ড. আব্দুস সালাম আজাদী
১.১
ছোট বেলায় সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা শুনতাম। তার “হে সূর্য” কবিতাটি যখন পড়েছিলাম তখন খুব ছোট আমি। কবিতার ছন্দ, তার উপমা, অনুভূতি ইত্যাদি বুঝার মতো বয়স ও যোগ্যতা তখন হয় নি। তবে দুটো জিনিস আমাকে খুব আকর্ষণ করে। প্রতমতঃ এই কবি। যার বয়স মাত্র একুশ কিংবা বাইশটা বসন্তফুল দেখে ফুরিয়েছে । দ্বিতীয়তঃ আমাদের বাড়ির সামনের আদাড় আলির ছেলের শীতের কষ্টে সূর্যের প্রতি তাকানোর সাথে কবিতার মিল দেখে। পরে শুনলাম তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ কবি। পরে বুঝলাম সত্যিই তিনি একজন শক্তিশালী কবি । তারপর জনকীট্সের একটা কবিতা পড়ি। তাকে আরো ভালো লাগলো। কিন্তু কৌতুহল সৃষ্টি হলো, যখন দেখলাম তিনিও মাত্র ছাব্বিশ বছর পৃথিবীর আলো বাতাস ভোগ করার অধিকার পেয়েছেন, তারপর অনিচ্ছা স্বত্বেও পৃথিবী ছেড়েছেন। আমার কৌতুহল সৃষ্টি হলো। আসলে শক্তিশালী লেখকেরাই কি অল্প সময় নিয়ে পৃথিবীতে আসে? না অল্প আয়ুর কবিরা তাদের আয়ুষ্কাল বুঝতে পারে বলেই, শক্তিশালী হাতেই কলম ধরে?
আরেকটু বয়স হলে আরবী সাহিত্যের কবি তরফা বিন আল আবদের সাথে পরিচয় ঘটে। এখনো তার প্রখ্যাত মুআল্লাকা যখন তখন আউড়াতে মন চায়। কত স্বচ্ছ তার উপমা।কত গভীর অনুভূতি তার কবিতার ছত্রে ছত্রে। তিনি শব্দ চয়ন, চরিত্র চিত্রন ইত্যাদিতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কিন্তু তিনিও বেঁচে ছিলেন মাত্র ২৬ বছর। অথচ তার কবিতা আরবি ভাষার সেরা সাত কবিতার একটি । যা সোনার কালিতে লিখে কা’বা ঘরে টাঙানো হয়েছে। কবি আবু ফেরাস হামাদানী সম্পর্কে সমালোচকগণ বলেন, “ইন্নাহু লাম ইয়ুমাত্তা “বিশ্শাবাব।“ যৌবনের স্বাদ যিনি পাননি। তিনিও ছিলেন একজন বলিষ্ঠ কবি। তিনি যখন মৃত্যু বরণ করেন তখন একজন টগবগে তরুণ।
১৯৮৯ সালে রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধয়ন হতে এসে পরিচয় হয় এক তিউনীসীয় বন্ধুর সাথে। নাম আহমদ শামলী। কবিতায় খুবই সমঝদার ছিলেন তিনি। ওর কাছ অনেককিছু শিখেছি আমি । একদিন আলোচনা করছিলাম কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে। নজরুলের জীবনপাত পরে ঘটলেও তার কাবা মৃত্যু ঘটে যখন , তখন তিনি পূর্ণ যৌবনের একজন দৃপ্ত যুবক। আমার কথা শেষ হওয়ার পর কিছুটা আবেগ ভরে আমাকে একজন কবির বই দেন। বইটার নাম ছিল “ আগানী আল হায়াত” তথা জীবন-সংগীত। আমি পড়তে থাকলাম। মনে আছে সেদিন শেষ রাতের জীবন পরশেও ঘুম আনতে পারে নি। ছোট্ট এই কাব্যগ্রন্থ আমার মতো বেরসিক কবিতা–প্রেমিককে মুগ্ধ করেছিল। আরবী ভাষায় বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, সাহিত্য সমালোচনা, সাহিত্য ইতিহাস যখনই পড়েছি আমার সামনে জীবন সংগীতের এই অনবদ্য কবির নাম জ্বলজ্বল করে জ্বলেছে।তিনি ছিলেন ভূমধ্য সাগরের দক্ষিণ তীরের সবুজ ঘেরা তিউনিসিয়ার জাতীয় কবি। নাম আব্দুল কাসিম আশশাব্বী।সবুজ বনের বিরহী পাখি।
১.২
শাব্বী জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৯ সালে। তিউনিসিয়ার গারসাহ এবং জারেদ হৃদের মাঝখানে শহর। কমলার বিস্তীর্ণ বাগান, নারকেলের সারি আর সবুজের সমারোহে এই শহরের কোনো উপমা নেই। এখানের “ হামামাত” নামক সুনিষ্ট পানির ঝর্ণাও বয়ে গেছে। কবি শাব্বী এই নয়নাভিবাম স্বাস্থ্যকর স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মুহাম্মদ বিন বালকাসীম । তার পিতা ছিলেন শরীয়া কোর্টের একজন বিচারপতি। আলআযহার বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি উচ্চ শিক্ষা নেয়ার পাশাপাশি মুহাম্মদ আবদুহুর সংস্কার আন্দোলনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শাব্বীর ভাষায় তিনি ছিলেন সত্যবাদী, দৃঢ়প্রত্যয়ী, অকুতোভয় সংস্কারক ও ইসলামের একজন একনিষ্ট সেবক। ( জীবন সঙ্গীতের ভূমিকা পৃঃ৮)
১.৩.১
