মাসুদ কামাল
এক।
বিশ্বাসের পারদে ঠাসা কবি গোলাম মোহাম্মদ (১৯৫৯–২০০২) আশির দশকের কাব্যাকাশে এক প্রদীপ্ত সূর্যের নাম ।
যে সূর্যের প্রখরতায় রোপিত হয়েছে বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার সুমিষ্ট ফলবতী বৃক্ষরা।
দিশাহারা পথিক পেয়েছে পথের সন্ধান, সত্য সুন্দর ও কল্যাণের আহ্বান। মূল্যবোধ ও ঐত্যিহের আবহে তার সাহিত্যের পাটাতন মজবুতি অর্জন করেছে। একজন পরিছন্ন সাহিত্যকর্মী হিসেবেই কবি গোলাম মোহাম্মাদ পাঠক মহলে নন্দিত হয়ে আছেন এবং থাকবেন চিরকাল। বোধ-বিশ্বাস-আবেগ-অনুভুতিতে বিশ্বাস যাদের একমাত্র অনুষঙ্গ কবি গোলাম মোহাম্মাদ সেই তাদেরই একজন। তিনি লেখালেখির সব পরিচয় ছাপিয়ে অতি অল্পসময়ে একজন অনন্য গীতিকার হিসেবেই আমাদের কাছে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন। সমাদৃত হয়েছেন। নৈতিক মূল্যবোধ ও আধুনিকতার রসায়ন তার গানসমূহকে মাধূর্য মণ্ডিত করেছে। এক স্বকীয় ও ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কবি হওয়ার কারণে তার লেখা গানে সবসময় এক দ্যুতিময় কাব্যময়তার আলোক বিচ্ছুরণ পরিলক্ষিত হয়, যা অনেক নামিদামি লেখকের লেখায়ও দৃশ্যমান হয় না । তার ভাষা শব্দচয়নের সহজাত পারঙ্গমতা গতিশীলতা তাকে সাধারনের মাঝে অসাধারণ করে রেখেছে। প্রেম ও নিসর্গের মাঝে তিনি কোন এক পরমাত্মার সন্ধান করেছেন সর্বদা যা তার গান–কবিতার এক উজ্জলতম
দিক।
দুই।
অনেকেই কবি গোলাম মোহাম্মাদ এর সাহিত্যে বিশ্বাসের প্রচার প্রসার প্রমূর্ত ও প্রকট বলে মনে করেন। দাবি করেন আদর্শই তাকে কবি হয়ে উঠতে সহায়ক হয়েছে। আমি বলি, না । আদর্শ বা বিশ্বাস কাউকে কবি করে না। কবিত্ব একটা সহজাত ব্যাপার। তার ভিতরের কবিত্বই তাকে কবি বানিয়েছে । কবিত্ব ক্রয়-বিক্রয়, হস্তান্তর ও আমদানি যোগ্য নয়। পৃথিবীতে হাজারো মানুষ আছে, আছে তাদের হাজারো আদর্শ মত-পথ । আবার আছে সেই সব আদর্শের জানবাজ অন্ধ অনুসারী। যেই আদর্শের সুরক্ষার জন্যে তারা নিজের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি। করে না । তাদের কয়জন কবি হতে পেরেছেন ? কয়জন কে আমরা উল্লেখযোগ্য কবি সাহিত্যিক হিসেবে পেয়েছি ? সেই জন্যেই বলা হয় “কবিরা জন্মে, তৈরি হয় না” ।
‘You will not find poetry anywhere unless you bring some of it with you.’
