spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদলিটল ম্যাগাজিনসাময়িকপত্রের সন্ধানে

লিখেছেন : ড. ইসরাইল খান

সাময়িকপত্রের সন্ধানে

ড. ইসরাইল খান

[মুখবন্ধ : পশ্চিমবঙ্গ (রানাঘাট) থেকে প্রকাশিত বিষয়ভিত্তিক উন্নতমানের লিটলম্যাগাজিন ‘হরপ্পা’র সম্পাদক সৈকত মুখার্জি মহোদয়ের অনুরোধ তাঁর গ্রন্থাগার-সংখ্যার জন্যে লিখতে হবে। আমি যতোই বলি আমি গ্রন্থাগার বিষয়ে লিখবার যোগ্য লোক নই, তিনি ততোই জোর করেন। বললেন আপনি যেসকল লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন তার অভিজ্ঞতাই লিখুন না! 

তখন আমার মনে পড়ে আহমাদ মাযহারের দুই বছর আগের কথাটি। মাযহার কয়েকবার বলেছিলেন আপনি সাময়িকপত্র নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যা দেখেছেন যা করেছেন তা লিখুন। আমি এই কথা পুরো হজম করে ফেলেছিলাম। আমি ঐ কাজের যোগ্যই নই !

কিন্তু দুজনের কথা যখন মিলে গেল তখন আমি লিখতে শুরু করলাম। একটি লিটলম্যাগে প্রকাশিত হবে মাথায় রেখেই আকার সীমিত রাখা হয়েছে। ]

‘সাময়িকপত্রের সন্ধানে’–,

কী লেখা যায় ভেবে পাচ্ছি  না। 

তবে বহুবিচিত্র বিষয়ের মধ্য থেকে কেন সাময়িকপত্রই হলো আমার প্রধান কর্মক্ষেত্র–তা ভাবা যেতেই পারে। 

মনে পড়ছে, উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ার সময় ‘ঝংকার’ নামে একটি সাহিত্য-পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। অথচ সাময়িকপত্র বলতে যা বোঝায়, তখনো তা আমি ভালো করে বুঝিই না। চারপাশের পরিবেশও সে রকম ছিল না। কেবল মাত্র ১৯৭১ সালে দশম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় প্রতিবেশী মাস্টার মশাই, শ্রীপ্রমথনাথ দত্তের কল্যাণে রুপাপাত হাই স্কুলের ১৯৭০ সালের একটি সাহিত্য-বার্ষিকী পেয়েছিলাম। তিনি ঐ স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ‘তিন’ নামে তাঁর একটি মজাদার লেখা ওতে ছিল। আধুনিক, পৌরাণিক দেবদেবী, পূজা-আহ্নিক, অজু-গোসল প্রভৃতিতে তিনবার বলা বা করার যতো প্রথা-পদ্ধতি রয়েছে, তার একটি রসজ্ঞ বিবরণ। 

১৯৭৩ সালে বাড়িতে পাই বড় ভাইদের ফরিদপুর সরকারী রাজেন্দ্র কলেজের একটি বার্ষিকী। ওতে অধ্যাপক শেখ শমসের আলীর ‘বাঙলা ভাষার জন্মকথা’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ ছিল। আমাকে ক’দিন সাহিত্যরসে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রেখেছিল ওটি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের অনুসরণে স্নাতক সম্মান শ্রেণির ছাত্রদের উপযোগী রচনাটি আসলে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস। পেলাম ১৯৭৩ সালের (কলকাতার) শারদীয় ‘প্রসাদ’। সাড়ে আটশো পৃষ্ঠার ‘প্রসাদে’ উত্তম-অপর্ণা অভিনীত কাজললতা ও নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের রানুর প্রথম ভাগ আরও একগাদা সিনেমার বিজ্ঞাপন ছিল। ছিল প্রতিভা বসু, মহাশ্বেতা দেবী, সৈয়দ মুজতবা আলী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও অন্যান্য ত্রিশ-চল্লিশজন বিখ্যাত লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিকের ছোট-বড় উপন্যাসোপম অনেক গল্প, ফিচার–নানা রকমের উপাচার। অনেকদিন মজে রইলাম ওতে। আমার তখন লেখক হবার সাধ জাগে।

১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ঢাকা তো রাজধানীই। কিন্তু সাহিত্য আর পত্রিকারও হাট-বাজার। মাস ছয়েক পরই এলো ১৯৭৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। শহীদদের স্মরণে বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রদের উদ্যোগে প্রকাশিত হলো ‘রক্তে ফোটা পলাশ’। এর একজন সম্পাদক ও লেখক হিসেবে সাহিত্যজগতে আমার আগমন। এরপর ‘স্বকীয়তা’ নামে একটি সাহিত্য সংকলন দশ বছর যাবত অনিয়মিত ভাবে প্রকাশ করেছি। সহপাঠি বন্ধুদের প্রতিফলন, বৈজয়ন্তী, কাকলী প্রভৃতি স্মরণিকার সঙ্গে যুক্ত থেকেছি। 

১৯৮২ সালে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রকাশ করেন সৃজনপ্রয়াসী মাসিক লোকায়ত। এই পত্রিকায় স্যার আমাকে লেখক হিসাবে যুক্ত করেন। পত্রিকার প্রয়োজনীয় নানান কাজের সাথেও আমি সম্পৃক্ত হলাম। এ সময়ে তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে আসার ফলে দেশকাল, সমাজ-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে সাময়িক পত্রের বিচিত্র ভূমিকা সম্পর্কে একাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে ওঠে। আমার একটা দীর্ঘ প্রবন্ধও লোকায়তের ১৯৮৫ সারের এক সংখ্যাজুড়ে প্রকাশিত হয় ‘সাময়িকপত্র ও সমাজগঠন: বাংলাদেশের পরিস্থিতি’ শিরোনামে।

