spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যনানান দেশের ঈদ

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

নানান দেশের ঈদ


কাজী জহিরুল ইসলাম


ধর্মানুভূতির ব্যাপারেই মানুষ সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল। ধর্মীয় অনুশাসন মানার ক্ষেত্রে মানুষের যত আগ্রহ তার চেয়ে অধিক আগ্রহ ধর্মীয় উৎসব পালনে। অনুশাসনগুলি, অর্থাৎ ধর্মীয় বিধি-নিষেধগুলি, ধর্ম-বৃত্তের মধ্যেই শৃঙ্খলিত থাকে কিন্তু উৎসব-পার্বন সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। একই ভাষা ও সংস্কৃতির দুজন মানুষ যখন দুই ধর্মের অনুসারী হন, এবং তারা যখন তাদের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলেন, খুব দ্রুতই তারা মতানৈক্যে পৌঁছে যান এবং বিবাদের আশঙ্কা তৈরি হয়। কিন্তু তারা যখন ধর্মীয় উৎসব নিয়ে আলোচনা করেন তাদের মধ্যে বিবাদের আশঙ্কা অনেক কম দেখা দেয় কারণ কালক্রমে ধর্মীয় উৎসবগুলি বহু-ধর্মের দেশ ও সমাজে সকলের উৎসবে পরিণত হয় এবং তা সেই ভূখণ্ডের সংস্কৃতি হয়ে ওঠে। এই অবস্থাটি আমার বিবেচনায় ইতিবাচক।
পৃথিবীতে দুশ কোটি মানুষ ঈদ উদযাপন করেন। ঈদের নামাজ পড়ার নিয়ম সর্বত্র একই কিন্তু ঈদ কেবল নামাজেই সীমিত নয়। এর সঙ্গে খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, উদযাপনের ধরণ এইসব অনুষঙ্গ যুক্ত এবং তা দেশে দেশে ভিন্ন। বাংলাদেশের মুসলমান নারীরা যেমন ঈদে দামী শাড়ি কেনেন, সোনার গহনা কেনেন, বাড়িতে পোলাও-কোর্মা রান্না করেন, হিন্দু নারীরাও দূর্গা পূজায় শাড়ি-গহনা কেনেন, ভালো খাবার রান্না করেন। এই দিক থেকে দুটি উৎসব উদযাপন রীতির মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। আবার বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মুসলিম নারীদের ঈদ উদযাপন কিন্তু ভিন্ন। তারা ভিন্ন ধরণের পোশাক পরেন, ভিন্ন ধরণের সাজগোজ করেন, ভিন্ন ধরণের খাবার রান্না করেন। কাজেই উৎসবের ভিত্তিটা ধর্ম হলেও উদযাপন-রীতি সাংস্কৃতিক। যে কারণে মিশ্র-ধর্মের দেশে আমরা প্রায়শই বলতে শুনি “ধর্ম যার যার উৎসব সবার”।
কর্মসূত্রে আমি পৃথিবীর নানান দেশে কাজ করেছি, থেকেছি। দেশের বাইরে বহু ঈদ কাটিয়েছি। বহু-বিচিত্র ঈদ-অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে আমার ঝুলিতে। অর্ধশতাধিক দেশ ভ্রমণ করলেও বাংলাদেশের বাইরে পৃথিবীর পাঁচ অঞ্চলের পাঁচটি দেশে লম্বা সময় কাটিয়েছি। পূর্ব ইউরোপের কসোভো, পশ্চিম ইউরোপের যুক্তরাজ্য, পশ্চিম আফ্রিকার আইভরি কোস্ট, পূর্ব আফ্রিকার সুদান এবং অতলান্তিকের ওপারের দেশ যুক্তরাষ্ট্র, এই পাঁচটি দেশে গত ২৩ বছর বসবাস করেছি এবং এখনও করছি। এই পাঁচ দেশে আমার ঈদ উদযাপনের কিছু অভিজ্ঞতা আজ উপস্থাপন করবো।
যুদ্ধের দ্রোহা পোড়া এক জনপদ কসোভো। সার্বিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন দেশ হবার জন্য লড়াই করছে। ১৯৯৯ সালের জুন মাসে ন্যাটো এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বিরতি হয়। তখন প্রভিন্সটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় জাতিসংঘ। আমি সেখানে যাই দুই হাজার সালের এপ্রিল মাসে। জল নেই, আলো নেই, হিট নেই, রাস্তায় খানাখন্দ, টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিকল। এক ভুতুড়ে জনপদ। সেই দেশে জেনারেটর চালিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সিভিল ও ভোটার রেজিষ্ট্রেশন করতে হবে। সেইরকম একটি টিমের নেতৃত্ব দিতে হবে আমাকে। কাজে লেগে যাই। এই কাজ করতে গিয়ে ছুটে গেছি কসোভোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে, দোভাষীর সাহায্য নিয়ে স্থানীয় নেতাদের সাথে সভা-সমাবেশ করেছি, গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলেছি। তখন কসোভোর ৮৫ শতাংশ মানুষ ছিল আলবেনিয়ান, ১২ শতাংশ সার্বিয়ান এবং ৩ শতাংশ অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর। আলবেনিয়ানদের ৯০ শতাংশ ছিল মুসলমান আর দশ শতাংশ খ্রিস্টান। ধর্ম ওদের দ্বন্দ্বের মূল কারণ ছিল না। দ্বন্দ্বের মূল কারণ ছিল ভাষা ও সংস্কৃতি। সার্বিয়ান ভাষা ছিল সার্বিয়ার শাসকদের ভাষা এবং কসোভোর মাত্র ১২% মানুষের ভাষা। অথচ এটিই ছিল কসোভোর দাপ্তরিক ভাষা। সার্বিয়ানরা খ্রিস্টান, ১০ শতাংশ আলবেনিয়ানও খ্রিস্টান, কিন্তু এই দুই খ্রিস্টানের মধ্যে ছিল চরম শত্রুতা। অথচ ৯০% আলবেনিয়ান মুসলমানের সাথে ১০% আলবেনিয়ান খ্রিস্টানের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না, ছিল স্বাভাবিক সম্পর্ক।
কসোভোর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান হলেও ধর্মীয় অনুশাসন মানার লোক খুব কমই চোখে পড়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে দীর্ঘ দিনের কম্যুনিস্ট শাসন এবং সদ্য খুলে যাওয়া পশ্চিম ইউরোপের প্রভাব। প্রতিটি গ্রামেই মসজিদ আছে কিন্তু নামাজ পড়তে যাচ্ছে তেমন মুসুল্লির সংখ্যা খুব কমই চোখে পড়েছে। বড়োজোর ৪/৫ জন বৃদ্ধ লোককে নামাজের ওয়াক্তে মসজিদে যেতে দেখা যেত। তরুণী মেয়েরা পশ্চিম ইউরোপের মতোই খোলামেলা পোশাক পরত, বয়ফ্রেন্ড রাখত। অবাধ ও অনৈতিক যৌনচর্চা তরুণ সমাজের কাছে ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু ওরা বুক ফুলিয়ে নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দিত। আমি অনেক তরুণ-তরুণীকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, ওরা ঠিকমত একটি কলেমা জানে না, একটি সুরা জানে না। তবে অনৈতিক কাজগুলো যে অনৈতিক এটা সবাই জানে।
আলবেনিয়ান মুসলমানেরা খুব অতিথিপরায়ন। উৎসব ছাড়াই আমি অনেক গ্রাম-প্রধানের বাড়িতে অতিথি হয়ে গেছি। ওদের অতিথি আপ্যায়নের সংস্কৃতি তুলনাহীন। গৃহকর্ত্রী অতিথির জুতোটা মুছে পরিস্কার করে দেন। এটিও অতিথি আপ্যায়নের একটি অংশ। কিন্তু আমি দেখিনি ঈদের দিন আমার কোনো আলবেনিয়ান সহকর্মী আমাকে তাদের বাড়িতে দাওয়াত করেছে। আমরা যেমন দাওয়াত ছাড়াই ঈদের দিন একে অন্যের বাড়িতে যাই, ওদের তা করতে দেখিনি। বেশ কিছু ঈদ আমি কসোভোতে কাটিয়েছি। ঈদের জামাতে গিয়ে আমার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে। ওদের কাছে নামাজটাও উৎসবের একটি অংশমাত্র। আমি দেখেছি নামাজের মাঝখানে উঠে গিয়ে জুতো ঠিক করছে, একে-অন্যের সঙ্গে কথা বলছে, আবার রুকুতে যাচ্ছে, সেজদায় যাচ্ছে। ঈদকে ওরা বলে বাইরাম। রমজান বাইরাম এবং কুরবান বাইরাম। ঈদে বড়োরা পরিস্কার এবং মূল্যবান পোশাক পরে, শিশুরা নানান রকম উপহার পায়, বাড়িতে ভালো খাবার রান্না হয়। ঈদের প্রধান খাবার হচ্ছে বিরিয়ান মে মিশ। ভেড়ার মাংসের বিরিয়ানি। এ ছাড়া বেশ কিছু মিষ্টান্ন রান্না করে। তুর্কি সংস্কৃতির প্রভাব ওদের খাবার, পোশাক এবং সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বিদ্যমান। মেয়েদের প্রথাগত থ্রি-পিস পোশাক পেশতিয়েলাকের আধুনিক সংস্করণ পরতে দেখা যায় ঈদের দিন। পুরুষেরা অন্য সকল উৎসবের মতো ঈদের দিনও স্যুট পরতে পছন্দ করে। যে কোনো উৎসবেই ওরা কালো শিপনঈয়া (দুই মাথাঅলা পাখি) খচিত রক্তলাল আলবেনিয়ান পতাকা নিয়ে মিছিল করে। ঈদেও তা করতে দেখা যেত।
একটা পর্যায়ে কসোভোতে কর্মরত হাতে গোনা কিছু বাঙালি পুলিশ, মিলিটেরি এবং সিভিলিয়ানদের নিয়ে আমরা গড়ে তুলি বাঙালি সমাজ, আমাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কিছু বাঙালিও (হিন্দু, খ্রিস্টান) যোগ দেন। তখন থেকে ঈদ এবং বিভিন্ন জাতীয় উৎসবে আমরা একত্রিত হতাম, প্রত্যেকে সাধ্যমতো খাবার রান্না করে নিয়ে আসতাম, উপহার কিনে আনতাম, এভাবে আমরা আমাদের মত করে বাঙালিয়ানায় উদযাপন করতে শুরু করি আমাদের ঈদ। প্রকৃতপক্ষে উৎসব-পার্বনে ধর্ম মানুষের তৃষ্ণা মেটায় না, তৃষ্ণা মেটায় সংস্কৃতি। কসোভোর মুসলমানেরা দীর্ঘদিন কম্যুনিস্ট শাসনের যাঁতাকলে থেকে ধর্ম ভুলে গেলেও ভুলে যায়নি বাইরাম-উৎসব, কেননা বাইরাম হয়ে উঠেছে ইলের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
২০০৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এক লম্বা সময় আমি বসবাস করেছি পশ্চিম আফ্রিকার আইভরি কোস্টে। আড়াই কোটি লোকের বাস এই দেশে। খ্রিস্টান এবং মুসলমানের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। ৩৮% মুসলমান এবং ৪৪% খ্রিস্টান, বাকিরা এনিমিস্ট বা নানান রকম মূর্তি, দেব-দেবী ও জীব-জন্তুর উপাসক। এক সময় পশ্চিম আফ্রিকার সবচেয়ে সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক শক্তি ছিল আইভরি কোস্ট। টোগো, বুরকিনা ফাসো, নিজার, ঘানা থেকে প্রচুর অভিবাসী এসে স্থায়ী আবাস গড়েছে এখানে। উত্তর এবং দক্ষিণের গৃহযুদ্ধ, যাকে রাজনীতিকরা মুসলিম ও খ্রিস্টানের যুদ্ধে পরিণত করেছে, দেশের অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করে। ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দফায় দফায় এই যুদ্ধ চলে। মুসলিম নেতা আলাসান উয়াত্তারাকে হাফ-আইভরিয়ান হবার কারণে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করে দেশটির সংবিধান। মেয়াদ পেরিয়ে যাবার পরেও প্রেসিডেন্ট লরেন্ট বাগবো ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ ছিলেন, এই দুটি কারণ দেশটিকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।
জাতিসংঘ সে-দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পা রাখলে আমিও সেই মিশনে যোগ দিই এবং দেশটিতে অবস্থান করি দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছর। এই সময়ে অনেকগুলো ঈদ কাটিয়েছি আইভরি কোস্টে। আবিদজানে বিশাল ঈদগাহ আছে, সেখানে ঈদের নামাজ পড়েছি, আইভরিয়ান মুসলমানদের বাড়িতে দাওয়াত খেয়েছি। ঈদের দিন নামাজ পড়া, কোলাকুলি করা, নতুন কাপড় পরা, মিষ্টান্ন খাওয়া এর সবই ওদের সংস্কৃতিতে আছে। আইভরিয়ান পুরুষেরা ঈদের দিন ফোর-পিস প্রথাগত পোশাক বুবু পরিধান করে। বুবু সেটে থাকে পাজামা, কোর্তা, কোর্তার ওপরে থাকে দুই বাহুর নিচে খোলা বিশাল এক আলখাল্লা এবং একই কাপড় দিয়ে বানানো টুপি। আমি নিজেও এক সেট বুবু বানিয়ে নিয়েছিলাম। এটি পরে আমি আইভরিয়ান ঈদের জামাতে বেশ ক’বারই অংশ নিয়েছি। কসোভোর মতো ওরাও ধর্মীয় অনুশাসন ততোটা মানে না। যেমন – বিয়ে ছাড়াই ছেলে-মেয়ে একত্রে বাস করে, সন্তানের বাবা মা হয়, সংসার করে। কোনো মেয়ের বিয়ে ছাড়া বাচ্চা হয়েছে এটা কোনো অযোগ্যতা নয়, বরং বিয়ের বাজারে এটি সেই মেয়ের বাড়তি যোগ্যতা, কারণ সে মা হতে পারে। যে পুরুষের ঔরসে মেয়েটির সন্তান হয়েছে প্রায়শই তার সঙ্গে বিয়ে হয় না, বিয়ে হয় অন্য কারো সঙ্গে। সিঙ্গেল মায়ের সংখ্যা আইভরি কোস্টে প্রচুর এবং তা সকল ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যেই সমান। ওরা সব সময় একটি কথা বলে, আমি আগে আফ্রিকান, পরে মুসলমান। তবে প্রায়শই দেখতাম মুসলিম ট্যাক্সি চালকেরা নামাজের অক্ত হয়ে গেলে রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ত, যা ওদের আচরণের সঙ্গে কিছুতেই যায় না। পরে জেনেছি, এদের অধিকাংশই নিজার কিংবা বুরকিনা ফাসো থেকে এসেছে। এই দেশগুলোর সকলেই ফরাসী ভাষী বলে একই সাংস্কৃতিক আবহে ওদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান টিকে আছে যুগ যুগ ধরে।
আমার সময়কালে প্রায় আড়াই হাজার বাংলাদেশি মিলিটেরি এবং ৫০০ পুলিশ সদস্য আইভরি কোস্টে জাতিসংঘের অধীনে কাজ করত। ইউনিফর্ম পার্সোনালিটিদের নিয়ে আমাদের বেশ বড়োসড়ো একটি বাংলাদেশি কম্যুনিটি ছিল। মিলিটেরি অফিসারদের সাথে কিছু সিভিলিয়ান অফিসার মিলে একটি বড়ো বাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়ে তুলেছিল বাংলাদেশ হাউজ। অল্প ভাড়ায়, কখনো বিনা ভাড়ায়, সেখানে দূর-দূরান্ত থেকে আসা বাঙালি অফিসারেরা থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেত।
আমাদের ঈদ-উৎসবগুলো জমজমাট হয়ে উঠত বাংলাদেশি মিলিটারি কন্টিঞ্জেন্টগুলোতে। আমাদের নিজেদেরই ঈদ জামাত হত। কন্টিজেন্টে অত্যন্ত সুসৃংখল এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে খাওয়া-দাওয়া এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। আইভরি কোস্টে থাকাকালীন সময়ে দেশের ঈদ তেমন একটা মিস করিনি, এর পুরো কৃতিত্বই বাংলাদেশ আর্মির। ধর্মীয় এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক আবহে আমরা দুটি ঈদই উদযাপন করতাম।