Joseph Joubert (1754-1824) French moralist
সুতরাং যারা এমন সমালোচনা করেন তারা তাদের অজ্ঞতা ও কূপমণ্ডূকতার পরিচয় দেন । কবি ফররুখ আহমদ সহ আরও অনেক খ্যাতিমান কবি লেখকদের বিরুদ্ধেও অনুরুপ মুখরোচক বায়বীয় অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে থাকে– যা তারা আমলে না নিয়ে আরো বেশি তীব্রতার সাথে তাদের সাহিত্যের ঘোড়া দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন। সময় ও কাল তাদেরকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। আর সেই সব সমালোচকরা নিক্ষিপ্ত ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। কেউ তাদেরকে মনে রাখেনি। একজন কবি লেখক বেঁচে থাকে তার নির্মাণ ও সৃষ্টিশীলতার জন্যে। কোন ক্ষমতা প্রভাব প্রতিপত্তি তাকে কবি হিসেবে বাঁচায় না। বাঁচাতে পারে না।
তিন ।
কল্পচিত্তের কবি গোলাম মোহাম্মদ। তার লেখা গান– কবিতার উজ্জলতম দিক হল তার অসাধারণ কল্পচিত্তের ব্যবহার ও সাবলীল প্রয়োগ। তার ‘অদৃশের চিল’ কাব্যগ্রন্থ পাঠে এ দাবীর সত্যতা মেলে। পাঠক শ্রোতা তার সেই মুনশিয়ানার স্বাদ দারুণভাবে প্রাণভরে উপভোগ করেন। হারিয়ে যান। তার কিছু অসাধারন গান আছে যাতে কল্পচিত্তের প্রয়োগ অত্যন্ত সফল ও সার্থকভাবে হয়েছে। যখন আমরা তার সেই বিখ্যাত গানগুলি শুনি বিমোহিত হয়ে, মন্ত্রমুগ্ধের মত আটকে যাই সাথে সাথেই।
সোনার পাখিরা একে একে উড়ে যায়
ভেঙে ভেঙে হৃদয়ের সকল বাঁধন
নেকড়ের উল্লাসে কাঁপে জনপদ
বঞ্চিত জনতার হৃদয়ে কাঁদন
….
গানটি শোনামাত্রই পাঠক শ্রোতার কল্পনার চোখে ভেসে ওঠে সুনিল আকাশে সোনার পাখিদের উড়ে যাওয়া। এই উড়ে যাওয়া কোন স্বাভাবিক দৃষ্টিনন্দন বিষয় নয়। এই উড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাসিত হচ্ছে সমাজের সমুদয় সুকুমার বৃত্তির অনুশীলন, প্রশান্তি-শৃঙ্খলা সমূহ। আর নেকড়ের উল্লাসে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি ক্রমাগত পরিণত হচ্ছে এক আতংকিত জনপদে। আমরা এক অস্থির সময়–সমাজের বর্ণনা পাই কবির এই গানের মাঝে।
কবি সামাজিক রাজনিতিক অর্থনীতিক ব্যাক্তিগত কোনোদিক থেকেই সুখি ছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। অর্থকষ্ট ছিল নিত্য সঙ্গী। স্বাদ স্বপ্নের মিলন খুব কমই ঘটেছে তার জীবনে। তার আরো কিছু বিখ্যাত গান যেমন : ‘হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি’ ও ‘হলদে ডানার সেই পাখিটা’– একই মেজাজ ও বার্তা বহন করে।
যুগ যন্ত্রণার প্রকাশ পেয়েছে প্রতিটি গানের মাঝেই। পাখি হচ্ছে তার লেখায় এক প্রিয় অনুষঙ্গ, বারবার এসেছে এক পরম শান্তি ও সমৃদ্ধির রূপক হিসেবে যার অনুপস্থিথির সাথে সাথে সমাজ জীবনে নেমে আসে অন্ধকার ও নিরাপত্তাহীনতা ।
কবির কয়েকটি কালজয়ী লেখা উল্লেখ করার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না। বিশেষ করে নিম্নোক্ত লেখাগুলো থেকে একেবারে নতুন পাঠকেরা কবির অসাধারণ কবিত্ব সম্পর্কে কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারবেন ।
১।
হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি
যতই তারে করুন কেঁদে ডাকি
দেয় না সাড়া নীরব গহীন বন
বাতাসে তার ব্যথার গুঞ্জরন ।।
কোথায় সাগর আকাশ মাখামাখি
কিংবা পাতা ফুলের লুকোলুকি
কারো ঝরার নিবিড় নিমন্ত্রণ
যেমন দিবস রাতের আলিঙ্গন ।।
বিচিত্র এই অনন্ত সংসার
সবাই শুধু ছুটছে দুর্নিবার
পাখির পাখায় সময় সন্দীপন
হৃদয় বুঝি তাই করে ক্রন্দন ।।
২।
হলদে ডানার সেই পাখিটা
এখন ডালে ডাকে না
মনের কোনে রঙিন ছবি
এখন সে আর আঁকে না
এখন কেন ধুসর হল মন
মিলিয়ে গেল মিষ্টি গোলাপ বন
এখন কেন স্বপ্ন ভরা
চোখটি চেয়ে থাকে না ।।
এখন কেন হচ্ছে মানুষ খুন
দুঃখের আগুন জ্বলছে অনেক গুন
লড়াকুদের মাথায় কেন
বিজয় রাঙা মাখে না
তারেক মুসা সালাউদ্দিন কই
বুকের আগুন জ্বলছে যে রৈ রৈ
বুলেট বোমা বুক কেড়ে নেয়
কেউ কি খবর রাখে না ।।
৩।
ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের মাঝে কিসের ব্যথা বাজে
নদীরে তোর দুঃখ আমি বুঝতে পারি না যে
উথাল পাথাল ঢেউয়ের টানে টানে
ক্লান্তি ছাড়া ছুটিস ভাটির পানে
তোর পায়ে পায়ে চলার গতি প্রাণে প্রাণে বাজে ।।
বাঁকের পরে বাঁক পেরিয়ে শেষে
থামবি ওরে কোথায় গিয়ে কোন সুজনার দেশে ।।
কোথায় যাবি কোন ঠিকানায় নদী
কোন সুদুরে বলিস আমায় যদি
কার টানে তুই ছুটিস ওরে
কার ভাবনার মাঝে ।।
চার ।
অভাব-অনটন, দুঃখ-ব্যথা, স্মৃ্তিকাতরতা কবি জীবনের এক অবধারিত অলংকার ও দিক । যেন একজন কবি সমৃদ্ধ ও সজ্জিত হন এইসব অলংকার পরিহিত হয়ে। এইসব কাঁচামাল–উপকরণ যতো বেশি থাকে তার সৃষ্টি ততো বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়, উৎকর্ষ লাভ করে। আমাদের ‘হিজল বনের পাখি’ খ্যাত কবিও স্বমহিমায় ভাস্বর হয়েছেন এইসব উপকরণের সার্থক প্রয়োগের মাধ্যমে। কবি নজরুল-ফররুখের মতো তিনিও হয়েছেন অভাবের কষাঘাতে জর্জরিত। নানাবিধ কষ্টের আঁচর তার মনোজগতকে করেছে ক্ষত-বিক্ষত। আর ততোধিক প্রবল হয়ছে তার সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা, নিজেকে মেলে ধরার বাসনা।
পাঁচ।
পরিশেষে এতোটুকু বলবো কবি গোলাম মোহাম্মদের যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। আজো হচ্ছে না। আমরা জানি কবির এখনো অনেক অপূর্ণ স্বপ্ন আছে, পরিকল্পনা আছে, সৃষ্টি সম্ভার আছে যা দ্রুত প্রকাশ করা উচিত। বিশেষ করে তার কবিতাকর্ম ও গানগুলোকে নতুনভাবে সময় উপযোগী করে প্রচার প্রসারের জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। তার গানে যে প্রাণ আছে, আবেদন আছে, শেকড়ের টান আছে, আত্মউপলব্ধির রসদ আছে, পরমাত্মার সন্ধান আছে, যুগ যুগান্তরের পাঠক তাকে অবধারিত ভাবেই গ্রহণ করবে। আমাদের কাজ শুধু তাকে নতুন প্রজন্মের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, একটা মেলবন্ধন তৈরি করে দেয়া। সময়ই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে আমাদের জাতীয় জীবনের এক অনন্য আলোর বাতিঘর হিসেবে। তার রেখে যাওয়া সৃষ্টি ও বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে, মেধা ও মননের বাতায়ন শত দিকে প্রশস্ত করে।