পিতার সরকারি চাকুরী হবার কারণে একস্থানে কখন থাকতে পারেননি তারা। এক শহর থেকে অন্য শহরে বার বার বদলি হতে হয়েছে তাদের। মালয়ানাহ ফাতালাহতে ছিলেন ১৯১০ সনে। ১৯৪১ সনে বদলি হয়ে গেলেন কাফসাহতে। সেখান থেকে কাবেসে ১৯১৪ সনে। ১৯১৭ সনে আবার এলেন ফাতালাহতে। তারপর মাজাফুল ১৯১৮ সনে যেয়ে ৬ বছর ছিলেন সেখানে। ১৯২৪ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত রা’সুল জাবালে কাটিয়ে অবশেষে ইন্তেকাল করেন ফাযাগুনে ১৯২৯ সনে। এজন্য শাব্বীও একশহরে থাকতে পারেননি কখনও। (শাব্বীঃ হামদা মুহাম্মদ, ১৬)
শাব্বীর প্রাথমিক লেখাপড়া পিতামাতার কাছেই। এখান থেকেই তার জীবনে ফুটে উঠে সত্য বলার দৃঢ়তা, নতুনভাবে ইসলাম বুঝার অনুপ্রেরণা। তিনি বলেন, “ আব্বা আমাকে প্রেম ও দয়ার অর্থ বুঝিয়েছেন, শিখিয়েছেন এই বিশ্বে সত্যই সবচে ভালো ও পবিত্র”। ( আল খায়াল আল শিঃ’রী শাব্বী, উতসর্গ)
তৎকালীন প্ৰথমত তিনি ভর্তি হন পাঠশালায়। তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ বছর । নয় বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআন হিফয করেন। বিভিন্ন শিক্ষপ্রতিষ্ঠান হতে ও আব্বার কাছ থেকে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন।
১.৩.২
১১/১০/১৯২০ সনে তিনি যায়তুনাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অবশ্য যায়তুনাহ তখন বিশ্ববিদ্যালয় মানে উন্নতি হয়নি। এ সময়েই তার প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে।মাত্র ১২ বছর বয়সের কিশোর। এ বয়সেই তার জীবনে এক দূরন্ত শনির আবির্ভাব হয়। প্রতিদিন স্কুলে যাবার পথে সৃষ্টি বিনিময় হতো এক সমবয়সী কিশোরীর সাথে। ধীরে ধীরে প্রেম নামক রোগে পেয়ে বসে দু’জনকে এরা এত ভালোবেসে ফেলে একে অপরকে যে, একজন আরেক জনকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না। মন দেয়া নেয়ার এই শুভক্ষণ হয়ত আল্লাহ চাইলেন না। তাই তিনি উঠিয়ে নিলেন শাব্বীর একমাত্র প্রণয়নীকে। শাব্বীর কিশোর মনে লাগে অত্যন্ত চোট। পরবর্তীতে যেসব ডাক্তার হৃদরোগের কারণ খুঁজেছেন, তারা তার এ মানসী বিয়োগকে একটা কারণ মনে করেন। হয়তঃ এই বেদনা বোধই তাকে চির বিরহী করে ফেলেছিলো। এই সময়েই তার প্রথম কবিতা “ওগো প্রেম” বের হয়। কবিতাটি নিম্ন রূপ –
ওগো প্রেম
ওগো অনুরাগ, আর ব্যথা তুমি,
আমার বেদনা, আমার শংকা, আমার হৃদয় আধি
আমার কৃশকায়, আমার অশ্রু, আমার কষ্ট তুমি
আমার বিমার, আমার বিরহ, আমার চিত্ত ব্যাধি
ওগো অনুরাগ, আমায় এনেছো তুমি ,
আমার জীবন, আমার যশঃ, আমার গৌরব,
যুগের নিকষ আঁধারের আলো তুমি
আমার সংগী, চোখের মণি, আশার সৌরভ।
ওগো প্রেম বলোনা আজি, বলো না আমায়
আঁধারে তোমার জন্ম নাকি আলোকের বন্যায়।
(জীবন সংগীতি : ৭৯)
আরবী কবিতায় এধরনের লেখা, শব্দচয়ন , ছন্দ সম্পূর্ণ নতুন । এজন্য মাত্র ১২ বছরে লেখা এই কবিতা সেসময় বেশ সাড়া জাগিয়ে ছিল । এভাবে তার কবি হৃদয়ে লাগলো দক্ষিণা বাতাস । আরো লিখলেন “হারানো স্বর্গ” , “প্রেমের প্রস্রবণ” ।
যায়তুনাহতে পড়াকালীন সময়ে কবি শাব্বী যেমন নতুন করে পৃথিবীকে আবিষ্কার করলেন। প্রিয়তমার শোকতো লেগেই আছে। পরিবার থেকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য পেতেন না। আবার বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন যুগপৎভাবে।“হারাকাতুশশাবাব আর মুসলিমিন” নামে এক নতুন সংগঠন দাড় করলেন। “কুদামা’ আল মাদরাসা আল সাদিকিঅ্যায়” নামক সাহিত্য সভার হলেন একনিষ্ঠ সাহিত্য কর্মী। সতির্তদের মাঝে অনুপম সম্মান, শিক্ষকগণের কাছে অপাত্য স্নেহ, বয়জ্যেষ্ঠদের কাছে ভালোবাসা কবির জন্য একান্ত নির্ধারিত ছিলো। তিনি সমাজের মাঝেও বেরিয়ে পড়লেন। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত জাতির দৈন্যদশা দু’চোখে প্রত্যক্ষ করলেন। সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী হামলায় তখন তিউনিসিয়া ধ্বংসের মুখোমুখি। মান-সম্মান , অর্থ-সম্পদ , ঈমান- আক্বীদা সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রে তিউনিসয়ার মাঝ থেকে বিলীন প্রায়। তিনি এসব দেখে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। এসময় যায়তুনাহকে বিশ্ববিদ্যালয় মানে উন্নতি করার প্রচেষ্টায় ও শক্তি নিয়োগ করলেন তিনি। ছাত্র সমাজকে একতা বদ্ধ করে তার প্রচন্ড এ আন্দোলন একদিন সফল হয়। ( শাব্বীঃ আব্দুল কাসিম মুহাম্মদ করো, ৩৫)
১.৩.৪
যাইয়তুনাহ থেকে পাস করলেন তিনি ১৯২৭ সনে। লেখাপড়ার অদম্য স্পৃহ্য তাকে আইন কলেজে ভর্তি হতে উদ্বুদ্ধ করলো। কবির শোকাভিভূত চেহারা, না পাওয়ার বঞ্চনা ইত্যাদি তার প্রিয়তম পিতা মাতার দৃষ্টি এড়াতো না।তার মনে একটু শান্তি দেয়ার যথা সাধ্য চেষ্টা তারা করতেন। কিন্তু ফল পাওয়া মোটেই যায়নি। সবাই মিলে তাকে বিয়ে করানোর চেষ্টাতে লাগলেন। পরিশেষে ১৯২৮ সালে তাকে বিয়ে দেয়া হলো।তখন কবির বয়স মাত্র ১৯ বছর। কবির জীবনে এই বিয়েটাও এক বিরাট ঘটনা বলে বিবেচিত। কিশোর বয়সের সেই দুর্নিবার প্রেমের মোহ কোনো ভাবেই কবি ছাড়তে পারছেন না। নতুন বিবাহিত স্ত্রীকে ও তাই তিনি প্রাণ খুলে ভালোবাসতে পারলেন না। যে বিরহের আগুনে তিনি দিন দিন ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন তার কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হলো না। এদিকে হৃদয়ের গভীর বেদনা বোধকে কবিতার আকারে তুলে ধরতে লাগলেন। ১৯২৬-১৯২৭ এই দুই বছর কবির প্রথম কাব্য সংকল বের হল। ১৯২৮ সনে প্রকাশিত হয় তার “আল খায়াল আল শি’রি ইনাদা আল “আরব” বা আরবদের কাব্যচিন্তা নামক ছোট গ্রন্থটি। এ গ্রন্থে কবি এমন এমন দিক উন্মোচন করলেন যে সমসাম়িক সাহিত্যে তার বিরাট প্রভাব পরলো। চতুর্দিকে হৈ চৈ পড়ে গেল।সাহিত্যে তিনি নতুনত্বের দিকে আহ্বান জানালেন। এমন নতুনত্ব তিনি চাইলেন যা অতীতকে পুজো করবে না। যার ইচ্ছা আকাঙ্খা থাকবে নতুন দুয়ারে হানা দেয়া। তিনি বললেন –
“আরব মস্তিষ্ক হতে যুগে যুগে যা কিছু উদগত হয়েছে তা প্রবাহমান মাত্র একটা সীমাবদ্ধ স্রোতে। কাব্যিক কল্পনার কোনো ছাপ তাতে নেই। এসবের মূল সুর হলো কোনো জিনিসের মুলতত্তে ও বাস্তবতায় না গিয়ে সীমাবদ্ধ ও সাদামাঠা চিন্তা নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করা। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাহ্যিক দিক এবং বানানো ছন্দ নির্ভরতা। প্রকৃতির কিছু রং বেরং আর কিছু অবয়ব মাত্র সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। মেয়েদের বাইরের দেহ নিয়ে ছাড়া তারা কবিতা লেখেনি”।(আলখায়াল – ৩০)
তিনি আরো বলেছেনঃ “আমাদের উচিত প্রাচীন আরবী কবিতাকে একমাত্র অনুসরনীয় উদহারন বলে মনে না করা। মনে করা ঠিক হবে না যে, এগুলরেই আমাদের অনুকরণ করতে হবে এবং তার শৈলিও রীতি পদ্ধতিই আমাদের মেনে চলতে হবে। বরং আমাদের উচিত এগুলোকে প্রাচীন সাহিত্য মনে করে তার সম্মান করা ও তার থেকে শিক্ষা নেয়া। তার থেকে বেশি মর্যাদা দেয়া ঠিক নয়”।
কবির এই কথাই আরব বিশ্বে প্রথম শুনা গেলো না। বরং ত্বাহা হুমায়ন, আল আক্কাদ, মাজেনী, ইসমাইল সাবরী, মিখাইল নু’আয়মাহ প্রমুখ কবি সাহিত্যিকগণ তার লেখার এই কথার দিকেই আহ্বান করেছেন । ফলে গড়ে উঠেছে আধুনিক আরবী সাহিত্য । যার ফলশ্রুতিতে আরবী ভাষা ও সাহিত্য পেল বিশ্বে সাহিত্য এক অনন্য আসন।
এ সময় কবি শাব্বির জীবন হয়ে উঠে কণ্ঠকাকীর্ণ। প্রতিপক্ষের একটানা অপপ্রচার, বিরহ- বেদনার অনবরত দহন, সাংসারিক জটিলতা কবিকে কিছুটা বিব্রত করে রাখে। তার জীবনে এলো আরেক দুর্ঘটনা। এত দিন তিনি যার অপাত্য স্নেহে বড় হয়ে উঠেছেন, যার ছায়ায় এতদিন জীবনকে উপভোগ করেছেন, সেই স্নেহময় পিতা ইন্তেকাল করলেন ১৯২৯ সনে। যিনি একজন খাঁটি ধর্মভীরু ও গোঁড়া হওয়া সত্বেও ছেলের এ ধরনের বাড়াবাড়িতে প্রকারান্তরে খুশি হতেন। যাঁকে শাব্বি তার গ্রন্থ উৎসর্গ করে অনাবিল তৃপ্তি দিয়েছিলেন। সেই পিতার বিয়োগে কবি একেবারে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন।বিরাট সংসারের বোঝা এখন তার ঘাড়ে। নিজের ভালোবাসা উদার করে দেবার মতো আর যেনো কেউ থাকলো না তার । এখন শুধু তাকে অপরের মুখে হাসি ফুটাতে হবে। মোমবাতির মত নিজেকে জ্বালিয়ে অন্যকে আঁধার রাতের রাস্তা দেখতে হবে । পিতার মৃত্যুতে তিনি গাইলেন :
মৃত্যু ওগো,
ভেঙেছে আমার বুকের পাঁজর ছিন্ন করেছো হৃদয় আমার
গিরি শৃঙ্গ হতে ফেলে দিয়ে। ক্রর হাসি ভরা মুখেতে তোমার।
রয়ে গেছি আজ চূর্ণ হৃদয় আশংকায় চোখ নাহিকো মেলি
স্বাপদ অরণ্যে পাগল বেশে আমারে রাখিয়া কি লাভ পেলি?
হৃদয় দিয়ে বাসিয়া ভালো বলা যায় যাকে যা কিছু গোপন
কালের গ্রাসে সঘন ত্রিমিরে যারে ধরা যায় প্রভাত তপন।
যাকে বলা যায় গোলাপের ঝাড়, অলীর পেয়ালা, মোহন বাঁশি
যে হতে পারে আমার বাগিচা, সুর, আশ্রয় আলোক রাশি।
তোমার নিষ্ঠুর হাতের থাবায় সব চলে গেল, সবাই গেল,
আশংকা আজ কার কাছে যাই, কার আশ্রয় যাবো হে বলো।
(আগানী আল হায়াত : ১৫৩)
মানুষের জীবনে সুখ দুঃখ উভয়ই আসে। কিন্তু কবি সাব্বি যেন চিরকাল ব্যথা বহন করার জন্যই এসেছেন। যাকেই ভালোবাসেন প্রানভরে, তাকেই হারান অকালে। বিরাট সংসারের বোঝা তার কাঁধে এসে পড়লো। তার পক্ষে জীবন যাপন করাই যেন দুঃসহ হয়ে উঠলো। জীবনের এই অসহ্য যন্ত্রনা তার প্রতিটি কবিতায় ফুটে উঠতে লাগলো। এখন তিনি যাকে তার সম্বল ভাবেন সে হলো তার নিজের আত্মা। সমস্ত দুঃখেও তিনি তার আত্মাকে এত ভালবাসতে লাগলেন যেন তার আর কোনো বাছাই নেই। সব দুঃখ কবিতায় থাকুক জীবনে যেন না থাকুক এই সাধনায় তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন। “হাবকাকুশ শাবাব আলমুসলিমিন” এর কাজ ও তিনি চালাছেন জোরেশোরে। জীবনের আরো কঠিনতম পরিক্ষার মুখোমুখি দাঁড়ালেন তিনি। তার ভাষায়, “জীবনের দুঃসহ এই দিনগুলো কাটছে আমার কোনো রকমে। বিরহের ভগ্নপ্রায় মনকে সাথে নিয়ে এক রাতে শুয়ে পড়েছি। মন ছিলো যন্ত্রনা ক্লিষ্ট। অর্ধরাত চলে গেছে ঘুমের ঘোরে। হয়তো রাত ১ টা বাজবে। হঠাত ঘুম ভেঙ্গে গেলো, বুকের ভেতর অসহ্য বেদনা। সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়লো সেই ব্যাথা। আমি বেহুশ হয়ে গেলাম।” (শাব্বি : হামুদা মুহাম্মানঃ ২৬)
হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন তিনি। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি বুকে ব্যাথা অনুভব করতেন। পিতার মৃত্যুর এক বছর ও গেলো না, দূরন্ত ব্যাধি তাকে অক্টোপাসের মত গিলে ফেললো। তিনি আর বাঁচার আশা করতে পারলেন না।
চোখের সামনে যেন মৃত্যু সব সময় তাকে নিয়ে উপহাস করে। চরম হতাশার মধ্যে কবি গাইলেন,
কবির কল্পনা নিয়ে আরো কিছুদিন সময় আমি জীবনের কাছে চেয়েছিলাম।
কিন্তু নিষ্ঠুর পৃথিবী আমার স্বপ্নের টুঁটি চেপে ধরলো।
শোন বন্ধ, দুনিয়ার সাথে যদি আমার সম্পর্ক চুকে যায়
আমি চলে যাই নৈশব্দে, আঁধারে। (আমার সমস্যা ছিল না)……….
কিন্তু আমি যে তা পারছিলেন। পাশেই আমার মা
তার অশ্রুভেজা স্নেহ আমার সব যন্ত্রণা দূর করে দ্যায়।
এবং আমার অনাথ ভাইবোনেরা যাদের
পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আমার বেঁচে থাকার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে।
ওদের দয়ালু পিতা যাবার পরে, আমাকে ওরা
বানিয়ে ছিলো এমন গুহা
দিন যাপনের রাক্ষসী থাবা থেকে যে ওদের বাঁচাতো।
পৃথিবী আজ সমস্ত দুঃসংবাদ নিয়ে আমাকে আক্রমণ করেছে
আমাকে ভয়ংকর উত্তাল তরঙ্গে ফেলে দিলো।
আজ হৃদয় ভেঙ্গে তার তটে অসহায়………
যন্ত্রণায় আমি দুগ্ধীভূত হচ্ছি।
(আগানি আল হায়াহ : স্বপ্নের জিঞ্জিরে, ১৬০)
দুশ্চিন্তা করা কিংবা কঠোর শারিরিক বা মানসিক পরিশ্রম করা ডাক্তারের বারণ। তাকে সম্পূর্ণ আরাম নিতে হবে বলে ডাক্তার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তিনি তা মানতে পারছেন কিভাবে?
“ঐ ওখানে ঘরের পাশে ছেলেরা খেলছে। ঐ তো যায়তুনাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা, তাদের শিক্ষকগণ মুক্ত বাতাসে হেটে বেড়াচ্ছে। আমি ওদের মত হতে পারছিনে কেন? ওদের মত আমি আর চলতে পারবো না। ডাক্তার আমাকে নিষেধ করেছে। বলেছেন, আপনার হার্টে অসুখ হয়েছে। হায়রে হৃদয় আমার, তুমিও হলে আমার যন্ত্রণা, আমার সমস্ত বেদনার উৎস। তুমি আজ রাতের আঁধার হয়ে জীবনালোকে কেন গ্রহের মত আসলে?
(কবির ডায়েরি : ২৫)
কখনো কখনো কবি ভালো হতেন। আশার আলো জ্বলে উঠত দু’চোখে। তিনি গাইতেন :
রোগ আর শত্রুর রক্তচক্ষুর সামনেও আমি বেঁচে রবো।
দিগন্তভেদী শিখরের পরে বাজের মত।
একদল মেঘ, কিছু বারিধারা এবং প্রচন্ড সাইক্লোন হাতে নিয়ে
আমি অহংকারী সূর্যের দিকে বিদ্রূপের চোখে তাকাবো।
(আগানি আল হায়াহ, বীরের সংগী, ১৭৮)
১.৩.৫
ডাক্তারের পরামর্শ কবিকে হাওয়া বদল করানো দরকার। দুই তিনটি বছর তিনি বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর স্থানে বাঁচার আশায় ঘুরেছেন। তিউনিসিয়ার ” আয়নু দারাহিম” নামক প্রসিদ্ধ সমুদ্রসৈকতে ১৯৩২ সালে গেলেন। সেখান থেকে যান আলজিরিয়ার আল মাশরুহাতে। ১৯৩৩ সনে একটা বছর এখানে কাটালেন। কিন্তু রোগ ভালো হওয়া তো দূরে থাক একেবারে শুকিয়ে গেলেন তিনি। তার জীবন স্পন্দন শেষ হবার উপক্রম হলো। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে আজ তিনি বড় ক্লান্ত ও শ্রান্ত। পরাজিত সৈনিক মাটির ধুলোয় তড়পাতে থাকেন। তার আত্মচিৎকারে সবুজ বনানীর আনন্দ কোলাহল থেমে গেল যেন। অসহ্য যন্ত্রণায় তার সারা দেহ নীল হয়ে যেত। আর্তস্বরে তিনি নিবেদন করলেন:
দয়া করো
পৃথিবীতে আজ আমি দীর্ণ বিদীর্ণ, দয়া করো।
নিরাশা এবং অন্তহীন আঁধার হতে আমাকে বাঁচাও।
কূলহীন বেদনার বারিধী থেকে আমাকে বাঁচাও।
আজ আমি এই ক্ষীণ অস্তিত্বটুকুও বইতে পারিনে।
আঁধারের শেষ নেই, আজ মরণের ভয়
ছড়িয়ে পড়ে কেঁপে সুদীর্ঘ নৈশদ্বের মাঝে
আজ তুমি আমার হৃদয়ে ঢুকিয়ে দাও জীবনের আশা
আর নিভু প্রায় জীবনে দাও বাঁচবার স্বাধ।
আমার রক্তে ঢেলে দাও উত্তাপ।
আমি আবার নতুন করে একটুখানি গান পেতে চাই।
(প্রেম কংকালের কাছে প্রার্থনা)
কিন্তু আল্লাহর ফয়সালায় কবিকে আত্মসমর্পণ করতে হলো। কবি এখন আত্মসমর্পণ করতে পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি এতেই যেন দেখলেন নতুন প্রভাতের দীপ্ত অরুণ। সব বেদনা, সব বঞ্চনা, সমস্ত অভিমান ঝেড়ে দিয়ে তিনি গেয়ে উঠলেন :
ক্ষত হতে ঝরা রক্ত তুমি যাও থেমে
আমার মনের ব্যাথাও যাও থেমে
কাঁদার আজ সময় কই?
