তাজ ইসলাম
আগুনের মজলিস– এটা কোন নাম হল! তাও আবার কবিতার বইয়ের নাম। আগুন কী? যা জ্বালিয়ে দেয়। মজলিস? একত্রিত আড্ডা। মজলিসতো খাঁটি বাংলা শব্দও না। আগুনের সাথে মজলিসের কী সম্পর্ক? মজলিস, একটা চিত্র ভেসে ওঠে মানসপটে। মজলিসকে জলসাও বলা যায়। মিটিং কী মজলিসের সমার্থক? হতেও পারে। হলে আগুনের সাথে মজলিস কীভাবে যায়? এসব সহজ প্রশ্ন–সরল পাঠকের।
প্রথমেই ভাষার প্রশ্নে আসেন। ভাষা হল শব্দের নদী, শব্দের সাগর। বিজ্ঞান উদঘাটন করেছে, পৃথিবীর যেখানে আজ মরুভূমি সেখানে বহুবছর আগে জলরাশি ছিল। উত্তাল সাগর ছিল। আজ মৃত। খা খা মরুভূমি। আজ এখানে বালুচর। একদা তীব্র ভাঙনের, খরস্রোতা নদী ছিল। আজ মৃত, চিকচিক বালুচর।
নদী ও সাগরের প্রধান চরিত্র গ্রহণ করা। শত নদীর স্রোত, স্রোতে আসা পানি ধারণ করা সাগরের উদার বৈশিষ্ট্য। খাল বিল শত নালার পানিস্রোত ধারণ করা নদীর বৈশিষ্ট্য। নদী ও সাগর যেদিন থেকে এই বৈশিষ্ট্য বিমুখ হয় সেদিনই শুরু তার মরণ। একদিন ডেড সী হয়ে মরুভূমি হয়। ভাষা– বাক্যের সাগর। শব্দ– স্রোত, শব্দ–ঢেউ, শব্দ–পানির প্রবাহ। যে ভাষা যত উদার সে ভাষার শব্দ ভাণ্ডার তত সম্বৃদ্ধ। বাংলা ভাষায় বহু ভাষার অগণিত শব্দরাজি বাংলা ভাষার সৌন্দর্য। বাংলা ভাষার অলংকার।
অন্য ভাষার যে শব্দসমুহ মুখের ভাষা হয়ে গেছে সেগুলোও আপন। টেলিফোন, মোবাইল, রিচার্জ, কল, রিসিভ আজ মুখের ভাষায় পরিনত হয়ে গেছে। উৎসমূলের চেয়ে প্রচলনটাই ধর্তব্য। প্রয়োগে প্রয়োগে প্রচলিত হয়ে অতিপরিচিত হয়ে গেছে। এমন অনেক অনেক শব্দ অন্য ভাষার হওয়ার পরও একান্ত আপন। তাই কবি যখন বলেন, শিখিয়েছে শৌখিন গণিত– নিয়ে বাণিজ্যের দরজায়/ বলেছে বিশুদ্ধ কালাম” এই কালাম প্রয়োগকে আমরা দেখি বিশুদ্ধ প্রয়োগ, যথাযথ শব্দ চয়ন।
বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দ নিয়ে কিছু ঊনচিন্তার মানুষ আছে। তারা অহেতুক বিতর্কিত আওয়াজ তোলে। বাংলা ভাষা থেকে বিদেশি শব্দ উচ্ছেদ করলে আমাদের সামনে পড়ে থাকবে ভাষার কংকাল। আমরা কংকাল দর্শনে আগ্রহী নই। হৃষ্টপুষ্ট সুঠাম দেহের ভাষা শরীরই কাম্য।
আগুনের সাথে মজলিসের অসামঞ্জস্য অনুভব করা অকবির চিন্তা। আগুন ও মজলিসের কাব্যময় সম্মিলন কবির বিস্ময়কর চিন্তা, উদার ভাবনা, কাব্যপ্রতিভার উজ্জ্বলতার স্বাক্ষর ।
আগুন দীপ্ত একটি মজলিস। যে মজলিসের আলোচনায় থাকবে অগ্নিগর্ভ ভাষণ, দীপ্ত অহংকার। অসভ্য,অসত্য,অন্যায়,অত্যাচার,অবিচার জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো প্রত্যাশার মজলিশ। দুই শব্দের মিলন, মিলনের সৌন্দর্য, অন্তর্নিহিত বক্তব্যই কবিতা। দুই শব্দের সম্মিলনেই প্রকাশ করে কবির কাব্যশক্তি।
” আগুনের মজলিস” কবি জব্বার আল নাঈম রচিত কবিতা কিতাবের নাম। নামেই পাঠের আগ্রহ তৈরী হয়। জানতে ইচ্ছে হয়, দেখি কী আছে এর অভ্যন্তরে। মজলিস মানেই জমকালো কিছু। আগুন মানেই বারুদ মশলা। আগ্রহ থেকেই আমরা দ্বারস্থ হই তার পুস্তকের। পৃষ্ঠা মেলে পাঠ করি :
” ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল/ সাত শত নদী/ ছোট- বড় খাল/ বিল/ ও/ পাহাড়ের দারুণ সমন্বয়ে অনিন্দ তুমি!
