একটি আর্তনাদ
…….
জীবন মানে সব সময় সহমর্মিতা নয়
সহযাত্রা সহপ্রতিষ্ঠা সহবাস কিংবা সহমরণ নয়
জীবন কি তবে কখনও-কখনও স্বেচ্ছায়
ওসবের বিরুদ্ধেও দাঁড়ায়
এই ভেবে মনটা খুব তাপদগ্ধ লৌহখণ্ডের মতো
নেতিয়ে গেল নিমিষেই
মহত্তম আত্মার অধিকারী প্রফেটগণ
দুনিয়া জাগানো সংস্কারকগণ
নীতি বা আদর্শে অবিচল দিগবিজয়ীগণ, তোমরাই বলো
এই মনোদেশে তবু কেন এ রকম কালো ছায়া এলো ঝেঁপে
তবে কি তোমরা নিজেদের নিঃশেষে বিলিয়ে
একধরনের হইহই শিরোপাধারী হয়ে
চির অমৃতের স্বাদ নিতে চেয়েছিলে
এই বিশ্বচরাচরে
একটাই তুচ্ছ জীবনের উচ্চ সাধ মেটাবার তরে
এই ভাবনার পশ্চাতে আমি কি ভ্রষ্টমানুষের প্রতিকৃতি
দাগা খেয়ে ঘরে ফেরা ব্যর্থ নীল নাবিক
ক্ষমতা বা বাণিজ্যের দৌড়ঝাঁপে ভরাডুবি শেষে
আঙিনায় উদাস ভঙ্গিতে বসে থাকা
সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মেদুর গেরস্ত
ভেবে দেখি, ভেবে দেখি– মিথ্যে নয়, ওসবে আমিও তো ছিলাম
আষ্টেপৃষ্ঠে জীবন ও যৌবনের পার্থিব রোশনাই পেতে
বিক্রমশীল বিচরণের রণভূমে
এ কোনো পোষিত বিদ্বেষ কী
এ কোনো অপআত্মার সঙ্গে অন্ধকারে দীর্ঘ বৈঠক শেষে বা
জঙ্গম মৌতাতে মেতে সময় কাটানোর ফলশ্রুতি কী
এও তো নয়– তবে এই সূত্র এলো কোথা হতে এই
অভাজনের হৃৎপটে
হে অদৃশ্য অথচ পরম পূজনীয় পরমেশ্বর
তোমার নিবিষ্ট, সদা হৃষ্টচিত্ত অনুসারী যুগন্ধর নারী ও পুরুষেরা
আমাকে আড়ালে-আড়ালে রেখে
এ কী শেখালে তোমরা
ভবসিন্ধুর মহাতরঙ্গে ভাসাতে-ভাসাতে
ডুবাতে-ডুবাতে
হে মানবগণ, জানিলাম তোমাদের নাকি বড় বিবেক
অভ্রভেদী সূক্ষ্মতম শিল্পান্বেষা, কাব্যবোধ
তোমাদের ব্যক্তিগত ও কৌম নন্দনচর্চা বিশ্ববিদিত
আমাকে কহ তবে তোমরা বুঝায়ে
এই রইল অধঃপতিতের করজোড় নিবেদন
তোমাদের চকচকে জুতোর তলায় আর
শাড়ি-ব্লাউজের নম্র ভাঁজে-ভাঁজে…
…..
শ্বাপদসংকুল পথে
……
পাশবিকতার আলিঙ্গনে বদলে গিয়েছি
শ্বাপদসংকুল পথে নিত্য আনাগোনা
নখরে আমার তীক্ষ্ণতা প্রবল, রক্ত ঝরাতে সক্ষম
যতই দরোজা আঁটো
চণ্ড থাবায় কবাট ভেঙে
টুঁটি ধরে টানতে-টানতে
আমার গুহায় স্তূপ করি তোমাদের তড়পানো
শরীরের ত্রাহি দশা
পচনের গন্ধে ভরে ওঠে যবে জঙ্গলের হাওয়া
গুটিগুটি পায়ে আরও আসে
কমজোরি বৃদ্ধ পিশাচেরা
উপঢৌকনের হাড়
গলায় ঝুলিয়ে
ওদের জিবের লালায় পথের ত্বক ভিজে যায়
বজ্র চাহনিতে উহাদের আনুগত্য উপভোগ করি
বিদঘুটে আঙুলের খুঁটে আঙুলের নখ
ঘষতে-ঘষতে
আর মুচকি হাসি নিয়ে থালথাল হাড়-মাস ভাগ করে দিই
মেপে-মেপে স্বজনপ্রীতিতে
একটাই শুধু শর্ত–
আমার জান্তব ক্রিয়ায় পূর্ণাঙ্গ রায় দিতে হবে নিরংকুশ
বনভূমি কাঁপানো হুক্কা হুয়ায় …
…..
ওড়াচ্ছ বিপুল স্বৈরতন্ত্র
…….
