spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধআতাউর রহমান : 'চতুরঙ্গ' পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা

স্মরণ। লিখেছেন : ড. ইসরাইল খান

আতাউর রহমান : ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা

ড. ইসরাইল খান

আতাউর রহমান (২৯ এপ্রিল, ১৯১৯) পাবনা শহরে তাঁর জন্ম । শিক্ষাজীবনের শুরু পাবনার স্থানীয় স্কুলে। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ ও কলকাতার সেণ্টজেভিয়ার্স কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন থেকেই ছাত্র আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। ইউনাইটেড স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক হুমায়ুন কবির, সহ-সভাপতি আতাউর রহমান। পরবর্তীকালে আতাউর রহমান বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি হন। শেরে বাঙলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবুল কালাম আজাদ ও হুমায়ুন কবিরের সান্নিধ্যে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের সংগঠিত করেন তিনি।
দিলীপকুমার গুপ্তের সহযোগিতায় ‘গুপ্ত রহমান অ্যান্ড গুপ্ত’ প্রকাশনী স্থাপন করেন।
অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের ‘বাংলার কাব্য’, জীবনানন্দ দাশের ‘সাতটি তারার তিমির’–গঠন
সৌষ্ঠবে ও মুদ্রণ-সৌকর্যে সকলের সসম্ভ্রম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তাঁরই হাতের শৈল্পিক-স্পর্শে।

তাঁর উদ্যোগে প্রকাশিত সাময়িকপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: কাজী নজরুলের নামে খ্যাত ‘দৈনিক নবযুগ’, ‘স্বরাজ’ ও ‘কৃষক’, ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘নাউ’, বাংলা সাপ্তাহিক ‘নয়া বাংলা’, ‘ভাবীকাল’, ইংরাজী মাসিক ‘ইণ্ডিয়া’, বার্ষিক ‘ত্রিকাল’ ও বিশিষ্ট সাহিত্য ত্রৈমাসিক ‘চতুরঙ্গ’।

১৯৫৪-৫৫ সালে সুভো ঠাকুরের পরিচালনায় ‘ইন্ডিয়ান আর্টস্ থ্রু দি এজেস’ প্রদর্শনীর সঙ্গে পূর্ব ইওরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন এবং ভারতীয় শিল্প ও সাহিত্যের সঙ্গে সেই সকল দেশের জনসাধারণের পরিচয়-সূত্র স্থাপন করেন।
দেশে ফিৱে ‘ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেসন্স’ প্রতিষ্ঠানের পূর্ব ভারতের প্রতিনিধির কার্যভার গ্রহণ করেন। এই দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি দেশ-বিদেশের বহ বিশ্ববন্দিত সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করেন।
১৯৬০ সালে তিনি ব্রিটিশ কাউন্সিলের আমন্ত্রণে ইংলণ্ডে যান।
কলকাতায় বিভিন্ন শিল্প ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। এছাড়া এশিয়াটিক সোসাইটিরও তিনি সদস্য ছিলেন।
চাকুরী জীবনে তিনি ইন্ডিয়ান অয়েল ও বামার লরির সঙ্গে কিছুকাল যুক্ত ছিলেন।
পরবর্তীকালে ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্টস প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ দেন এবং মৃত্যুকাল পর্যন্ত ঐ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।
২৭ নভেম্বর, রবিবার, ১৯৭৭ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যুর পর ১৩ অগ্রহায়ণ ১৩৮৪ মঙ্গলবারের আনন্দবাজার পত্রিকার ‘কলকাতার কড়চা’ য় আতাউর রহমান সম্পর্কে লেখা হয় :

‘সালটা ১৯৪২। চারিদিকে আগস্ট আন্দোলনের ঢেউ। সে সময় দেখা গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
চত্বরে একজন ছাত্র লুকিয়ে পুস্তিকা বিতরণ করছে। পুস্তিকার নাম : How to make incindiery bomb–লেখক জয়প্রকাশ নারায়ণ। কিন্তু এই পুস্তিকা যিনি বিলি করছিলেন, তাঁকে দেখে মনে হবে না যে, তিনি বোমা তৈরির হদিস দিতে উদ্গ্রীব। শান্ত, সুদর্শন। মুখে হাসি লেগে। ছেলেটি তদানীন্তন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র আতাউর রহমান। কংগ্রেস সোসালিস্ট দলের সক্রিয় ছাত্র নেতা। সেদিন তাঁরই অক্লান্ত চেষ্টায় বাঙলায় গড়ে উঠেছিল (১৯৪৩) ইউনাইটেড স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। সভাপতি হলেন অধ্যাপক হুমায়ুন কবির। আর সহ-সভাপতি আতাউর রহমান। এই সংগঠনই পরবর্তীকালে মিশে যায় ছাত্র কংগ্রেস ও ছাত্র ফেডারেশনে। ছাত্র ফেডারেশনের তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন এবং কয়েক বছর বাঙলার বিপ্লবী ছাত্র সমাজের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু সংগঠন হলেই চলে না। চাই তার মুখপত্র । প্রকাশিত হল ‘ভাবীকাল’।