এই তুমি তার পরম প্রিয়া। এ প্রিয়া কোন মানবী না। প্রিয়া বা প্রিয়তম তার জন্মভূমি বাংলাদেশ।
“স্ত্রী –সে তো অন্যের অলংকার” এই বাক্যের সাথে পাঠক হিসেবে আপনার সুযোগ আছে একমত এবং দ্বিমত হওয়ার। তবে একমতের চেয়ে আপনি অধিক দ্বিমত হলেও মতামত সমর্থনযোগ্য। এই কথা মূলতঃ কবি লিখেছেন ব্যক্তির একাকিত্বের পরিবেশ বুঝাতে। মানুষ দিন শেষে একান্তই একা। কর্ম কোলাহলে একা। অনেকের মাঝে থেকেও একা। বুকের সিন্ধুকে রক্ষিত দুঃখ কেউ দেখে না। কাউকে দেখানোর মতো, কাউকে বুঝানোর মতো বিশ্বস্ত জন পাওয়া যায় না। তখনই কবির কলমে লেখা হয় :
” আমি কার কাছে কমু দুঃখের কথা/ কার কাছে!”
তিনি উপলব্ধি করেন ” নেই নেই কেউ নেই মাঝদরিয়ায় পরম আপন”। তখন পাশ থেকে কেউ হয়তো বলতে পারে আছেতো। আছে রাষ্ট্র, আছে সমাজ,পরিবার। বাবা, মা ভাইবোন। এই প্রশ্ন কিংবা সম্ভাবনা নস্যাৎ করেই লেখা হয় : ” ভাই গেছে নিজের হিস্যা বুঝতে/ বোন পরের আবাসে/ স্ত্রী– সে তো অন্যের অলংকার/ সন্তান যখন স্বার্থের দুনিয়া খোঁজে/… ” পৃথিবীতে,জীবনে তখন আর কী অবশিষ্ট থাকে? বাপ সে তো কবেই গেছে না ফেরার দেশে। সব গেলেও মানুষ বাঁচে। সব যাওয়ার পরও মানুষ নিঃস্ব ও রিক্ত হয়েই যাপন করে জীবন। কিন্ত নাগরিক যদি রাষ্ট্রহীন হয়? তখন জীবন আর জীবন থাকে না। কবি নাগরিক। নাগরিকদের মাঝে একজন কবি হন সর্বোচ্চ সচেতন নাগরিক। তার কথা, সে কথা বক্তব্যেই হোক, কিংবা গদ্যে অথবা কবিতায়; তা তখন বিবেচনায় রাখতে হয়! নাগরিকতো এক ও একা হয়ই। এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে জাগে শংকা।
” রাষ্ট্র গেছে, রাজধানী গেছে– ভুল বাক্যের বাণে/ এখন আমি,আমিহারা!/ কার কাছে কমু/ আমি কার কাছে কমু দুঃখের কথা/ কার কাছে! এই প্রশ্ন,এই অসহায়ত্ব নিয়েই সমাপ্ত হয়েছে কবিতা ” কার কাছে কমু দুঃখের কথা”।
জব্বার আল নাঈম কবি। কবি তিনি,সচেতন নাগরিকও তিনি। তার চোখে ধরা পরে জুলুম ও জুলুমবাজের চরিত্র। তিনি প্রত্যক্ষ করেন মজলুমদের অসহায়ত্ব। পরিবেশ, পরিস্থিতি তাকে দ্রোহী করে তোলে। তিনি হয়ে যান বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী। ক্ষোভের সাথে উচ্চারণ করেন : ” রাষ্ট্র, তোমার সংবিধানের পাতায় থামতে পারছি না বলে দুঃখিত”। ” তোমার ফ্যাসিবাদ তোয়াক্কা করি না”।
রাষ্ট্র তখন আরও বেপরোয়া হয়।
ফ্যাসিবাদ হিংস্র হয়।কবিও হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। ওঙ্কারে হুংকারে রণগর্জনে কবি বলেন: ” এমন ভয়ে ভীত নয় কবিপ্রাণ।/ আমি মরে যাবো– দেখি কতটা হিম্মত তোমার/( আমার মৃত্যু ঠেকাতে পারবে না)।”
এই কবিতাতেই আরও একটি ইঙ্গিত আছে। এই ইঙ্গিত একটি বললে ভুল হবে। এখানে লুক্কায়িত আছে দুটো বক্তব্য। এক. ফ্যাসিবাদের কুৎসিত চরিত্র জেনে গেছে বিশ্ব। ফ্যাসিবাদের বিপরীতে জনস্রোতকে টোপে ও ট্যাপে ফেলে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চক্রের এদেশ নিয়ে গভীর চক্রান্ত। কবির বক্তব্য বিশ্লেষণের জন্য পাঠ করুন:
” তোমার কথার দুর্গন্ধময় ভুভুজেলার শব্দ পৌঁছে গেছে পশ্চিমের দরজায়/ যারা আমাদের ফেলতে চায় অচেনা স্রোতে।”
তবে ভয় নেই। যে জাতি বলতে পারে ” আত্মোপলব্ধি থেকে নিজেকে ঘোষণা করেছি — স্বাধীন” তাকে ঠেকায় এমন সাধ্য কার?
বাণী, বক্তব্য, প্রেম, মানবিকতা, প্রকৃতি, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, চিন্তা, শিল্প, সংস্কৃতি নিয়ে তার কবিতা। এসবই তার কবিতার বিষয়। বিষয়কে কাব্যময় পঙক্তিতে পাঠকের সামনে মেলে ধরেছেন। বিষয়কে বিশিষ্ট করতে গিয়ে কবি হয়ে যান কখনো বিদ্রোহী,কখনো হন প্রেমিক। প্রেমিক তিনি প্রিয়ার, প্রেমিক হয়ে হাজির হন প্রেমিকার সামনে। আবার দেশের জন্য হন অপরিহার্য দেশপ্রেমিক হয়ে। সমাজ ও মানুষের কথা বলেন। কখনো দরদী কণ্ঠে। কখনো বিদ্রোহের সুরে। নানা বৈচিত্র্যে পূর্ণ করা কবিতা পুস্তক ” আগুনের মজলিস”।
“আগুনের মজলিস” কবিতা গ্রন্থকে আমি মনে করি একের ভিতর তিন। মূল বইটাকে তিনি সাজিয়েছেন তিনটি পর্বে। পৃষ্ঠা ৯ থেকে প্রথম পর্ব অঙ্কের শরীর থেকে রক্ত ঝরে অংশ ২৯ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। ৩১ পৃষ্ঠা থেকে ৩৮ পৃষ্ঠা ব্যাপী দ্বিতীয় পর্ব। প্রেম আংশিক অ(সত্য) আছে বইয়ের শেষ পর্যন্ত।
একটি বই বহন করে একজন কবির জীবন, চিন্তা, দর্শন। রাষ্ট্র সমাজ নিয়ে ভাবনা। প্রেম প্রকৃতির প্রেম। পুস্তক বয়ে বেড়ায় লেখককে।
কবি জব্বার আল নাঈমকে বুঝতে হলে পাঠ করা জরুরি তার এই বইসহ অন্য বই লগুলো। জব্বার আল নাঈম যখন বলেন: ” মিঠুন দা,/ আপনার পরিচয় হোক— মুক্তিকামী মানুষের পক্ষের লোক”। মিঠুন দা হতে পারেন আপনি, আমি,কবি নিজে ও দেশের প্রতিটি লোক। কেবল যারা মুক্তিকামী মানুষের বিপক্ষ তারা ছাড়া।
একটি বই আলোচনা করতে গিয়ে সামনে আসে ভাব,ভাষা,বক্তব্য।আগুনের মজলিসে দ্রোহ যেমন আছে,আছে তেমন প্রেমের কথাও। প্রেমের ভাব প্রকাশ করেছেন ছন্দের আঁটসাঁট বাঁধনে। প্রয়োগ করেছেন অলংকার,উপমার কারুকাজ। তার প্রিয় মানুষকে লক্ষ করে বলেন, ” জীবন- জ্যাকেট ভেবে জড়িয়ে থাকি তোমাকে/…ধূল পাহাড়ে উড়তে থাকে কামুক রঙের শাড়ি/( প্রেমের খেলায় অজ্ঞ আমি)”।
২০২৪ র ফেব্রুয়ারি সাহস পাবলিকেশন্স প্রকাশ করেছে জব্বার আল নাঈম র কবিতার বই “আগুনের মজলিস। বইয়ের মূল্য ১৩৫ টাকা। প্রচ্ছদে ধ্রুব এষ। বইটি মেলা থেকে সংগ্রহ করেছি আমি। আপনি সংগ্রহ করতে দ্বারস্থ হতে পারেন অনলাইনের। বই কিনুন,বই পড়ুন।