| মাহমুদ নোমান |
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সাহিত্য পত্রিকা কিংবা কবিদের কবিতা কেমন উজ্জীবিত করেছে একতার শক্তিকে, এইসব বলার উপলক্ষে ‘বাংলা রিভিউ’ এর কর্মযজ্ঞ আমার বোধ বিশ্বাসকে উৎসাহিত করেছে; এতোটুকু লিখে এসে কবিতা কতটুকু জরুরি একটা আন্দোলন চলাকালীন, মুহূর্তকে কীরকম ধারণ করে সেটি আমার ভাবনাকে টোকা দিচ্ছে; এখানে উল্লেখ করতে হয় কবিতা কী? হয়তো প্রশ্নের বিভিন্ন আঙ্গিকে না- গিয়ে বলতে পারি ‘কবি যা লিখে তা’– সেটাই কবিতা আর এখন প্রশ্ন কবি কে? আমি মনে করি যাঁর ভেতরটা ভাবায় এবং সেটি বলতে কেউ কিছু অথবা ‘কিছু- না’ সেটাই বলতে বলে আর বললে তিনিই কবি। তাহলে সবাই কবি? কবির কি আলাদা মাপকাঠি নেই?? তাহলে বলতে হয়– কে কী দিয়ে মাপকাঠি অনুযায়ী নির্ণয় করে দেবে একজন কবি’কে…
আদতে কবি হলে নিজে টের পায়,কেউ কবি বলবে সে আশায় কবি কবিতা লেখে না। আদতে কবি নিজেকে বুঝ দিতেই কবিতা লিখে; তাহলে কবিতা হওয়া আর না- হওয়া এমনসব হা-হুতাশ বাহিত আলাপ আলোচনা যে সাহিত্য পাড়ায়,সেসবের অবসান কীভাবে করতে পারি! এজন্যই আমি বলি কী আমার ভালো লাগা সেটি অন্যজনের ভালো না-ও লাগতে পারে এজন্যই কবিতা নিয়ে এতো মাস্টারি করার প্রয়োজন নেই, তাহলে তো শ্রেণীশিক্ষক মাত্রই কবি হতেন আর তথাকথিত কবিদের কী হাল হতো ভাবছি। এসবের মারপ্যাঁচে না-গিয়ে আমি কারও কবিতার কথা বলতে গিয়ে প্রথমে লক্ষ্য নির্ধারণ করি কবির কবিতার প্রশংসা কীভাবে করা যায়, আমার মাথায় আসে আমার কাছে যেটি ভালো লাগেনি সেটি অন্যের কাছে ভালো লাগতে পারে। আদতে আমি পাঠকবান্ধব হতে চাই; এটা কেন করি খোলাসা করছি– ইদানিং লক্ষ্য করেছেন কবিদের কী কামড়াকামড়ি, একটা আড্ডায় যেসব কবি নেই সেসব কবিদের নিয়েই গীবত কুৎসা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা যেন স্বাভাবিক চরিত্র অথচ গন্ডির বাইরে গিয়ে খুব কম কবিই আছেন প্রশংসা করতে পারে এজন্যই আমরা লেখক জগতের বাইরে মানুষদের কাছে দিনদিন ভূয়া হিসেবে পরিচিত হচ্ছি। এবং শুধু সম্মান লাগবে টাকা লাগবে না মানে কবির পেট নেই চেট(কাপড়ে ঢাকা অঙ্গ) নেই!! এইজন্য বুঝি কবি এখন লিখলে টাকা পয়সা পায় না অথচ একজন ইমাম( যিনি নামাজ পড়ান) টাকা পায় নামাজ পড়ানোর জন্য, নামাজ পড়া কিন্তু ইমামের নিজের ফরয কাজ,তবুও টাকা পায়,সৃজনশীলতা নেই, তবুও টাকা পায়, এখন নাকি উল্টো কবিই উপহার দেয় কবিতা ছাপানোর জন্য!
এজন্যই আমি কোন কবির কবিতা নিয়ে লিখতে মনস্থির করলে উনার কবিতার প্রশংসা খুঁজতে চেষ্টা করি; একজন নতুন পাঠক সৃষ্টি হোক, এটাই কামনা। আমি যখন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ‘বাংলা রিভিউ’ পত্রিকার কার্যকলাপ তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছি সেক্ষেত্রে আন্দোলনে কবিতা কেন জরুরি মাধ্যম সেটা বুঝিয়ে দিতে একটা কথা বলি– ভেতরের তাগাদা পেয়ে আন্দোলন করে আর আন্দোলনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে হয় না, কিছু বলতে হয়, যদি সেটি তাগাদা পাওয়া কথা সমস্ত হয় সুসংহত আন্দোলনকারীরও ভেতরের কথা হয়তো ওরা বলতে পারছে না, যাঁরা বলতে পারে তাঁরাই তো কবি…
এখন বলি আন্দোলনে সবার কবিতা একই মানের হবে সেটি না-ভেবে আন্দোলনকে এগিয়ে দিতে পারছে কীনা সেটি দেখা জরুরি। আমার কাছে ‘বাংলা রিভিউ’ এর বৃহৎ পরিসরের আয়োজনে অনেক কবির কবিতা নতুন কিছু দিতে পেরেছে মনে হয়; খুব সাদামাটা কথাও ঐ মুহূর্তকে যদি ছুঁয়ে দিতে পারে, যদি বলে এভাবে –
ঘুম থেকে উঠে কপাল চাপড়াই
আর হাসি রে ভাই,কারন মাইনষে
নেতা হওয়ার লোভে,মানুষ হইতে ভুলে গেছে।
– বীর থেকে কাপুরুষ; স্বচ্ছ দে)
স্বচ্ছ দে এর কবিতা আগে পড়া হয়নি, উঠতি বয়সী মনে হয়েছে, কবিতার মধ্যে উঠতি সূর্যে শিশির বিন্দুর ঝলমলানি;
০২.
‘বাংলা রিভিউ’-এর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শেষদিকে যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে– স্বচ্ছ দে, তাসনীম মাহমুদ, হাসান আলীম, ফেরদৌস সালাম ও নয়ন আহমেদের কবিতাগুলো লেখা কিন্তু প্রকাশে তারিখের এদিক-ওদিক হয়েছে; কেননা কবিতা লেখার নিচে তারিখ উল্লেখও আছে কয়েকটার তদুপরি কবিতার মধ্যে ঝাঁঝ দেখে বুঝতে পারা যায়। তাসনীম মাহমুদের কবিতা আমাকে আশা দিয়েছে, কবিতার মেজাজ স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে বেশ এগিয়ে নিতে পারে বোধ আর আশপাশের দেখাটা চমৎকার–
সুখআনন্দ কিংবা মার্সিয়া নয়—
একাত্মতার ঘোষণা নিয়ে আজ আমরা
আমাদের বিবাহের পঞ্চ বার্ষিকীর ‘উপল’
ছাত্রশহীদদের মাগফিরাত কামনায় উৎসর্গ করছি…।
যে বিষণ্ণঘন রাত তাদেরকে করে তুলেছে অকুতোভয়
তার প্রতিটি পদক্ষেপকে জানাই লাল সালাম।
তাদের টগবগে রক্তের শপথ করে বলছি—
আমরা আমাদের আনন্দের স’বটুকু; আসন্ন বিপ্লবের
বিজয় মিছিলের জন্য ইতিহাসের ডায়েরিতে লিখে রাখছি।
টিয়ারসেলের ব্যাগ, সাউন্ড গ্রেনেড, গুলির খোসা
আর রাজপথে দাপিয়ে বেড়ানো গামবুট, যন্ত্রদানব
সাক্ষী থেকো: ‘কীভাবে তোমাদের ব্যবহার করা হয়েছে
অধিকার আদায়ের সুষম দাবীর বর্ণিল বাগানে— আর কীভাবে
তছনছ করতে চাওয়া হয়েছে একটি মেধাবী প্রজন্মের স্বপ্নসমেত’!
প্রতিটি জিম্মি জীবন; প্রতিটি ক্যাম্পাসের
ইঁটকাঠ, টেবিল-বেঞ্চ, বৃক্ষরাজি জেনে রেখো;
‘আমার নিষ্পাপ মেয়েকে সাক্ষী রেখে
দস্তখত দিয়ে রাখছি প্রতিজ্ঞাঅলিন্দের সবুজ মালঞ্চে—
ছাত্র-বন্ধুদের অসীম সাহসের তুমুল আয়োজন/
কখনো; না কখনোই পথ হারাতে দেবে না
রক্তের উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে কেনা; সাড়ে তিন হাত মাতৃভূমির’!
এ আমার এবং আমাদেরই প্রতিজ্ঞার এক অনিবার্য দস্তখত।
– অনিবার্য প্রতিজ্ঞার দস্তখত; তাসনীম মাহমুদ)
এরপরে ‘বাংলা রিভিউ’তে ৫আগস্ট প্রকাশিত হাসান আলীমের কবিতাগুলো অন্যরকম ভাবনার সড়কে হাঁটাহাঁটি; হাসান আলীমের কবিতার খেয়াল ভেতরে নিবীড় নিয়ে যায় মুহূর্তে, সত্যের স্বচ্ছ আলো ছড়িয়ে দেয় বিবিধ সৌন্দর্যে–
এইতো সেদিন আইচ্যানেল আমার চোখ খুলে দিলো,
একটা সুন্দরী বাঘিনী এবং তার গর্জন আমাকে দারুণ জীবন্ত করেছে।
সে একজন একচোখা হরিণ,
কালো সোনা মানিকের চোখে ঠা ঠা বজ্র দীপ্তি ছড়িয়ে
চিতকার করে উঠলো–
‘কোন অধিকারে আমাকে রাজাকার বলছেন,
আমার বাপদাদারা মুক্তিযোদ্ধা’।
ওই বাঘিনীর প্রচণ্ড ছোবলে, বিজুরি দীপ্তির ঝলকে ঝলসে গেলো সে —
লেজ গুটিয়ে পালালো কালো শিয়াল!
আমি রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখিনি
দীপ্তি চৌধুরীকে দেখেছি, বাঘিনী দেখেছি।
জয় দীপ্তি চৌধুরী —
জয় মুক্তিযোদ্ধার উত্তর পুরুষ,
জয় সত্যের বিমল জয়।
— আমি বাঘ দেখিনি: দেখেছি দীপ্তি; হাসান আলীম)
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যেদিন বিজয় আসে সেদিন প্রকাশিত হয় কবি হাসান আলীমের তিনটি কবিতা। এরপরে প্রকাশিত কবি ফেরদৌস সালামের কবিতা যেন এই আন্দোলনে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির নিখুঁত আলাপন; এসবে কবির শাণিত বোধ আন্দোলনের মুহূর্তকে বর্ণনা করে নিজস্ব ছাঁচে–
বিভ্রান্তির ধুম্রজালে জাতিসত্তা করা হয় ভাগ
চেতনার কানামাছি গুম করে কতো নাগরিক
দুর্নীতির ঘোড়দৌড়ে কেউ ভাঙে বিচারিক শিক
বিরোধী হলেই কারো ভাগ্যে জোটে রাজাকারি দাগ।
কোটা নিয়ে আন্দোলনে প্রতিপক্ষ ছিল স্বৈরাচার
জনতার দ্রোহ যুদ্ধে গণশত্রু হয় ছারখার
– গণশত্রু ছারখার; ফেরদৌস সালাম)
যাঁর কবিতার মধ্যে প্রতিটি শব্দ কথা বলে, যাঁর কবিতা পড়লে কোনো শব্দকে ফেলনা মনে হবে না, কত সহজ সরল বয়ানে আন্তরিক ডাক সহজেই বুঝিয়ে দিতে পারঙ্গম অথচ প্রতিটি শব্দ আশপাশের খুব চেনাজানার আর তিনিই হলেন কবি নয়ন আহমেদ; দৃশ্য থেকে দৃশ্যের এমন মনটানা ছবি টানিয়ে দেবে নিবিড় পরিচর্যার টিউনিংয়ে, মুহূর্তে মন জয় করতে পারে এমন সম্মোহনী স্তর –
একদা এক রাজ্যে রাক্ষস নেমে এলো।
হাউ- মাউ -খাউ ধ্বনিশাস্ত্র মুদ্রিত হলো।
মানুষের আবেগ মারা গেলো ।
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন।
আহা ! আহা!
জনাব রাক্ষস, খেতজুড়ে লাগালেন দুঃখের চারা।
সেই গাছ বড়ো হলো;
ছায়া বিস্তৃত হলো।
শামিয়ানার মতো বিষাদ দীর্ঘ হলো একদিন।
এইকরে রাজ্যে বহু বছর বেদনার চাষবাস হলো।
মরে গেল সভ্যতা
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন।
আহা! আহা!
একদা হঠাৎ, রাজ্যে রূপকথার মতো একঝাঁক পাখি নেমে এলো।
পায়ে স্বর্ণের মল।
গায়ে দুধের মতোন শুভ্র জামা।
তাদের প্রত্যেকের ঠোঁটে একটাকরে চকচকে পাথরের কণা।
ঘন বৃষ্টির মতো পাথর নিক্ষেপ করেন পাখিরা।
নিহত হলো রাক্ষস। পুড়ে ছাই হলো।
ধানের মতোন প্রেম ও আবেগ ফিরে পেলো মানুষেরা।
– রাক্ষস ও পাখিসম্প্রদায়; নয়ন আহমেদ)
এতই নিখুঁত সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে দিতে পারে নয়ন আহমেদের কবিতা। বেদনা বিষাদ কীভাবে সৌন্দর্যে সৃজিত হতেই পারে,নয়ন আহমেদের কবিতা না-পড়লে বুঝবেন না। আমরা ‘রাক্ষস ও পাখিসম্প্রদায়’এর কাহিনি আর দেখতে চাই না, পাখিসব বাঙালির স্বাধীনতার আকাশে সবুজে অরণ্যে বিচরণ করুক আনন্দ নিয়ে যেখানে বৈষম্যের মেঘ থাকবে না, এই কামনা…
কৃতজ্ঞতা জানাই কবি মাহমুদ নোমান ও কবি সাজ্জাদ বিপ্লবকে। বাংলারিভিউ
সাহিত্যের দিগন্ত উন্মোচন করুক গভীর প্রত্যয়ে — এই কামনা করছি।
সম্পাদক,আলোচক ও সকল কবিগণকে তুমুল অভিনন্দন।