যেহেতু আমি উপলব্ধি করি, সাহিত্য-শিল্প সমাজচিত্র সকল কিছুর সূতিকাগার সাময়িকপত্র, সেহেতু যুগেযুগে প্রকাশিত পত্রিকাগুলো পড়ার কৌতূহল জাগে। একারণেই বিদ্যায়তনিক চর্চার বিষয়রূপে বিষয়টি বেছে নিই। ততদিনে অবশ্য এ-ও জেনেছি, ‘সাময়িকপত্র’ গবেষণার জন্য অবহেলিত কমদামী একটি বিষয়। যাঁরা পত্রিকার বিবরণ লিখেছেন, গবেষক হলেও তাঁরা সাহিত্যিক নন।

গ্রাজুয়েট হওয়ার পরই আমি একটি সরকারি ব্যাংকে যোগদান করেছিলাম। কর্মকর্তাদের অনুমতি নিয়েই আমি নিয়মিত ক্লাস করি। চাকুরির বয়স এক বছর হওয়ার পর এমএ পরীক্ষা দিই। এ সময় সিরিয়াস কর্মী হিসাবেই আমি লোকায়তস্বকীয়তা সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজ করতে থাকি। দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্যের পাতাসহ বিভিন্ন দৈনিক সাপ্তাহিক এবং লিটল ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ-গল্প হরদম লিখছি। পাঁচ-ছয় বছর পর মনে হলো, ব্যাংকের চাকুরি সাহিত্য চর্চার অনুকূল নয়। 

কি ভেবে আইন কলেজে ভর্তি হলাম। আবার স্যারদের শরণাপন্ন হয়ে পিএইচ-ডি করার অভিলাষও ব্যক্ত করলাম। ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্য ও সাময়িকপত্রের ভূমিকা নির্ণয় করার লক্ষ্যে অভিসন্দর্ভ রচনার জন্যে সারাংশ জমা দিয়ে এমফিল এবং ১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে পিএইচ-ডি প্রোগ্রামে ভর্তি হলাম। তবে ডিগ্রি নিয়ে চাকুরির সন্ধানে ঘুরতে হবে, সেরকম কোনো তাড়াহুড়ো আমার ছিল না। উদ্দেশ্য কাজের মধ্যদিয়ে আনন্দ অর্জন।

সাময়িকপত্র-গবেষক পূর্বসূরি মনীষীগণ উনিশ শতকের পত্র-পত্রিকার বিবরণ লিখেছিলেন। আমার স্বপ্ন : বিভিন্ন মতপথ ও ধারায় বিকশিত বিশ শতকের সাময়িকপত্রের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা সম্পর্কে তত্ত্বক আবুল কাসেম ফজলুল হক স্যার ধারণা দিলেন। রিসোর্স পারসনদের সাথে কথা বলতে বললেন। আমি প্রবীণ সাহিত্যসেবীদের কাছ থেকে পাকিস্তান আমলের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও পত্রপত্রিকার গতিপ্রবাহ অনুধাবনের চেষ্টায় লেগে পড়ি। কেদারনাথ মজুমদার, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ, আনিসুজ্জামান ও মুস্তাফা নূরউল ইসলামের প্রাসঙ্গিক বইগুলো পড়ে ফেলি। বাংলা একাডেমির সাবেক গ্রন্থাগারিক শামসুল হকের ‘বাংলা সাময়িকপত্র (১৯৪৭-৭১)’ বইটি আমাকে দিশারীর মতো পথ দেখালো। 

শহীদুল্লাহ্ গবেষণা কক্ষ শামসুল হকের বই 

বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলনের প্রসূণ ঢাকার বাংলা একাডেমি। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সম্মানে একটি গবেষণা কক্ষ গড়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য-সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পূর্ব বাঙলার ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংগ্রহ সংরক্ষণ ও পরিপোষণের লক্ষ্যে বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলা একাডেমি গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন। প্রতিষ্ঠার মূল দর্শনের আলোকে বাংলা ভাষার লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক সকলের উদ্দেশে আহবান জানানো হয়েছিলো পুরনো দিনের বই-পত্র-পত্রিকা যার কাছে যা আছে তা যেনো জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারের জন্য বিক্রয় বা দান করা হয়। 

কলকাতা যখন অবিভক্ত বাঙলার রাজধানী, তখন সেখান থেকেই প্রকাশিত হয়েছে উনিশ ও বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলা ভাষার বেশির ভাগ বই পুস্তক সাময়িকী। বাংলা ভাগের পরে কলকাতা থেকে আগত লেখকদের সংগ্রহ অনেক পাওয়া গেলো। যাঁরা পূর্ববঙ্গে বসে সংগ্রহ করতেন কলকাতার পত্রপত্রিকা তাঁদেরও অনেকেই উজাড় করে দান বা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। ফলে সেকালের দুষ্প্রাপ্য বহু পত্র-পত্রিকার সংগ্রহ বা নমুনা ঐ গবেষণা কক্ষক্ষে সমৃদ্ধ করেছে। উনিশ শো সাতচল্লিশ সাল থেকে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত সাপ্তাহিক-মাসিক প্রভৃতি পত্রপত্রিকার নমুনাও যতদূর সম্ভব সংগৃহীত হয়েছিল। অনেকে নিজের আগ্রহেও তাঁদের প্রকাশনা সংরক্ষিত হবে ভেবে জমা দিয়েছিলেন। 

এই সকল পত্র-পত্রিকাই লাইব্রেরিয়ান শামসুল হকের নিপুণ তত্ত্বাবধানে নথিভুক্ত করা হয় কয়েকটি মোটা শক্ত খাতায়। এই খাতাগুলোই শহীদুল্লাহ্ গবেষণা কক্ষের ক্যাটালগ। ওখানকার সংগহ অবলম্বন করে পরিকল্পিত ভাবে পূর্ব বাঙলা থেকে সাতচল্লিশ সালের আজাদীর পরে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রকাশিত বাংলা ভাষার পত্রিকাগুলোর তথ্যসূত্র মাসবর্ষক্রমে বর্ণিত হয়েছে তাঁর ‘বাংলা সাময়িকপত্র’ বইটিতে। তথ্যের সাথে অনেক পত্রিকার সম্পাদকীয় ঘোষণাও সংকলিত হয়েছে। এ-বইয়ের ভুক্তি সংখ্যা পাঁচশোর মতো। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানা গেছে, এমন পত্রিকার নামও যুক্ত হয়েছে। এ বইয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত দৈনিক সাপ্তাহিক মাসিক ত্রৈমাসিক শিশু মহিলা ও বিজ্ঞান বিষয়ক সকল পত্রিকার নাম আছে। প্রবীণ সাহিত্যিকদের কাছে গিয়ে জানতে চেষ্টা করি কোন্ পত্রিকার মাধ্যমে কারা কি করেছিলেন। 

যাঁদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি, তারাঁ হলেন–ড. আহমদ শরীফ, ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ড. কাজী দীন মুহম্মদ, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, ড. আনিসুজ্জামান, ড. ওয়াকিল আহমদ, অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, কবি আবুল হোসেন, শিশুসাহিত্যিক আতোয়ার রহমান, কবি মফিজ-উল হক, কবি আতাউর রহমান, কবি শামসুর রাহমান, অধ্যাপক আবু রুশদ মতীনউদ্দীন, কথাশিল্পী রশীদ করীম, অধ্যক্ষ মহীউদ্দীন আহমদ, ড. রফিকুল ইসলাম, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. এনামুল হক, কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কবি রফিক আজাদ, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি ফজলুল হক সরকার, কবি সৈয়দ আবুল মকসুদ, সাহিত্যিক আহমদ ছফা, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, সওগাত-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন, ড. মযহারুল ইসলাম, মিসেস রাবেয়া চৌধুরী (দিলরুবা পত্রিকার সম্পাদকের স্ত্রী), কথাশিল্পী বশীর আল হেলাল, সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম বেদু প্রমুখ। 

যে-সকল পত্রিকা অনুসন্ধানের জন্য তালিকাভুক্ত করি সেগুলোর নাম বর্ণানুক্রম অনুসারে– অগত্যা, অন্ন চাই আলো চাই, অভিযান, অতএব, আল্-ইসলাহ, ইমরোজ, উত্তরণ, উত্তর-অন্বেষা, একান্ত, কৃষ্টি, কণ্ঠস্বর, কিছুধ্বনি, গণমন, জাগরী, পূর্বলেখ, পলিমাটি, পূর্বাশা, বিবর্তন, বই বিচিত্রা, মুক্‌তি, মেঘনা, যাত্রিক, যাত্রী, যুববাণী, লেখক সংঘ পত্রিকা, সওগাত, সীমান্ত, সংকেত, সমকাল, স্পন্দন, সংলাপ, সাহিত্য, সুন্দরম্, স্বাক্ষর, স্বদেশ, সৈকত, সুনিকেত মল্লার, সুরভি, সাম্প্রতিক ইত্যাদি। 

বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগার

বাংলা একাডেমির ক্রমবিকাশমান মূল গ্রন্থাগারটিতে কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির মতো নিত্যনৈমিত্তিক প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক বিভিন্ন ক্যাটাগরির পত্র-পত্রিকা বই-পুস্তক প্রতি বছর সরকারি বাজেটের আওতায় কেনা ও সংরক্ষণ করা হয়। এই লাইব্রেরি বয়সে নবীন হলেও উনিশ ও বিশ শতকের ভারত বা বাংলা ভাগের পূর্ববর্তীকালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সকল পত্রিকারই কিছু না কিছু নিদর্শন এখানেও পাওয়া যায়। শনিবারের চিঠি, চতুরঙ্গ, ভারতবর্ষ, বসুমতী, প্রবাসী এমনকি বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত বঙ্গদর্শনের জীর্ণশীর্ণ নথিও যত্নে সংরক্ষণের প্রচেষ্টা বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গ্রহণ করা হয়। 

দেশভাগের পর এদেশের ছাত্রশিক্ষক-গবেষকদের বিদ্যাচর্চার ধারা অব্যাহত রাখার সংকল্প থেকেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ র নেতৃত্বে ড. মুহম্মদ এনামুল হক, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবদুল কাদির, সৈয়দ আলী আহসান, কবীর চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহিম, আশরাফ সিদ্দিকী, সরদার  ফজলুল করিম, আবদুল হক প্রমুখ মনীষাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের তৎপরতায় সকল কিংবদন্তী সাহিত্য পত্রিকা চাক্ষুষ দেখার সাধ মেটে বাংলা একাডেমির লাইব্রেরিতে। 

‘শহীদুল্লাহ গবেষাণা কক্ষ’ একটি পূর্ণাঙ্গ লাইব্রেরিই। কিন্ত এখানে মূলত পুরাতন বই-পুস্তক, পত্রপত্রিকা ও হাতে লেখা লাল সালু মোড়া মধ্যযুগের দুষ্প্রাপ্য পুঁথিসমূহ সংরক্ষিত হয়েছে। মূল লাইব্রেরিটি চলমান তথ্য ও গ্রন্থ-ভান্ডার। প্রতিদিন জড়ো হচ্ছে এর সাহিত্য-সম্ভার। প্রতিটির ব্যবস্থাপনায় রয়েছেন স্বতন্ত্র কর্মকর্তা-কর্মচারি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার 

