spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যফজল শাহাবুদ্দীন

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

ফজল শাহাবুদ্দীন

কাজী জহিরুল ইসলাম

খোয়াই নদীর পাহাড়ি জল গা থেকে ঝেরে ফেলি। ১৯৯১ সাল। আগস্টের এক বিকেল। হাঁটতে হাঁটতে হবিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াই। প্রিয়তমা ঢাকার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠি। একেবারে পরিকল্পণাহীন, ঢাকাগামী একটি বাস দেখে, লাফ দিয়ে উঠে পড়ি। ব্যাস, আমার ব্র্যাক-এর কর্মজীবন শেষ। ঢাকায় এসে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেই। তখন আমি যোগ দেই সাপ্তাহিক পূর্ণিমায়, এটি ছিল খন্ডকালীন কাজ, পূর্ণকালীন কাজ নেই বিজ্ঞান গণশিক্ষা কেন্দ্র নামের একটি এনজিওতে।
পূর্ণিমার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, কবি আতাহার খান। সন্ধ্যার পরে পূর্ণিমা অফিস আলোকিত হয়ে উঠতো বিখ্যাত কবি/লেখকদের মুখর আড্ডায়। নিয়মিত আসতেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, বুলবুল চৌধুরী, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ আখন্দ, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ এবং মাঝে মাঝে আসতেন আল মাহমুদ। সেখানেই ফজল ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়। ফজল ভাই ক্ষিরিকাবাব খেতে পছন্দ করতেন। তিনি এলেই আতাহার ভাই ঠাটারি বাজারের স্টার কাবাব থেকে ক্ষিরি কাবাব আনাতেন। পরবর্তিতে আমি বিদেশ থেকে যখনই ছুটিতে দেশে যাই ফজল ভাইকে নিয়ে স্টার কাবাবে ক্ষিরি কাবাব খেতে গিয়েছি। মাঝে মাঝে তাঁর হারূন ডায়েরির অফিসে বসে ড্রাইভারকে দিয়ে ক্ষিরি কাবাব আনিয়েও খেয়েছি।
১৯৯৮ সালে আমার প্রথম কবিতার বই ‘পুরুষ পৃথিবী’ প্রকাশিত হলে এর একটি প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করে কবি জসীম উদদীন পরিষদ মতিঝিলের একটি রেস্টুরেন্টে। বইটির ওপর সেই অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবদুল মান্নান সৈয়দসহ আরো অনেকেই। হঠাৎ আমার মনে হলো, আরে মাহমুদ ভাই, ফজল ভাই আর আমি, তিনজনই তো দেখি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ। কথাটা আমি বলেছি কি অমনিই ফজল ভাই আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘শুধু আমরা তিনজনই না এখানে যে কয়জন কবি আছে সকলের বাড়ি একটি গ্রামে। সেই গ্রামের নাম কবিতাগ্রাম। একজন কবির আর কোথাও কোনো বাড়ি নেই, কবিতাগ্রাম ছাড়া’।
দৈনিক বাংলা পত্রিকা অফিসের উল্টোদিকে ছিল হারূন ডায়েরীর অফিস, সেই অফিসের দোতলায় ফজল ভাই বসতেন। অফিসের কাজ তিনি তেমন কিছুই করতেন বলে আমার মনে হয় না, মূলত ওটা ছিল তার আড্ডাখানা। সপ্তাহে অন্তত একদিন আমি যেতামই সেখানে। প্রথম প্রথম তিনি আমাকে দেখলেই বলে উঠতেন, এই ছেলে, তোমাকে চেনা চেনা লাগছে, কোথায় যেন দেখেছি বলো তো? একদিন দৈনিক জনকন্ঠের অফিসে (তখন মতিঝিলে অফিস ছিল) আমি, নাসির আহমেদ, শাকিল রিয়াজ এবং আরো কয়েকজন বসে আড্ডা দিচ্ছি। ফজল ভাই ফ্লোরে ঢুকে এদিকেই আসছেন। কিউবিক্যালে অফিস হবার কারণে দূর থেকেই দেখা যেতো কে আসছেন, কে যাচ্ছেন। ফজল ভাইকে দেখেই আমি বলি, দেখবেন, ফজল ভাই এসেই আমার দিকে তাকিয়ে বলবেন, এই ছেলে তোমাকে যেন কোথায় দেখেছি। হলোও তাই, তিনি কিউবিক্যালের দরোজায় দাঁড়িয়েই সোজা আমার দিকে তাকিয়ে নাটকের সংলাপের মতো বলে উঠলেন, ‘এই ছেলে তোমাকে যেন কোথায় দেখেছি’। সকলেই হো হো করে হেসে উঠলো। ঘটনার আকস্মিকতায় ফজল ভাই হতবিহ্বল। আমি তখন তাঁকে বলি, আপনি যে এই কথাটা বলবেন এটা আমি আগেই ওদের বলে রেখেছিলাম। এর পর থেকে আর কোনোদিন ফজল ভাই আমাকে দেখলে ওই কথা বলেননি।
একদিন আল মাহমুদের সাথে তুমুল ঝগড়া। সেটা হারুন ডায়েরীতে। তৃতীয় মানুষ একমাত্র আমি সেখানে। মাহমুদ ভাই ঢুকতেই পারেননি, তিনি আক্রমণ শুরু করলেন এবং চিৎকার করতে করতে মাহমুদ ভাই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন। ঢুকলেনই না। মহমুদ ভাই তাকে বলছেন, মিথ্যুক। আর ফজল ভাই তাঁকে বলছেন, গ্রাম্য। ঝগড়ার বিষয়বস্তু যে কি ছিল আমার এখন আর মনে নেই। তবে দুজনের এই দুটি আক্রমণাত্মক শব্দ আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে।
২০০৩-এর এপ্রিলে আমি বিদেশের চাকরি ছেড়ে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাসের জন্য ছুটে আসি। দ্রিনি কিংবা মুরোভী নদীর জল আমাকে আটকাতে পারেনি, আমি সোজা উড়াল দিয়ে তুরাগ-তীরে এসে নামি। আমার এই প্রত্যাবর্তনে ফজল ভাই, আতাহার ভাই এবং মাহমুদ ভাই খুব খুশি হয়েছিলেন। খুশি হয়েছিলেন আরো একজন, তিনি সমুদ্র গুপ্ত। তাঁর গল্প অন্য আরেকদিন করবো। তখন মাসে একবার তো বটেই, কোনো কোনো মাসে ২/৩ বারও আড্ডা বসতো আমাদের নিকেতনের ফ্ল্যাটে। ফজল ভাই এবং মাহমুদ ভাইয়ের সেই ঝগড়ার রেশ তখনো আছে। একদিন দুজনই এলেন আড্ডায়। মাহমুদ ভাই ড্রয়িং রুমে থাকলে ফজল ভাই চলে যান বারান্দায় আর ফজল ভাই ফিরে এলে মাহমুদ ভাই চলে যান বারান্দায়। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর ফজল ভাই উঠে চলেই গেলেন। আমার ওপর কিছুটা রাগই করেন ফজল ভাই, আল মাহমুদ আসবে তুমি আমাকে আগে বল নাই তো। তাঁদের ঝগড়া যে এই পর্যায়ে, কেউ কারো মুখ দেখতে চান না, সেটা আমি আন্দাজ করতে পারিনি।
দেড় বছরের মাথায় আমি আবার উড়াল দেই। এবার পশ্চিম আফ্রিকা, সাসান্দ্রা নদী আর অতলান্তিকের গালফ অব গিনির নীল জল আমাকে চুম্বকের মতো টেনে ধরে। ২০০৯ সালের কথা। আমি ছুটিতে ঢাকায় এসে ফোন করি ফজল ভাইকে। তিনি তাড়া দেন, কাল তুমি আমার সাথে লাঞ্চ করবে। আমি বলি, স্টার কাবাবে? তিনি একটু হাসেন। তুমি জানো না? আমার তো ডায়াবেটিস, এখন হিসাব করে খাই। তুমি হারূন ডায়েরীতে আসো। আমি নিজ হাতে তোমাকে রান্না করে খাওয়াবো। দুপুরে গেলাম। তিনি টিফিন ক্যারিয়ার ভরে খাবার নিয়ে এসেছেন। এবং সত্যি সত্যি সেই খাবার তাঁর নিজের হাতে রান্না করা। সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্না করেছেন। কাঁচকলা দিয়ে ইলিশ মাছ, ডাল, করল্লা ভাজি এবং ভাত। কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের নিজ হাতে রান্না করা খাবার, আমার জন্য? আমার চোখে আনন্দাশ্রু।
ফজল ভাইয়ের সাথে এমনি অসংখ্য আড্ডার স্মৃতি মাথায় গিজগিজ করছে। আজ এপর্যন্তই থাক। শেষ করার আগে ফজল ভাইয়ের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন তুলে দিচ্ছিঃ
তোমারি ক্লান্তির মধ্যে আবর্তিত চেনো কি আমাকে
সমুদ্রের ব্যাপ্তি আমি অরণ্যের চির আন্দোলন
আমার অস্থির গানে উচ্ছসিত তোমার কঙ্কন-
ধ্বনিত তোমার রক্ত বারংবার আমারি বৈশাখে।
গোপন আর্তির মতো তুমি এক নিঃসঙ্গ কিঙ্কিনী
তোমার সৌরভে নিত্য মগ্ন আমি অন্ধ ও মাতাল
ধর্ম কর্ম স্বর্গ মর্ত মৃত্যুঞ্জয়ী তুমি মহাকাল
তবুও আশ্চর্য শোনো সেইদিন তোমারে চিনিনি।
(নিমগ্ন একজন)

এই কবিতাটি পড়তে পড়তে তাঁর হারুন ডায়েরির অফিসের দরোজায় লাগানো একটি পোস্টার সাইজ ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। ছবিতে দুচোখ বন্ধ নিমগ্ন কবি ফজল শাহাবুদ্দীন।

হলিসউড, নিউইয়র্ক।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা