আহমাদ মাযহার
সলতে পাকানো
…..
বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পচর্চার ইতিহাসে নভেরা আহমেদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর কাজের যথার্থ দূরের কথা সাধারণ মূল্যায়নও দীর্ঘকাল হয়নি। রেজাউল করিম সুমন তাঁর নভেরা প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বক্তব্যে যথার্থই বলেছেন, বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যচর্চার ইতিহাস দেখলে তাঁর আগের কোনো ভাস্করের নামই খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ কয়েক বছর আগেও তাঁকে বাংলাদেশের প্রথম নারী ভাস্কর হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। যেন তাঁর আগেও আধুনিক ভাস্করদের মধ্যে আর কেউ ছিলেন! শিল্পী হিসাবে তাঁর কাজের যে যৎসামান্য মূল্যায়ন দেখা যাচ্ছে তা-ও অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। আমি নিজেও নভেরা সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখছি তাঁকে নিয়ে ছিটেফোঁটা আলোচনা গণমাধ্যমে আসার পর।
নভেরার ভাস্কর্য নিদর্শন জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে পড়ে থাকতে দেখেছি অবহেলায়। তেজগাঁওয়ের মনিপুরি পাড়ায় এখন যেখানে পারটেক্সের শো রুম সে বাড়িতে নভেরার ভাস্কর্য চোখে পড়েছে। কিন্তু কোনো রকম শিল্পদৃষ্টি দিয়ে আমার তা দেখা হয়ে ওঠেনি। এমনকি এখন যেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, সেখানে তাঁর যে মুরালটি রয়েছে তা-ও দেখেছি। কিন্তু শিল্পকর্ম হিসেবে এর গুরুত্বের কথা অগ্রজদের কাছে আশির দশক বা নব্বইয়ের দশকে আমি অন্তত শুনেছি বলে মনে পড়ে না।
১৯৯৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় নভেরাকে নিয়ে লেখা হাসনাত আবদুল হাইয়ের নভেরা উপন্যাসটি কিংবা তারও আগে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তাঁকে নিয়ে করা বিশেষ সংখ্যাটি তাঁর সম্পর্কে আমার কিছু কৌতূহল মেটালেও তাঁর কাজ সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ ধারণা জন্মেনি। হাসনাত আবদুল হাইয়ের নভেরা উপন্যাসটিতে শিল্প সমালোচকের দিক থেকে খানিকটা আলো ফেলা হলেও আমার তখনকার নিজের শিল্প-আস্বাদ সামর্থ্যের ঘাটতির কারণে নভেরাকে অনুধাবনে উপন্যাসটি আমাকে তেমন একটা গভীরে নিতে পারেনি।
২০১৫ সালের ৭-১৯ অকটোবর জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী জাদুঘরে নভেরার কাজের সংরক্ষণ প্রক্রিয়া শেষে যে প্রদর্শনীটি হয় তা আমি মনোযোগ দিয়ে দেখেছিলাম। ঐ প্রদর্শনীর সবগুলো ভাস্কর্যের আলোকচিত্রও আমি আমার মোবাইল ক্যামেরায় তুলে রেখেছিলাম তাঁর কাজগুলো ভালো করে অনুধাবনের লক্ষ্যে। উল্লেখ্য, নভেরার এই প্রদর্শনীর মাস ছয়েক আগে আমি নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম ও মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট-এ কিছু ভাস্কর্য দেখার সুযোগ পেলে ভাস্কর্য বিষয়ে আমার মনোযোগ তীক্ষ্ণতর হয়। ফলে নভেরার কাজ দেখার ব্যাপারেও আগ্রহ বোধ করতে থাকি।
জীবনী-উপন্যাস ও হাসনাত আবদুল হাইয়ের নভেরা
…..