বাাংলা একাডেমির উপর্যুক্ত দুটি সংগ্রহশালার ধারণা নিয়ে প্রবেশ করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে। কাক্সিক্ষত পত্রিকাগুলোর কত অংশ সেখানে পাওয়া যায় এবার সেটা মিলিয়ে দেখার পালা। বাংলা একাডেমির লাইব্রেরি খোলা থাকে শুধু অফিস চলাকালীন সময়ে। ঢাবি লাইব্রেরিতে পড়া যাবে রাত নটা অবধি। অনুসন্ধানের ফলাফল লিপিবদ্ধ করবার জন্য একটি তথ্যশীট  প্রণয়ন করি এ৪ সাইজ রেডিওবন্ড কাগজে। সাতটি কলামে যখন যে পত্রিকা পাওয়া যাবে সাথে সাথে তার তথ্য লিখে ফেলতে হবে। বাকিগুলো বাংলা একাডেমি ও অন্যান্য গ্রন্থাগারে খোঁজা হবে,–এই হলো পরিকল্পনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে কি কি পত্রিকা আছে সেগুলো নিজের চোখে বাস্তবে মিলিয়ে দেখার জন্যে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে লাইব্রেরির নিচতলা ও দোতলার সাময়িকপত্র সেকশনের সেলফে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সেখানে ১৯৪৭ সালের পূর্ববর্তী প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা পত্রিকাগুলো যেমন–প্রবাসী, নারায়ণ, মানসী মর্মবাণী, ভারতবর্ষ, বসুমতী, নবপর্যায়ের বঙ্গদর্শন (১৯৪৭-৫২), পরিচয়, মোহাম্মাদী, সওগাত, পূবালী, পরিক্রম, লেখক সঙ্ঘ পত্রিকার অধিকাংশ সংখ্যার সন্ধান পেলাম। কিন্তু বাংলা একাডেমির শহীদুল্লাহ্ গবেষণা কক্ষে প্রাপ্ত অপ্রাতিষ্ঠানিক জনপ্রিয় অস্থায়ী পত্রিকাগুলোর টিকিটিরও দেখা পাওয়া গেলো না এখানে। সওগাতমোহাম্মদী, মাহেনও, পরিক্রম, পূবালীর প্রায় পুরো সেটের কাজ ঢাবিতেই করে নিলাম। যে-সকল সংখ্যা এখানে পাওয়া গেলো না এবং কেবলমাত্র বাংলা একাডেমি লাইব্রেরিতেই রয়েছে, সেসমুদয়ের তথ্য সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বাংলা একাডেমিতে বসেই নোট নিতে থাকি। প্রতিটি পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যার সকল লেখার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের বিবরণ বুঝে বুঝে লিখে নিতে থাকলাম। থিসিস লেখার জন্যে বাছাই করা তথ্য ছাড়াও প্রতিটি পত্রিকার সূচিগত ইতিহাস লেখার উপকরণও একই সঙ্গে নোট করতে থাকি।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত উনিশ শতকের দৈনিক ঢাকা প্রকাশবান্ধব; নবনূরধূমকেতু–দৈনিক আজাদ প্রভৃতি কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকার মাইক্রোফিল্ম কপি এই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত হয়েছে। তাছাড়া বিভাগ পূর্ববর্তীকালের সকল বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকার নমুনাও যতদূর সম্ভব সংরক্ষণের প্রচেষ্টা দেখা যায়। লন্ডন আমেরিকা জার্মানী থেকে প্রকাশিত ইংরেজি লিটারেরিক ও সায়েন্টিফিক ম্যাগাজিন, জার্নাল থরে থরে সংরক্ষিত আছে। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ভাইস চ্যান্সেলর অনেকে ছিলেন জাতিতে ইংরেজ আর লণ্ডনের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও প্রফেসর। 

আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের মধ্যযুগের পুঁথি-সাহিত্যের বিশাল সংগ্রহের সাথে অন্যান্য গবেষকদের সংগৃহীত মধ্যযুগের তাল পাতা বা তুলোট কাগজে হাতে লেখা পুঁথিরও এক বিশাল সংগ্রহ এখানে রয়েছে। তবে পাওয়া যায় নি নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত দৈনিক নবযুগ, দৈনিক সেবক, ধূপছায়া, অগ্রগতি, লাঙল, সংহতি, নবশক্তি, সবুজপত্র, কল্লোল, কালি-কলম, প্রগতিকবিতা’র নথি। শুধু ঢাবিতেই নয়, বাংলাদেশের কোনও গ্রন্থাগারেই নেই। উপরের প্রধান তিনটি লাইব্রেরিতে যে সকল পত্রিকার কপি আছে সেসবের খন্ডিত ভলিউম মেলে ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি, আগারগাঁওয়ে অবস্থিত জাতীয় গ্রন্থাগার, জাতীয় আর্কাইভ, এশিয়াটিক সোসাইটি লাইব্রেরি, ঢাকার নিকটে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গ্রন্থাগার প্রভৃতিতে। 

সাময়িকপত্রের সন্ধানে নেমে নাম-জানা সকল পত্রিকার পুরো সেট কোথাওই মিললো না। এমন কি পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত জীবিত ও সাহিত্যসমাজে সক্রিয় সাহিত্যসেবী সম্পাদকদের সম্পাদিত পত্রিকারও পুরো সেট নামকরা গ্রন্থাগারে তো নয়ই, বাংলাদেশের প্রধান সংগ্রশালা বাংলা একাডেমির শহীদুল্লাহ্ গবেষণা কক্ষ বা অন্যটিতেও মিলল না। যেমন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সম্পাদিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত, ‘পূর্বমেঘ’, জাতীয় জাদুঘরের সাবেক মহাপরিচালক ড. এনামুল হক সম্পাদিত পাকিস্তান আমলের অন্যতম প্রধান সামিয়িকপত্র ‘উত্তরণ’। এগুলোর সন্ধানে তাঁদের সাথে দেখা করে পত্রিকার কপি চাইলাম। ড. এনামুল হক কয়েক কপি উত্তরণ আমাকে উপহার দিলেও অন্যেরা কিছুই দিতে পারলেন না। পূর্বমেঘ পেলাম গিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গড়ে ওঠা লাইব্রেরিতে। রাজশাহী থেকে দুজনেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন উপাচার্য ও অপরজন বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে যৌবনের স্মৃতিময় ‘পূর্বমেঘের’ একসেট জমা দিয়েছিলেন বলে সেখান থেকে ফটোকপি নিতে সক্ষম হলাম। সংলাপের একটি বিশেষ সংখ্যা উপহার দিয়েছিলেন অন্যতর সম্পাদক প্রফেসর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন। 

এইভাবে সিলেট ও দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে আমি পূর্ব বাঙলার সাময়িকপত্রের ওপর একটি অভিসন্দর্ভ প্রণয়ন করি। আনুষঙ্গিক তথ্য দিয়ে তৈরি হয় আরও দু খানা বই। এসবই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। 

সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সংগ্রহশালা 

সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সংগ্রহশালা লাইব্রেরিতে রূপ নিয়ে বিকশিত হয়েছে ১৯৩৬ সাল থেকে। ১৯৩২ সালে সম্পাদক মুহম্মদ নূরুল হক তাঁর আল্-ইসলাহ্ মাসিক পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৬ সালে এই আল্-ইসলাহ্ অবলম্বনে সেখানকার জমিদারদের আনুকূল্যে গড়ে ওঠে সিলেট মুসলিম সাহিত্য সমিতি। এই নাম নতুন নয়। ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হলে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের জাগানোর স্বপ্ন নিয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। এর আগে ১৯১৫ সালে কলকাতায় গড়ে উঠেছিল ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’। মুহম্মদ নূরুল হকের আল্ ইসলাহ্ একেবারেই মুসলিম সাহিত্যি চর্চার পত্রিকা ছিল। অন্যান্যের ন্যায় সমগ্রতাবাদী সম্পাদক ছিলেন না তিনি। সিলেটের মুসলিম সাহিত্য সমিতির লাইব্রেরিতে নূরুল হক তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে আবেদন নিবেদন ও উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে দেশের সকল সম্পাদকদের সৌজন্য কপি প্রেরণের আহবান জানাতেন। সম্পাদককে প্রেরিত তখনকার পত্র-পত্রিকার সৌজন্য কপি, অনুরোধে প্রেরিত বই-পুস্তক-পুস্তিকা দিয়েই প্রথমে গড়ে তোলা হয় লাইব্রেরিটি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এখন বহুতল বিশিষ্ট ভবনে লাইব্রেরিটি অবস্থিত। বহুজনের উপহৃত দুর্লভ হাজার বছরের পান্ডুলিপি, হস্তাক্ষর, মুদ্রা, প্রভৃতি সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি দিয়ে একটি জাদুঘরও গড়ে উঠেছে সমিতির ভবনের তৃতীয় তলায়। দ্বিতীয় তলায় ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরিটি নতুনরূপে সজ্জিত হয়েছে। সরকারি বরাদ্দ পেয়ে প্রতি বছর নতুন প্রকাশিত বইও তাঁরা সংগ্রহ করেন। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে সেখানকার সুধীজনের ব্যক্তিগত সংগ্রহ জমা হয়ে ওই লাইব্রেরিটিও এখন আঞ্চলিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি লাইব্রেরির মর্যাদা অর্জন করেছে। বিভাগ পূর্ববর্তী কালে প্রকাশিত পত্রিকা পুস্তকাদিও সেখানে জড়ো হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীর গ্রন্থাগারে নেই এমন অনেক বই, প্রাচীন কালের সিলেটি নাগরী হরফে লিখিত দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি, পুঁথি সেখানকার গ্রন্থাগারটিকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। তবে আমার কাজের জন্যে যে সকল সাময়িকী প্রয়োজন ছিল তা আমি বাংলা একাডেমির শহীদুল্লাহ্ গবেষণা কক্ষেই পেয়ে গিয়েছিলাম।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর লাইব্রেরি 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তান আমলের শেষ মুহূর্তে ১৯৬৯ সালে উদ্বোধিত হলেও কার্যক্রম জোরদার হয় স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটু ভিন্ন কায়দায় পুরোনো দিনের পত্রিকা ও বই-পুস্তক দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর নামে লাইব্রেরির একটি শাখা পরিচালনা করা হয়। এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সাময়িকপত্রের বিশাল সংগ্রহ দিয়ে। তাঁর দেখাদেখি ঐ অঞ্চলের কৃতি সন্তানদের পারিবারিক সংগ্রহও ঐ জাদুঘরে জমা হয়। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের সুবিশাল সংগ্রহ দান করেন তাঁর পালক পুত্র (ভ্রাতুষ্পুত্র) ড. আহমদ শরীফ। এক ভাগ দেন রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্স ইনিস্টিটিউশনে, কিছু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর কিছু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ গবেষক ও মনস্বী লেখক ছিলেন। তিনি আর্থিকভাবে দরিদ্র ছিলেন যদিও কিন্ত কলকাতা থেকে প্রকাশিত চল্লিশটি সাহিত্য-সাময়িকীর তিনি নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামেরই সন্তান হওয়ায় তাঁর সংগ্রহের সুবিশাল অংশ তাঁরা পেয়ে যান তাঁরা। এগুলো দিয়েই যাত্রা শুরু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নবগঠিত জাদুঘরের।

সাময়িকপত্রের সন্ধানে : কলকাতা মুর্শিদাবাদ

ভারত সরকারের আইসিসিআর স্কলারশীপ জুটে গেলে আমি শিক্ষা-ছুটি পেলাম ব্যাংক থেকে। দুই-এক করে এই সুবাদে চার-পাঁচ বছর আমি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয়ে কলকাতার গ্রন্থাগারসমূহ দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম যা আমার জীবনের এক বিরাট আনন্দঘন সুযোগ ও স্মৃতি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রদের কাছে কলকাতা নিঃসন্দেহে তীর্থসম। সাতচল্লিশ থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাসের নতুন কাণ্ডের বিকাশ ধরা হলে মূলকাণ্ড তো পড়ে আছে কলকাতাতেই। 

এবার বিষয় বাছলাম সাতচল্লিশ পূর্ববর্তী কালের মুসলিম সম্পাদিত ও প্রকাশিত সাময়িকপত্রের কার্যক্রম বিচার-বিশ্লেষণ। বাংলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর নির্মলকুমার দাশের তত্ত্বাবধানে নিবন্ধিত হবার অনুমোদন দিলেন তদানীন্তন উপাচার্য ড. পবিত্র সরকার। কলকাতায় মুসলিম সাময়িকপত্রের প্রধান উৎস– বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎন্যাশনাল লাইব্রেরির কথা আমি আগেই জানতাম। কিন্তু ওখানকার পত্রিকা সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করার জন্যে আমি মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায়ের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করি। 