মরিচীকারা পালিয়েছে দূর পশ্চিমে
উঁকি দিল মোর শেষ প্রভাত
বহু শতাব্দীর দীর্ঘ পর্দা ছিঁড়ে ছিঁড়ে
ক্ষুব্ধ জলের কল্লোল আর
ঘন আঁধারের পশ্চাতে ঐ
প্রভাত দিলো হাতছানি মোর
ডাকলো নতুন বসন্ত।
ওর করুণ সে সূর আজ শুনে
হৃদয়তন্ত্রী যায় ছিঁড়ে। মোর
হায়রে কেন আজ থেকে নেই
মন ভোলা এই ফুল বাসরে
একটুখানি বাঁচার অধিকার।
আজকে আমার চিরবিদায়
ওগো আমার বেদনার পর্বত
ওগো আমার নিরাশার কুহেলী
ওগো আমার নরকের যাতনা
আজ যে আমার চিরবিদায়।
ক্ষুদ্ধ মাতাল তরঙ্গ কোটরে
জীবনতরী এখনই যাবে ডুবে
আজ তাই মোর চিরবিদায়।
(নতুন প্রভাত : ১৩৫)
এটাই ছিল কবির শেষ জীবন সংগীত। অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে করে কবি অবশেষে তার প্রিয় ভূমি তিউনিসিয়ায় ফিরে এসেছিলেন। তিনি ফিরে এসেছিলেন সে সবুজের বাগিচায় যেখান থেকে তার কবি জীবন শুরু হয়েছিল। নতুন প্রেমের পরশে জীবনকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন তিনি। যেখান থেকে তার জীবন তরী পাল তুলে ছুটে ছিলো, সেখানেই এসে ডুবে গেল অনন্ত সাগরের বুকে। ১৯৩৪ সনে ৯ ই অক্টোবরের প্রভাতে তিনি ইন্তেকাল করেন। এভাবেই তার চির বিরহ ও সীমাহীন বেদনার জীবন শেষ হলো।
১.৪
কবি চলে গেলেন। তার এই স্বল্প আয়ুর মধ্যে তিনি বেশ কয়েকখানি গ্রন্থ রেখে গেছেন। তন্মধ্যে তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় “জীবন সংগীত” এবং “আল খয়াল আল শি’রী ইনদা আল আরব।”
বাকিগুলো হলো :
১. “জামিল ওয়া বুসায়নাহ” গল্প সংগ্রহ।
২. “শু’আরা’ আল মাগরিব”
৩. “মুযাক্কিরাত” কবির ডাইরি। সাহিত্য ও তার সমালোচনা এবং কবির আত্মজীবনী এখানে বিধৃত হয়েছে।
৪. “আল আদাব আল আরাবী ফি আল আসর আল হাদীস”
৫. রাসাইল
৬. ফি আল মাক্ববারাহ
৭. সাফহাতুন দামিয়াহ
৮. আলেসকীর (নাটক)
৯. কিসসাহ আল হিজরাহ আনাবাওয়ীয়্যাহ
১০. প্রবন্ধ সংকলন।
২.১.১
আবুল কাসিম আশ শাব্বির মত যারা রোগে ভোগেন তাদের পদক্ষেপ, অবস্থা এবং অবস্থান ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। এক ধরনের রোগী আছেন যারা তাদের রোগ যন্ত্রণায় কাতর হন এবং এই কাতরতার ফলে সৃষ্টি করেন দর্শন। সেই দর্শনকেই পৃথিবীর অসংখ্য অসুখী ও ব্যথাতুর মানবতার হৃদয়ের দর্শন রূপে প্রকটিত করেন। ব্যথা, নৈরশ্য, আশাভঙ্গ ও বঞ্চনার প্রতিধ্বনি হয় তাদের দর্শনের ছত্রে ছত্রে। আবুল আলা আল মাআরবী এ ধরনের কবি-সাহিত্যিকগণের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত।
অনেকে আছেন তারা দুর্বল চিত্তের অধিকারী নন। অসুখের দাবদাহে তারা ভেঙ্গে পড়েন না। তারা সমস্ত যন্ত্রণাকে জয় করতে চান। বিদ্রূপের হাসির বাণ হেনে তারা মৃত্যুর রক্তচক্ষুকে বিনাশ করতে চান। তারা হাসেন, তারা বেদনার আঘাত সয়েও আনন্দের গান গেয়ে চলেন। এভাবে তারা বিপদকে উপেক্ষা করে পা বাড়ান বিজয়ের দিকে। মৃত্যুর সাথে তাদের আলিঙ্গন হয় হাসিমুখে।
কিন্তু শাব্বি? তিনি তার রোগ যন্ত্রণাকে দর্শন সৃষ্টির সহায়ক মনে করলেন না। কিংবা রোগ যন্ত্রণাকে বিদ্রূপের হাসি দিয়ে জয় করতে পারলেন না। প্রলয়ংকরী রোগের যাতনায় তিনি ব্যথার বাণী উদগীরণ করেছেন। যখন ব্যথা কমেছে, আশার সুপ্রভাত আর দু’চোখে দেখেছেন। মৃত্যুর কালো দু’হাত দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছেন। নিরাশায় মন ভরে গেছে তখন। সুতীক্ষ্ণ অনুভূতির সৃষ্টি বেদনার বাণী কবিতার পংক্তিতে বেরিয়ে এসেছে। যার প্রতিটি শব্দে পাই ব্যথা, প্রতিটি ছন্দে পাই সুরের আঘাত, প্রতিটি পরতে দেখি দগ্ধ ও মৃতপ্রায় হৃদয়ের সকাতর ক্রন্দন। যেমন দেখুন :
নিরাশার কালো হাত ভেঙ্গেছে
স্বপ্নের দু’হাতে রাখা
আমার গীটার
প্রেমের গানগুলো তাই চুপিসারে
শরতের শুকনো ফুলের দোযখে
বিলীন হলো।
এবং বেদনার বৈশব্দে
কুজনের প্রতিধ্বনির মত
মিলিয়ে গেল।
*********
খুশীর তরঙ্গবাহী এই সংগীত
ওগো পাখি বন্ধ কর,
বহুদিন চলে গেল
আমার জীবন শুধু
বেদনার গান ভালোবাসে,
হয়ত এখন
হৃদয়ের নিরবতায় বিরহের গান
বাজিয়ে যাবে বুকভাঙা কান্নার তার
*********
ওগো তুমি গেয়ো নাকো প্রভাতের গীত
বাজিয়ো না আনন্দের সুর,
আমার হৃদয় তো ক্ষত-বিক্ষত
ক্রন্দসী জীবনের ঘাতে
ওকে আজ হাসাতে পারে না
খুশীর লহরী আর আলোর সংগীত।
**********
মৃত্যুর পদধ্বনি যে শুধু শোনে
চোখে যার লাশের আনাগোনা
তাকে কি পাগল করে
বসন্তে মনোহর ফুলের মিছিলে
আর খোদার মহিমা গায়ক
জীবনের মুচকী হাসির মাঝে উচ্চকিত
পাখির সংগীত?
************
ওগো পাখি আমাকে শোনাও
নারকীয় যাতনার সুর,
পিলাও আমায় তুমি বেদনার সুরা
মহা দুর্ভাবনার কষাঘাতে
চুয়ে পড়া যাতনায়
পেয়ালা পূর্ণ করে আমাকে পিলাও।
ঠোঁট ফাটা হাসি আর সইতে পারিনে
আজ আমাকে শোনাও
নিরাশ আকাংখার সুর
আর নিকষ রাতের ক্রন্দন
আমাকে শোনাও
বিষণ্ণ আঁধারের সুর
আমি শুধু তাই ভালোবাসি।
(বেদনার গান, ১৮৪)
কবি একেবারে নিরাশ হয়ে গেছেন। তার স্বপ্ন স্বাদ আজ যেন গরলে পরিণত হলো। মৃত্যুর হাত তার কত দেশে। লাশের আনাগোনা তার চোখের তারায়। হৃদয়তন্ত্রী যেন একেবারে ছিঁড়ে গেছে। তার ক্রন্দন ধ্বনি যেন প্রতি পংক্তিতে উঠে আসে। তিনি নতুন জীবন চান। আচা এবং স্বপ্নে বিভোর হতে চান। কিন্তু তিনি শরতের ঝরা পাতার মত যখন আশা ও স্বপ্নকে ঝরে পড়তে দেখেন তখন না কেঁদে পারেন না। অশ্রুর বাণ যেন প্রবাহিত হতে থাকে দু’টো কোটরাগত চোখ দিয়ে। তিনি গাইছেন :
অন্ধকারে
চুপিসারে
করব কানে আমার ব্যথা করুণ সুরে শুনিয়ে দিয়েছি
হাওয়ার মুখে কান পেতে ফের আমার ব্যথার প্রতিধ্বনি
শুনতে পেয়েছি।
আমি দেখতে পেয়েছি
সেথায় আমার কন্ঠের সুর একাকিত্বে কেঁদেই মরেছে
প্রণয় গেল
হৃদয়ও গেল
ওগো রাতের কৃষ্ণ চক্ষু মুক্ত বারি ঝরিয়ে তুমি একটু কাঁদনা
(আমার) পোড়া হৃদয় সে সলিলে একটু শীতল পরশ লাগুক
তা চাইতে পারো না?
তুমি দেখতে পাওনা
অনেক দিনের অগ্নিদগ্ধ ব্যকুল হৃদয় এ সুক্ষণে
এই সীমাহীন যন্ত্রণাকে বিদায় দিতে চায়।
(হৃদয়ের মাতম : শওকি দায়ফ দিরাসাত, ১৪৭)
কবির জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। তাড প্রণয় শেষ হয়ে গেছে। সম্ভবত প্রণয় বলতে “জীবনের আশা” কে বুঝাতে চেয়েছেন। হৃদয় বলতে বুঝিয়েছেন তার আয়ু। তাই তার কান্নাও আজ একাকিত্বে কেঁদে মরছে। নিরাশ আঁধার, ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন এবং মৃত্যুর ছায়া ছাড়া যেন আর তার জন্যে কিছুই নেই। তিনি গাইলেন :
তুমি কি দেখনি বাসন্তী ফুলের শুকিয়ে গিয়াছে পত্রপুট
মাটির বুকেতে দেখ না আকাশ পাখী গাহিতেছে গান কুঞ্জ শাখে
মরণের হাত হেরি দু’নয়নে গান গেছে থেমে অমনি বুকে।
মরে গেল তাই বন্ধ হলো অনাবিল তার জীবন গীতি।
শাখের মায়া ত্যাগ করে আজ শুকনো ফুলের হয়েছে সাথী?
তুমি কি দেখ না একমাত্র কিশোর হারিয়ে বিধবা মাতা
কেঁদেছে কত ছিনিয়ে যাবে মৃত্যুর হাত নিয়েছে মাথা?
তিনি আজ মরণের পদযাত্রী। তার গান থেমে যাচ্ছে। তার বিয়োগে বিধবা মাতার ক্রন্দন যেন এখনি ভেসে আছে তার কানে। ভাইবোনদের অসহায় মুখ তাকে আরো কাতর করে তুলেছে। কালো রাতকে তাই ডেকে ডেকে কবি বললেন :
ভীতি আর যন্ত্রণার প্রসূতি হে কালো নিশি
ভয়ংকর কালের ওগো প্রেত কংকাল
তুমি আজ পৃথিবীর ঘরে হয়ে এলে
বিক্ষুদ্ধ নরকের লেলিহান শিখা
জীবনের শত্রু তুমি ব্যথা বিরহীর
ব্যথাতুর প্রয়ানে তুমি সকরুণ সুর
তোমার প্রগাঢ়তায় সুম্মিত স্বপন
অচেতন কলিরা সব যেন হেসে মুখ খোলে
চেতনায় আঘাতে আবার
নিমিষে ঝরে পড়ে হারিয়ে জীবন।
(ওগো রাত : জীবন সংগীত)
একেকটা রাত তার কাছে ভয়ংকর মনে হয়। নৈরাশ্য, বেদনা ও শাস্তির প্রতিমূর্তি যেন সে। সে রাত যেন জীবনের চাকা থেমে গেছে এমন রোগীর উপর প্রেতের ছায়ারূপ এসেছে। তিনি আঁধারের মাঝে ভয়াতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। তার ভাষায় :
“হৃদয় আমার এক নিমিষে দৃষ্টি দিল,
দূর সুদূরে জমে থাকা স্তব্ধ ধরায়
শোনের দৃষ্টি ছেড়ে চলে ঘোর রাতের কালো
তার ওপারেও ভয়ের আঁধার দন্ত খিচায়।
দেখলো যে তার গভীরে নাচে ব্যথার আগুন
শুনলো সেথায় দগ্ধ মনের ব্যথার কাঁদন।
অবশেষে কবি আত্মসমর্পণ করেন। তার ভাষায়ঃ ” পৃথিবীতে মানুষ যেন এমন পাখির মত থাকে শিকারির নিক্ষিপ্ত বাণ ভয়ংকর উপত্যকায় ফেলে দেয়। তার চার পাশে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন কালো ঘূর্ণিঝড়ের প্রতিরূপ তেড়ে আসে। এভাবে যে গান বুলবুলিকে ও হারিয়ে দিতো তা শেষ হয়ে যায়।” (দিরাসাত ফি আল শি’র আল আরবী আল মুআসিরঃ শাওকি দায়ফ,১৪৯)
শাব্বীর জীবন সংগীতের প্রায় প্রতিটি গান যেন এই সুরে ঝংকৃত হয়েছে। ব্যথা-বেদনা,নিরাশা,বিরহ,ক্রন্দন এবং দীর্ঘশ্বাসে যেন ভরা তার প্রতিটি কবিতার পংক্তি। হৃদয়ের দীর্ঘদিনের জমে থাকা যন্ত্রণারই ফল এগুলো। এই ব্যথাই তাকে কবিতার দিকে এগিয়ে এনেছে। তার কবিতাবোধকে উন্মীলিত করেছে। তার শৈল্পিক মানকে পরিশোভিত ও উন্নত করেছে। আমার মনে হয় এই ব্যথা যদি না পেতেন কবি তাহলে তার কাব্যসত্তার এত পরিস্ফুটন সম্ভব হতো না। আপনি তার প্রকাশিত সমস্ত কবিতা পড়ুন। দেখবেন তা বেদনার মাটিতে গজিয়ে ওঠা পুষ্পরেণু, রোগ, বঞ্চনা ও ব্যথার চৈত্রী বাতাসে তার পাতা গুলো যেন শুকিয়ে গেছে।
২.২
কবির জীবনের বিরাট যেদিকটি আলোচনার দরকার ছিল তা বোধহয় ইতিপূর্বের কিঞ্চিত ইংগিতে বুঝতে পারবেন। আমার কবির জীবনের অন্যান্য পৃষ্ঠাসমূহও উল্টাতে চাই। কবি তার দীর্ঘ যন্ত্রণায়ও তার আপন জাতিকে ভুলতে পারিনি। তিউনিসিয়ায় তখন ফ্রান্স সাম্রাজ্যবাদ আসন গেড়ে নিয়েছে। ৯৬% মুসলিম অধ্যুষিত এ দেশটিকে তারা শেষ করে দিতে চায়। এদেশের অজস্র সম্পদ, অনাবিল তাওহীদী বিশ্বাস এবং স্ট্রাটেজিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এদেশ তারা পরিবর্তন করতে চায়। চায় এ দেশকে ফরাসীদের সেবাদাস বানাতে। এ সময় কবি দূরন্ত আত্মবিশ্বাসে উঠে দাঁড়ালেন। বিদ্রোহের গান গাইতে থাকলেন কবি। তিনি গাইলেন :
নিঠুর শোষক আর স্বৈরাচারী শোন
আঁধারের প্রণয়ী তুমি, জীবন নাশক
এ জাতির কান্না দেখে করেছো বিদ্রুপ,
হাতে তব দুর্বলের শোণিতের দাগ
ধরেছো পাগল করা তিউনিসের টুটি
ছড়ায়েছো টিলার ফুলে নিরাশার কাটা
একটু থামো
প্রতারিত হয়ো ন হে, বসন্ত দেখে
হয়ত অম্বর তব জেগেছে
কিংবা আলোয় প্রভাত হেসেছে
কিন্তু তা দিগন্তে দেখ আঁধারের নাদ
ভীষণ বজ্র নিপাত
ঐ দেখ ঝড় আসে শিকড় ভাঙ্গার
সাবধান হও
ঘেটেছো বালুর নিচে বারুদের খনি
কাঁটা ছড়ালে পাবে ব্যথার ফসল।
ভেবে দেখ একবার কেটেছে কত
পৃথ্বীর মাথা আর আশার কুসুম।
নিদায় এ ধরার প্রাণ রক্ত এবং
অশ্রুত ধারা ঢেলে ঢেলে
করেছো নিস্তাপ। আজ চেতনার
ঘাত প্রতিঘাতে নিমিষে হলো
সে প্রন্ড ভাসিয়ে নিতে দেখ নিষ্ঠুর বান
দেখ রক্তের বান
জ্বলন্ত রদ্র ঝড় সাথে নিয়ে বিক্ষোভে
তেড়ে আসে ঐ দেখ। রক্ষা নেই রক্ষা নেই।
(বিশ্ব জান্তাকে : ১৩৬)
সাম্রাজ্যবাদী ঘাতক শক্তিকে তিনি ভয় দেখালেন। বিদ্রোহের আগুন ছুঁড়ে তাদেরকে ক্ষতবিক্ষত করতে চাইলেন। দুর্বল তিউনিসবাসীদের নিয়ে তিনি পরাধীনতার শৃংখল ভাঙার শপথ নিচ্ছেন। অগ্নিবীণায় তার ঝংকার হলো :
কালকে দেখ শোষক তোমার ভাঙবে প্রাসাদ ভাঙবে
উঠবে হেঁকে মৃতপ্রায় জাতি, ফের বিদ্রোহের বীজ বুনবে।
একদিন দেখ পরাধীন তোর জিঞ্জীর টেনে ছিঁড়বে
উঠবে জ্বলে লেলিহান শিখা, বুঝবে সেদিন বুঝবে।
মরণ পথের যাত্রী ভেবেছো, দিন আসে, দিন দেখবে
তোমার পৃথিবী হয়েছে ক্ষুদ্র, যেই দিন ওরা রুখবে।
তিনি ধমক দিয়ে গেয়ে উঠলেন:
দেশের চোখের রঙীন স্বপ্ন আজিও যে সংগুপ্ত
হৃদয় গভীরে কান্না তাদের ধীরে হলো উত্তপ্ত
একদিন দেখ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে তুমি, শেষ হবে
আলোর বন্যায় হাসিব আমরা, তোমার আঁধারে নাশ হবে।
(স্বৈরাচারীকে : ১৪০-১৪১)
ইসলামি বিশ্বের চতুর্দিক হতে স্বাধীনতার এই বিদ্রোহ জেগে উঠল। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল সাম্রাজ্যবাদ শক্তি। দৃষ্টি ফেরালেন আপন জাতির প্রতি। পরাধীনতার আবিলতায় তারা আজ সব হারিয়েছে। তেজোদ্দীপ্ত সেই শক্তি আজ যেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশ্বেষ প্রায়। ঘুমের ঘোরে এ জাতি আরো সম্বিত ফিরে পায়নি। কবিতায় ডেকে (..) জাগাতে চাইলেন প্রতিটি সিংহ শাবককে। তিনি বজ্র নিনাদে বলে উঠলেন :
চারিদিকে আজ ঋতুর লিলা, কোকিলের গান
হাসলেনা তবু গাইলে না, গান প্রাণ খুলে
তোমার মাথায় শকুনি উড়েছে সাইক্লোন
সময় হলো যে আঘাত হানিবে তোর মূলে
তোমায় ঘিরিয়া গুমরে মরেছে সিংহবাঘ
শংকিত নয়, ব্যথিতও নয় তোমার মন
দোহাই খোদার এত টুকু বোধ হারালে আজ?
হারালে কথা প্রতিবাদ আর দ্রোহের গান।
কিন্তু পরাধীনতার নিগড়ে পড়ে মুসলিম জাতিসত্তা তাদের ঈমান ও আত্মবিশ্বাস ভুলে গেছে। তারা হারিয়েছে শৌর্যবীর্য। আজ তাদের মনে আগুন ঢেলে দিলেও তা যে বরফের পানিতে ঠান্ডা হয়ে যায়। বরং সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শাব্বীর এই জ্বিহাদকে অনেকে ভালোভাবে নিলেন না। অনেক মোল্লা মাওলানা তো এক পাগলের প্রলাপ হিসেবে মনে করলেন। ফতোয়া দিলেন এই জ্বিহাদ ইসলামি জ্বিহাদ নয়। জ্বিহাদ ছিল আমার অতীত ইতিহাসে। সে যুগও এখন নেই। সে জ্বিহাদও এখন সম্ভব নয়। কবি এদের কথা হতাশ হলেন না। বরং তাদের বিরুদ্ধেই লেগে লেগেন তিনি। বিদ্রুপ করে গাইলেন :
কবরেই থাকো, সেটা তোমার মানাবে ভালো
নিরাপদে ও নিঃশব্দে থাকবে সেথা
অতীতকে দিয়ো পূজার অর্ঘ্য, অতীত ছবি
মরার চোখে বারবার দেখে কহিয়ো কথা।
শুধু তাই নয়, একদল তো বলে বসলো সাম্রাজ্যবাদের অধীনেই তো ভালো আছি। রীতিমতো তাদের হাতের ছোঁয়ায় আজ তিউনিস হারা সম্বিত ফিরে পেয়েছে। নতুন জাগরণ ও প্রগতির ডাক দিয়েছে। এমনকি আমাদের দৈনন্দিন ইবাদতও ঠিকমত করতে পারছি। তাহলে খোদার আশীষ পাওয়া এই সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা করতে হবে কি জন্যে? এসব শুনে কবি কাঁদবেন না হাসবেন বুঝতে পারেন না। তিনি বিদ্রোহী। বিদ্রোহের আগুন তার প্রতিটি লোমকূপে যেন গরল ঢেলে দিলো। তিনি এসব বক্তব্যের তোরণে পদাঘাৎ করলেন। তিনি তাদের কে বাণী শুনিয়ে দিলেন :
আঁধারেই থাকো চক্ষু বন্ধ করে
নিজেকে নিয়ো না আলোকের হাঙ্গামায়
সেখানেও আছে বিপদের হাতছানি।
বললেন:
আধমরা ওহে বয়োবৃদ্ধ জীবনের তুমি যোগ্য নও
জীবন নাশক দুষ্ট ব্যাধি, নবজীবনের তুমি কসাই।
অভাবে তিনি জরাজীর্ণ জাতিকে জাগিয়ে তুললেন। তিনি গাইলেন শিকল ভাঙ্গার গান। গাইলেন ঈমানের বলে বলীয়ান হবার জন্যে। গাইলেন সাম্রাজ্যবাদীর নাগপাশ হতে মুক্তির জন্যে। জাগ্রত জনতার বিশাল মিছিলে তিনি অগ্নি ফুঁকে দিলেন। গাইলেন:
প্রতিশোধ নিবো প্রতিশোধ
নিশান ভেঙেছো, করেছো যে বরবাদ
রাজ্যের মুকুট ইসলাম শীরোপরি
প্রতিশোধ নিবে প্রতিশোধ
দাঁড়িয়েছে আজ কাতারবদ্ধ বীর
চোখে যাহাদের আগুনের শিখা কাঁপে
কন্ঠে যাদের আল্লাহু আকবর।
প্রতিশোধ নেবে প্রতিশোধ
দাঁড়িয়েছে আজ কাতার বদ্ধবীর,
অপমান যারা একটুও সয় না
মৃত্যু যাদের কন্ঠে হাত বাড়ালে
সিংহ নাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে
ভেঙে করে চুরমার।
(শাব্বী : হামদী মুহাম্মদ, ৫৯)
এভাবে কবিতার বিদ্রোহী সত্তা কে আরবী কবিতায় নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কবিতাগুলো নতুন বলয়ে পা দিতে ঘুরে দাঁড়ালো, যা ইতিপূর্বে আর কখনো দেখা যায়নি। মাত্র কয়েকটি বছরে আরবি সাহিত্যকে যে পর্যায়ে তিনি নিয়ে এলেন তা আসলেই অবিশ্বাস্য।