কিছু নীরবতা আনে তোমার নিশ্চিত বার্তা
হাঁপ ছেড়ে বাঁচে দুঃখের ভেতরে তপ্ত আত্মা
এত শব্দ এত কলরব
বিশ্বজুড়ে এত ধ্বনি ধুমধাম ঝড়ের তাণ্ডব
তোমার টোকায় শুয়ে পড়ে বিশাল ধসের মতো
সকল স্নায়ুতে তুমি থাকো অবিনশ্বর জাগ্রত
প্রতিদ্বন্দ্বীর পরাস্ত বৈজয়ন্তী খুলে
নিভৃতের মানবের মর্মমূলে
তুমি ওড়াচ্ছ বিপুল স্বৈরতন্ত্র
এইসব ভঙ্গুর তন্ত্র ও মন্ত্র
কল্যাণ রাষ্ট্রের বিকট বিক্রম
সেখানে অবৈধ, সর্বক্ষণ থমথম
ওই শরাফতে পরম বেশভূষায়
একমাত্র তোমারই সেবতিগুচ্ছ দোল খায়
এও নীরবতা
এও নীরবতা
গাঢ় নীরবতা
তোমার উপস্থিতির সৌম্য অমরতা…
…..
করুণাগীতি
…….
এবার বেরোবো রাস্তায় ভিক্ষার পাত্র হাতে
প্রেমের আঘাতে এই চোখ অন্ধ করে দেবো
মুক্তিযুদ্ধের কালের অসহায় স্মৃতি খুঁড়ে-খুঁড়ে এনে শরণার্থী হবো
তোমার বা তোমাদের রাজকীয় গেটের কবাটে
কাঁপা-কাঁপা হাতে বলবো– প্রভু হে, তব করুণার অমিয়ধারায়
আমাকে আশ্রয় দাও শাহি বাগিচার এলেবেলে কুঞ্জে
স্বর্ণপোকাসম বিচরণশীল
ওহ্, পেট জ্বলে যাচ্ছে ভীষণ ক্ষুধায়
তোমাদের গাড়ির ড্রাইভারের নুনু ধুয়ে দেবো
তোমাদের রূপসি বুয়াকে মা বলে ডাকবো হাত কচলে-কচলে
যদি এক মগ বাসি ডাল দেয়
তোমাদের সংরক্ষিত বিস্তীর্ণ এগ্রোফার্মে অস্ট্রেলিয়ান
গাভির নাদা হবো
পোষা ভয়ালদর্শন সারমেয়র পেঁচানো রোমে-রোমে
সুগন্ধি সোপের ফেনা হবো ধবল বুদ্বুদে
ঝকঝকে তকতকে নালায় ভাসতে-ভাসতে কর্ণফুলির
স্রোতে মিশে যাবো
সাংবাদিক আদনান খাসোগির মতো চিরতরে …..
ঙাপ্পি কিনতে গিয়ে
…….
ঙাপ্পির বাজারে বিক্রেতা মহিলাগণ খুব কম কথা কন
ভেজা-ভেজা তিনরঙা ঙাপ্পি : একটু শাদাটে
ছাইরঙা আর ঠিক কালো নয়, কালচেই বলা যায়–
ওটারই আবার দাম বেশি–
এপ্পোয়া কিনিলে কয়েকদিন মউজে কাটাতে পারি
টাটকা সবজির লগে পরিমেয় নুন
জুমের সবুজ লাল শাদা পেষা কাঁচামরিচের
ঝালে আর ঝোলে
কিন্তু দামে পিলে চমকানো আমি আরেকটু ঘুরি
হাভাতে কোলার যা স্বভাব
অথচ ওদিকে মারমা লোকেরা
পরিপটি খোঁপায় চিরুনিগোঁজা, থামিপরা
মারমা মহিলাগণ থলের ভিতরে ঙাপ্পিভরা
পলিথিনের পুঁটলিপুরে
দাম চুকিয়ে কী অবলীলায় ঘরের মিক্কে চলে যাচ্ছে
ফিরেও চাহে না
হা অভাগা আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে
ঙাপ্পিতে রসনাবিলাসের স্বপ্ন দেখেই চলেছি …
…..
:: ঙাপ্পি : দোরসা মাছ আর শুঁটকি গেঁজিয়ে ভেজা পাউডারের মতো প্রস্তুত করা উপাদেয় খাদ্য উপাদানবিশেষ। প্রধানত তরকারির স্বাদ বাড়াতে মারমা অধ্যুষিত অঞ্চলে রান্নায় ব্যবহার করা হয়। এপ্পোয়া : আঞ্চলিক শব্দ : এক পোয়া। কোলা : মারমা আদিবাসী ভাষায় জলাভূমির মানুষ অর্থাৎবাঙালি। মিক্কে : চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দ : দিক বা মুখ।
খুব সুন্দর লেখাগুলো
ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
হাফিজ রশিদ খানের একগুচ্ছ কবিতা পড়ে খুব ভালো লেগেছে।সম্পাদককে অভিনন্দন চমৎকার কিছু কবিতা পাঠের সুযোগ করে দেয়ায়।সবগুলো কবিতাই অসাধারণ। কবিকে শুভেচ্ছা।