তাঁকে আমার কাজ সম্পর্কে টেলিফোনে জানালাম। তারপর যেতে বললেন তাঁর আশুতোষ চৌধুরী এ্যভিনিউর ফ্লাটে। ৯ এপ্রিল ১৯৯৫ সকাল ১১ টায় বাংলা একাডেমি প্রকশিত ড. সন্দীপক মল্লিক প্রণীত ‘অন্নদাশঙ্কর রায় : সাহিত্য প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ (ডিসেম্বর,১৯৯৪) বইটি পেয়ে খুশি প্রকাশ করলেন। বললেন, কলকাতার অনেকেই তাঁর ওপর কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু বই-পুস্তক পায় না বলে করতে পারেন না। ঢাকা থেকেই তাঁকে নিয়ে আগে বই বেরুলো! তিনি বিস্মিত মুগ্ধ হলেন। বললেন ছেলেটা ‘বই-পুস্তক  সংগ্রহ করলো কীভাবে?’ 

কাজী আবদুল ওদুদের ওপর পশ্চিমবঙ্গ বাংলা বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত (জানুয়ারি ১৯৯৫) তরুণ মুখোপাধ্যায়ের বইটি আমাকে দেবার জন্যে খুঁজলেন। জানালেন, ৯১ বৎসর পার হলেও কিছু কিছু কাজ এখনও করছেন। আমার গবেষণার বিষয় জেনে খুশি হলেন। নিজের লোক ডেকে আমাকে পাশে বসিয়ে ছবি তুললেন। তাঁরপর বলতে লাগলেন–

‘কাজী আবদুল ওদুদ সাহেবকে প্রথম দেখি ঢাকাতে। সেটা ১৯৩৩ সালে। উনি আমার অচেনা হলেও লেখা আমার অচেনা ছিল না। প্রবাসীতে আমি ওঁর ‘রবীন্দ্র-কাব্যপাঠ’ পড়ে মুগ্ধ  হয়েছিলুম। জানতাম না তিনি কে, কোথায় থাকেন, কি করেন। তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে রবীন্দ্রকাব্যের বিশ্লেষণ করেছেন। ঢাকাতে আলাপ হওয়ার সময় আমি লক্ষ্য করি, তিনি একজন সৌম্যদর্শন পুরুষ। মুখে স্মিত হাসি। কথাবার্তা বিদগ্ধজনের মতো। কাজীর সঙ্গে একবার কি দু’বার দেখা হয়েছিল। তাঁকে একটা বইও উপহার দিই–‘অজ্ঞাতবাস’। তাঁর কাছ থেকে উত্তর পেলুম, তাঁর সহযোগী কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে। কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গেও আমার একই সঙ্গে আলাপ হয়। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। দু’জনের সঙ্গেই পরবর্তীকালে আমার বন্ধুতা হয় এবং সে বন্ধুত্ব গভীর স্তরের। দেশভাগ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের বন্ধুতায় আঘাত লাগেনি। 

কাজীর মৃত্যুর আশংকা যখন দেখা দেয়, তিনি আমাকে ডেকে পাঠান। গিয়ে দেখি যে তিনি সংকট মুক্ত হয়েছেন। কী পরিমাণ অনুরাগ ছিল আমার উপর এটাই তার প্রমাণ। মৃত্যুর ঠিক পূর্বে একটি পুরস্কার পান। তাতে আমারও কিছু হাত ছিল। সেই টাকা থেকেও তিনি বেশ কিছু দান খয়রাত করেন। পরে তাঁর অন্ত্যেষ্টির জন্যে টাকায় টান পড়ে। অন্ত্যেষ্টি একদিন পিছিয়ে গেল। তাঁর ছেলে ও জামাইর আসতে একদিন দেরি হল বলে। 

পরে গোরস্থানে গিয়ে ওঁর কবর দেখেছি। স্ত্রীর কবরের পাশেই ওঁর কবর। কোনটায় ওঁর কবর বোঝা যায় না। নামধাম পরিচয় লিখে রাখা হয়নি। আপনারা দেখবেন গিয়ে কী করা হয়েছে। তাঁর বাসভবন পরিদর্শনের সুযোগ থাকা ও রক্ষণাবেক্ষণ হওয়া উচিত। আপনার গবেষণার জন্য আতাউর রহমান সাহেবের স্ত্রী মিসেস নীরা রহমানের সঙ্গে কথা বলে সাক্ষাৎকার নিতে পারেন। আবদুর রউফ সাহেবের কাছে ‘চতুরঙ্গ’র ব্যাপারে সাহায্য নিতে হবে।’

বললেন : মাহবুব আলম, দিদারুল আলম, উমরতুল ফজল, আবদুল কাদির, আহমদ শরীফ এঁদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক অনুভব করি। মাহবুব আলমের ‘মোমেনের জবানবন্দী’ চতুরঙ্গে পড়ে মুগ্ধ হই। জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ পড়ছেন বলে জানালেন। ‘এটা পড়ে মনে হয় না হিন্দু ও মুসলমানের জীবন-যাত্রা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস-সংস্কারে কোনো পার্থক্য আছে। দু’একটা ব্যাপারে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, তাতো থাকবেই, ধর্ম দুটো।– 

আরও বললেন : আপনাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ‘রূপায়ণ’ নামে একটি পত্রিকা বের করেছিলেন ১৯৩৯-৪০ সালের দিকে। আমার লেখা নিতে এসেছিল। বলেছিলামÑআগে কয়েক সংখ্যা বের করো। পরে নিশ্চয়ই দেবো। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত সাহিত্য-সম্মেলনে গেলে জানিয়েছিল কয়েক সংখ্যা বের করেছিল। নারায়ণগঞ্জের খান বাহাদুর ওসমান গণি সাহেবও ১৯৩৩এর দিকে ঢাকায় থাকতে ‘সবুজ বাঙলা’ নামে পত্রিকার জন্য লেখা নিতে এসেছিলেন। এ-সব পত্রিকা খুঁজতে পারেন।’