এমন পরিপাটি, নিখুঁত পত্রিকা এর আগে ক্বদাচিৎ দেখা গেছে এবং এ-কাজ শধু তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। কারণ তখন তিনি চতুরঙ্গ ত্রৈমাসিক পত্রিকা পরিচালনা করতেন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত এই পত্রিকার সব দায় তিনি বহন করেছিলেন।
আর এই সেই পত্রিকা যার সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু এবং প্রেমেন্দ্র মিত্র। চতুরঙ্গের মতো এমন রুচিবান পত্রিকা আজও বিরল। গ্রন্থ প্রকাশনে তাঁর উৎসাহ অচিরেই চোখে পড়ল। তিনি সম্পাদনা করলেন ফজলুল হকের ‘বেঙ্গল ‍টু-ডে’। প্রকাশ করলেন ইংরেজীতে
‘ইণ্ডিয়া’ মাসিক পত্র। সাহিত্য সংকলন ‘ত্রিকাল’।

অনেকেই হয়ত জানেন না, দিলীপকুমার গুপ্তর
সঙ্গে একত্রে তিনি একটি প্রকাশনী স্থাপন করেন। এবং অত্যন্ত দুঃসাহসের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের
কবিতার বই ‘সাতটি তারার তিমির’ প্রকাশ করেন।
জাতীয়তাবাদী মুসলমান সমাজের সংগঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ‘নবযুগ’ দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে তিনি প্রচার করার চেষ্টা করলেন সুস্থ জাতীয়তাবোধ। পত্রিকাটির তিনিই ছিলেন প্রকাশক।

চতুরঙ্গে কে না লিখেছেন? বাংলায় যদি দশটি গল্প বেছে নিতে হয়, তবে দেখা যাবে তাদের মধ্যে হয়ত আটটি গল্পই প্রকাশিত চতুরঙ্গে। অচিন্ত্য, বুদ্ধদেব, প্রেমেন্দ্র, মানিক, সবোধ ঘোষ—এঁদের প্রত্যেকেরই শ্রেষ্ঠ গল্প কোন-না-কোনো সময় চতুরঙ্গে ছাপা হয়েছে।

অফিস ছুটির পর, বাড়ি না গিয়ে চতুরঙ্গের অফিসে বসে বসে প্রুফ দেখছেন, অপেক্ষা করে আছেন কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মী অথবা রাজনৈতিক কর্মী—যাঁরা তাঁর বন্ধু, তাঁদের হেসে অভ্যর্থনা জানাতে।
সেই শান্ত, সৌম্য মানুষটি হঠাৎ যেন তাঁর বন্ধুদের ওপর অনেক ঋণের বোঝা রেখে অদৃশ্য হয়ে গেলেন‘।

‘যুগান্তর’-এ একই দিনে লেখা হয়–

‘গত রবিবার পি জি হাসপাতালে চতুরঙ্গ পত্রিকার কর্ণধার আতাউর রহমান মারা গেছেন।
তাঁর বাড়ি ছিল পাবনা জেলায়। দেশ বিভাগের পর তিনি কলকাতাতেই ছিলেন। পাকিস্তানে পাড়ি
জমাননি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে যখন গোটা দেশ তোলপাড় আতাউর রহমান তখন ছিলেন জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের দলে। এর জন্য তাঁকে লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে। —অধুনালুপ্ত নবযুগ পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন তিনি। তাছাড়া তাঁর তত্ত্বাবধানেই প্রকাশিত হত নাউ, চতুরঙ্গ এবং আরও কখানি পত্রপত্রিকা। মুদ্রণ শিল্প সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল ব্যাপক এবং গভীর। — ‘

শেষ প্রহর
…..
আতাউর রহমান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শেঠ সুখলাল করনানি মেমোরিয়াল হাসপাতালে।
সঙ্গে সঙ্গে সে খবর শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে ও হাসপাতালে শোকাহত বন্ধু-পরিজনেরা
সমবেত হতে থাকেন। সন্ধে ছ’টা নাগাদ মরদেহ তাঁর বাসভবন ৮-এ, শামসুল হুদা রোড, পার্ক স্ট্রিটে ডেভেলাপমেণ্ট কনসালটেন্টের অফিস, রাসেল স্ট্রিট ও চতুরঙ্গ অফিস হয়ে গোবরা গোরস্তানের দিকে অগ্রসর হয়। ততক্ষণে বেতারে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রচারিত হয়ে গেছে সেই দুঃসংবাদ সঙ্গে আতাউর রহমানের আটান্ন বছরের জীবনের দীর্ঘ রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক কাজ-কর্মের পরিচয়।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