কবিরুল ইসলাম একই সঙ্গে আত্মনিবেদিত এবং অনীশ্বরতার স্বাধীনতায় দীক্ষিত। আত্ম নিবেদনে কবি লেখেন
‘আমার সমস্ত কিছু জুড়ে
তোমার নিঃশব্দ সংকীর্তন
সেই সূর্যে শষ্যের দুপুরে
প্রতিদিন আত্ম নিবেদন।
রোজ ভোরে তোমার নিঃশ্বাস
আমাকে শতধা শুদ্ধ করে,
বস্তুত আমার বসবাস,
তোমার সাকার চরাচরে।’
(‘আত্মনিবেদন’ / বিবাহ বার্ষিকী)
কিংবা
‘আমি তো আনত আছি, অবনত আছি
সিজদায় যাবার মুখে নামাজী যেমন
আরও যে কদিন বাঁচি বাঁচার সমগ্রে
আমি তো বিনত আছি, পদানত আছি।’
লক্ষণীয়, কবিরুল ইসলামের শব্দের ব্যবহার বিশুদ্ধ কথ্যরীতির বাংলা কিংবা তৎসম শব্দ। কদাচ তাঁর কাব্যভুবনে আরবি ফারসি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। সেদিক থেকে ‘সিজদা’ (প্রণিপাত) কিংবা ‘নামাজী’ শব্দের ব্যবহার খুব ব্যতিক্রম একটি প্রয়োগ। কখনো কখনো তাঁর কবিতা সহজিয়া বাউল তত্ত্বের লোকজ আধ্যাত্মিকতায় গৈরিক। বাউলের মতোই রৌদ্রালোকিত তাঁর আত্মআবিষ্কার দর্শন :
‘তাহলে সবই কী প্রচ্ছদ, ছদ্মবেশ?
অর্থাৎ বিশদ অভিনয়
শুধু ঘুমের সময় খুলে
যত্নে তুলে রাখা হাতের নাগালে
স্বপ্নের ভিতরে দুই স্বপ্নহীন ভুলে
পুতুল না, প্রতিমা না
তাহলে নিজের সঙ্গে আর কবে বোঝাপড়া হবে।।
(‘সবই কী প্রচ্ছদ’ / কাব্যসমগ্র-২)
কিংবা
‘চতুর্দিকে মধ্যদুপুরে
কারা স্নান করে যাচ্ছে কাদের পুকুরে
ওইটুকু মাত্র সময়
সুতরাং হেলাফেলা নয়
এইবেলা সব ছেড়ে ছুড়ে
ঐ ঘাটে ডুব দাও মধ্যদুপুরে।’
(‘মধ্যদুপুরে’ / ‘তুমি রোদ্দুরের দিকে’)
দ্বিতীয় কবিতাটির রচনাকাল সাতের দশক, প্রথমটির সময় ২০০২। এ তথ্যটুকু না জানালেও কবিতা দু-টির সময়ের ব্যবধানে স্বরগত পার্থক্য অনায়াসে বোঝা যায়। কবির এই আত্মনিবেদন কখনো প্রশ্নাতীত নয়। আত্মনিবেদনে আত্মবিস্মৃত হন না কবি। বরং তিনি প্রশ্নার্ত। ফলত তার জিজ্ঞাসা—
‘আমার নাস্তিক্য নিয়ে এত প্রশ্ন কেন
যতোটা আস্তিক তুমি ঠিক ততোটাই
কিংবা তারও বেশি আমি ….
শিকড়ে বাকড়ে
৬৪ বছর যাচ্ছে ৬৫-র দিকে
তিন-কুড়ি দশ আর ঠিক কতদূর!’
বাঁচার সমগ্রে ‘শিকড়ে বাকড়ে’ ওতপ্রোত তাঁর জীবনযাপন। এই সমাজবদ্ধতার সবটুকুই নিঃসংশয় নয়। প্রশ্নহীন নয়। নয় প্রতিবাদহীন। তবু প্রতিবাদেরও তাঁর এক নিজস্ব ভাষা আছে। প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করেও তিনি ফিরিয়ে দেন নম্র নমস্কারে। তাঁর বিরক্তি এবং অপছন্দ জানান দিতে তিনি উত্তেজিত হন না। শুধু তার বলে ওঠা বিবৃতি; আবেগ উত্তেজনাহীন। কেননা তিনি জানেন কবির যাপিত জীবন নিয়ে কোনো সংবাদ শিরোনাম হয় না। কেননা তাঁর ‘কোনো নিজস্ব সংবাদদাতা নেই।’ পরিপার্শ্বের শুধু মিথ্যার মুখোশ, মিথ্যার মিছিল। কবি দেখেছেন, তার বাঁচার পরিবেশ-প্রতিবেশ প্রতিদিন নোংরা হচ্ছে ‘ভুল বানানে’। কবি দেখতে পান সেই অদৃশ্য দেওয়াল লিখন। এতসব দৃশ্যদূষণে আর কোথাও নয়, শুধু ভূমিকম্প হয় কবির ভেতরে ভেতরে—
“শুধু ভুল বানানের দেওয়াল-লিখনে আরও একটু
ক্লিষ্ট হয় আমার শহর
হায়, কেউ পড়তে পারে না।
আরও কিছু ধুলো ওড়ে, ঢের বেশি শব্দ ওড়ে,
শকুনেরা ওড়ে
পঙ্গপালের মতো।
অথচ আমার ব্যক্তিগত ভূমিকম্পে
আমি ছাড়া কেউ আর
ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।…
(‘খসড়া’ / ‘বিদায় কোন্নগর’)
কিন্তু এই সামাজিক অসঙ্গতিতে, দ্বিরালাপে কবির করণীয় কী! সক্রিয়তা বলতে শুধুই ‘উন্মোচন’! নিজের স্বস্তিহীনতার উন্মোচন? পরিবর্তনের ভূমিকাটা তবে কি নেবেন কবির ঈশ্বর! (আমাদের মনে পড়বে ঈশ্বরের ভূমিকাটা আবুসয়ীদ আইয়ুব দিতে চেয়েছেন কবির হাতে।)
‘আর কেন মিথ্যা, প্রভু
মিথ্যার মিছিলে
লাঠিচার্জ টিয়ার গ্যাসে ছিন্নভিন্ন করো
আর কেন মুখোশ, প্রভু
মুখের অমিলে
করো ছিন্নভিন্ন
ধুয়ে দাও তীর্থসলিলে।।’
(‘উন্মোচন’ / ‘বিকল্প বাতাস’)
কবিরুল ইসলামের কবিতা সমগ্র মুখ ও মুখোশের আড়াল ঘোঁচানোর ‘তীর্থসলিল’। তাঁর জীবনদর্শন এবং যাপিত জীবন একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক এবং আধুনিক, মরমী নাবিকের এবং সচেতন নাগরিকের। প্রেমার্ত এবং প্রশ্নার্ত। সূর্য মেঘ জল বৃষ্টি রোদ্দুর, হাওয়া, পাতা, শেকড়, দূর্বাঘাস তাঁর কবিতার পৌনঃপুনিক উপমা। তাঁর কবিতার রৌদ্র-উজ্জ্বল ভূখণ্ড আমাদের এক অলৌকিক সমন্বয়ের কথা বলে। বেঁচে থাকার সংকট এবং বাঁচার আনন্দ তার কবিতাকে ছুঁয়ে থাকে। জীবনযাপনের অতিরিক্ত অতীন্দ্রিয়তা তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু নয়। কালীকৃষ্ণ গুহ-র আত্মমগ্নতা তাঁর নেই; নেই সুব্রত চক্রবর্তীর ভয়াল অসহায়তা। তাঁর আছে জীবনের সঙ্গে লগ্ন থাকার ব্যাকুল প্রয়াস। তাঁর প্রায় সব কবিতাই এক ধরনের ব্যাকুলতার কবিতা। তাঁর যোগযুক্ততা একান্ত জাগতিক চাওয়া পাওয়ায়। পাওযার চেয়ে না-পাওয়ার প্রতিই তার আসক্তি। প্রেম ও দার্শনিকতা তার কবিতায় প্রায় সমধর্মী। দার্শনিকতার মধ্যে রোমান্টিক আততি তাঁর সময়ের আর কোনো কবির কবিতায় সেভাবে পাওয়া যায় না।
আমরা যারা তাঁর কবিতার পাঠক, ব্যক্তিগতভাবে কবিকে চিনি, আমাদের বাল্য কৈশোর পেরিয়ে, চল্লিশ পরবর্তী বয়সে পৌঁছে আজও দেখছি কবিরুল ইসলামের একাকীর জগৎ। শিল্পের সংসারে তাঁর একাকিত্বের শিল্পিত সংরাগ। সুদর্শন তাঁর রোমান্টিক চেহারায় (যে রোমান্টিক চেহারায়, আয়ত গভীর মর্মভেদী দু-টি চোখে আমাদের আবাল্য বিস্ময়) আজ বার্ধক্যের ভার। জরা তাঁকে স্পর্শ করেছে এবং কিঞ্চিৎ হতাশা। তবু আজও তিনি কবিতা লিখছেন। এখনো তাঁর প্রত্যাশা তরুণ কবিদের কবিতা সন্ধ্যায় মুখরিত হবে রাত্রিলোক; তরুণেরা তাঁকে চিঠি লিখুক, স্পর্শ দিক। তাঁর কবিতা-সামগ্রে আমাদের আগ্রহী অবলোকন আজ একটিই প্রশ্ন তোলে — একযুগ ধরে প্রতিষ্ঠান, অপ্রতিষ্ঠান লিটল ম্যাগাজিন সর্বত্র লিখলেন, তবু আজ তিনি আমাদের চোখের আড়ালে চলে গেলেন কেন? শিবনারায়ণ রায় এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘বাঙালি কবিতারসিক মহলে তাঁর যতটা আদর পাওয়ার কথা, তা যদি তিনি এখনো না পেয়ে থাকেন, তার একটা কারণ সম্ভবত তার মফস্সল নিবাস এবং অন্য কারণ হয়তো তাঁর উদাসীন প্রকৃতি।’ হয়তো এই স্বভাব উদাসীনতা কবিরুল ইসলামকে একা করেছে। একজন কবির মফসসলবাস অর্থাৎ এক রণক্ষেত্র। কবিতার মূল স্রোতে থাকতে চাওয়ার যুদ্ধ। যতক্ষণ যুদ্ধ করে জানান দিতে পারেন আমি আছি, ততক্ষণ তার অস্তিত্ব। কিন্তু সব সৈনিককেই একদিন অবসর নিতে হয়। মফসসলবাসী কবিসৈনিক নগরকেন্দ্রে যুদ্ধযাত্রা করতে না পারলে নাগরিক বন্ধুরা তাকে ভুলে যান। বাংলা কবিতার ভূগোলে, ইতিহাসে এমনটি অনেকবার ঘটেছে। মফসসলবাসী কবির এটাই নিয়তি।