মুসলিম সম্পাদিত যে-সকল পত্রিকার ওপর তথ্যানুসন্ধান করার জন্যে তালিকা করলাম তাহলো–ক. সওগাত, শিখা, জয়তী, প্রাতিকা, বুলবুল, ছায়াবীথি, চতুরঙ্গ, রূপায়ণ, ত্রিকাল; খ. মোয়াজ্জিন, গুলিস্তাঁ, সবুজ বাঙলা, মৃত্তিকা, পুরবী, বঙ্গভূমি,শীশ মহল, প্রতিভা, নব্য বাংলা, রূপ ও রেখা, বর্ষবাণী,  অভিযান, মোহাম্মদী, আল-ইসলাহ্, প্রভাতী (সিলেট), আল্ আমান (সিলেট), নওরোজ (দিনাজপুর), জাগরণ, নয়া জামানা ঘ. শিশু-সওগাত, গুল-বাগিচা, সবুজ-পতাকা প্রভৃতি। 

এরপর আমি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, ইন্ডিয়ান সেন্ট্রাল আর্কাইভ, আচার্য যদুনাথ সরকারের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত সোস্যাল সায়েন্সেস এন্ড রিসার্স ইনিষ্টিটিউট, উত্তরপাড়া লাইব্রেরি, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের পিতা পুরাতন সাময়িকপত্রের সংরক্ষক ভারত সরকারের বৃত্তিভোগী স্বাধীনতা-সংগ্রামী, মুর্শিদাবাদের খোসবাসপুর নিবাসী সৈয়দ আবদুর রহমান ফেরদৌসীর সংগ্রহ, ফেরদৌসীপুত্র, কবিতা-পত্রিকা ‘অর্কেস্ট্রা’-সম্পাদক, মুসলিম সাময়িকপত্র-গবেষক সৈয়দ খালেদ নৌমান, লিটলম্যাগাজিনের সংগ্রাহক শ্রীসন্দীপ দত্ত, চতুরঙ্গের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব আবদুর রউফ, চতুরঙ্গের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য শ্রীনীহাররঞ্জন চক্রবর্তী, শ্রীসুভো ঠাকুরের কন্যা শিল্পী শ্রীমতি… (নামটি এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, তাঁর কার্যালয় ধর্মতলায়), মিসেস নীরা রহমান ও তাঁর চতুরঙ্গ কার্যালয় পরিদর্শন করি, সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি, তথ্য লিপিবদ্ধ করি। 

শুধু মুসলিম সম্পাদিত পত্রপত্রিকার ওপরই নয় বিশ শতকের সূচনা হয় যে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত নবপর্যায়ের (৩য় পর্যায়) বঙ্গদর্শন আর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের দীঘজীবী সর্বাধিক প্রচার সংখ্যার মাসিক প্রবাসীসহ বিশ শতকের প্রধান-প্রধান ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ সকল পত্রিকাই একে একে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে সকাল-সন্ধ্যা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পাক্কা চার বছর আমি ইতিহাসের ক্রম অনুধাবন করে পড়ে-দেখে বিস্তৃত নোট গ্রহণ করে নিয়ে আসি, যেনো বহুদিন আর না আসতে পারলেও ঘরে বসেই কাজ করা যায়। 

অনেক দিন অনুমোদন নিয়ে ন্যাশনাল লাইব্রেরির আন্ডারগ্রাউন্ড সেকশনে সাময়িকপত্রের সেলফে-সেলফে ঘুরে সমস্ত পত্রিকার চেহারাই দেখবার চেষ্টা করেছি। সকল পত্রিকার নাম উল্লেখ ক্লান্তিকর হবে। তবে ‘কল্লোল যুগের পরে’ বুদ্ধদেবের ‘কবিতা’র ঠিক সমসময়ে রোম্যান্টিক ঘরাণার সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব শ্রীআশু চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক অগ্রগতি’ আবিষ্কারের ঘটনা আমার জীবনে আরেকটি অবিস্মরণীয় স্মৃতি। ব্যাপারটি ঘটেছিল আচমকা। চতুরঙ্গ পত্রিকায় আলোচনার জন্যে আসা আশু চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা ‘কল্লোল যুগের পরে’ (প্যাপিরাস, কলকাতা, ১৯৯৩) বইটি নির্বাহী সম্পাদক আবদুর রউফ সাহেব আমাকে দিয়েছিলেন রিভিউ করার জন্যে। এটি তাঁর সম্পাদিত অগ্রগতির ইতিহাস স্মৃতি থেকে লেখা। কারণ পত্রিকার কোনো সংখ্যারই নাকি কোনো হদিস নেই। অথচ মুখবন্ধ লেখক ঐতিহাসিক, অধ্যাপক শ্রীঅসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও লিখেছেন ত্রিশের দশকে এটি একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী অত্যাধুনিক কাগজ ছিল। আমার জিঁদ চেপে যায় আগে এই পত্রিকার নমুনা উদ্ধারের জন্য। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পত্রিকাটির কপি আছে বলে আমি নিশ্চিত হই। আবিষ্কারের মোহে মোহিত আমি। কল নম্বর দিয়ে অগ্রগতির রিকুইজিশন দিলে প্রতিবারই নট ফাউন্ড বলে প্রত্যাখাত হচ্ছিল। পরে সেলফে গিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিটি পাতা আলগা দড়িবাধা অবস্থায় পাওয়া গেলে কারণ বোঝা গেল। অনুরোধ করে সতর্ক অবস্থায় নাড়াচাড়া করার শর্তে পত্রিকাটির নথি টেবিলে এনে আমি এক সপ্তাহ জুড়ে ঐ পত্রিকার বিস্তারিত নোট নিয়ে ওখানে বসেই পুরো সূচিগত ইতিহাসসহ পরিচিতিমূলক বিয়াল্লিশ পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ লিখি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীয় গবেষণা পত্রিকার ১৯৯৫ সালেরি এক সংখ্যায় তা ছাপা হয়েছিল। এরকম নবশক্তি, মাতৃশক্তি, প্রগতি, কবিতা, সবুজপত্র, কল্লোল, কালি-কলম, ধূপছায়া, শনিবারের চিঠি, সুন্দরম, বাসন্তিকা, শতদল, ছায়াবীথি, দেশ, চতুরঙ্গ ও আরও বহু পত্রিকার নোট নিয়ে এসেছি আমি বিশ শতকের সাময়িকপত্রের ইতিবৃত্ত লিখব বলে। লিখতে কিছু না পারলেও সাথে নিয়ে বসবাস করায় আমি সব সময় তৃপ্তিবোধ করি যে আমি প্রায় সকল সেরা সাহিত্য-পত্রিকা নিজের চোখে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। 

দুই.

পুরো দুবছর কাজ করার পর অভিসন্দর্ভ রচনার সাথে সাথে লক্ষ্য করি পত্রিকার পাতায়, বিশ শতকের প্রথমার্ধে হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থ নিয়ে সাহিত্য-জগতে বিরোধ চরমে উঠেছে। সাময়িকপত্রে এ নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। বাংলার শ্রেষ্ঠ-অশ্রেষ্ঠ সকল লেখকই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চলেছেন। গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ মনে হওয়ায় এই রচনাগুলো আমি স্বতন্ত্র একটি (সাময়িকপত্রে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি-সাধনা) বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরির কথা মাথায় রেখে সংগ্রহ করে এক পর্যায়ে মনীষী অন্নদাশঙ্কর রায়কে দেখাই। আমার মুসলিম সম্পাদিত সাময়িকীর ওপর রচিত সন্দর্ভখানাও দেখার জন্যে তাঁর আগ্রহে রেখে আসি। সংগৃহীত তথ্যাবলী দেখে প্রতিক্রিয়া লিখিত ভাবেই তিনি আমাকে জানিয়ে কৃতার্থ করে গিয়েছেন। 

প্রথম পত্রটি তিনি আমাকে লিখেছিলেন ০৯.০৯.১৯৯৬ তারিখে–

‘অবিভক্ত বঙ্গপ্রদেশে সরকারী চাকরী করতে এসে আমি বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হই। ‘বুলবুল’ আমার কাছে লেখা চাইলে আমি হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখি। পরে সেগুলির থেকে বাদসাদ দিয়ে কিছু আমার প্রবন্ধ সঙ্কলনে সঞ্চয় করে রাখি। কিন্তু আপনার সংগৃহীত পত্রিকাগুলি দেখে বুঝতে পারছি যে আমার আরো কিছু প্রবন্ধ ও চিঠিপত্র পুস্তকাকারে গ্রথিত হয়নি। হওয়া উচিত। সুতরাং আপনার উদ্যম দেখে আমি প্রীত। কৃতজ্ঞ। আপনার গ্রন্থের ভূমিকা আমি যথাকালে লেখব। আদাব জানবেন। 

আপনাদের 

অন্নদাশংকর রায়। 

দ্বিতীয় পত্রটি ২৪ এপ্রিল ১৯৯৮ তারিখের। তিনি লিখেছেন—-

প্রীতিভাজনেষু,

আপনার গবেষণা-সন্দর্ভ একটি মূল্যবান আকরগ্রন্থ। আপনি প্রচন্ড পরিশ্রম করেছেন।  আপনার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। কিন্তু আপনার কাছে আরও কাজ চাই।

আপনি কি জানতেন না যে কলকাতা থেকে ‘মোসলেম ভারত’ নামে  একটি পত্রিকা বের হতো। তাতে নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা বেরোনোর পর কবিতাটি বিখ্যাত হয়ে যায়। কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয় ‘প্রবাসী’তে। যতদূর মনে পড়ে ১৯২০ সালে। যতদূর মনে পড়ে পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন আফজাল-উল-হক। শান্তিপুরের স্যার আজিজুল হকের আত্মীয়। কলকাতায় সে সময় ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। মুজফফর আহমদ ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর প্রতিষ্ঠাতা। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সেই গোষ্ঠীর সদস্য। তাঁরা চেয়েছিলেন মুসলমান সমাজের নবজাগরণ। এ বিষয়ে আলোকপাত করা সঙ্গত। চতুরঙ্গ-সম্পাদক জনাব আবদুর রউফ আপনাকে সাহায্য করতে পারেন। শুনেছি, হুমায়ুন কবির থাকতেন W.M.C.A. Youth Hostel-এ। হিন্দু ও খ্রীস্টান ছাত্রদের সঙ্গে।

আপনার সন্দর্ভ সমাদর পাবে আশা করি। আমার প্রীতিপূর্ণ শুভকামনা জানবেন। 

ইতি। বিনীত অন্নদাশংকর রায়। 

পুনশ্চ : সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ বোধ হয় বলতে পারবেন ‘মোসলেম ভারত’ সম্পর্কে সব কথা। তাঁর সংগ্রহে থাকতে পারে সে পত্রিকা। সলমা রওশন জাহান কামাল উদ্দীন সাহেবের ছদ্মনাম। তিনি ‘বুলবুল’-এ আমার লেখার সমালোচনা করেছিলেন ছদ্মনামে।’

ওঁর পরামর্শ অনুসরণ করে ভারতে বাসকালে সাময়িকপত্রের সন্ধানে ছুটেছি আরও অনেক প্রান্তে। নগর থেকে গ্রামে, সমষ্টি থেকে ব্যক্তির লাইব্রেরিতে। সে অনেক দীর্ঘ আখ্যান। পরে বাংলাদেশে ফিরে এসেও ঘুরেছি বহু গ্রন্থাগার। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে আমার সাময়িকপত্র সন্ধানের প্রয়াসলব্ধ উপাত্ত। কিন্তু আমার মন শান্ত হয়নি। আজও চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পর নানা কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই ঢুকে পড়ি লাইব্রেরিতে—প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগত সব সংগ্রহের ভিতরই আমার নজর থাকে পাখির চোখের দিকে। হয় নানা নূতন অভিজ্ঞতাও। সেকথা বিস্তারে বলা যাবে বারান্তরে।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. অসাধারণ আলোচনা।
    পাঠ করে খুব ভালো লাগলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা