আবু তাহের সরফরাজ
বাংলা ভাষায় কবিতা লিখছেন এমন কবির সংখ্যা বর্তমানে কত? আহাম্মকি প্রশ্ন, সন্দেহ নেই। এরপরও করলাম। অনেকে বলবেন, বঙ্গদেশে যত কাক রয়েছে কবির সংখ্যা তত। কাকের সঙ্গে সংখ্যাগত বিবেচনায় এ মন্তব্য মেনে নিলেও বলার কথা কিছু থেকেই যায়। আর তাহলো, কাকদের ভেতর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নেই। কিন্তু মানুষের আছে। এ কারণে কবির সংখ্যা অগণন হলেও পাঠক হিসেবে আমাদের কোনোই সমস্যা নেই। বরং সুবিধেই রয়েছে। এই যে এত এত কবি, আর তারা এত এত কবিতা লিখছেন, অথচ প্রত্যেক কবিতাতেই অন্তর্গত বোধের অভিব্যক্তি আলাদা আলাদা। এক কবির কবিতার ভেতর প্রকাশিত অনুভূতির সাথে আরেক কবির কবিতায় প্রকাশিত অনুভূতির ভেতর সীমারেখা চিহ্নিত করা যায়। জগতে যত মানুষ, তত চিন্তা। প্রতিটি মানুষের বোধের জগৎ আলাদা আলাদা। অনুভূতির শিহরণ আলাদা। নরম রোদের বিকেল। ঝাঁকবেঁধে উড়ে যাচ্ছে পাখি। এই দৃশ্য যতজন মানুষ দেখবে, তত রকমের ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হবে এক একজন মানুষের ভেতর। জগতের আরসব প্রাণী থেকে এই স্বাতন্ত্র্যই মানুষকে মানুষ হিসেবে বিশেষভাবে মর্যাদা দিয়েছে। সুতরাং, কবির সংখ্যা কাকের সংখ্যার সমান হলেও প্রতিটি কবিতাতেই কবির অনুভূতির গাঢ় প্রকাশ আমরা আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারি। এমনকি, একই কথা একই অনুভূতি দুই কবির কবিতায় প্রকাশিত হয়, তাহলেও দুজনের স্বাতন্ত্র্য আলাদা করা সম্ভব। তারা মানুষ বলেই এটা সম্ভব, কাক হলে সম্ভব ছিল না। তবে সত্যি যে, কবিতায় প্রভাব বলে একটা বিষয় আছে। তবে এই প্রভাব কবিতার আঙ্গিক ও প্রকরণে, শিল্পসৌন্দর্যে। কোনোভাবেই অনুভূতির প্রভাব নয়। একজন কবির অনুভূতি দ্বারা তাড়িত হয়ে আরেকজন কবি কবিতা লিখতে পারেন না। এটা অসম্ভব।
হঠাৎ হঠাৎ ভাবনা হয়, সেই প্রাচীন যুগের মানুষ থেকে আজতক কত অসংখ্য কবিতাই না মানুষ লিখেছে। লেখা হচ্ছে, এবং হবেও। এসব কবিতা পাঠক পড়েছে, পড়ছে, এবং পড়বেও। কেন কবিতার এই আবেদন? নিজের ভেতর থেকেই জবাব উঠে আসে, অনুভূতির বিচিত্র রূপ ও রঙের আনন্দেই একজন মানুষ আরেকজন মানুষের লেখা কবিতা পড়ে। এখানেই কবিতার চিরকালীন আবেদন। জানি যে, মানুষের অন্তর্জগৎ অতলান্তিক। কত বিচিত্র আর নানা বর্ণিল ঢেউ যে সেই জগতে প্রতিমুহূর্তে ঘূর্ণি তোলে, তার হিসাব তো আমাদের কারো জানা নেই। কবিতায় কবির অন্তর্জগতের ঢেউ আছড়ে পড়ে। সেই কবিতা পাঠে পাঠক তার অন্তর্জগতে আলোড়ন উপলব্ধি করে। এই আনন্দ আসলে শিল্পের আনন্দ। যাপিতজীবন থেকে কিছু সময় অবসর নিয়ে আত্মমগ্ন হয়ে নিজের আমিত্ব আবিষ্কারের আনন্দ। এক কবির কবিতার স্বাতন্ত্র্য থেকে আরেক কবির কবিতার স্বাতন্ত্র্য কোথায়, কিভাবে সেই স্বাতন্ত্র্য কবিতার ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয় সেই জবাব পাওয়া যাবে নব্বইয়ের দশকের কবি মুহম্মদ আবদুল বাতেনের ‘বিন্দু’ কবিতায়।
যে রাস্তায় আমি এখনো হাঁটিনি
সেটিই আমার পথ, জীবনরেখা মানেই হলো
অনির্দিষ্ট বিন্দু থেকে পরের বিন্দুতে
পৌঁছানো, রেখা যতই সরল হোক প্রতিটি
বিন্দু তো আলাদা আলাদা এক দুনিয়া।
আমার কাজ ওই বিন্দুগুলো সাজিয়া তোলা।
আমার ভেতরে লিপি ও ধ্বনিহীন অনুচ্চারিত
ভাষা সংকেত আমার পথ আলোকিত রাখে।
নিজের ভেতর নির্জন অভিসারের লগ্নতা
কেবল গোপনীয়তায় মধুর হয়ে ওঠে।
আমরা ভাবতে পারি, অনন্তের পথ চলে গেছে মহাবিশ্বের ভেতর দিয়ে। এই পথের আশপাশে অসংখ্য ছায়াপথ ও গ্যালাক্সি। পৃথিবীতে মানুষের জীবনকাল হচ্ছে অনন্তের পথে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেয়ার মতো কালখণ্ড। এতটুকু এই জীবনযাত্রায় কত রকমের যে চড়াই-উৎড়াই মানুষকে পেরোতে হয়, তার ইয়ত্তা নেই। জীবন পথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা মনে করি, এই তো জীবন পথ। এই ভাবনা স্বাভাবিক। এই ভাবনা সর্বজনীন। কিন্তু কবির অন্তর্জগৎ প্রশ্ন তোলে, সত্যিই কি চলমান পথই আমার পথ! কবির বোধের ভেতর ঘূর্ণি ওঠে। কবি টের পান, প্রকৃতির সন্তান হিসেবে অনন্তের পথ আসলে তার পদচিহ্ন ধরে রাখায় দায় বহন করে না। তাই তো তার পষ্ট উচ্চারণ, যে রাস্তায় এখনো তার পা পড়েনি সেটাই আসলে তার পথ। এই যে অনুভূতি, কী মানে এর? কবিতাটির প্রথম পাঠে এই মানে খুঁজতে গেলে পাঠক হোঁচক খাবে। কারণ, শাদামাটা শব্দের বুননে মধ্যবিত্তের থরো থরো আবেগি কবিতা এটি নয়। জীবনবোধের সূক্ষ্ম দর্শন শব্দের ভাঁজে ভাঁজে বিন্যাস্ত হয়ে রয়েছে। ওই বিন্যাসকে খুলে নিজের বোধের অন্তর্জমিনে সাজিয়ে নিতে কবিতাটি কয়েকবার পাঠ করতে হয়। এরপর বোঝা যায়, কবিতাটির গূঢ়ার্থ। জীবন ছন্দময় গতি। সেই গতি প্রকারান্তরে অনন্তের পধ ধরে আমাদেরকে মৃত্যুর দরজায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। এর মাঝখানে যে জীবন মানুষ যাপন করে সে জীবন আসলে মানুষ যাপন করতে চায় না। কিন্তু তাকে সেই জীবন বহন করেই পথ চলতে হয়। দিনশেষে হিসাব-নিকাশের খাতা থাকে শূন্য। তাই কবির মনে হচ্ছে, যে রাস্তায় তিনি এখনো হাঁটেননি, সেটাই তার পথ। এই ভাবনা আসলে সব মানুষের ভেতরই কোনো না কোনো সময়ে উপলব্ধ হয়ই। তাই বলে কি জীবনের কোনো মানে নেই? আছে তো। কবির ভাষায়, ‘জীবনরেখা মানেই হলো অনির্দিষ্ট বিন্দু থেকে পরের বিন্দুতে পৌঁছানো।’ সহজ কথা। কিন্তু দর্শনগত ভাবনায় গভীরতর মানে উদ্ঘাটন করে। আমরা ভেবে নিতেই পারি, জীবনরেখা সরল। কিন্তু আমাদের ভাবনায় কবি আরেকটু সংযোজন করে দিয়ে বলছেন, ‘জীবনরেখা সরল হলেও প্রতিটি বিন্দু আলাদা আলাদা দুনিয়া।’ মানুষের জীবনের সঙ্গে জ্যামিতির সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায় এখানে। আমরা জানি, অসংখ্য বিন্দু একসাথে মিলিত হয়ে তৈরি হয় সরলরেখা। এই সংজ্ঞার পাশাপাশি কবির কাছ থেকে জানতে পারলাম, অসংখ্য দুনিয়া একসাথে মিলিত হয়ে তৈরি হয় মানুষের জীবনরেখা। দুনিয়া বলতে কী বোঝাচ্ছেন কবি? সত্যি বলতে কি, কোনো একটি নির্দিষ্ট মানেতেই দুনিয়া শব্দটি আটকে থাকছে না এখানে। একেক পাঠকের কাছে দুনিয়া শব্দটি একেক রকম প্রতীকে ও ব্যঞ্জনায় পেন্ডুলামের মতো ঝুলতে থাকে। তবে সহজভাবে আমরা ধরে নিতে পারি, অনন্তের পথে মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকেই কবি দুনিয়া বলে আখ্যায়িত করছেন। এরপর কবি বলছেন, তার কাজ ওই বিন্দুগুলো সাজিয়ে তোলা। এবার আমরা মোটামুটি বুঝতে পারলাম যে, কেন তিনি কবিতার শুরুতেই বলে নিয়েছিলেন, যে রাস্তায় তিনি এখানো হাঁটেননি সেটাই তার পথ। কিন্তু সেই পথে তিনি হাঁটেন কিভাবে? কবি বলছেন, ‘আমার ভেতরে লিপি ও ধ্বনিহীন অনুচ্চারিত/ভাষা সংকেত আমার পথ আলোকিত রাখে।’ বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা? সেই যে বলেছিলাম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কথা। এখানে সেই আভাসই কিন্তু আমরা পাচ্ছি। অন্তর্জগতের সংকেতই আলো হয়ে কবিকে চলার পথ দেখাচ্ছে। এই সংকেত একেক মানুষের কাছে একেক রকম। কারোটার সাথে কারোটার মিল নেই। মিল থাকেও না। কারণ, ‘নিজের ভেতর নির্জন অভিসারের লগ্নতা কেবল গোপনীয়তায় মধুর হয়ে ওঠে।’
মুহম্মদ আবদুল বাতেনের একটি কবিতার ভেতর দিয়ে আমরা খানিক জার্নি করে এলাম। এখানে কিন্তু কবির অনুভূতির সংকেত বুঝে নিতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কী ভাষায় তিনি সেই সংকেত কবিতার শরীরে রোপণ করলেন, সেদিকে এবার একটু চোখ ফেরানো যাক। দর্শনগত যে পর্যটন তিনি কবিতার ভেতর দিয়ে করছেন সেই যাত্রায় যেসব শব্দ তিনি বুনে চলেছেন সেসব শব্দ স্বাভাবিক গতিতেই কবির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রোপিত হয়েছে। আর, এসব শব্দের ভেতর কোষ্ঠকাঠিন্য নেই। আছে সরলরেখার মতো সরলতা। আছে সহজেই শব্দের প্রাণস্পন্দন অনুভব করার প্রাঞ্জলতা। শব্দের ভেতর দিয়ে নিঃসীম এক ধরনের অনুভূতি বাতেন আমাদের ভেতর ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তার কবিতার অন্তর্নিহিত বোধে তাড়িত হতে এই অনুভূতি আমাদের দরকার ছিল, কবিতাটির পাঠশেষে বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি।
বাতেনের কবিতা পাঠে আমার ধারণা হয়েছে, কবিতার ভেতর দিয়ে আসলে তিনি ধ্যান করেন। ধ্যানের মগ্নতা পাওয়া যায় তার প্রতিটি কবিতায়। শব্দ যেন তার হাতের তসবিহর দানা। বোধের ভাষারূপ দিতে কবিতার শরীরে একটি শব্দ বসানো মানে, তসবিহর এক একটি দানা তিনি ভক্তিভরে উচ্চারণ করেন। কবিতার প্রতি এই নিবিষ্টতা যে কোনো কবির আত্মার শুদ্ধতাকে উন্মোচিত করে আমাদের শৈল্পিক দৃষ্টির সীমানায়। কবিতা তো একঅর্থে আত্মার কাতরতা। যত মানুষ, তত আত্মা। আর তাই, বিভিন্ন কবির কবিতায় আত্মার কাতরতা বিভিন্ন রকম। একইভাবে, কবিতার শিল্পসুষমাও একেক কবির বেলায় একেক রকম।
মুহম্মদ আবদুল বাতেন কবিতার স্বভাবজাত জাদুকর। তার বোধের জগৎ শব্দদৃশ্য শোভাকর। কখনো তার কবিতার শব্দ জাদুময়ী ঘোর তৈরি করে, আবার কখনো খুবই আটপৌরে যাপিতজীবনের ব্যঞ্জনা প্রকাশ করে। মূলত কবিতার ভেতর দিয়ে তিনি পাঠকের বোধকে উজ্জীবিত করে তোলেন। তার কবিতার শব্দগুলো অনুভূতিকে ভাষারূপ দিতে গার্ড অব অনার দিতে দিতে নিজ থেকেই এগিয়ে আসে। বাতেন শব্দকে খুঁজে আনেন না। যে কোনো কবির শক্তিমত্তা এখানেই। তার চিত্রকল্প অনন্য ও নানা ব্যঞ্জনায় পাঠককে অনাস্বাদিত দৃশ্যের ভেতর নিয়ে যায়। এমনও দেখা গেছে, বাতেনের কোনো কোনো কবিতার চিত্রকল্প দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাওয়ার সাঁকো তৈরি করে দেয়। সেই সাঁকো পেরিয়ে পাঠক সহজেই ঘুরে আসতে পারে কবির অন্তর্জগতে। এরকম কয়েকটি পঙক্তি আমরা পড়ে ফেলতে পারি। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, কবিতার মাঝখান থেকে টুক করে দু’একটি বাক্য তুলে ধরলে ওই বাক্যে কবিতার শিল্পসৌন্দর্য থাকে না। আগের-পরের বাক্যের সাথে পারম্পর্য রক্ষা করেই কবিতায় প্রতিটি বাক্য শিল্পের মহিমা ধারণ করে। এরপরও বাতেনের কবিতার চিত্রকল্প বুঝতে আমরা বাক্যগুলো পাঠ করব:
১. পড়ন্ত চৈত্রের দুপুর, তাবৎ মখমলের
কারুকাজ নিয়ে পাড়ি দেয় স্বপ্নের দরিয়া। (সিমেট্রি)
২. ভোরের কোমল ঘাসে প্রথম নক্ষত্রের আলো। (তুমি তার নিরক্ষীয় মাঝি)
৩. সভ্যতার ভিটায় জটা বটের ডালে বসে আছে ভুতুম ভূত। (ওয়ান ওয়ে জার্নি)
৪. রাতের ফাঁকা স্টেশন, লোহার একটা বেি তে তিনি শুয়ে ছিলেন। (ওই)
৫. সাদা ফরাসের ওপর পায়ে পায়ে পৃথিবীর কালো কালো দাগ। (কারাভান)
৬. জীবন ভেসে আছে মাঝ দরিয়ায়। (ঘোর)
দার্শনিকতা বাতেনের কবিতার প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য। অনেকেই মনে করে, কবিতা দর্শন নয়। কবিতা সাহিত্য। তারা আসলে দর্শন ও সাহিত্য কিছুই বোঝে না। প্রতিটি কবিতাই আসলে এক একটি দর্শন। জীবনানন্দের ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’ কি দর্শন নয়? জীবনকে কিভাবে, কোন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে কবিতার উপজীব্য করে তোলা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে কবিতায় দর্শন-প্রয়োগের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা। কবিতায় বাতেন যখন দার্শনিক দৃষ্টি ফেলেন সেই সময় পাঠক হিসেবে আমরা টের পাই, এ কাজে সার্থক শিল্পী তিনি। কয়েকটি উদাহরণ:
১. মনের অন্ধত্ব ছাড়া দৃশ্যমান সবকিছু। (সিমেট্রি)
২. কিছু নাই, তবু আছে সব, তবু আছে। (সিমেট্রি)
৩. আপন গরাদের ভেতর বন্দি মানুষের হৃদয়। (সিমেট্রি)
৪. গান থেমে গেছে, ঢোল থামে নাই। (টাইম টানেল)
৫. পৃথিবীর আবছা অন্ধকারে
আয়নায় আমার ছায়ার ওপর ডুবে
আছে সময়ে সব মাছি। (সন্ধ্যায় আলোর ফলা)
৬. মননে ভাষাহীন জগৎ বাঙ্ময় হইতেছে। (একলা সোনাইলের ফুল)
কবিতায় বৈজ্ঞানিক শব্দের ব্যবহার চোখে পড়লে আমি বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে উঠি। বিজ্ঞান হচ্ছে প্রকৃতির জ্ঞান। আর কবিতা হচ্ছে অন্তর্জগতের উপলব্ধির ভাষারূপ। বিজ্ঞান সুনির্দিষ্ট এবং পরীক্ষালব্ধ। বিপরীতে, কবিতা অনির্দিষ্ট এবং পরীক্ষার ধার ধারে না। সুতরাং, বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট শব্দ যখন কবিতার মতো অনির্দিষ্ট মাধ্যমে ব্যবহৃত হয় তখন ওই শব্দ কী অর্থ প্রকাশ করছে, কিভাবে করছে, সে বিষয়ে আমার আগ্রহ তৈরি হয়। মুহম্মদ আবদুল বাতেনের কবিতায় প্রচুর বৈজ্ঞানিক শব্দ চোখে পড়ে। অবাক হয়ে দেখি যে, সেসব শব্দকে নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে বের করে এনে বাতেন আশ্চর্য শিল্পনৈপুণ্যে নানা মাত্রিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। মনেই হচ্ছে না, শব্দগুলো বিজ্ঞানের। বরং মনে হচ্ছে, এসব শব্দ বুঝি কবিতায় ব্যবহৃত হতেই সৃষ্টি হয়েছে। জানি যে, বিশ্বাস করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে দুলছেন কেউ কেউ। তাদের উদ্দেশ্যে কয়েক পঙক্তি:
১. স্মরণকোষ থেকে মুছে যাওয়া ফরেনসিক ইতিহাস। (টাইম টানেল)
২. জানি সেই ঋণাত্মক রাশির বয়ান। (ওই)
৩. প্রতিসরিত আলোয় ছায়াহীন বিভ্রমের
মধ্যে হয়তো এই পৃথিবীর একটা চাঁদ
নিঃশব্দে হাঁটিতেছে উপবৃত্তাকার। (একলা সোনাইলের ফুল)
৪. এলগারিদমের শেষ সংখ্যাগুলো ভবিষ্যতের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। (ভাপ)
৫. ডপলার ইফেক্ট থেকে আমার বর্ণালি
আগামীকালের দিকে
ক্রমশ নীল থেকে রক্তাভ-ম্লান। (ভাপ)
৬. পৃথিবীর কক্ষপথ নেটের ভেতর শুয়ে আছে
মন, হাইপার রিয়েলিটি থেকে ডাউন সিন্ড্রোম। (নর্দান লাইট)
বাতেনের কবিতা পাঠে এসব বৈজ্ঞানিক শব্দ থাকায় সাধারণ পাঠক হোঁচট খাবে। বিরক্ত হবে। কিন্তু যেসব পাঠক শব্দগুলো বৈজ্ঞানিক মানে ব্যাখ্যাসহ জানে তারা বিস্মিত হয়ে দেখবে যে, শব্দগুলো বিজ্ঞানের সীমা ছাড়িয়ে মানবিক বোধের অসীমে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় নানা মানে প্রকাশ করছে। এর মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে কবির মানে মানুষের বোধের অতলান্তিক জগৎ। এই হিসেবে বলা যেতে পারে, বাতেনের কবিতা শিক্ষিত পাঠকের জন্য। বিজ্ঞান ও সাহিত্যে রুচিমান পাঠকের জন্য। এরই পাশাপাশি সাধারণ পাঠকের জন্যও রয়েছে বাতেনের কবিতা। এরকম একটি কবিতার ভেতর দিয়ে শুরুতেই আমরা জার্নি করে এসেছি।
বাতেনের কবিতার ভাষাশৈলী ও উপলব্ধির দার্শনিকতা তার সময়ের আরসব কবি থেকে তাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে। প্রতীকের কৌশলেও তার কবিতার বিশিষ্ট রূপ পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায় না। কবিতা নির্মাণে সহজাত ঝোঁক রয়েছে বাতেনের। এই সত্য তার কবিতার পাঠকমাত্রই স্বীকার করবে। আবহমান বাংলার কবিতার ঐহিহ্যের আবহে বাতেন অতি-আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক শব্দের সমাবেশে কবিতায় তার বোধের স্ফুরণ ঘটান। এই স্ফুরণ ঋদ্ধ পাঠক টের পান মর্মমূলে। সেই উপলব্ধির অভিঘাত এসে পড়ে পাঠকের মানশ্চক্ষে। বাতেনের কোনো কোনো কবিতা পাঠকের দেখার চোখকে বিস্তৃত করে দেয়। এতকিছুর পরও বলতেই হয়, একেবারে আনকোড়া নতুন পাঠকদের জন্য বাতেনের কবিতা নয়। বাতেনের কবিতা পড়ার আগে নিজের ভেতর শিল্পের একটি জগৎ পাঠককে তৈরি করে আসতে হয়। তার কবিতায় বোধের নিঃশব্দ দ্যোতনা শুনতে হলে নিজ দেহের রক্তের স্পন্দন শোনার মতো কান থাকতে হবে। অনেকে বলতেই পারে, এতকিছু প্রস্তুতি নিয়ে তো ভাই কবিতা পড়ব না। কবিতা হবে সহজবোধ্য, অনায়াসে যেন তা বুঝে যাওয়া যায়। তাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন, সিনেমায় মাধুরী দীক্ষিতের নাচ দেখে যে অনুভূতিতে আপনি তাড়িত হন সেই অনুভূতিকে ভাষায় রূপ দিন তো। জানি, পারবেন না। সেই অনুভূতি কেবল নিজের ভেতর জারিত করা যায়, প্রকাশ করা যায় না। প্রত্যেক কবির কবিতাই আসলে এই রকম। আর, বাতেনের কবিতা কেন পড়বেন তার কারণ হিসেবে আমি বলতে পারি, বাতেনের কবিতা আপনার বোধকে শাণিত করবে। আপনার বোধের জগতে লুকিয়ে থাকা উপলব্ধিকে নানা রাঙিয়ে আপনার নতুন রূপে উপলব্ধির দিকে তাড়িত করবে। এই প্রক্রিয়ায় তো ষোলো আনা লাভের অংশ পাঠকের পকেটেই ঢুকছে, বেচারা মুহম্মদ আবদুল বাতেন তো লিখেই খালাস!