spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাক্ষাৎকারসাক্ষাৎকার : আহমাদ মাযহার 

গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব

সাক্ষাৎকার : আহমাদ মাযহার 

১. জীবন কি? আপনার বর্তমান জীবন, অবস্থান–যা হতে চেয়েছিলেন বা যা হয়েছেন–এসব নিয়ে কোন আক্ষেপ, অনুশোচনা বা গর্ব হয়?

আহমাদ মাযহার : এই বিশ্বজগতের একটি ক্ষুদ্র সত্তা হিসাবে যার যার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে অস্তিত্বশীল থাকার নামই আমার কাছে জীবন। জীবনের যে পর্যায়ে আমার মধ্যে সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ জন্মায় তখন থেকে আমি লেখক হতে চেয়েছি। সফলতা না আসাই যে স্বাভাবিক ব্যাপার, সফলতা যে ব্যতিক্রম তা জেনেই আমি যাত্রা শুরু করেছিলাম। সাহিত্যিকতার অনুশীলনই যেহেতু আমার জীবনানন্দ সেহেতু আমার কোনো আক্ষেপ বা অনুশোচনা নেই! সাফল্য লাভ যেহেতু আমার বিবেচ্য নয় সুতরাং গর্বিত বোধ করার কথা ভেবে ওঠা হয়নি!

২. সাহিত্যে এলেন কেন? কীভাবে এলেন?  অর্থাৎ শুরুটা কীভাবে? কোথায়?

আহমাদ মাযহার : ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় শিশু সংগঠন খেলাঘরের শিক্ষা ও বিজ্ঞান কর্মসূচিতে  যোগ দিলে সেখানে দলভুক্ত হয়ে একটি দেয়াল পত্রিকা করার দায়িত্ব পাই। সেখানে লেখা দিতে বলা হলে রেডিয়াম নিয়ে একটা গদ্য লিখি। পরে কলেজে উঠে সেখানেও একটি দেয়াল পত্রিকা করি সহপাঠীরা মিলে! ওখানেই সহপাঠী মোস্তফা জামানকে আবিস্কার করি একজন লেখক হিসেবে যার লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ওর ওপর ঈর্ষান্বিত হয়ে আমিও লেখার চেষ্টা করি। দুই বন্ধু মিলে আবিস্কার করি অনুশীলন সংঘ নামে একটি সাহিত্য সভার। সেখানে নিয়মিত যেতে যেতে পরিচিত হবার সুযোগ পাই অনেক বিশিষ্ট সাহিত্যিকের সঙ্গে। অনুপ্রাণিত হই লেখালিখিতে।

৩. আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে? কীভাবে কেটেছে? কোন অব্যক্ত কথা বা স্মৃতি কি মনে পড়ে? তাড়িত করে?

আহমাদ মাযহার : জন্ম ঢাকায় হলেও আমার সামান্য বুঝ হওয়ার সময়ের কিছুটা কেটেছে তখনকার ঢাকার (এখনকার গাজীপুর জেলার) কাপাসিয়া থানার তরগাঁও গ্রামে, আমার নানাবাড়িতে। ক্লাস ওয়ান ও টুতে পড়ার সময়টা অর্থাৎ মোটামুটি পাঁচ ও ছয় বছর বয়স কেটেছে করাচিতে, আব্বার কর্মস্থলে। ১৯৭০ সালে করাচি থেকে ফিরে ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়টুকু, অর্থাৎ আরো বছরখানেক গ্রামে, নানাবাড়িতে। ১৯৭১ সালে ক্লাস ফোরে উঠে ভর্তি হয়েছিলাম ঢাকার পল্লবীর এক স্কুলে। স্কুলের নাম মনে নেই! মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আবার গ্রামে অল্পদিন নানাবাড়িতে থেকে আমার পৈত্রিক গ্রামে চলে যাই। একাত্তরের অবশিষ্ট সময় ও ১৯৭২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত পৈত্রিক নিবাস ঢাকা জেলার (বর্তমানে নরসিংদী জেলার) গণ্ডারদিয়া গ্রামে কেটেছে। মাস দুয়েকের বেশি গ্রামের স্কুল যাওয়া আসা করে আবার ঢাকায় ফিরে আসি। এরপর থেকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ঢাকা নগরীতেই বসবাস করেছি!

ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম উল্লেখযোগ্য গুণহীন ও সাধারণ। ছাত্র হিসাবেও মধ্যম সারির। তবে শিক্ষক বা সহপাঠীরা আমাকে একজন ভালো ছেলে বলেই মনে করতেন! বাবা ছিলেন সরকারি ছোট পদের চাকুরে। মোটকথা আমাদের পরিবারকে বলা চলে আধা গ্রামীণ কৃষি নির্ভর নিম্নবিত্ত। মনে আছে কিছুদিন ছবি আঁকার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কোনো রকমে একটা সাদামাঠা রঙের বাক্স কিনতে পেরেছিলাম। সেটি শেষ হবার পর দ্বিতীয়টি আর কেনার সামর্থ্য হয়নি। তখন বুঝে গিয়েছিলাম খুব বেশিদূর এ পথে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না! এসএসসিতে ভালো করার জন্য কিছু চেষ্টা করেছিলাম। এখনকার মতো এত কোচিং ছিল না তখন, তবে অর্থকষ্ট সত্ত্বেও আম্মার দায়িত্বশীল উদ্যোগের কারণে একজন প্রাইভেট টিউটর রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষায় ভালো ফল না করায় এক ধরনের নৈরাশ্য কাজ করত তখন। তবে বই পড়ার আনন্দে অনেক সময় নৈরাশ্যের কথা ভুলে যেতাম।

৪. আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?

