মুহম্মদ আবদুল বাতেন
‘আমরা নিরন্তর বিস্ময়ের প্রাণী, সৌন্দর্যে কৌতূহলী, পাতা এবং পুষ্পে, দুঃখ এবং আনন্দে, সূর্য এবং ছায়ায়।’
প্রথমবার কবিতা পাঠানো হচ্ছে মহাকাশে, মার্কিন কবি ২৪তম ন্যাশনাল পোয়েট লরিয়েট অ্যাডা লিমনের কবিতা পাঠানো হচ্ছে নাসার ইউরোপা ক্লিপার মিশনে।
কবিরা সবসময় আমাদের চাঁদের কথা বলছেন। কিন্তু এইবার অ্যাডা লিমন, বৃহস্পতির গ্রহের রহস্যময় চাঁদ ইউরোপা (গ্যালিলিয়ান, প্রায় ৪০০ বছর আগে গ্যালিলিও আবিস্কৃত) নিয়ে লেখা কবিতা নাসার মহাকাশ যানে খোদাই করে এবং কবির কন্ঠে অডিও রেকর্ড যুক্ত করা হচ্ছে।
‘রহস্যের স্তুতি: ইউরোপার জন্য একটি কবিতা’ শিরোনামের মূল কবিতাটি দুটি জগতকে সংযুক্ত করেছে – পৃথিবী এবং ইউরোপা। পৃথিবীর প্রাণের উৎস পানি এবং বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপার ভূত্বকের নিচে জমাট বরফস্তর রয়েছে, যা সেখানে প্রাণের বিকাশের উপযোগী পরিবেশ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আমাদের রাতের আকাশে আমরা একটি চাঁদ দেখতে পাই, কিন্তু বৃহস্পতির চাঁদের সংখ্যা শতাধিক, ওখানে অনেকগুলো চাঁদ রাতের আকাশে উজ্জ্বলতা ছড়ায়। এর একটি হলো ইউরোপা।
অ্যাডা লিমনকে (৪৭) একুশ শতকের কবি হিসেবে ২০২২ সালে মার্কিন ন্যাশনাল পোয়েট লরিয়েট মনোনীত করা হয়, তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন, অ্যাডা লিমনের কবিতার একুশ শতকের চিন্তা, কল্পনা এবং সভ্যতার ভবিষ্যৎ যাত্রার বার্তা উঠে এসেছে। কবিতার জগতকে বদলে দেয়ার এই কাজের জন্য এবার পোয়েট লরিয়েটের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে অ্যাডা লিমনকে দ্বিতীয়বার মার্কিন পোয়েট লরিয়েট নির্বাচিত করা হয়েছে। একটানা চার বছর পোয়েট লরিয়েট নির্বাচিত হওয়া একটি বিরল সম্মান, যা আগে কখনো ঘটেনি। এরমধ্যেই নাসা তাকে ইউরোপা মিশনের জন্য কবিতা লেখার প্রস্তার পাঠায়। এটি প্রথম কোন কবির জন্য লোভনীয় সম্মাননা। অ্যাডা লিমন এই প্রস্তাবে প্রথমে থমকে যান,আবেগ আপ্লূত হয়ে পড়েন, তার কবিতার কল্পনা মহাকাশযানে পৃথিবী থেকে ২.৮৯ বিলিয়ন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপার আকাশে হাজির হবে। ইউরোপার মিথেন সাগরের উপর দিয়ে এই উপগ্রহটি আবর্তন করবে। চলতি বছরের ১০ অক্টোবর ইউরোপা ক্লিপার মিশনের মহাকাশ যাত্রার কথা রয়েছে এবং এটি ২০৩০ সালে ইউরোপায় পৌঁছে আবর্তন শুরু করবে।
অ্যাডা লিমনের ‘রহস্যের স্তুতি: ইউরোপার জন্য একটি কবিতা’টি ইউরোপা ক্লিপার মহাকাশযানে বহন করা একটি ফলকে খোদাই করা হবে, যা সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয় ও কল্পনার আকুতি ধারণ করেছে।
সায়েন্টিফিক আমেরিকান এর সম্পাদকীয় দলের সদস্য ব্রি ক্যান বলেছেন, আজ, আমি নিজেই অ্যাডা-এর সাথে কবিতায় আগামীর বিশ্বভাবনা এবং নাসার এই প্রজন্মের মিশনের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং কীভাবে আমরা সবাই ইউরোপার এই অ্যাডভেঞ্চারে তার সাথে যোগ দিতে পারি সে সম্পর্কে কথা বলছি৷
ব্রি ক্যান বলেন, ইউরোপার বরফের ভূত্বকের নীচে লুকানো সমুদ্র আমাদের সৌরজগতের জীবনকে আশ্রয় করার জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য স্থানগুলোর মধ্যে একটি, তবে আমাদের নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও ঘনিষ্ঠভাবে নজর দেওয়া দরকার। এই কারণেই আমরা ইউরোপা ক্লিপার মিশন পাঠাচ্ছি, যা এই চাঁদের প্রায় ৫০ বার আবর্তন করবে, ডিটেইল চিত্র ধারণ করবে।
তিনি বলেন৷ কিন্তু মহাকাশযান শুধু বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি বহন করবে না। এটি অ্যাডা লিমনের একটি কবিতাও নিয়ে আসবে, যার শিরোনাম ‘In Praise of Mystery: A Poem for Europa’।
মাত্র সাতটি স্তবকে, অ্যাডা পাঠকদের অজানা রহস্যের সন্ধান অন্তহীন মহাকাশ যাত্রার প্রেরণা দেয়।
ব্রি ক্যান কবির প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে
অ্যাডা লিমন তাঁর আগ্রহ ও উদ্দীপনা প্রকাশ করেন। ইউরোপা ক্লিপার মিশনে কাজ করার জন্য নাসার প্রস্তাব সম্পর্কে অ্যাডা লিমন বলেন,তারা (নাসা)আমাকে প্রথমে ইমেল করেছিল। আমি তখন কংগ্রেসের লাইব্রেরিতে ছিলাম। তারা আমাকে বৃহস্পতির দ্বিতীয় চাঁদ, ইউরোপা সম্পর্কে সব বলেছিল এবং প্রকল্পটি সম্পর্কে, ক্লিপারের মিশনটি কী হতে চলেছে সে সম্পর্কে বলেছে। এর শেষে, তারা বলেছিল, ‘আপনি কি একটি মৌলিক কবিতা তৈরি করতে আগ্রহী যা মহাকাশযানের ভিতরে যাবে?’ এবং আমি এতে সম্মতি জানালাম।
তারা বলেছিল, পৃথিবীতে পানি রয়েছে, ইউরোপায়ও পানি আছে, এটা পৃথিবীর বাইরের সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক সূত্র তৈরি করেছে। প্রকৃতি ও মহাবিশ্বের সঙ্গে আমাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আমার কল্পনার দৃষ্টি প্রসারিত করেছে, আগামী দিনের কবিতা মানুষের অভিযাত্রা ও কল্পনা ধারণ করবে, অনাগত প্রজন্মের কাছে আমরা আমাদের কবিতাকে রেখে যাবো, যা আমাদের কল্পনা ও আবেগের প্রতিনিধিত্ব করবে। সেদিন কবিরা হয়তো মহাকাশযান থেকে কবিতা লিখবে, দূর থেকে পৃথিবীকে দেখবে, একই সাথে মহাবিশ্বের অভিযাত্রায় সামিল হবে।
“কালো বিস্তৃতি সহ রাতের আকাশের নীচে খিলান, আমরা আমাদের পরিচিত গ্রহগুলির দিকে নির্দেশ করি, আমরা
তারার উপর দ্রুত শুভেচ্ছা পাঠাই পৃথিবী থেকে, আমরা আকাশকে এমনভাবে পড়ি যেন এটি মহাবিশ্বের একটি অবিচ্ছিন্ন বই…
তবুও, আমাদের আকাশের নীচে রহস্য রয়েছে: তিমির গান, গান পাখি তার ডাক গাইছে বাতাস-কাঁপানো গাছের ডালে।
আমরা নিরন্তর বিস্ময়ের প্রাণী, সৌন্দর্যে কৌতূহলী, পাতা এবং পুষ্পে, দুঃখ এবং আনন্দে, সূর্য এবং ছায়ায়।
এবং এটি অন্ধকার নয় যা আমাদের একত্রিত করে, স্থানের ঠান্ডা দূরত্ব নয়, তবে জলের নৈবেদ্য, বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা,
প্রতিটি নদী, প্রতিটি নাড়ি, প্রতিটি শিরা। হে দ্বিতীয় চাঁদ, আমরাও পানির তৈরি, বিস্তীর্ণ এবং ইঙ্গিতকারী সমুদ্রের।
আমরাও, বিস্ময়, মহান এবং সাধারণ ভালবাসার, ছোট অদৃশ্য জগতের, অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ডাকার প্রয়োজনে তৈরি।” অ্যাডা লিমন।
……
২৫/০২/২৪
অসাধারণ একটি লেখা প্রকাশের জব্য বাংলা রিভিউকে এবং লেখাটি লেখার জন্য বিশিষ্ট চিন্তক, কবি মুহাম্মদ আবদুল বাতেনকে অনেক ধন্যবাদ।