এরপর ছুটে যাই পূর্ব আফ্রিকায়। সুদানের দারফুরে কাটাই প্রায় দুবছর। ধু ধু মরু প্রান্তর। আমার কর্মস্থল ছিল মিশন সদর দফতর, আল ফেশারে। সুদানের মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলে। তবে ওদের আরবিতে সুদানিজ ডায়ালেক্ট আছে। ৭০ শতাংশ মানুষ অ্যারাব হলেও মধ্যপ্রাচের মানুষদের মতো ফর্শা আরবীয় মানুষের সংখ্যা আমি খুব বেশি দেখিনি। অনুমান করি আফ্রিকান-সুদানিজদের সঙ্গে বহু বছরের মিশ্রণের ফলে কোকড়া চুলের বাঙালি গাত্র বর্ণের এক সুবৃহৎ জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তবে ফর্শা সুদানিজদের সাথে এদের কোনো ধরণের বিভেদ বা বিবাদ নেই, দুই পক্ষই নিজেদের সমগোত্রীয় মনে করে। জনসংখ্যার বাকি ত্রিশ শতাংশ বিভিন্ন এথনিক গ্রুপে বিভক্ত, প্রধান গ্রুপগুলোর মধ্যে আছে ফুর, বেজা, নুবা, ফাল্লাতা ইত্যাদি। এইসব সম্প্রদায়ের লোকেরা ১১৫ টি আঞ্চলিক ও উপভাষায় কথা বলে। দক্ষিণ সুদান, যেটি এখন স্বাধীন দেশ, সে দেশের মানুষ মূলত খ্রিস্টান। তা ছাড়া মূল সুদানের ৯১ শতাংশ মানুষ মুসলমান।
সুদানের মানুষ আইভরি কোস্ট বা কসোভোর মুসলমানদের মতো না। তাদের কাছে ধর্মীয় অনুশাসন বা বিধিনিষেধ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মই ওদের সংস্কৃতি। ঈদ সবচেয়ে বড়ো উৎসব। রমজান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে সুদানের বা দারফুরের স্থানীয়দের সঙ্গে মেশার সুযোগ খুব কম হয়েছে। তার পরেও জুম্মা কিংবা ঈদের নামাজ পড়তে ছুটে গেছি স্থানীয় মসজিদে। দরিদ্র এবং ভীষণ অপরিচ্ছন্ন একটি জাতি। ধর্ম ওদের কাছে যে কোনো মানবিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সুদানের লোকেরা স্বল্পাহারী। ওরা দুইবেলা খায়। দিনের প্রথম খাবার খায় সকাল ১১ টার দিকে, দ্বিতীয় বা শেষ মিল খায় বিকেল ৪ টায়। সর্বত্রই যেহেতু বালু আর বালু এই বালুকেই ওরা কাজে লাগায় দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে। বালু দিয়ে নোংরা বাসন-কোশন মেজে রোদে রেখে দেয়। শুকিয়ে গেলে শুকনো কাপড় দিয়ে ঝেড়ে-মুছে সাফ করে ফেলে। এভাবেই পানি ছাড়া ওরা অনেক কাজ সেরে নেয়। সুদানিজদের কাছে পানি হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। পানির দখল পেতে মারামারি, যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে যায়। অধিকাংশ গোত্রদ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় মরুভূমিতে খুঁজে পাওয়া পানির দখল পেতে। সুদানের প্রথাগত পোশাক হচ্ছে থব এবং জেলাবি। মেয়েরা থব পরে, পুরুষেরা পরে জেলাবি। দুটো পোশাকই দীর্ঘ, পুরো শরীর আবৃত রাখে।
সুদানেও বাঙালি মিলিটারিদের সরব উপস্থিতি ছিল এবং যথারীতি পুলিশ-মিলিটেরিদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল বাঙালি কম্যুনিটি। ঈদের আনন্দটা অর্থবহ হয়ে উঠত বাঙালি সাহচর্যেই।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অভিবাস গ্রহনের একটি পদক্ষেপ নিই ২০০৯ সালে কিন্তু চার বছর থেকে অতলান্তিক পাড়ি দিয়ে চলে আসি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে। এই দুটি শহরের বৈশিষ্ট্যে অনেক মিল আছে। নানান দেশ ও জাতির বাস যেমন আছে, আবার আছে বৃহত্তর বাঙালি সমাজ। দেশের বাইরে থাকা বাঙালিরা অধিক দেশপ্রেমিক হয়। তারা একটু বেশি বেশিই বাঙালি হতে চায়। বেশি বেশি উৎসবে মাতোয়ারা হয়। যে কোনো উৎসবে দাওয়াত পেলে, বা না পেলেও, ছুটে যায়। শাড়ি, পাঞ্জাবি পরার সুযোগ মিস করে না। ভর্তা, শুটকি, বিরল এবং বিলুপ্ত প্রায় শাক-শব্জি, মাছ ও শুটকির খোঁজ করে, আকাশ ছোঁয়া দাম দিয়ে সেগুলো কিনে আনে। পান খায়, হুক্কা টানে, বাড়ির পেছনে আগুন জ্বালিয়ে আলু পোড়া দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষেধ থাকা সত্বেও কোরবানির ঈদে নির্জন লোকালয় খুজে গরু কোরবানি দেয়। গ্রীষ্মে শাক-সবজির চাষ করে।
পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেন, হোয়াইট চ্যাপেল, বেথনাল গ্রিন এসব এলাকায় বাঙালিরা সত্তরের দশক থেকে অভিবাস গ্রহন করতে শুরু করে। যদিও বিশের দশকে কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছিল কিন্তু ব্যাপক হারে বাঙালি অভিবাস শুরু হয় সত্তরের দশকে। এইসব এলাকায় গড়ে উঠেছে প্রচুর মসজিদ। ব্রিটিশরা যখন ধর্ম-কর্ম ছেড়ে দিচ্ছে, গীর্জাগুলো বিক্রি করে দিচ্ছে তখন বাঙালি মুসলমানেরা সেগুলো কিনে নিয়ে মসজিদ বানাচ্ছে। ঈদে এখন পূর্ব লন্ডনে বাঙালিদের বড়ো ঈদ-জামাত হয়। দেশের মতোই বাঙালিরা নতুন জামাকাপড়, শাড়ি, গহনা কেনে। ঈদের দিন বিনা নোটিশে একে-অন্যের বাড়িতে চলে যায়। সেমাই-পোলাও খায়, কোলাকুলি করে। ছোটোরা বড়দের পা ছুঁয়ে সালাম করে এবং বড়োরা ছোটোদের নগদ অর্থে ঈদি দেয়।
নিউইয়র্কের জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার সবচেয়ে বড়ো ঈদের জামাত আয়োজন করে। এখানকার বাঙালিরাও দেশের মতোই সকল অনুষঙ্গ দিয়ে সাজানো পূর্ণাঙ্গ ঈদ উদযাপন করে। খাবার, পোশাক, গহনা এমন কিছু নেই যা বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যায় কিন্তু নিউইয়র্ক বা লন্ডনে পাওয়া যায় না। শুধু একটিই অন্তরায়, ঈদের দিন তারা কোনো ছুটি পায় না। তবে সম্প্রতি নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষ দুই ঈদে দুইদিন স্কুল ছুটি ঘোষণা করেছে।
মানুষ যতো শিক্ষিত হচ্ছে, যতো আধুনিক হচ্ছে ততোই বর্ণ, ধর্ম, জাতি-গোষ্ঠীর বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসছে কিন্তু সকল বৈষম্য ছাপিয়ে মনুষ্য সমাজে একটি বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে বিত্তের বৈষম্য। ঈদের মূল দর্শন হচ্ছে সব ধরনের বৈষম্য থেকে বেরিয়ে এসে এক আল্লাহর পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠা। তাই ঈদের নামাজ পড়ে আমরা সবাই বিত্ত-বৃত্ত ভেঙে পরস্পরকে বুকে জড়িয়ে ধরি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা