এ কে আজাদ
১৭২৬ সালের কথা। প্রকাশিত হলো ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত স্যাটায়ারিস্ট জনাথন সুইফট এর রম্য রচনা “গালিভারস্ ট্রাভেলস্’’। পড়ে গেল হইচই। আর হই চই পড়বেই না বা কেন? সমকালীন রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি সব কিছুই তো উঠে এসেছে চমৎকার ব্যঙ্গ রচনায়। তাই তো সাহিত্যপ্রেমীদের মনে সারা জীবনের জন্য নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন জনাথন সুইফট।
সে যাই হোক, বাংলা সাহিত্যে খুব কম সংখ্যক কবি এবং ছড়াকারের সাহিত্য-কর্মে বিধৃত হয়েছে এমন রসময় ব্যঙ্গ রচনা। বিংশ শতাব্দীর সমাপনী চতুর্থাংশ থেকে শুরু করে একবিংশ শতকের সূচনা পর্ব পর্যন্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখযোগ্য সময় ধরে এক মাত্র সাজজাদ হোসাইন খানই বাংলা সাহিত্যে এই ধারা অব্যহত রেখেছেন। বর্তমান বাংলা সাহিত্যে তিনিই একমাত্র জাত ছড়াকার, যিনি ছড়ার মূল গতিধারাকে সচল রেখেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে সত্তরের দশক থেকে। ব্যাঙ্গাত্মক রস বা হাস্যরস যেন তাঁর ছড়ার মূল সুর। তবে সে সুরে সুদূর প্রসারী ঐক্যতান আছে, আছে শুদ্ধাচারের নীতি-দর্শন। তাঁর ছড়া নৈতিকতার প্রগাঢ় আহ্বানে ভরপুর। তবে সে আহবানের ভাষা যেন সরল পথে নয় খানিকটা বক্র, আছে ছড়ার নানান ছন্দচক্র। কেননা দেশ-ভূঁই সবখানে, রাজনীতির ময়দানে, সমাজনীতির গর্দানে এবং সর্বোপরি ক্ষমতার মস্তিষ্কে কেবল দুষ্টচক্র। এই দুষ্টচক্রকে যেন বাবার শাসনে সন্তানকে সৎপথে আনার প্রয়াস। তাই তো ক্ষিপ্ত বাবার দৃপ্ত শাসন, ছন্দের পয়ারে মৃদুমন্দ ভাষণ। বোধ করি, এ কারণেই সাজজাদ হোসাইন খানকে জনাথন সুইফটের সাথে তুলনা করা যায়। তাঁকে অভিহিত করা যায় বাংলার জনাথন সুইফট নামে।
স্যাটায়ারিক্যাল রাইম বা ব্যঙ্গ ছড়ার মূল প্রতিপাদ্য হলো কারেকশন অব দ্যা সোসাইটি বা সমাজের সংশোধন। তার জন্যই ছড়াকারের খানিকটা রসের এবং খানিকটা কষের ছান্দসিক ভাষণ। এই ভাষণের বহুমাত্রিক প্রকাশের নামই যেন সাজজাদ হোসাইন খানের “প্রেমের বরাক বাঁশ’’। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ। প্রকাশক- আত্মপ্রকাশন, পল্লবী মিরপুর, ঢাকা। বইটির অর্থবহ সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী হামিদুল ইসলাম।
সেই ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় সাজজাদ হোসাইন খানের ছড়াগ্রন্থ “রাজার কথা প্রজার কথা’’। সেই সময়ে তিন দিয়েছিলেন অ্যালিগোরিক্যাল ব্যঙ্গ-ভাষণঃ-
চালে ডালে সব জিনিসেই জড়িয়ে আছে সোনা,
গতর থেকে গোস্ত উধাও হারগুলো যায় গোনা।
দেশটা জুড়ে মাতম কিসের কিই বা এমন হলো,
মনের কথা কইতে গেলে লাল দালানে চলো। [মাতম]
সেই ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৫, দীর্ঘ ৩৭ বছর পরে এসে “প্রেমের বরাক বাঁশ’-এ সাজজাদ হোসাইন খান লিখেছেনঃ-
রাজপথে রাজনীতি
ফুটপাতে ব্যবসা
চাঁদাবাজ ঘুষখোরে
ছিঁড়ে বুঝি জনতার
তরতাজা ফ্যাপসা। [মনস্তাপ]
ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খানের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৬ মে। অর্থাৎ তিনি ব্রিটিশ শাসনের অব্যবহিত পরেই এই উপমহাদেশের অবস্থা স্বচক্ষে দেখেছেন, দেখেছেন পাকিস্তান আমলের জীবন চরিত এবং এখন দেখছেন বর্তমান বাংলাদেশের সমাজ চিত্র। সেই ১৯৭৮ এর ছড়া আর ২০১৫ সালের ছড়া, দীর্ঘ ৩৭ বছরেও যেন বদলায়নি সাধারণ মানুষের ভাগ্য।
১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। দেখতে দেখতে প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চললো স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স। কিন্তু সে স্বাধীনতা যেন পরিপক্ক হয়ে আজও শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে পারেনি। বোধ করি সে কারণেই হয়দার হোসেন এর গান:
“কি দেখার কথা কি দেখছি………..
তিরিশ বছরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি।”
কারা যেন সুকৌশলে আমাদের মনের চোখকে রেখেছে বেঁধে। আমাদের কথাবার্তা চাল চলন থেকে আজও মুছে যায়নি ছেলেমীর ভাব। আক্ষেপ করে সাজজাদ হোসাইন খান লিখেছেনঃ-
বয়স খানা অর্ধশতের কাছাকাছি
চলছে তবু পুতুল বিয়ের নাচানাচি।
………………………………
চোখের মগজ করছে কারা ঘোলা
মনের কাঁধে ছিন্ন কাঁথার ঝোলা।
আকল দাঁতের নেই যে দেখা উঁকি
বুকের ঘরে ঘৃণার আঁকি বুঁকি। [আকল দাঁত]
সাজজাদ হোসাইন খান সমাজের সফল চিত্রকর। রঙ পেন্সিলের পরিবর্তে শব্দের বুননে সমাজের অন্ধকার চিত্রকে অতি চমৎকারভাবে চিত্রায়িত করেছেন তিনি অতি দক্ষতার সাথে। তবে প্রশ্ন জাগে কেবল অন্ধকার দিকটাকেই কি চোখে দেখেন তিনি? তবে হ্যাঁ এ কথা মেনে নিতেই হয় যে, সমাজের কদর্যতা, অসঙ্গতি, অসুন্দর এসবই যেন সাজজাদ হোসাইন খানের উপজীব্য। একটা সমাজের শুধু কি অন্ধকার দিকই আছে? একটা জাতির কেবলই কি নৈতিকতা-বিবর্জিত দিকটাই আছে? কোন কিছুই কি ভাল নেই? হ্যাঁ আছে। অবশ্যই আছে। কিন্তু যা ভালো আছে, তাকে তো আর ভালো করবার দরকার নেই। যা ভালো নেই, অন্ধকার- যেখানে আলো নেই, তাকে তো ভাল করবার এবং আলোময় করবার দরকার অবশ্যই আছে। ইংরেজি রোমান্টিক যুগের কবি পার্শি বিশি শেলী, জন কিটস্ আর বায়রনদের মত রিফরমিং বা সংস্কার সাধনের জন্য কাজ করাও যে কবিরই কাজ। তাঁদের মতে – পোয়েটস্ আর দ্যা রিফরমার – অর্থাৎ কবিরাই সংস্কারবাদী। সুতরাং কবিকে তো সমাজ সংস্কারকের দায়িত্ব নিতেই হয়। তবে কবিরা অস্ত্রযোদ্ধা নন, ঘাড় ধরে কিংবা মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে কাউকে কোন কাজ করতে বাধ্য করা কিংবা কোন কাজ থেকে কাউকে বিরত রাখাও কবির কাজ নয়। কবির কাজ কেবল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া। তবে সেই দেখিয়ে দেবার ঢং একেক জনের একেক রকম। আর সাজজাদ হোসাইন খানেরটা না হয় একটু ভিন্নরকম। তাতে কি, কাজটাই তো আসল। তবে হ্যাঁ, এত নিরাশা আর হতাশার মাঝে ব্যঙ্গ ছড়া কাটা দেখে প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে যে, তিনি নৈরাশ্যবাদী কি না। ডযবঃযবৎ যব রং ঢ়বংংরসরংঃরপ ড়ৎ হড়ঃ.
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যায় থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত একটা বিরাট সময় জুড়ে ইংরেজি সাহিত্যে নৈরাশ্যবাদীদের পদচারনা বিদ্যমান। তাঁরা হতাশ। তাদের চোখে জীবনের কোন ক্ষেত্রেই যেন আশার আলো নেই। জীবনকে তারা দেখেন বাঁকা চোখে। জীবনের সব বিষয়ে তারা যেন বীতশ্রদ্ধ। বিতৃষ্ণার বেড়াজালে জীবনের যেন হা-পিত্তেস। সাহিত্যের ইতিহাসে তারাই পেজিমিষ্ট বা নৈরাশ্যবাদী নামে অভিহিত। বাংলা সাহিত্যেও জীবনান্দ দাশ, শুকান্ত ভট্টাচার্য, কাজী নজরুল ইসলাম এই নৈরাশ্যবাদীদের অন্তর্ভূক্ত বলে অনেকেই মনে করেন। তবে অতি উৎসাহী সম্রাজ্যবাদের ধ্বজাধারী কেউ কেউ কাজী নজরুল ইসলামকে অবশ্য নৈরাশ্যবাদীর পরিবর্তে নৈরাজ্যবাদী বলেই আত্মতৃপ্তি বোধ করেন। সে যাই হোক, আমাদের আলোচ্য ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খানের দিকে এবার মনোনিবেশ করা যাক।
সাজজাদ হোসাইন খানের “প্রেমের বরাক বাঁশ”-এ বিধৃত সমাজ বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি ফেরালে আমরা খুঁজে পাই সমাজের নানান অসঙ্গতি। সে অসঙ্গতি সামাজিক অবক্ষয়ের ইতিপাঠ। “দিন বদল” নামক ছাড়ায় সাজজাদ হোসাইন খান লিখেছেন-
জং ধরেছে মগজে/ জং লেগেছে ঠোঁটে
অসুধপাতি ছাই ঘষাতে/ এসব কি আর ওঠে!
চোখের ভেতর ঢাললো কারা সিসা
ফর্সা রোদে হারাই কেবল দিশা।
অনিয়ম, অনাচার, অত্যাচার নিপীড়ন সবই যেন আজ আমাদের নিত্যসঙ্গী। চোখের উপর অনিয়ম হয়, অনাচার হয়। কেউ দেখে না, কেউ লেখে না; কেউ ভাবে না কিছু। সবাই যেন ছুটছে আজ কালো হাতীর পিছু। অন্ধকার অমানিশা ঘিরে ফেলেছে জাতির বিবেক। টাকার কাছে, ক্ষমতার কাছে সবাই যেন বিক্রী করেছি আমাদের বিবেক বুদ্ধি। ন্যায় নীতি আজ নির্বাসিত সুন্দরবনে। আমরা কেবল বদলের ¯োগান শিখেছি- বদলে যাও, বদলে দাও। বদলাতে বদলাতে আমরা রাতের অন্ধকারের সাথে বদল করেছি আমাদের হৃদয়ের আলো, ভালোর বদলে মন্দ, আর ছন্দের বদলে দ্ব›দ্ব আজ আমাদের নিত্যসঙ্গী। জাতীয় বিবেকের ঘরে তালা দিয়ে আমরা সবাই যেন ছুটে চলেছি মানসিক দূর্নীতির আস্তাকুঁড়ে। ছড়াকার লিখেছেনঃ-
দিন বদলের পালা
বাক্সে রাখো বিচার বিবেক
চোক্ষে লাগাও তালা। [অদল বদল-২]
কিন্তু এমন কেন হলো? কি কারণ আছে আমাদের এই নৈতিক অবক্ষয়ের পেছনে? সাজজাদ হোসাইন খান মনে করেন- আমাদের মস্তিস্ক পঁচে গেছে। দেশের চালকের আসনে যারা বসে থাকেন তারা আমাদের রাজনীতিবিদ, তারা মন্ত্রী, তারা এমপি, তারা প্রশাসক, তারা শাসক। কিন্তু এই শাসকেরা আজ শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। নৈতিক চরিত্র বলতে যা বুঝায়, আমাদের রাজনীতিবিদদের ভেতরে তা আজ নেই। তারা জনগণকে ঠকান। তারা ধুরন্ধর। তাদের উদ্দেশ্য জনকল্যাণ নয়, তাদের উদ্দেশ্য আত্মকল্যাণ। সাজজাদ হোসাইন খানের ভাষায়ঃ-
যেন তেন প্রকারে
জনগণ ঠকারে,
তবু তিনি নেতারে
এলানটা বেতারে। [নেতা ও জনগণ]
মিছা কথার উড়াও নিশান/ ঘুরাও নাওয়ের বৈঠা,
সঙ্গে রাখো ভাঁওতাবাজির/ রাজনীতির ঐ মৈটা। [নেতা]
সুনীতির পরিবর্তে আমাদের রাজনীতিতে আজ সংঘাতের উত্থান। স্বার্থপর রাজনীতির কদর্যরূপ সাজজাদ হোসাইন খানের ছড়ায়ঃ-
নেতা চোষে ললিপপ/ জনগণ কাঠি
গদি নিয়ে হররোজ/ মাথা ফাটাফটি। [গদি]
যারা রাজনীতিবিদ তারা শহরে থাকেন। শহর কেন্দ্রিক আমাদের সভ্যতার উত্থান। প্রতিটি শহরেই শহর-কেন্দ্রিক একটা প্রশাসন থাকে। এই প্রশাসনের একজন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি প্রশাসক থাকেন। শহুরে জনগণের মানোন্নয়ন, নগর উন্নয়ন প্রভৃতি তার অওতাধীন। কিন্তু সেখানেও দূনীর্তির জগদ্দল পাথর যেন চেপে বসে আছে ঘাড়ের উপর। জনগণের ট্যাক্স আদায় করে প্রতিনিয়ত সেখানে অবাধে চলে বানরের রুটি ভাগের মহোৎসব। নগর সভ্যতার আঁড়ালে অসভ্য লোকদের উত্থান ও উৎসব যেন বিস্বাদ আর দুর্বিসহ করে তোলে নাগরিক জীবন। ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেতার পরিবর্তে যেন দৈত্যের বসবাস। সমস্ত সুযোগ সুবিধা নিয়ে নেতারা থাকেন চাঁদে, আর মাটির মানুষের জন্য কেবলই অসুস্থ ও আস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কীটের মত জীবন যাপন। ঠকবাজ দাগাবাজদের শহরে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে ধূর্তদের গলাবাজি। নগর জীবনের এমন দুর্বিসহ সময়ের ইতিহাস আর নেতাদের স্বার্থপরতার বয়ান যেন তৈলচিত্র লাভ করে শব্দ-শিল্পী সাজজাদ হোসাইন খানের শব্দের বুনোনেঃ-
বিভীষণের হল্লা শুধু বৃক্ষসীমায়
বিদ্বজনের সিদ্ধ মগজ দাওয়ায় ঝিমায়;
তক্ত পোশের শক্ত জমীন রক্তমাখা
নগরব্যপী পুষ্পবনে দৈত্য আঁকা। [ওমা!]
নেতা আমি সত্য বলি/ মিথ্যা বলা পাপ
যদিও রাখি জিবের তলে/ ধূর্ত কালো সাপ। [ধান্দাবাজ]
পৌরসভার খৌরকারে সৌরে করেন বাস
সেখান থাকে পাঠান তিনি প্রেমের বরাক বাঁশ।
রাঙা ইটের ভাঙা সড়ক ডেঙ্গু মশার বাপ
উপচে পরা নর্দমা আর করের পানখ সাপ।
খড়ের মত চরের জমি হচ্ছে বেহাত রোজ
ফুটপাতে হায় মস্ত বাজার নেই যে পথের খোঁজ।
ভবন জুড়ে পবন ঘুরে চ্যাবনপ্রাশের থলি,
নগর ভরা ঠগের মামা করছে গলাগলি। [প্রেমের বরাক বাঁশ]
‘প্রেমের বরাক বাঁশ’ ছড়াটি এই ছড়া-সংকলনের শিরনাম ছড়া। নামটাই যেন ব্যঙ্গোক্তিমূলক অভিব্যক্তির উচ্চমাঙ্গের বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ, সমাজপতি, নগর পিতা, প্রশাসক ও শাসকদের ভালবাসা জনগণের জন্য কতটুকু, তারা কতটা জনকল্যাণে কাজ করেন এবং প্রতিবেশী রাস্ট্র আমাদের এই দেশের সাথে কি রূপ আচরণ করে তার প্রতিচ্ছবি যেন “প্রেমের বরাক বাঁশ”। বক্রোক্তিতে প্রেমের সাথে বাঁশ- এ যেন চমৎকার শব্দের স্যাটায়ারিক্যাল সম্মিলন।
আর শিল্পী হামিদুল ইসলামও ধন্যবাদ পাওয়ার দাবীদার সুন্দর স্যাটায়ারিক্যাল প্রচ্ছদের জন্য। বাঁশের আগায় শহুরে পোষাক পরা নাগরিকের ছবি। এ যেন নির্দিষ্ট কোন বইয়ের প্রচ্ছদ নয় এ যেন বাংলাদেশের নগর সভ্যতায় ভীত সন্ত্রস্ত, অতীষ্ট মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের মুখচ্ছবি। এ যেন নগর জীবনেরই প্রচ্ছদ।
সাজজাদ হোসাইন খান কেবল রাজনীতি সচেতন ছড়াকারই নন, বাঙালী সংস্কৃতির প্রতিও রয়েছে বুব ভরা দরদ। অধিকাংশ ছড়াতে রাজনীতি, সমাজনীতি এবং নেতা নেত্রীর অপকর্ম ও কুকর্মের ব্যঙ্গাত্মক প্রকাশ থাকলেও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিদেশী প্রভাব এবং আমাদের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বের প্রতিও অঙ্গুলী নির্দেশ করতে ছাড়েননি তিনি। তিনি লিখেছেন-
কালচারে ভালচার/ ইতিহাসে কুড়া
ভূগোলের ধারাপাত/ বুঝি গুঁড়া গুঁড়া।
বুদ্ধির তেজারতি/ ঘরে মাঠে ঘাটে
বিবেকের চৌকাঠ/ উইপোকা কাটে। [কাঁচকলা]
বাঙালী উৎসব ঐতিহ্যের প্রতিও সাজজাদ হোসাইন খানের রয়েছে অগাধ বিশ্বাস, আর মানসিক টান।
সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের মানুষের এক সময় অবসর ছিল। সেই অবসরে বনভোজনের নামে আমোদ প্রমোদ হত। কোথাও বনের ভেতর গিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে অত্মীয় স্বজন মিলে এক সময় বেড়ানো হত, রান্না করে খাওয়া হত। বনভোজনে মজা হত খুব। কখনো নদীতে বা গাঙে করা হত নৌবিহার। সময়ের বিবর্তনে আজ বড় বেশী যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে মানুষের জীবন। অবসর নেই, বেড়ানোর মত ফুরসত নেই। বহু কষ্টে একটু সময় বের করতে পারলেও বেড়ানোর মত জায়গা নেই। বন কেটে উজাড় করা হয়েছে। নদীতে পানি নেই। প্রায় নিঃশেষ হতে চলেছে নৌকার ব্যবহার। আর ছোট ছোট গাঙ বলতে যা বুঝায় তা যেন আজ কেবলই ইতিহাস। তাই বলে ফাঁক ফোঁকরে লোকজন যে বনভোজনে যাচ্ছে না তা নয়। হ্যাঁ যাচ্ছে, ঐ শহরের আশে পাশে কোথাও কোন ঐতিহাসিক পতিত জমিতে। দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে? না মিটুক। তবুও বনভোজন নাম দিয়ে স্বাদ নেবার চেষ্টা। সাজজাদ হোসাইন খান তার “বনভোজন” ছড়ায় লিখেছেনঃ-
আহার করো বনের ভেতর/ বিহার করে গাঙে
এমনতর সংজ্ঞা এখন/ উঠলো বুঝি চাঙে।
সোনার গাঁওয়ের ভাঙা হোটেল/ আশুলিয়ার চর
বনভোজনের মেকি আসর/ বসছে থরে থর।
বনবাদাড়ের বৃক্ষ উজাড়/ নিপানিতে গাঙ
ভোজন রসের শখের হাঁড়ি/ মাথার তালুত ভাঙ।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিশেষ অবদান রেখেছে ডাক বিভাগ। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে খবরের আদান প্রদানে ডাক বিভাগের অবদান অনস্বীকার্য। এমনকি পোষ্ট অফিসই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম- তা সে ব্যক্তিগত যোগযোগই হোক, পারিবারিক যোগযোগই হোক, আর রাষ্ট্রীয় যোগযোগই হোক। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পোষ্ট বাকশোগুলো যেন ছিল গণমানুষের হাসি-কান্না আর দুঃখ-ব্যাথার একমাত্র সাথী। কিন্তু কালের বিবর্তনে আর পোষ্ট অফিসের সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবহেলা, অপকর্ম, অযোগ্যতা আর অযতেœর কারণে পোষ্ট অফিসের কদর প্রায় শূন্যের কোঠায়। সে স্থান দখল করে নিয়েছে অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতির আর অন্তরিক সেবার কুরিয়ার সার্ভিসগুলো। আবার কোন ক্ষেত্রে অফিসিয়াল পত্র যোগযোগের মাধ্যম হয়েছে ইন্টারনেট, ইমেইল। আর ব্যক্তিগত যোগযোগের ক্ষেত্রে দেশে কি বিদেশে কোনখানেই চিঠি বা পত্রালাপের প্রয়োজন পড়ে না। সে স্থান দখল করেছে মোবাইল ফোন। ফুরিয়ে গেছে চিঠি-সাহিত্যের দিন। চিঠি বহনকারী রানার কিংবা ডাক পিয়নের আশায় এখন আর কেউ পথ চেয়ে থাকে না। আবেগঘন কথামালার সুবিন্যস্ত কিংবা অবিন্যস্ত কাঁচা কিংবা পাকা হাতের লেখা চোখে পড়ে না আর। দূরপরবাসী কোন প্রেমিকের রসময় কথামালার ফুলঝুড়ি কিংবা নীল খাম পাবার আশায় বুক বাঁধেনা আর দূরের কোন প্রেমিকা। চিঠির পরিবর্তে এখন ইঁদুর, চিকা, কিংবা আরশোলা বাস করে ডাক বাক্সের ভেতরে। কলকব্জা খুলে ডাক বাকশের বেহাল দশা আজ। কেউ ফেলে না কোন চিঠি, আসে না এবং খুলে দেখে না কোন ডাক পিয়ন। দেখবে কি? ডাক পিয়নের প্রয়োজনই যেন আজ প্রায় শেষ। তাই তো রোদ বৃষ্টি ঝড়ে বড় অভিমানে মুখ বুঁজে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে ডাক বাকশো। ইতিহাস ঐতিহ্য সচেতন ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খানের চোখ এড়িয়ে যায়নি পোষ্ট বক্সের এই বেহাল দশাও। তাই তো তিনি লিখেছেনঃ-
কেউ ফেলে না চিঠির তোড়া/ প্রেমের রঙিন খাম
শূন্য বুকে ডাকবাক্স/ হাওয়ায় লেখে নাম।
মোড়ে মোড়ে রোদন করে/ চিঠির ঝোলা লাল
কপাল পুড়ে ডাক পিয়নের/ হাসছে মহাকাল।
কোথায় গেল কাগজপাতি/ কাটবে কুটুর কুট
মুঠোফোনের দারুন ডাকাত/ করলো সবই লুট। [ডাকবাক্স]
বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। প্রায় হাজার খানেক নদী প্রবাহিত হয়েছে বাংলাদেশের উপর দিয়ে। অধিকাংশ নদীর উৎপত্তিস্থল প্রতিবেশী দেশ ভারতে। হিমালয় পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে কোন কোন নদী ভারত বাংলাদেশ উভয় দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিশে গেছে বঙ্গোপসাগরে। বাংলাদেশের উজানের দেশ হওয়ায় ভারত কোন কোন নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে গতিরোধ করেছে সাধারণ পানি প্রবাহের। যখন পানি বেশী হয়, তখন বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দেয় ভারত। আবার যখন পানি কম হয়, তখন নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে ভারত তার অপেক্ষাকৃত শুষ্ক এলাকায় পানি নিয়ে যায়। ফলে শুকিয়ে যায় বাংলাদেশের নদী। মৎসজীবী জেলেপাড়ায় থাকে না কর্ম। আবার পানির অভাবে ফসলহানী হয় বাংলাদেশে; মরে যায় ধান গাছ। একদিকে মাছ নেই, অন্যদিকে ধান নেই। আজ যেন মিছে হয়ে যাচ্ছে “মাছে ভাতে বাঙালী’’ প্রবাদ। এতবড় ঘটনা কী করে এড়িয়ে যায় একজন দেশপ্রেমিক ছড়াকারের চোখ। তাই তো সাজজাদ হোসাইন খান লিখেছেনঃ-
আমাদের বড় নদী চলে ধুকে ধুকে
বছরের বার মাস ঘটি জল বুকে।
……………………………..
উড়াউড়ি করে সেথা শকুনের ঝাঁক
ভরা গাঙে জল নেই সকলি অবাক।
জেলেপাড়া ভিঁউ ভিঁউ, জালে নেই মাছ
মাঠে মাঠে ঐ দ্যাখো মরা ধানগাছ।
জল কই? ছল ছল কৃষকের আঁখি
তৃষ্ণায় দাঁড়কাক করে ডাকাডাকি।
প্রতিবেশী কানীনেরা বেঁধে রেখে জল
আমাদের সব নদী করেছে অচল।
টল টলে নদী ছিল, তীরে তীরে ঘাস
জনগণ করো পাঠ সেই ইতিহাস। [আমাদের বড় নদী]
শুধু দেশের ফুল, পাখি, নদী, প্রকৃতি নিয়েই কথা বলেননি ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খান। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়েও সাজিয়েছেন ব্যঙ্গ ছড়ার বাকশো। সবুজ শ্যামল এই বাংলাদেশ যেন প্রকৃতির লীলাভূমি। তাই তো ভিনদেশীদের শকুনী নজর বরাবরই আহত করেছে বাংলাদেশকে। বিভিন্ন দেশ থেকে ক্ষমতালোভীরা এসে ঘাঁটি গেড়েছে বাংলাদেশের নরম বুকে। বাংলাদেশের সহজ সরল আতিথিয়তা আর হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণের সুযোগ নিয়েছে ভিনদেশী কুচক্রীরা। আবার বাংলাদেশের মানুষেরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের লোকদের তুলনায় খানিকটা সহজ সরল আর বোকা। তাই তো বাংলাদেশকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। এমন কি এখনো থেমে নেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। আত্ম সচেতন ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খান লিখেছেনঃ-
মাকাল গিলে তিলে তিলে উধাও সবার পিলে
হচ্ছে গুঁড়া বুকের ছাতি ভিনদেশীদের কিলে। [দিন বদল-২]
না, শুধু ভিনদেশীরা এসে একা একা বাংলাদেশে খুব বেশী ফায়দা করতে পারবে না, পারেওনি কোন দিন। এদেশীয় কিছু মীর জাফর আর ঘসেটি বেগমরা, রাজবল্লভ আর উমি চাঁদেরা টু-পাইস কামাইয়ের জন্য দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে বিক্রি করতে পারে এমন আশঙ্কা এই ছড়া-শিল্পীর মনে। এই উপমহাদেশে ভারত হলো সবচেয়ে বড় দেশ এবং এই ভারতই তার প্রতিবেশী ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। ইতিপূর্বে এই ভারতই প্রতিবেশী ছোট রাষ্ট্র সিকিম দখল করে নিয়েছে। তবে এই কাজে ভরতকে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন সিকিমের প্রধান মন্ত্রী লেন্দুপ দর্জি। পরে অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজের স্ত্রী ও মেয়ের কাছে লাঞ্চিত হয়ে এবং ভারত অধিকৃত সিকিমের মূখ্য মন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত হয়ে দেশ থেকে মনের দুঃখে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে চলে যান তিব্বতে। আজকের বাংলাদেশেও লেন্দুপ দর্জি কিংবা মীর জাফর-এর মত অতি লোভী দেশদ্রোহী আছে যারা নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য দেশের বড় ক্ষতি করতে পারে বলে মনে করেন ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খান। শুধু তাই নয়, লেন্দুপ দর্জির মত দেশকে বিক্রী করাও তাদের জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাদের কাছে এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব কোনভাবেই নিরাপদ নয়। তাই তো দেশপ্রেমিক ছড়াকার লিখেছেনঃ-
ক্লাইভ আর মির্জারা হাঁকছে
ঐ যেনো সারমেয় ডাকছে
লেন্দুপ দর্জিরা বঙ্গে
মিরনের শার্ট দেখো অঙ্গে। [পাদুকা ও পয়জার]
চোখের তারায় ভাসে তুফান/ যায় না সূরুয দেখা।
লেন্দুপেরা মজমা করে
অন্ধকারে শীতল ঘরে
বকুল ডালের উম ছেড়ে হায়/ উড়ল বুঝি কেকা। [লেন্দুপ বঙ্গদেশী]
এখানে একটি ইতিহাস তুলে ধরেছেন সাজজাদ হোসাইন খান। স্বাধীনতা যু্েদ্ধর পর পরই আমাদের বেরুবাড়ি, তালপট্টি, তিন বিঘা করিডোর আগেই দখল করে নিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। ছড়াকারের আশঙ্কা হয়তো পুরো দেশটাই তারা একদিন দখল করে নেয় কি না, আমাদের স্বাধীন পতাকা একদিন থাকে কি না। তিনি লিখেছেনঃ-
ক্ষেতের ফসল জমিজমা
শহর ভাটির তিলোত্তমা
কর দাবি এসে
আগেই দিছি বেরুবাড়ি
ভীষণ ভালবেসে।
হাঁটতে দিলাম উদাম সিনা
গাঙের চাতাল খানা পিনা
টাট্টিখানার বদনটাও
দিলাম অবশেষে;
নিশান খানা থাকবে তো?
অবাধ খুশীর ময়না পাখি
চোখের ডালে নাচবে তো!
তপ্তবায়ু কপাল ঘেঁষে ঘেঁষে। [বদনা]
‘ঘোড়াদের আন্ডা ছড়া’য় বাংলাদেশের কাছে বিভিন্ন সময়ে ভারতের দাবী প্রসঙ্গে সাজজাদ হোসাইন খান লিখেছেনঃ-
এটা চাই ওটা চাই
ট্রানজিট ভিটা চাই
গ্যাস চাই পাইপে
মিয়া সাব, লিখে দাও টাইপে।
দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিষয়ে যেমন সজাগ ছিলেন সমাজ সচেতন ছাড়াকার সাজজাদ হোসাইন খান, দেশের অর্থনীতির প্রতিও ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। আমরা বাঙালী। কৃষিপ্রধান আমাদের এই দেশের প্রধান খাদ্য হলো ভাত। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে সরকারের বিশেষ বিজ্ঞতাপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে দেখা দেয় হাভাত। দেশের অদক্ষ অর্থনীতিবিদ এবং কর্তা ব্যক্তিরা ভাতের উপর চাপ কমিয়ে আলু খাওয়ার পরামর্শ দেন দেশবাসীকে। কিন্তু অনেক আগে থেকেই বাঙালীদের বদনাম ছিল “ভেতো বাঙালী” [বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের দেয়া অবজ্ঞার্থে বিশেষণ] হিসেবে। সুতরাং ভাত না হলে বাঙালীর চলে না। আবার আলুর আঁড়ালে বাঙালীকেই আলু বানানোর পাঁয়তারা করে ধূর্ত অন্ত্রী-মন্ত্রী নেতারা। তারা ঠিকই দামী চালের উপাদেয় ভাত খান, এসি ঘরে থাকেন, এসি গাড়িতে চড়েন। আরা যত্ত দোষ ঐ নন্দঘোষ সাধারণ মানুষদের। আর সাধারণ মানুষদের অবস্থাও যেন আলুর মতই। কেউ কিছু বলে না। ধান্দাবাজ নেতা নেত্রীরা যা বলে সবাই তা মেনে নেয়। ন্যায় অন্যায় বলে হিতাহিত জ্ঞান তাদের নেই। এই রকম আলু খাওয়ার অর্থনীতি আর গোল আলু মার্কা জনগণকে ব্যঙ্গ করে “মইন ইউ রেসিপি”-তে সাজজাদ হোসাইন খান লিখেছেনঃ-
দেশ তাই আলুময় / আলু খায় বাদুরে
জনতাও গোল আলু / কী মজার যাদুরে।
বাজারে অর্থনীতির কালো সাপ মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব, ঘুষ, চাঁদাবাজি আর দূর্নীতিকে ব্যঙ্গ করতে গিয়ে অর্থনীতি-সচেতন সাংবাদিক ছড়াকার তাঁর “বাড়তি বেতন” ছড়ায় লিখেছেনঃ-
বেতন বাড়াও বেতন বাড়াও / বাড়লে বেতন লাভটা কী?
লম্ফ দিয়ে উঠবে চাঁদে / আনাজপাতি দুগ্ধ-ঘী।
মাস-কাবারে পাত্তি বাড়াও / বাড়িঅলার কুকুর কুক
হপ্তা গেলে পকেট খালি / সেই পুরানা ধুকুর ধুক।
চান্দাবাজের ডবল ফিটিং / অফিস থানায় বাড়তি ফি
রিক্সা বাসে দ্বিগুন ভাড়া / কমবে মাথার চাপটা কী?
বিবিধ বিষয়ের বর্ণিল উপমা, গতিশীল ছন্দ-ব্যবহার বক্র ও ব্যঙ্গোক্তির মাধ্যমে “প্রেমের বরাক বাশ” সাজাতে গিয়ে জাতির জাগ্রত বিবেক সাংবাদিকবর্গকেও বাদ দেননি ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খান। ছড়াকার নিজেও একজন সাংবাদিক। তাতে কী? তাই বলে সাংবাদিক পরিচয়ে অনাচার দূর্নীতিতে আকন্ঠ ডুবে যেতে চাননি তিনি। বর্তমানে সাংবাদিকতা পেশাকে নানাভাবে কলুষিত করছে একশ্রেণীর সাংবাদিক নামের কুলাঙ্গার। সাংবাদিক পরিচয়ের কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোকের কারণে এক সময়ের মহৎ পেশা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। জাতির জাগ্রত বিবেক এখন সময়ের ব্যবধানে দুষ্ট রিপুতে পরিণত হয়েছে। টাকার বিনিময়ে জিরোকে হিরো আর হিরোকে জিরো বানাতে এক শ্রেণীর সংবাদপত্র এখন মরিয়া। নীতি নৈতিকতাকে টাকার পদতলে বলী দিয়ে এই মহান পেশাকে কলঙ্কিত করছে কেউ কেউ। সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদক বা মালিকেরা আজ আর সাংবাদিক নন, টাকার জোরে মালিক। এটি আর মহৎ পেশা নেই; কেবলই ব্যবসা। দূর্নীতিপরায়ন রাজনীতির কাছে নিজের বিবেক কেনাবেচার ব্যবসা এখন এটি। কিন্তু এই ব্যবসার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারেননি সাজজাদ হোসাইন খান। সাংবাদিক আর সংবাদ মাধ্যমের এহেন বজ্জাতির মুখে থুথু ছিঁটিয়ে মারতেও কুন্ঠাবোধ করেননি তিনি। ‘সাংবাদিক’ শিরনামীয় ছড়ায় তিনি লিখেছেনঃ-
এক কাগজে এমপি সাহেব আউলিয়াদের রাজা
ভিন খবরে বানায় তারে সন্ত্রাসী তরতাজা।
পালের গোদা সম্পাদকে হাতায় শুধু কড়ি
সেই কড়ি কি চোর-চামারের, ভুমি-দস্যুর বড়ি?
এসব কথা ভাবার এখন সময় কি তার আছে?
বিবির নামে অড়বে প্রাসাদ বারিধারার কাছে।
হরহামেশা কিচ্ছা লিখি জবাই করি সত্য
পাঠক কুলের তশতরীতে রাখছি বিষের পথ্য।
সাংবাদিক না সাংঘাতিক কোন্ নামে যে ডাকি?
হাল আমলে তাদের মুখে থুথুর মাখামাখি।
না, কেবল স্বদেশের অনিয়ম অনাচার আর অবিচারকেই ব্যঙ্গ করেননি সাজজাদ হোসাইন খান। বিশ্বব্যাপী যে অনাচার-অন্যায় চলছে তার বিরুদ্ধেও কলম ধরেছেন তিনি। তেলের খনির লোভে অনৈতিকভাবে আমেরিকা আর তাদের পশ্চিমা দোসররা ইরাকের ফোরাত নদীকে মানুষের রক্তে লালে লাল করে যেভাবে ইরাক দখল করে নিলো, তাকেও টিপ্পনি কেটেছেন ছড়াকার কলমের খোঁচায়। জঙ্গী দমনের নামে আফগানিস্তানের উপর যে নির্লজ্জভাবে মরা গরুর উপরে শকুনের মত হামলে পড়লো সম্রাজ্যবাদের ধ্বজাধারীরা তাকেও ছেড়ে কথা বলেননি এই বিশ্বনাগরিক। তিনি লিখেছেনঃ-
ইরাকে বয় খুনের নদী / ফিলিস্তিনে রকেট,
আফগানটা লুটে পুটে / ভরছে ওরা পকেট।
এক পকেটে তেলের খনি
আর পকেটে কাঁপছে শনি
বৃহস্পতির কপাল জুড়ে / খড়ায় মরা লকেট। [ইরাক]
তবে হতাশ হননি তিনি। মহানবীর (সাঃ) দৌহিত্র ইমাম হোসাইন আর ইমাম হাসানকে হত্যা করেছিল যে এজিদ বাহিনী, তারা চিরকালের জন্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। সারা জীবন ঘৃণাভরে এজিদকে স্মরণ করে বিশ্বের মানুষ। আজকে যে নব্য এজিদেরা মানুষের রক্ত নিয়ে হোলী খেলছে তাদেরও পরিণতি একদিন ভয়াবহ হবে। যত মানুষকে তারা হত্যা করেছে তাদের লাশের গন্ধে একদিন এই নব্য এজিদদের রাস্তা হবে বন্ধ। ‘নব্য এজিদ’-এ সাজজাদ হোসাইন খানের ভাষায়ঃ-
বুশ আর ব্লেয়ারের চামচা
খুলে ফেলো কোমরের গামছা।
পালাবার পথ দেখো বন্ধ
চারদিকে মরণের গন্ধ।
দেশের প্রতি ভালবাসার কারণে তাঁর হৃদয়ের জমিনে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের দাবানল। আর যারা এত অনিয়ম অনাচার দেখে নীরব থাকে তাদেরকে গর্ধব আখ্যায়িত করেছেন তিনি। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের অপকর্ম দেখেও যারা নির্লিপ্ত থাকে তাদেরকে ব্যঙ্গ করে তিনি লিখেছেনঃ-
বিবিজান বিভীষণ / লাল নীল ধলা
বুরবুক আদমেরা / চোষে কাঁচ কলা। [কাঁচ কলা]
তবে ছড়াকার নিজে কাঁচকলা চোষার মত লোক নন। এই এখানেই জনাথন সুইফটের সাথে সাজজাদ হোসাইন খানের পার্থক্য। জনাথন সুইফট ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেই ক্ষ্যান্ত থেকেছেন, আর যাঁকে আমরা বাংলার জনাথন সুইফট বলছি তিনি কিন্তু ব্যঙ্গোক্তি আর বক্রোক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন। তিনি একটা সুখী-সমৃদ্ধ ও সুস্থ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখেন কালিমামুক্ত একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। যে দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে, সেই প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে পুত-পবিত্র করতে, অনাচার-অবিচার -অনিয়ম থেকে মুক্ত করতে নিজেকে আবার সাজিয়েছেন কলম সৈনিকরূপে। কলম সৈনিক এই ছড়াকার বিদ্রোহের অনলে পুড়িয়ে শুদ্ধ করেছেন নিজের ছন্দমালা। বাংলাদেশের নৈতিক ক্রমাবনতির বিরুদ্ধে তিনি তৈরি করতে চান নিজের কলম তীর। তিনি লিখেছেনঃ-
বিভীষণের বাড়ছে ভিড় / বঙ্গদেশের বক্ষচির
এই যদি হয় বদলে যাওয়া / শানাও তবে ধনুক তীর। [দিন বদল]
স্বাধীনতা বেচতে চায়
দাদার লগে ঘেঁষতে চায়
তাই তো ঘরে করছি জমা বাঁশ বরাকের আইক্কা
দিও তারে জাগা মতো তেল সাবানে মাইক্কা। [স্বাধীনতা]
তিনি মনে করেন বাঙালীরা বীরের জাতি। তারা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে জানে না – এ বিশ্বাস তাঁর বুকের ভেতর। এই বাঙালী জাতি একদিন যুদ্ধ করে এদেশকে স্বাধীন করেছে। ঘসেটি বেগম, রাজ বলভ, রায় দুর্লভ, মীর মদন, জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ আর মোহন লালেরা যদি এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে আবার নস্যাৎ করতে চায়, এই বাংলার বীর জনতা তা হতে দেবে না।
বীর বাঙালীর প্রতি তার আহবানঃ-
মাছ মাংস ভাতের বদল / খাবার এখন রুটি
ভাটির দেশের বাঙালেরা / শক্ত করো মুঠি। [বাঙাল]
ছড়াকার বিশ্বাস করেন- যে অমানিশার অন্ধকার বাংলাদেশকে গ্রাস করেছে তা একদিন কেটে যাবে। আঁধার পেরিয়ে আলো ঝলোমল দিনের সূর্য উদিত হবেই একদিন। সেদিন বেশী দূরে নেই, যেদিন ভেঙে যাওয়া গাছের ডালে গজিয়ে উঠবে নতুন পাতা, ঝরে যাওয়া ফুলের স্থানে দেখা দেবে নতুন কুঁড়ি। ছড়াকারের ভাষায়-
আঁধারগুলো কাটবে দেখো ত্বরা
দুধের মতো ফর্সা হবে ধরা। [জীবন]
ক্রিয়ার থাকে প্রতিক্রিয়া / মন্দের পিছে ভালো
অন্ধকারের উল্টা পিঠে / দাঁড়িয়ে থাকে আলো।
দুখের কালো কলজে থেকে / সুখের বাতাস উড়ে
বানের পরে প্রাণের কুঁড়ি / জমিন ফুঁড়ে ফুঁড়ে। [প্রাণের কুঁড়ি]
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, সাজজাদ হোসাইন খান ব্যঙ্গোক্তি বা স্যাটায়ারের দিক থেকে জনাথন সুইফটের ভাবশিষ্য হলেও, বিদ্রোহী চেতনা ও বিপবী মনোভাবের কারণে তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনুসারী। আবার আধূনিক ছড়াকার হিসেবে তার ভেতরে নৈরাশ্যবাদিতা থাকলেও তা তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। বরং আশার আলোয় উদ্ভাসিত তাঁর ছন্দমালা। এই প্রসঙ্গে আশির দশকের আরেকজন কবি মোশাররফ হোসেন খানের “পাথরে পারদ জ্বলে” কবিতার লাইন দুটি স্মরণ করা যেতে পারেঃ-
পাথরে পারদ জ্বলে, জলে ভাঙ্গে ঢেউ,
ভাঙতে ভাঙতে জানি গড়ে যাবে কেউ।
উপসংহারে একথা অনায়াসেই বলা যায় যে, “প্রেমের বরাক বাঁশ” সাজজাদ হোসাইন খানের অসম্ভব রকমের একটি সৃষ্টি যা সমকালীন বাংলা সাহিত্যে বিরল। একই সাথে ব্যঞ্জনামুগ্ধ ব্যঙ্গোক্তি, বিদ্রোহের ঝনঝনানী, আর আশার ফল্গুধারা ছড়ার এই বইটাকে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যতা দান করেছে। বইটির নামকরণটাও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, বিদ্রোহ আর আশার রসে টই-টুম্বুর। পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজ বাস্তবতার নিরীখে রচিত “প্রেমের বরাক বাঁশ” ছড়াগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য মৌলিক সংযোজন এবং এই বইটি একই সাথে সাহিত্য, দর্শন আর ইতিহাসের সম্মোহনী শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকবে অনেকদিন- অন্ততঃ এ আশাটুকু করা যায়। #
[লেখকঃ- এ কে আজাদ, কবি, গীতিকার, ও প্রাবন্ধিক ]