শিল্পসংরূপগত দিক থেকে হাসনাত আবদুল হাইয়ের নভেরাকে বিবেচনা করতে গেলে বলতে হবে যে এটি একটি জীবনী-উপন্যাস। বাংলাদেশে এ ধরনের উপন্যাস হাসনাত আবদুল হাইয়ের সুলতান (১৯৯১)-এর আগে কেউ লিখেছেন বলে এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। তবে তাঁর এই ধারার উপন্যাস রচনা প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর নাম আসবে। কারণ সমরেশ বসু শিল্পী রামকিংকর বেইজকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে শুরু করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। অবশ্য তারও আগে তিরিশি ধারার অন্যতম খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের জীবনী-উপন্যাস: পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ (চার খণ্ড, ১৯৫১-৫৬), বীরেশ্বর বিবেকানন্দ (তিন খন্ড, ১৯৫৮-৬৯), নেতাজী সুভাষ বসুকে নিয়ে লেখা উদ্যত খড়্গ (তিখণ্ড একত্রে প্রকশিত সংস্করণ ১৯৮৩), ও কবি নজরুলকে নিয়ে লেখা জৈষ্ঠ্যের ঝড় (১৯৬৯), রত্নাকর গিরিশচন্দ্র (১৯৭৩) উপন্যাসের কথাও আমরা মনে করতে পারি। কেউ কেউ তারও প্রমথনাথ বিশীর লেখা কেরী সাহেবের মুন্সীর (১৯৫৮) কথাও হয়তো মনে করবেন।
হাসনাত আবদুল হাই সুলতান-এর পর তিনি একে একে লেখেন একজন আরজ আলী (১৯৯৫), নভেরা (১৯৯৫) ও লড়াকু পটুয়া (২০১০)। উল্লেখ্য, লড়াকু পটুয়া শিল্পী কামরুল হাসানকে নিয়ে লেখা। অনেক গল্প-উপন্যাস ভ্রমণসাহিত্য ও নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে বই লিখলেও বাংলাদেশের সাহিত্যে জীবনী-উপন্যাসের লেখক হিসেবেই তিনি মূলত উল্লিখিত হবেন। তবে হাসনাত আবদুল হাইয়ের প্রসঙ্গে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের চেয়ে মার্কিন সাহিত্যে আরভিং স্টোনের (১৯০৩-১৯৮৯) কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হবে। কারণ অচিন্ত্যকুমার লিখেছিলেন ধর্মগুরু রাজনীতিক ও সাহিত্যিকের জীবনভিত্তিক উপন্যাস। আরভিং স্টোনের তাঁর দুটি উপন্যাসের নাম অনেকেই জানেন। একটি লাস্ট ফর লাইফ (১৯৩৪), অন্যটি দ্য এগোনি অব দি এক্সট্যাসি (১৯৬১)। প্রথমটি শিল্পী ভিন্সেন্ট ভ্যান গখকে নিয়ে, দ্বিতীয়টি ভাস্কর মাইকেলেঞ্জেলোকে নিয়ে। দুটি উপন্যাস নিয়েই হলিউডে সিনেমা হয়েছে। ফলে এখানে উপস্থিত কেউ কেউ হয়ত দেখেওছেন। সেইসূত্রে বাংলাদেশে এই দুটি বইয়ের নাম অনেকেই জানেন। আরভিং স্টোন আরো কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন অন্যান্য ক্ষেত্রের মানুষের জীবনীভিত্তিক। যেমন তাঁর লেখা একটি উপন্যাস আমি পড়তে চাই, বিখ্যাত মার্কিন লেখক জ্যাক লন্ডনকে নিয়ে লেখা, সেইলর অন হর্সব্যাক (১৯৩৮)। আরভিং স্টোন আরও বেশ কয়েকটি জীবনী উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু তা এখানে আলচ্য নয়। শুধু মনে করিয়ে দিই লাস্ট ফর লাইফ উপন্যাস দেশ পত্রিকায় অনুবাদ করেছিলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ জীবন তৃষ্ণা নামে। তখন অনেকেরই মনোযোগ পেয়েছিল। এই উপন্যাসের আরও একটি অনুবাদ করেছিলেন নির্মলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, জীবন পিয়াসা নামে। এটির নতুন সংস্করণ এখন কলকাতায় পাওয়া যায়।
আরভিং স্টোনের জীবন তৃষ্ণা , সমরেশ বসুর দেখি নাই ফিরের ( দেশ পত্রিকায় প্রকাশ, ১৯৮৭) খ্যাতি হাসনাত আবদুল হাইকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। বাংলদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এমন ব্যক্তি ও শিল্পীদের বেছে নিয়েছেন যাঁদের জীবন যাপন ছিল খুবই স্বতন্ত্র। সুলতান, আরজ আলী মাতুব্বর, বা কামরুল হাসানের জীবন এমনই ঘটনা বহুল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ যে জীবনতথ্য জানা গেলে অল্প আয়াসেই কাহিনিবিন্যাস করা সম্ভব। ঘটনা নির্মাণের জন্য কল্পনাশক্তি বেশি প্রয়োগ করতে হয় না। সেই দিক থেকে নভেরার জীবনের স্বাতন্ত্র্য আরও বেশি। ফলে তাঁর জীবনকথা আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। অন্যান্য উপন্যাসের তুলনায় নভেরা আলচিত ও পঠিত হয়েছে বেশি!
ভাস্কর নভেরাকে খোঁজা
…..
নভেরা উপন্যাসটি লেখার সময় নভেরার সম্পর্কে বেশি জানাও ছিল না শিল্প-সাহিত্য আগ্রহী মহলে। হাসনাত আবদুল হাই উপন্যাস লেখার জন্য বেশ গবেষণাও করেছেন। বিচিত্রা পত্রিকার ঈদসংখ্যায় উপন্যাসটি বের হবার পর পরই নভেরা সম্পর্কে কৌতূহলীদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়! নভেরার শিল্পকর্ম নিয়েও অল্পবিস্তর আলচনা হতে থাকে। তখনই কথা ওঠে যে তিনি কি চাঞ্চল্যকর জীবনের অধিকারী একজন মানুষই কেবল, নাকি শিল্পী হিশেবে গুরুত্বপূর্ণও?
রেজাউল করিম সুমনের মুক্তাঙ্গন ব্লগে প্রকাশিত রচনা ‘নভেরা: মৃত ও জীবিত’ (২০০৯) ‘নভেরা আহমেদ: ধুমকেতু নয়, ধ্রুবতারা’ (২০১৫) প্রবন্ধের আলোচনাসূত্রে জানা যাচ্ছে যে, ভারতের আধুনিক ভাস্করদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই নাম আসে রামকিংকর বেইজের। তেমনি পাকিস্তানের প্রথম আধুনিক ভাস্করের নাম করতে হয় তাহলে নাম আসবে নভেরার। অর্থাৎ বাংলাদেশেরই নয় পাকিস্তানেও তাঁর আগের উল্লেখযোগ্য আধুনিক ভাস্করের নাম পাওয়া যায় না। তাঁর সমসাময়িক যাঁদের নাম পাওয়া যায় তাঁরা আধুনিকতার দিক থেকে তুলনীয় নন। আর বাংলাদেশে তাঁর আগে তো কেউ নেইই।
নভেরা কাজ শিখেছিলেন ইয়োরোপে–লন্ডনে ও ইটালিতে। দেখেছেন প্রচুর মহৎ পাশ্চাত্যরীতির ভাস্কর্য। সেই সূত্রে তাঁর কাজে পাশ্চাত্য প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু পাশ্চাত্যের চেতনা তাঁকে পুরো আত্মসাৎ করতে পারে নি। মঈনুদ্দীন খালেদ যথার্থই বলেছেন, পূর্বদেশের ভাবনাকে পশ্চিমের শিল্পভাষার সমন্বয়ে আধুনিক বাংলাদেশের শিল্পে রূপায়িত করেছেন নভেরা। বরং পাশ্চাত্যকেই অধিকার করে নিয়েছেন তিনি। বিষয়বস্তুতে ও আঙ্গিকে তিনি পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। মাধ্যম ব্যবহারে তিনি মনে রেখেছেন বাংলার লোকায়ত বৈশিষ্ট্যকে। পাথরের কাজ কম করেছেন, সিমেন্ট ও কাঠ ছিল তাঁর মূল মাধ্যম। টেপা পুতুলের আদল নিয়েছেন অবয়ব তৈরির জন্য। ভিয়েতনাম যুদ্ধের গাড়ির লোহালক্কড় সংগ্রহ করে ব্যাংককের প্রদর্শনীর জন্য যে ধরনের কাজ করেছেন সে ধরনের কাজের কথা এই উপমহাদেশে ছিল কল্পনারও অতীত। হাসনাত আবদুল হাই অবশ্য এই সময়ের কাজের খোঁজ-খবর নভেরা উপন্যাসেও দিয়েছেন। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়! কিন্তু এই পর্বের কাজ নিয়ে অনেক অলোচনা দরকার। এই সময়ের কাজের শৈল্পিকতা প্রসঙ্গ আরো গভীর বিশ্লেষণ দরকার।
তাঁর কাজগুলো সামনে নিয়ে তাঁর আধুনিকতার স্বরূপ বিশ্লেষণ বাংলাদেশে মাত্র শুরু হয়েছে। মোটামুটিভাবে তাঁর কাজগুলোর খবর পাওয়া গেছে বেশিদিন হয়নি। জাতীয় জাদুঘরে কাজগুলোর উল্লেখযোগ্য একটা অংশ সংরক্ষিত হওয়ায় এবং ঢাকার এফডিসিতে ও চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠানে তাঁর কাজের খোঁজ পাওয়ায় কেউ চাইলেই দেখতে পাছেন। কেউ সেগুলো বারবার দেখেছেনও। তাঁর ভাস্কর্য বিশ্লেষণের গভীরে যাওয়ার মাত্র তো শুরু!
বাংলাদেশে আধুনিক ভাস্কর্য চর্চা নভেরার হাতে খুব ভালো ভাবে শুরু হলেও আমাদের সমাজে এই চর্চা খুব একটা প্রসার লাভ করতে পারেনি। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে এখনো মুক্তভাবে অঙ্গনভাস্কর্য স্থাপন করা যায় না। ভাস্কর্য স্থাপনা চোখে না পড়লে এর রসাস্বাদনের অনুশীলন বা ঐতিহ্য গড়ে-ওঠা সম্ভব নয়। আমাদের অবাক লাগে যে খুব অল্প সময়ের প্রশিক্ষণে বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যের অভিমুখ কী হওয়া উচিত তার দূরদৃষ্টি নভেরা অর্জন করেছিলেন। তাঁর দূরদৃষ্টির গভীরতা অনুভব করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। ১৯৬০ সালের ৭ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় গণ গ্রন্থাগারে (এখন যেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার) নভেরার প্রথম প্রদর্শনী অন্তর্দৃষ্টি বা Inner Gaze উদ্বোধন কালে তিনি বলেছিলেন ‘আজ এখানে নভেরা যা করছেন, তা বুঝতে আমাদের অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।’ তাঁর সে কথাই যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। কারণ এতদিনেও নভেরার কাজ বোঝা হয়ে উঠল না।
তাঁর কাজের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরার আগে তাঁর ১৯৬০ সাল পরবর্তী অন্যান্য প্রদর্শনীগুলোর খবর নিয়ে নেয়া যাক। ৫ জুলাই ২০১৫ তারিখে ওয়েব পোর্টাল ‘মুক্তাঙ্গন’-এ প্রকাশিত রেজাউল করিম সুমনের রচনা ‘নভেরা আহমেদ: ধুমকেতু নয়, ধ্রুবতারা’ সূত্রে আমরা জানতে পারছি যে, তাঁর দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ১৪ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংককে। একই সূত্রে আরো জানা যাচ্ছে ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে তাঁর তৃতীয় একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল প্যারিসের রিভগেস গ্যালারিতে। এখানে ১২টি ধাতব ভাস্কর্য প্রদর্শিত হয়েছিল, এর সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছিল ১২টি চিত্রকর্মও। দীর্ঘ বিরতির পর জাতীয় জাদুঘর নভেরার পড়ে থাকা ভাস্কর্যগুলো সংরক্ষণ করে দুই মাসব্যাপী (এপ্রিল-মে) একটি প্রদর্শনী করেছিল ১৯৯৮ সালে। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে তাঁর জীবনব্যাপী কাজের একশ দিনব্যাপী একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয় (১৬ জানুয়ারি–২৬ এপ্রিল ২০১৪)। এই প্রদর্শনীটির খবর বাংলাদেশের মানুষ জানতে পেরেছিল অনেক পরে। প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয় তাঁর ১৯৬৯–২০১৪ কালপর্বের ৫১টি শিল্পকর্ম, যার মধ্যে রয়েছে ৪২টি চিত্রকর্ম ও নয়টি ভাস্কর্য। জাতীয় জাদুঘরে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর নভেরার জীবন ও সমগ্র শিল্পকর্মের ওপর একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। ৭ থেকে ১৯ অক্টোবর ২০১৫ এই দুই সপ্তাহব্যাপাী প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী চিত্রশালায়। এতে নভেরার ৩৫টি শিল্প কর্ম প্রদর্শিত হয়। একাধিক দিন এই প্রদর্শনীটি ভালোভাবে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। এই প্রদর্শনীটিতে স্থান পাওয়া সবগুলো ভাস্কর্য ছাড়াও ঢাকার এফডিসিতে সংরক্ষিত কাজটি সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির দেয়ালে সংরক্ষিত নভেরার ভাস্কর্য স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার।
নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যের মূল প্রবণতা দেহাবয়বের অভিব্যক্তি প্রকাশ। তাঁর সব কাজ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বিষয়বস্তু হিসেবে অসছে নারী। উল্লেখ্য যে, দেহাবয়ব রচনায় তিনি বিমূর্ত আঙ্গিক পছন্দ করছেন। বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ ভাস্কর হেনরী মুরের (১৮৯৮ – ১৯৮৬ খ্রি.) কাজের প্রভাব লক্ষ করা যায় তাঁর কাজে।
নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য নারীকে দেখা যাচ্ছে পুরুষ শিল্পীদের চেয়ে আলাদা রূপে, তার কর্মময় জীবনে। তাঁর কাজে নারীর দেহাবয়ব কেবল সৌষ্ঠব পায় না, আবেগমথিত রূপ ফুটে ওঠে। তাঁর নারী অবয়বে রয়েছে বৈচিত্র্য। আশ্চর্য যে নভেরাও ভাস্কর্যরচনায় তাঁর নিজের মতো করে অধুনিকতার সন্ধান করতে গিয়ে লোকজ আঙ্গিককেই গ্রহণ করেছেন। পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে লোকজ বোধের সমন্বয় সাধনের আঙ্গিকগত রূপকল্পনা বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্য চিন্তায় একটি লঙ্কালাফ। তাঁর কাজের বিষয় হিসেবে বাংলার গ্রামীণ জীবন যেমন এসেছে তেমনি এসেছে টেপা নারী পুতুলের অবয়বের আভাস। বাংলার আধুনিক ভাস্কর্যের এও এক স্বতন্ত্র মাত্রা। বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও বাস্তবতার নিরিখে ভাস্কর্যের মাধ্যম বেছে নিয়েছেন তিনি। বিষয়বস্তুতেও গ্রামীণ সমাজ আবহ উঠে এসেছে তাঁর ভাস্কর্যে। পরে করা তাঁর চিত্রকর্মগুলোও স্বাতন্ত্র্যের পরিচায়ক। সেগুলো নিয়েও আলোচনার অবকাশ রয়ে গেছে। মোটকথা আগামী দিনগুলোতে আমরা ভাস্কর নভেরা আহমেদকে ক্রমশ উজ্জ্বলিত দেখতে থাকব।
৩১ মার্চ ২০১৯