আহমাদ মাযহার : আমার প্রথম বই ছোটদের কবিতার। নাম ঘুমের বাড়ি। প্রকাশ ১৯৮৫ সালে। প্রথম বইটি নিজ অর্থব্যয়ে বেরিয়েছিল। সে সময় একটি বই সাধারণ ভাবে উন্নত প্রকাশনা যেমন রুচির হতো আমার লক্ষ্য ছিল প্রকাশনাটি যেন রুচিগত মানে এর চেয়ে ঊন না হয়! সেজন্য দামি কাগজ কার্ট্রিজ পেপার ব্যবহার করছিলাম। প্রচ্ছদ ছাপা হয়েছিল ভালো মেশিনে। প্রচ্ছদ অঙ্গসজ্জার ড্রয়িং এবং টাইপ সেটিং  করে দিয়েছিলেন শেখ তোফাজ্জল হোসন। কিন্তু পৃষ্ঠাবিন্যাস, টাইপ নির্বাচন ছিল আমার। পাণ্ডুলিপির ঘষামাজায় তুলকালাম সময় কাটিয়েছিলাম। নিজেই নিজের কাজের সমালোচক হয়ে চেষ্টা করেছিলাম উত্তরণ ঘটাতে।  বইটি প্রকাশের পর এর প্রকাশনা মানকে মোটামুটি ভাবে সবাই রুচিসম্পন্নই বলেছিলেন। কম্পোজ, ছাপা, বাঁধাই–সবগুলো পর্বেই আমি একেবারে সেঁটে ছিলাম কাজগুলোর সঙ্গে। সুজন বড়ুয়ার প্রথম বইও একই সঙ্গে একই নামের প্রকাশনা হিসেবে বেরিয়েছিল। দুজনেই ছিলাম সেদিনগুলোতে দিনরাত্রির সঙ্গি! একজন আরেক জনের প্রুফ দেখেছি যত্ন করে। প্রয়োজনীয় সমালোচনাও করেছি নিজেদের। ফলে বই-সংস্কৃতির যতটা সম্ভব মান্য করেছিলাম আমরা। সে ছিল রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা! লেখক হতে চাওয়ার প্রথম ধাপে পা দেয়ার আনন্দে বিভোর ছিল সেই স্মৃতি আমাদের!

৫. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?

আহমাদ মাযহার : আমি মনে করি বাংলা সংস্কৃতির সামগ্রিক সাহিত্যিক প্রবাহের সব কিছুরই আমি উত্তরাধিকার বহন করি। চর্যাগীতিকা থেকে শুরু করে পুথিসাহিত্য, পদাবলি কিংবা জনসংস্কৃতি বা লোকসংস্কৃতি যে নামেই ডাকা হোক তার মধ্য দিয়ে বাহিত হয়ে আসা হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খৃষ্টান কিংবা বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতি প্রভাবিত সংস্কৃতি যা পশ্চিম থেকে যা কিছু আমাদের সামগ্রিক সংস্কৃতিতে অন্তর্ভূত হয়েছে তারই উত্তরাধিকার আমার মধ্যে আছে। ফোর্ট উইলিয়ামের পণ্ডিতসৃষ্ট বাংলাভাষা যতটা ধারণ করতে পেরেছে কিংবা পারেনি কিন্তু অন্য ভাষিক বাস্তবতায় বাহিত হয়ে এসেছে তেমন যাবতীয় ধারারই আমি নিজেকে উত্তরাধিকারবাহী বলে মনে করি!

৬. আপনার লেখালেখিতে দেশি-বিদেশি কবি/ সাহিত্যিকদের কারো কোন প্রভাব কি আছে?

আহমাদ মাযহার : আমার লেখা এতটাই অকিঞ্চিৎকর যে সেভাবে তা নিয়ে আমি কখনোই ভাবিনি। তবে দীর্ঘ কাল ধরে মনের আনন্দে দেশি বিদেশি অনেক সাহিত্যিক বা দার্শনিকের লেখা আমি পড়েছি বা তাঁদের চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি যে প্রভাব পড়াই স্বাভাবিক!

৭. এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?

আহমাদ মাযহার : রচিত, অনূদিত, সম্পাদিত, সংকলিত মিলিয়ে মোট কতগুলো বই বেরিয়েছে আমি ঠিকমতো গুণে দেখিনি। তবে অনুমান করি সংখ্যায় সত্তরের কাছাকাছি হবে! নিজের কাজের মূল্যায়ন নিজে করা যায় না। তবে অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ পেয়েছি প্রাবন্ধিক-কথাসাহিত্যিক-নাট্যকার আবদুল হককে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে। মনন ও সৃষ্টিশীলতা এবং জীবনানুশীলন মিলিয়ে এই মানুষটিকে গভীরভাবে বুঝতে গিয়ে যা উপলব্ধিতে এসেছে তা আমার নিজেকে জীবনানুশীলনে পথ দেখিয়েছে।

আমার কাজ কিছুটা ছড়ানো। প্রথম দিকে আমি প্রধানত শিশুসাহিত্য চর্চাই করেছি। সেগুলো নিয়ে ভাবমূলক তিনটি সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। আরো একটি সংকলন বের করার প্রস্তুতি চলছে ইতিহাস ভাষা ও নানা বিষয়ে ছোটদের জন্য লেখা বিচিত্র রচনা দিয়ে। লিখেছি সাহিত্য-সমালোচনা ও গবেষণাধর্মী রচনা। লেখালিখি শুরুর পনের বছর পরে বেরিয়েছে প্রথম সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ ও গবেষণাধর্মী রচনার সংকলন। আবদুল হকের দুষ্প্রাপ্য রচনা যেমন উদ্ধার করেছি, তেমনি সম্পাদনা করেছি ভাব ভিত্তিক রচনা-সংকলনও। প্রধানত তাঁর অসমাপ্ত আত্মকথনমূলক পাণ্ডুলিপি ও দিনলিপির ওপর এবং বিভিন্ন সময় প্রকাশিত রচনার সমন্বয়ে আমার জীবন-কথা: স্মৃতিকথা ও দিনলিপি নামে একটি বই রচনা করেছি যা গঠনগত দিক থেকে অভিনব। এটি রচনা করতে আমি দীর্ঘ ২০ বছর সময় নিয়েছি। আমার মনে হয় একজন লেখকের সারা জীবনের লেখালিখি পাঠ করে তাঁর চৈতন্যকে আবিস্কার করে তাঁর সারা জীবনের টেক্সটগুলো থেকে একটি সম্পন্ন আত্মজীবনী নির্মাণ করার প্রয়াস এর আগে বাংলা ভাষায় আর কেউ করেছে কি-না আমার জানা নেই। এই দিক থেকে আমার সম্পাদিত ও সংকলিত এই বইটি পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। সেদিক থকে এটিকে আমি নিজের একটি উল্লেখযোগ্য প্রয়াস মনে করি!

আমার লেখালিখির একটা বড় অংশ রয়েছে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য নিয়ে। শিশুসাহিত্য বিষয়ে নানা ধরনের ভাবনামূলক প্রবন্ধ যেমন লিখেছি তেমনি লিখেছি গবেষণা-অভিসন্দর্ভ ধরনের রচনাও। বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য নিয়ে সত্তর ও আশির দশক পর্যন্ত আতোয়ার রহমান বেশ কাজ করেছিলেন। পরে যেসব কাজ হয়েছে তার বেশিরভাগই তালিকাসর্বস্ব। আমি বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের একটি সামগ্রিক ইতিহাস রচনায় প্রয়াসী হয়েছি। আলাদা আলাদা ভাবে কয়েকটি বইয়ে তা ধারণ করার মধ্য দিয়ে সচেষ্ট আছি একটি সম্পন্নতর সামগ্র্যমুখি ইতিহাসধর্মী বই রচনায়। ঢাকা থেকে ২০০৯ সালে প্রকাশিত শিশুসাহিত্যের রূপরেখা, ২০১৩ সালে প্রকাশিত ছড়াতত্ত্ব ছড়াশিল্প, কলকাতা থকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য এবং ২০১৯ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত শিশুসসহিত্যের মনন ও মনীষা আমার এই ধারার প্রাথমিক কাজের দৃষ্টান্ত! শেষোক্ত দুটি কাজকে বিচার করে দেখা যেতে পারে!

বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আমি বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিককে নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে চেষ্টা করেছি। সেইসব বিষয়ের বইগুলোর মধ্যে রয়েছে পূর্বসূরীগণ: স্মরণ সত্তা মনন, সৃষ্টি বুদ্ধি মুক্তি, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তবুদ্ধি!

আমাদের সাহিত্যিক সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁদের কর্মাবলি সময়ের নানান সঞ্চারী অনুষঙ্গের প্রভাবে উপেক্ষিত। সেইসব মানুষের জীবনকে আমি সহৃদয় সমাদর করতে চেষ্টা করেছি। আমার এই কাজগুলোর কোনো গুরুত্ব আছে কিনা তার বিচারের ভার আমি সময়ের কাছেই দিয়ে রেখেছি।

৮. বাংলা ভাষার তথা বাংলাদেশের প্রধান কবিবৃন্দ যেমন : আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ–তাঁদের সাহিত্যকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন? কার-কার সঙ্গে আপনার সখ্য বা বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল বা আছে? তাদের সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা বা তাঁদের সাহিত্য নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

আহমাদ মাযহার : সৈয়দ আলী আহসন, ফজল শাহাবুদ্দীন ও শহীদ কাদরীকে সামনা সামনি দেখলেও তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয়নি। সাহিত্য যাত্রার শুরুর দিকে আহসান হাবীবের পরামর্শ পেয়েছি। সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে আলাপ না থাকলেও তাঁর কয়েকটি বক্তৃতা শুনেছি। আবুল হোসেনের সঙ্গে জীবনের শেষের কয়েক বছর নৈকট্য পেয়েছিলাম। নানা উপলক্ষ্যে শামসুর রাহমানের আড্ডাসান্নিধ্য পেয়েছি তাঁর আমৃত্যু! আশির দশকে তিন চার বছর আল মাহমুদের সঙ্গে প্রায় নিয়মিত আড্ডা দিয়েছি! আশির দশকের একেবারে গোড়ার দিক থেকে শুরু করে আমৃত্যু আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে ছিল আমার গভীর সখ্য। এঁরা সকলেই বাঙালি মুসলমান সমাজের আধুনিকতা অভিমুখি জীবনবোধ ভিত্তিক সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব। আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান ও আবুল হোসেনের ভূমিকা যতটা পথিকৃতের অন্যদের কৃতি তুলনায় প্রতিভাবানের। বিশেষ করে শামসুর রাহমান ও আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্যের জন্য যেমন নিবেদিত ছিলেন তা আমাদের সমাজে বিরল। আমি সাহিত্যে সর্বসত্তা নিমগ্নতার দিক থেকে আবদুল মান্নান সৈয়দকে আরেকটু এগিয়ে রাখব! তিনি একাধারে যেমন সৃষ্টিশীল ছিলেন তেমনি ছিলেন নকাল্পনিক সাহিত্য সৃষ্টিতে অবিরল। আমাদের সমাজের প্রায় কোনো সাহিত্যিক তরঙ্গই তাঁর মননসীমার বাইরে যেতে পারেনি!

৯. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।

আহমাদ মাযহার : ২০২৪ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত স্মৃৃতিতে ও সান্নিধ্যে এবং মৌহূর্তিকী আমার সর্বশেষ দুটি বই। স্মৃতিতে ও সান্নিধ্যে ২৮ জন প্রয়াত বিশিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে লেখা প্রবন্ধ। স্মৃতি ও সান্নিধ্যের কথা উল্লিখিত হলেও এতেই সীমিত নয়! ২০২৩ সালে প্রকাশিত আমার অনূদিত বই হেমিংওয়ের দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী-র কথাও বলব, কারণ বইটি মূলত অনুবাদ হলেও এতে একটা দীর্ঘ অভিনিবেশ সহ লেখা লম্বা ভূমিকা যোগ করে এটিকে একটি স্বতন্ত্র বই হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। ২০২১ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তবুদ্ধি নামের প্রবন্ধের বইটিকেও সাম্প্রতিক বই হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এর আগের বইগুলোর কথা না-হয় আর উল্লেখ করলাম না অতীতের কাজ বিবেচনা করে!

১০. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?

আহমাদ মাযহার : আমি লেখক কবিদের দশক কোঠায় ফেলতে পছন্দ করি না। নিজেও প্রতিনিধিত্ব করতে চাই না! হয়তো এ কারণেই কোনো নির্দিষ্ট জনরার প্রতিনিধি হিসেবে কোনো নির্দিষ্ট দশকের প্রতিনিধি হিসেবে আমার নাম কোথাও আসেওনি! আমার লেখার তাৎপর্য কালাতিক্রম করলে আমার লেখা পরবর্তী কালে উল্লিখিত হবে, কিন্তু তাৎপর্য না থাকলে হবে না! এ নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই। কিন্তু যদি প্রথম লেখা ছাপা হবার কাল থেকে ধরা হয় তাহলে ১৯৭৮ সাল থেকে পত্র পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশ হতে শুরু করে! সেই অর্থে আমি সত্তরের দশকের লেখক। আর প্রথম বই প্রকাশের কাল ধরা হলে ১৯৮৫ সালে ছোটদের কবিতার বই ঘুমের বাড়ি প্রকাশের সূত্রে আমি আশির দশকের লেখক। অন্যদিকে লিটল ম্যাগাজিন অনিন্দ্য-সংবেদ-রূপম-কিছুধ্বনি কিংবা আহসান হাবীব সম্পাদিত দৈনিক বাংলার সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত লেখা থেকে ধরলে আমি আশির দশকের লেখক। তাই আমি নিজে দশকীর কোন ট্রেনের যাত্রী তার কোনো মীমাংসা করতে চাই না!

১১. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।

আহমাদ মাযহার : এক অর্থে সব কালই জটিল।  আমাদের সময়ও ব্যতিক্রম নয়! গোলোকায়নের নামে দুনিয়াব্যাপী অর্থনীতির আলোকে বিন্যস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থায় নানা উপায়ে শ্রমশোষণের মাধ্যমে স্বল্পসংখ্যক মানুষের কাছে অর্থের পুঞ্জীভবন চলছে। মানবাধিকারের কথা বাহ্যত জোর দিয়ে বলা হলেও মানবাধিকারেরই লঙ্ঘন ঘটছে বেশি! এরই সূত্রে সারা পৃথিবীতে সংকীর্ণ অর্থে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রাবল্য বৃদ্ধি এই সময়ের আরেকটা বৈশিষ্ট্য! ধর্মের নির্দেশনায় যে মানবিকতার কথা বলা হয় ধর্মের উল্লেখ করে সে মানবিকতার লঞ্ছনার পরিমাণও আনুপাতিক হারে আমাদের কালে বেড়েছে মনে হয়! অর্থলোভী মানুষ পৃথিবীর প্রাকৃতিকতাকে ধ্বংস করে অর্জন করছে মুনাফা! বাংলাদেশেও পড়েছে এর ব্যাপক প্রভাব! মূল্যবোধের ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও মানুষের মুক্তি লাভের বাস্তবতা যেন সরে গেছে আরো দূরে! যে জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশের মানুষের মানবাধিকার অর্জনের মাধ্যম তথা মানবমুক্তির মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল তা এখন কেবল ক্ষমতা ও অর্থবিত্ত অর্জনের অস্ত্র হিসেবে অনুশীলিত হচ্ছে! তবে মানসিকতার রূপান্তর কোনো একটা অভিমুখ পেলে হয়তো আমরা আশাবাদী হতে পারব। রূপান্তরের বাস্তবতাকে আমাদের বিবেচনা করতে হবে।

১২. সাম্প্রতিক কালে কারা ভালো লিখছে বলে মনে করেন?

আহমাদ মাযহার : অনেকেই ভালো লিখছেন। আমার তো মনে হয় আমাদের সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক তরুণ লেখক ভালো লিখছেন। এখন যাঁরা ভালো  লিখছেন তাঁদের দু একজনের নাম হয়তো বলতে পারি যাদের লেখা আমার কিছুটা মনোযোগ সহকারে পড়া হয়ে উঠছে। যেমন মাত্রই পড়ে উঠলাম হাসান রোবায়েতের ছায়াকারবালা। তাঁর মুসলমানের ছেলেও ভালো লেগেছিল। ভালো লাগে রিমঝিম আহমেদ ও রুম্মানা জান্নাতের কবিতা। এঁদের কারো সঙ্গেই ব্যক্তিগত জানাশোনা নেই! আমার নিজস্ব সন্ধানী পাঠ থেকেই এদের লেখা ভালো লেগেছে। এমনি ভাবে আরো অনেকের লেখা আমার ভালো লেগেছে। বিশেষ করে অনুভব করছি মেয়েদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ভালো লিখছেন! গল্প-উপন্যাসে কিংবা সাহিত্য-সমালোচনা মূলক প্রবন্ধ ভালো লিখছেন এমন লেখকও বেশ কয়েক জনকে আমার পছন্দ! যেমন তাৎক্ষণিক ভাবে মনে পড়ছে বর্ণালী সাহার কথা। বিভিন্ন সূত্রে বর্ণালীর গল্পপাঠ মানে আমার কাছে বিশ্বজগৎ, জীবন ও বিচিত্র শিল্পমাধ্যমের মর্মসংগ্রন্থনকে আস্বাদন! জীবনোপলব্ধি ও শব্দব্যঞ্জনায় বিভিন্ন শিল্পবিহারী ক্ষমতায় সামর্থ্যবান তাঁর মতো কথাসাহিত্যিক আমাদের কালে আর কেউ আছেন কিনা সন্দেহ। বিশেষ করে সংগীতসংস্কৃতিকে জীবনের দৈনন্দিনতায় সম্পর্কিত করার গুণে আবদুশ শাকুর ছাড়া আমাদের সাহিত্যে আর কারো মধ্যে আভাসমাত্র পেয়েছি বলে মনে পড়ে না! একজন ঢাকা নগরীতে জাত মানুষ হিসেবে এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক চৈতন্যকে ধারণে তাঁর সহজতাও তাঁকে আমার নিকটজন করে তুলেছে। জীবনবোধে বিচিত্র ঢাকাই অনুষঙ্গ উপস্থাপনার ভঙ্গিমা সৃষ্টি করেছে রসবৈচিত্র্য!

হয়তো তরুণতরদের মধ্যে যাদের অনেকের লেখা পড়েছি তা নিয়ে একটা রচনা আমি লিখেও ফেলতে পারি। তাই এখানে দু একজনের নাম বলে রাখলে হয়তো আমার বিবেচনার প্রতি সুবিচার হবে না! বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা অবস্থান থেকে যাঁরা লিখছেন তাঁদের কথা আমি আলাদা মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে লিখতে চাই। সেজন্য এখানে কারো নাম আলাদা করে বলতে চাই না। যাদের নাম উল্লেখ করেছি আকস্মিকভাবে মনে এসেছে বলে উল্লেখ করেছি। তবে  এটুকু বলে রাখা যায় যে, বাংলাদেশের অনেক বিলীয়মান স্থানিকতাকে যেমন ধারণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের লেখায় তেমনি আবার স্থানিকতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বৈশ্বিক বিচিত্র অনুষঙ্গও! সমালোচনা-সাহিত্য এখন নতুন দৃষ্টিকোণ পাচ্ছে। সেসব নিয়ে স্পষ্ট ও সামগ্রিকভাবে বলবার জন্য আমার নিজের দিক থেকে আরো পর্যবেক্ষণের অবকাশ রয়েছে! আমি অবশ্য খুঁজে খুঁজে অনেকের লেখা পড়ে বুঝতে চেষ্টা করি। কারণ বাংলাদেশের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ বিকশিত হবে তাদের হাতেই!

১৩. কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।

আহমাদ মাযহার : স্ত্রী অভিনয়শিল্পী শিরীন বকুল ও একমাত্র পুত্র সুদীপ্ত প্রিয়দর্শনকে নিয়ে ২০১৭ সাল থেকে আমি নিউ ইয়র্ক মহানগরীর কুইন্স বরোতে বসবাস করছি। সুদীপ্ত প্রিয়দর্শন কিউনি থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতক। এখন একটি ইউনিয়ন-সেবা সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত!

নিউ ইয়র্কে এসে খুব সাধারণ জীবিকা অর্জনের জন্য একটা কাজ তো করছিই। কিন্তু মূলত সাহিত্য চর্চাই করছি নিবিষ্টতর ভাবে। প্রতি বছরই দু একটি করে বইও বের হচ্ছে। চলছে অনেকগুলো অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপিতে সংযোজন সংস্কার ও পরিমার্জনা।

সবসময়ই আমি খুব আটপৌড়ে জীবন যাপনের নির্ভারতার মধ্যে থেকেই জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছি। কিন্তু আমার মতো পারিবারিক সাংস্কৃতিক ও অর্থিক পর্যায়ের পটভূমি থেকে উঠে এসে একজন মানুষের পক্ষে সাহিত্যিক জীবন যাপন করে কোনো রকমে বাংলাদেশে টিকে থাকাও অনেক কঠিন। বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলেও আমার প্রবেশাধিকার নেই বলে সেই ক্ষেত্রের সহযোগ পাওয়া সম্ভব নয়! আকস্মিকভাবে স্ত্রীর সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ এলে নানা দিক বিবেচনা করে আমি এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। যুক্তরাষ্ট্র সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন আয়ের আর্থিক বিন্যাসে বসবাস করেই আমি আমার জীবন যাপন ও সাহিত্য অনুশীলন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। একে এক অর্থে সীমিত যাপনের পরিমিতিতে থেকে অপরিমেয়ের সাধনা বলে কৌতুকও করা যেতে পারে!

১৪. স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সাহিত্য–কোন ধারায়? কিভাবে প্রবাহিত হয়েছে– হচ্ছে–বলে আপনি মনে করেন?

আহমাদ মাযহার : স্বাধীনতাপূর্ব কালে আমার মনে হয় আমাদের লেখকদের মধ্যে আধুনিক জীবনবোধ অর্জনের তৃষ্ণা ছিল বড়। একই সঙ্গে আত্মআবিষ্কারের প্রেরণা! দারিদ্র্যের জন্য দায়ী সমাজের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশেও প্রাধান্য নির্ভর ছিল সাহিত্যের অন্যতম ধারা। বিশ্বকে দেখা হতো বাংলাদেশের স্থানিক দৃষ্টিকোণ থেকে। সোভিয়েত-চীন প্রভাবিত সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রগতিশীল জীবনদৃষ্টি মনে করা হতো! ফ্রয়েডীয় লিবিডো চেতনারও একটা তরঙ্গ ছিল! সেইসব লেখকেরাই সমাজে গুরুত্ব পেতেন যাঁরা গ্রামজীবনের ভাঙন ও শহর গড়ে উঠতে-থাকা জনিতকারণে সৃষ্ট জীবনের জটিলতাকে ধারণ করতেন!

স্বাধীনতার পরের সাহিত্যেও অন্তত তিন দশক রুশ-চীন প্রভাবিত সমাজতান্ত্রিক মোহগ্রস্ত জীবনবোধেরই প্রাধান্য ছিল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নৃশংসতা আমাদের সাহিত্যকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধপূর্ব যে জীবনবোধ বিস্তার লাভ করেছিল স্বাধীনতার পরপরই তা আহত হতে শুরু করে। ১৫ আগস্টের ঘটনায় দ্রুত সামরিক শাসনের প্রত্যাবর্তন, পাকিস্তান আমলের যে সাংস্কৃতিকতা থেকে সরে যাওয়া ছিল বাংলাদেশের মানুষের রাষ্ট্রস্বপ্নের ভিত্তি অতি দ্রুতই তার পতন দেশের মানুষকে যে হতবিহ্বলতায় আচ্ছন্ন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার প্রভাব প্রবল হতে থাকলে আমাদের সাহিত্যে প্রচ্ছন্ন বাঁক বদল শুরু হয়! ‘প্রগতিশীল’ দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য কমে। নতুন নতুন মূল্যবোধের মূল্য বাড়ে। জীবনবোধ আরো জটিল হয়। সরল দার্শনিকতার আর প্রাধান্য থাকে না! ভাষাবোধের সংস্কার বদলে যায়। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে জীবনসংগ্রামের বৈচিত্র্য আসে। অর্থনীতির নিয়ামকশক্তি আগের তুলনায় বেশি হওয়ায় সাহিত্যে এর ছাপ পড়ে। টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের বিস্তারে বিশ্বঅভিজ্ঞতা সহজতর হয়, আমাদের জীবনবোধে এর প্রভাব পড়ে। সে প্রভাব আমাদের সাহিত্যকে কিভাবে প্রভাবিত করে চলেছে তার পরিচয় এখনো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি আমাদের শক্তিশালী সমালোচনাসাহিত্যের অভাবে। কিন্তু আমার বিক্ষিপ্ত পাঠে আমি এমনটাই অনুভব করি!

১৫. আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।

আহমাদ মাযহার : আশির দশকে কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে যুক্ত ছিলাম! ১৯৮২ সালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যখন তৃতীয় পর্বে কণ্ঠস্বর বের করেন তখন সহকারী সম্পাদক হিসেবে আমি যুক্ত হই! প্রায় একই সময় পারভেজ হোসেন ও শহিদুল আলম যখন ‘সংবেদ’ প্রকাশ করার কথা ভাবেন তখন থেকে আমিও তাঁদের সঙ্গে যুক্ত।  ১৯৮৫ সালে আন্ওয়ার আহমদ আমাকে তাঁর রূপম-কিছুধ্বনি-সাহিত্য সাময়িকীর সঙ্গে যুক্ত করেন! রূপমের তিনটি সংখ্যা আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও ১ টি সংখ্যাতেই আমার নাম মুদ্রিত হয়েছিল ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসাবে। প্রথম সংখ্যাটির লেখা পুরোপুরি আমার পরিকল্পনায় সংগৃহীত না হওয়ায় আমার নাম উল্লেখ করতে দিইনি। তৃতীয় সংখ্যাটির বেলায় আমার সম্পাদনায় কাজ শেষ হলেও এক জন লেখককে নিয়ে আমার সঙ্গে সম্পাদকীয় নীতিতে মতভেদ দেখা দিলে আমার নাম প্রত্যাহার করে নিই! ১৯৮৬ সালে লিয়াকত আলি প্রেক্ষিত নামে একটি সমাজবিজ্ঞান ও রাজনীতি বিষয়ক পত্রিকা বের করেন। আমি ওই পত্রিকার সঙ্গেও দুটি সংখ্যায়  যুক্ত ছিলাম সহকারী সম্পাদক হিসাবে। এ ছাড়াও কোনো নামোল্লেখ ব্যাতিরেকেও নানা ধরনের সংকলনের সম্পাদনা ও প্রকাশনায় আমি যুক্ত ছিলাম। তবে শুধুমাত্র বই-সমালোচনার ত্রৈমাসিক কাগজ বইয়ের জগৎ আমি ৬ বছর সম্পাদনা করেছি। সরাসরি বাংলাভাষায় ও বাংলাদেশে রচিত বিচিত্র ধরনের বইয়ের সমালোচনা নিয়ে বইয়ের জগৎ প্রকাশ করতাম! কোনো ধরনের কর্পোরেট বিজ্ঞাপন তাতে গ্রহণ করা হতো না। কেবলমাত্র স্বল্পমূল্যের বইয়ের কিছু বিজ্ঞাপন ছাপা হতো। বিজ্ঞাপনের টেক্সট ও ডিজাইন প্রস্তুতিতেও এক ধরনের পরিশীলনের প্রয়াস ছিল!

১৬. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।

আহমাদ মাযহার : লিটল ম্যাগাজিন বলতে আমি সংক্ষেপে শিল্প-সাহিত্য-রাষ্ট্র-সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ে যোগ্যতর সামর্থ্যের ও স্বাধীন চিন্তার অনুশীলনপ্রয়াসী পত্রিকা বুঝি। প্রকাশনায় আর্থিক ও ক্ষমতাগত সহযোগিতা পাওয়ার বিনিময়ে কোনো ব্যক্তি বা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিয়ে প্রকাশিত পত্রিকাকে আমি লিটলম্যাগাজিনদূষণ মনে করি!

১৭. অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন  চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?

আহমাদ মাযহার : ওয়েব ম্যাগাজিন বা অনলাইন ম্যাগাজিন সময়ের মাধ্যম। লিটল ম্যাগাজিনের কাছে আমরা যেমন প্রত্যাশা করি অনলাইন বা ওয়েব ম্যাগাজিনের কাছেও আমরা ইচ্ছে করলে তেমন প্রত্যাশা করতে পারি! কিন্তু জনপ্রিয়তা ছাড়া এ ধরনের ম্যাগাজিন টিকে থাকতে পারে না বলে এ ধরনের ম্যাগাজিনে শঠতারও আশ্রয় নেয়া সম্ভব হয়! মুদ্রিত কপি সংরক্ষণ করা যত সহজ অনলাইন ম্যাগাজিন সংরক্ষণ সহজ নয়।

১৮. আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা বলতে আপনি কি বোঝেন? বাংলাদেশের কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

আহমাদ মাযহার : আধুনিকতা বলতে আমি সাধারণভাবে বুঝি উৎকর্ষাকাঙ্ক্ষায় জীবনানুশীলনের মধ্য দিয়ে রূপান্তরমুখী জীবনবোধ। তবে বিশশতকের ‘আধুনিকতাবাদ’ বা ‘আধুনিকবাদ’ বৈচিত্র্যের মধ্য ধৃত বিশেষ এক ধরনে দার্শনিক আন্দোলন। উত্তরাধুনিক দৃষ্টভঙ্গি মূলত আধুনিকবাদেরই ক্রিটিক্!

বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে আমার মনে হয় পাশ্চাত্ত্যের আধুনিকবাদের প্রভাবে গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে যে ধরনের কবিতা লেখা হয়েছে তার ক্রিটিক হয়েছে লোকজীবন তথা লোকসাহিত্যের পুনর্নবায়ন ও ধর্মানুষঙ্গ আমাদির মধ্য দিয়ে। কবিতার সৃজনকলায় উত্তরাধুনিকতা কিংবা আধুনিকোত্তরতা আমার কাছে তখনই গুরুত্বপূর্ণ যখন সামগ্রিক অর্থে একটি কবিতার সার্থকতায় তা কোনো ভূমিকা রাখতে পারে!

১৯. আদি বাংলা তথা চর্যাপদ থেকে আজ অবধি বাংলা সাহিত্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে–আপনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণে?

আহমাদ মাযহার : আপনার উল্লিখিত বিষয়ে একটা সামগ্র্যধর্মী মত দিতে হলে যে মাত্রায় বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কিত পাঠ ও অনুধাবন অনুশীলন দরকার তা আমার যথেষ্ট নেই বলে এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করলাম না। তবে এটুকু বলতে পারি বাংলাভাষার সাহিত্যের যেটুকু সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে তা আমাকে জীবনঅনুধাবনে যথেষ্ঠই জলসিঞ্চন করে!

২০. আপনি একাধারে একজন কবি-সম্পাদক-সাহিত্যবিশ্লেষক–অর্থাৎ বহুমাত্রিক। আপনার অভিজ্ঞতা ও বিচরণক্ষেত্র ব্যাপক ও বর্ণিল। বিচিত্র। এই সামগ্রিক সত্তাকে কিভাবে দেখেন? কিভাবে উপভোগ করেন?

আহমাদ মাযহার : আমি মনে করি একজন সাহত্যিক অস্তিত্বশীল হয়ে থাকেন তাঁর জীবনবোধের সামগ্র্যে, তা যে মাধ্যমের লেখকই তিনি হন না কেন! সুতরাং আমার কাজের ধরনে ও মাধ্যমে আপাতবৈচিত্র্য থাকলেও সবটাই একই সত্তার উৎসারণ। মানুষ তার জীবনবোধের সাহিত্যিক রূপ দেয়ার জন্য নানা পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সংরূপ বেছে নেয়। হয়তো শৈল্পিক সামর্থ্যে সকল প্রকাশ সার্থক নাও হতে পারে। আমিও আমার প্রকাশের মাত্রাগুলোকে এই দৃষ্টিতেই দেখে থাকি!

২১. আপনি কবিতায় মিথ, ধর্ম ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করা বিষয়ে কি ভাবেন? বিশেষত ইসলামিক বিষয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি ব্যবহার করা বিষয়ে। 

আহমাদ মাযহার : সাহিত্য চর্চায় আমার ভাবনার জন্য আমি আমার স্বাভাবিক জীবনবৃত্তকেই অবলম্বন করি। অর্থাৎ বিশ্বজীবনের দিকে তাকাই আমার নিজের সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে। মিথের ব্যবহার আসে ব্যক্তিজীবনের মননঅনুশীলন থেকে। আমি যেহেতু একটি বাঙালি মুসলমান সাংস্কৃতিকতার মধ্যে জন্মেছি ও বিকশিত হয়েছি তাই অন্যান্য ধর্মসংস্কৃতিকতাকেও আমাকে বুঝতে হয়েছে জীবনবোধের বিকাশের অনুকূলে। আমার রচনায় মিথ যদি এসে থাকে তাহলে তা এসেছে আমার স্বাভাবিক জীবনবোধের আলোকেই। সে দিক বিবেচনায় ইসলামি অনুষঙ্গও এসেছে। হয়তো পরিমাণে বেশিই এসেছে। কিন্তু এর পটভূমিতে বিশেষভাবে ইসলাম-বিবেচনা কাজ করেনি!

২২. সাম্প্রতিক বাংলাদেশে, শিল্প-সাহিত্যচর্চায় কোন-কোন চ্যালেঞ্জ বা সুবিধা-অসুবিধা আছে বলে আপনার মনে হয়? কীভাবে এগুলি মোকাবিলা করেন?

আহমাদ মাযহার : আমার মনে হয় চ্যালেঞ্জ সব কালেই থাকে। প্রতিভা বা যোগ্যতাও অনেকেরই আছে। কিন্তু যার অভাব তা হলো সততা! সাহিত্যিকের জীবনবোধ তার সততার ওপর ভিত্তি করেই সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু প্রতিভাবানও যদি আত্মপ্রবঞ্চনা করেন তাহলে তাঁর প্রতিভাও যথেষ্ট হয় না সৃজনশীলতার উৎকর্ষের জন্য! যত কায়দা করেই প্রতিষ্ঠা অর্জন করা যাক না কেন প্রকৃত সুবেদী পাঠকের সত্তায় ফাঁকিগুলো ঠিকই ধরা পড়ে যায়! আমি সাহিত্য চর্চার শুরুতেই অনুধাবন করেছিলাম যে প্রতিভাসামর্থ্যে আমি তেমন শক্তিমান নই। পরিশ্রম অধ্যবসায় উপলব্ধির সৎ অথচ অচটকদার প্রকাশে আমি যদি অনুশীলন করি তাহলে আমার সাহিত্য চর্চা কিছু তাৎপর্য পেতে পারে। পরিণাম আমার অজানা; তাই বলা যেতে পারে অনুশীলনেই আমার অবলম্বন। এটাই আমার চেষ্টা!

২৩. আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে? আপনার কল্পনায়।

আহমাদ মাযহার : আমি মানুষের সৃষ্টিশীলতার ওপর আস্থাশীল। আগামী দিনে আমাদের জীবনযাত্রা সেসব বিষয় ও অনুষঙ্গের ওপর নির্ভরশীল হয়ে নির্বাহ হবে তা-ই হবে আমাদের সাহিত্যের ভিত্তি! সাহিত্য যেহেতু মানুষের জীবনকে নির্ভর করে এগিয়ে চলে সেহেতু কালের নানা জিজ্ঞাসা তাকে প্রভাবিত করবে। যেমন বাংলাভাষার সাহিত্য এক সময় ছিল মূলত বাংলাদেশ ভূখণ্ডের স্থানিকতা ভিত্তিক জীবনবোধ নির্ভর ভবিষ্যতে বাংলাভাষার সাহিত্য হবে বাংলাভূখণ্ডজাত সাংস্কৃতিকতা উৎসের বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার বাস্তবতা দ্বারা প্রবলপ্রভাবিত! এটুকু আভাস এখনই দেখা যাচ্ছে!

সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব 

এপ্রিল ০৮, ২০২৪ 

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on দু’টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on পাখিমানুষ